সাদেক আর বাঘের স্বপ্ন
হুমায়ূন আহমেদের “মাতাল হাওয়া” পড়ছিলাম। ভাদু নামের একজনের প্রসঙ্গ আসতেই আমার সাদেকের কথা মনে পড়ল আচমকা। প্রায় এক যুগ আগে সে আমাদের বাড়ীতে থাকত। ভাদুর সাথে তার হুবহু মিল ছিল......“মহিষের মতো বলশালী চেহারা। গাত্রবর্ণও মহিষের মতো কালো। শরীরের তুলনায় মাথা ছোট। মাথার চুল কদম ছাট করা”...। তবে ভাদু যুবক আর সাদেক ছিল দশ বারো বছরের কিশোর। আমি তখন আই এ পড়ি। কলেজ থেকে ফিরে দেখি কুতকুতে চোখের একটা ছেলে হাফ সার্ট আর প্যান্ট পরা। তার ত্বক ছিল মাছের আঁশের মতো। শীতে ফেটে তাকে ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছিল। মুরগী আর কবুতর দেখাশোনার জন্য আমাদের একটা কাজের লোকের প্রয়োজন ছিল তখন। সীমান্ত এলাকার এক গ্রাম থেকে এসেছিলো সাদেক। প্রথম দেখাতেই খুব মায়া হয়েছিল আমার যদিও বাড়ীর কারো পছন্দ হয়নি। ছোট একটা ছেলে সে নাকি হোটেলে কাজ করত এতদিন! খেতে দিত না আর মার খেত বলেই ওর অলস বাবা ওকে আমাদের বাড়ীতে রেখে যায়। আম্মাকে বললাম ওকে গোসল করে তেল মাখতে বলেন। কেউ বোধহয় ওকে কখনো তেল সাবান মাখতে দেয়নি তাই ওর এমন খসখসে হাত পা। সাদেক ভীষন চুপচাপ অনুভূতিহীন একটা ছেলে বকা হোক বা প্রসংশা করা হোক ও নির্বিকার। খুবই বোকা বলে বকা খেত আমার ভাইদের কাছে খেলার সময়। যতবার দৌড়াত ততবার উপুড় হয়ে পড়ত আর বকা খেত। একদিন ডিম রান্না হয়েছিল কিন্তু খেতে বসে চারটা ডিম নেই। বাড়ীতে আরো কাজের মানুষ আছে কিন্তু কে খেয়েছে কেউ বলছে না। আম্মা সাদেক কে জিজ্ঞেস করতেই আমি ক্ষেপে যাই। ও চারটা খেতে পারে আম্মা! আমার ভয় সাদেক কথা কম বলে সবাই চেপে ধরলে ও হয়তো না খেয়েও বলবে খেয়েছি। পরে বুঝলাম ও খেয়েছে। আমি সবাইকে বললাম ওকে কিছু বলো না। হোটেলে বেচারা না খেয়ে থাকতো। খুব হয়তো খেতে ইচ্ছে হয়েছিলো। ধীরে ধীরে সাদেকের বোকামী বাড়তেই থাকে আর বকা খাওয়াও নিয়মিত। আমি সহ্য করতে পারতাম না ওর সাথে দূর্ব্যবহার করা আবার কিছু বলতেও পারতাম না কারন কেউ অকারনে ওকে বকা দিত না। সবাই অস্থির ওর বোকামীতে।
আমার ঘরে আসতো ও খুব চুপিচুপি। পড়তে পড়তে মনে হতো কেউ আমার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে বা আমাকে দেখছে। পিছন ফিরেই দেখতাম ও দাঁড়িয়ে আছে। কিছু বলবি সাদেক? না,খুব ছোট্ট উত্তর তার। আমি আমার কাজে ব্যস্ত হতাম ও দাঁড়িয়েই থাকতো একভাবে। আমি ভাবতাম ও বোধহয় ওর বাড়ীর কথা মনে পড়ছে। তোরা কয় ভাইবোন রে? দুই ভাই এক বোন। তোরের বোনের নাম কি? সাদেক তাকিয়ে থাকে বোকার মতো।
অনেকক্ষন পর বলে জানি না কি নাম। ছোট থেকেই বাইরে থাকে বলে ও চিনতো না ওর ভাইবোনকে আর ওর কোন খেলার সাথীও ছিল না। মনে হতো ওর ছেলেবেলা নেই,অতীত বলে কিছু নেই। তোর মায়ের কথা মনে পড়ে? এ প্রশ্নেও নিরুত্তর সে। “মাদার ইন ম্যানভীল পড়ছিলাম তখন। সাদেক কে আমার জেরীর মতোই মনে হতো। আমি সাধারনত ওকে কিছু করতে বলতাম না জানি মেজাজ ঠিক থাকবে না। সবার বকা খায় আমি না হয় নাই বকলাম। কখনো খেয়াল করতাম সাদেক আমার পড়ার টেবিলে খুব কাছে এসে দাঁড়াতো আবার কখনো আঙ্গুল দিয়ে আমাকে ছুঁয়ে দেখত। আমার অস্বস্তি হতো তবু কিছু বলতে পারতাম না। আহা বেচারা কেউ কখনো আদর করে কাছে টেনে নেয়নি,রুক্ষ চুলে হাত বোলায়নি,মিষ্টি করে ডাকেওনি। ও হয়তো আমার দূর্বলতা দেখে টের পেয়েছিল আমি ওকে খুব ভালোবাসি। আমি বুঝতে দিতাম না ওর জন্য আমার কষ্ট হয়। ও যখন শিশুর মত ঘুমাতো আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকতাম। কেন মা বাবা ছেড়ে এতটুকু ছেলেকে অন্যের বাড়ী থাকতে হয়? কত আনন্দে বড় হচ্ছি আমরা আর ওদের কত কষ্ট। তবু আমাদের বাড়ীতে ওকে না খেয়ে থাকতে হয় না,মার খেতে হয় না।
সাদেক মিথ্যা বলত,হাতেনাতে ধরা পড়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতো। আমার ছোট ভাই প্রায় ওকে বলত আজ থেকে তোর নাম সাদেক( সত্যবাদী) না, তোর নাম এখন কাযেব(মিথ্যাবাদী)। আবার জিজ্ঞেস করত বল তোর নাম কি? ও নির্দ্বিয়াই বলত কাযেব।
একদিন আমার খুব প্রিয় হাতঘড়িটা হারিয়ে গেল বাথরুম থেকে। আব্বা ওটা বিদেশ থেকে এনেছিলেন আমার ছোটবেলায়। সবাই একবাক্যে সাদেককে সন্দেহ করল কারন ওখানে সাদেক ছাড়া কেউ যায়নি। আমি বুঝেও অবুঝ হলাম যথারীতি। এমনি তে ঘড়ির জন্য মন খারাপ আবার সাদেকের বিচার আমার ভালো লাগলো না। থাক লাগবে না আমার ঘড়ি। বাদ দাও। আমার ইচ্ছা ছিল আমি একাকী সাদেককে জিজ্ঞেস করব। আমাকে নিশ্চয় ও মিথ্যা বলবে না। আমি ওকে আমার ঘরে ডেকে বললাম,সাদেক ঘড়িটা তো খুব সুন্দর তুই নিয়েছিস না?
ও মাথা নিচু করে করে বলল,আমি দেখিনি ঘড়ি।
পরে দিস এখন তোর কাছে রাখ।
আমি নেয়নি।
আচ্ছা যা।
আমি ছাড়লেও আমার ভাই ওকে ছাড়ে না। ও ওকে জেরা করতেই থাকে। পরদিন শুনি ও স্বীকার করেছে হয়তো ভয়ে। তদন্ত চলতেই থাকে আমি আর খোঁজ রাখিনি। দুদিন পর আমার গোল্ডেন চকচকে ঘড়িটা মলিন আর বন্ধ অবস্থায় আমার ভাই আমাকে দেয়। আমি অবাক কোথায় পেলি? তোমার সাদেকের কাছেই ছিল। এই অবস্থা কেন? সাদেক এই কয়দিন নানা জায়গাই ঘড়িটা লুকিয়ে রেখেছিল এমনকি মাটির নীচেও পুঁতে রেখেছিল। অথচ কেউ ওকে সহযে স্বীকার করাতে পারেনি। আমি এত প্রশয় দিয়েছি বলেই কি আমার জিনিষ চুরি করল?
আমি তারপরও সাদেককে কিছু বলিনি। মনে হয়েছে এটা স্বাভাবিক ওর কাছে। সত্য মিথ্যা, ন্যায় অন্যায় কেউ শিখায়নি ওকে। শুধূ শাসনই করেছে সবাই। আমি ওকে শেখাবো সবকিছু। এর কিছুদিন পর থেকেই অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখি আমি। আমি স্বপ্নে বিশ্বাসী মানুষ না এখনো ভাবি মানুষের ভাবনাগুলোই মানুষ স্বপ্নে দেখে। সে সময় স্বপ্নে দেখলাম ছোট একটা বাঘ,আমার পোষা। আমার কাছেই থাকে। সে বাঘ একদিন পাশের বাড়ীর ছোট মেয়েটাকে খেয়ে ফেলে। ওরা এসে নালিশ করলে আব্বা ভীষণ রেগে ওকে দা নিয়ে তেড়ে আসে। আমি ওকে আমার ঘরে লুকিয়ে রাখি সেখান থেকেই আব্বা ওকে টেনে নিয়ে মারতে থাকে। ওর চোখে কি মায়াবী চাহনী আমি কাঁদতে কাঁদতেই ঘুম থেকে জাগি। স্বপ্নটা আমার সারাদিনই চোখে ভাসে। ব্যাখ্যা করি টি ভি তে বাঘ দেখেছিলাম তাই হয়তো এমন স্বপ্ন। কয়দিন পর আবার দেখি স্বপ্নে বাঘ আর সে বাঘ আমার খুব আদরের। পশুপাখি আমি খুব পছন্দ করি এমন নয় তবু স্বপ্নের সে বাঘের জন্য অদ্ভুত মায়া। এদিকে সাদেকের অপরাধের মাত্রাও বাড়তে থাকে অথচ সে আগের মতোই নির্বিকার,চুপচাপ। আমি খোঁজ নেই না সে কি করেছে আমার কানে বাজে শুধু সাদেককে বকা হচ্ছে প্রতিদিন। একদিন আচমকা আমার মনে হলো স্বপ্নের বাঘটার জন্য যেমন আমার মায়া তেমন মায়া তো সাদেকের জন্যও হয়। দুজনেই গুরুতর অপারাধ করছে অথচ আমি ওদের বাঁচানোর চেষ্টা করছি!
একদিন ওর বাবা ওকে নিতে আসে হঠাৎ করেই। একটা দোকানে কাজ করার প্রস্তাব পেয়েছে। বেতন দিবে আমাদের দিগুন। বেশী বেতন দিলে রাখবে না দিলে নিয়ে যাবে। এত টাকা দিয়ে সাদেককে রাখার ইচ্ছা কারো নাই আবার ওর জায়গাই কাউকে পাওয়াও মুস্কিল। আমার কেন জানি ভালো লাগলো সাদেকের চলেও যাবার কথা শুনে। আম্মা হয়তো চাইছিলেন ও আর কিছুদিন থাকুক তখন স্বপ্নের কথা বলতে বাধ্য হলাম আম্মাকে। আম্মা সাদেক কে বাড়ী পাঠিয়ে দেন। আমার ভালো লাগছে না ওকে। আম্মা অবাক আমার মুখে এমন কথা শুনে। সাদেকের জন্য আমি মনে মনে আম্মার উপর রাগ করতাম আম্মা তা বুঝতেন। স্বপ্নের কথা শুনে তিনিও চিন্তিত হয়ে পড়েন। স্বপ্নটা আর কেউ জানে না কারন সবাই আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করবে। সাদেক বিদায় হওয়াতে সবাই এমনিতেই স্বস্তি পায়। কাজের চেয়ে অকাজই সে বেশী করেছিল। শুনেছিলাম দোকানের কাজ ছেড়ে কয়েকবছর পর ও একাই এসেছিল আমাদের বাড়ীর উদ্দেশ্যে কিন্তু বাড়ী খূঁজে না পেয়ে চলে যায়। ততদিনে অনেক বদলে গিয়েছিল আমাদের চারপাশ। সাদেক আর আসেনি আমিও অনেকক্ষন টি ভি তে বাঘ দেখেও আর বাঘের স্বপ্ন দেখিনি............।