বিতাড়িতা
নাজীব মাহফুয
এ যুগের যুবকরা দুটো বিষয়ে কথা বলতে ভালবাসে। একটি হল নারী অপরটি রাজনীতি। বন্ধুদের আড্ডায় অংশ নিলে এ দুটো বিষয়ে কথা বলতেই হয় অথবা শুনতে হয়।এ ব্যাপারে কেউই নিশ্চুপ থাকতে পারে না।এক আড্ডায় আমাদের এক বিজ্ঞ বন্ধু তার জীবনের এমন একটি ঘটনা বলেছিল সেই যা আমাদের মনে দাগ কেটেছিল,বন্ধুটির ভাষ্যে গল্পটি ছিল এরকম,
যৌবনকালে বহু নারী মানুষের জীবনে আসে কিন্তু এমন কিছু নারী আছে যারা মনকে এতটা প্রভাবিত করে যে সারাজীবনেও তাদের স্মৃতি ভোলা যায় না। আমার জীবনেও অনেক নারী এসেছে কষ্ট অথবা আনন্দ দিয়ে তারা হারিয়েও গেছে। কিন্তু একটি নারী, যে আমার জীবনে এসেছিল ক্ষণিকের জন্য,উজ্জ্বল তারকার মত ছিল তার উপন্থিতি,সে শুধু নিজেই উজ্জ্বল নয় সে আলোকিত করত তার চারপাশের সবাইকে। আমি তাকে কখনোই ভুলতে পারিনি,আমার অন্তরে তার স্মৃতি এখনো জাজ্বল্যমান। কিন্তু কেন? সে কি সবচেয়ে সুন্দরী আমার দেখা নারীদের মধ্যে? নাকি আমি তাকে খুবই ভালোবাসি? আমি ঠিক বলতে পারব না,সম্ভবত সে খুবই দুঃখী আর এ কারনেই আমি তাকে ভুলতে পারিনি।আমার সৌভাগ্য তার সংস্পর্শে ছিলাম কিছুটা সময় আর সে সুখ আমার জীবনে আসবে না।
১৯২০ সালে আমি তখন কৃষি কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। একদিন ভোরে কেবলমাত্র ঘুম থেকে জেগেছি তখন আমার মা এসে বললেন,
:হাসুনা! আমাদের বাড়ীতে একজন মহিলা অতিথি এসেছেন,আমার মনে হয় সে বেশ কিছুদিন এখানে থাকবে।
:মা! তিনি কে?
:তিনি আমাদের প্রতিবেশী ক্যাপ্টেন মুহাম্মদ রাযীর স্ত্রী যয়নব হানুম।আমি অবাক হয়ে বললাম,
:কিন্তু সে তো নববধূ। তার বিয়ের তো একমাসও অতিবাহিত হয়নি, তাই না?
:হ্যাঁ,তাই। কিন্তু সে হতভাগীনি বাধ্য হয়েছে তার ঘর ছেড়ে আমাদের বাড়ীতে আশ্রয় নিতে।তার স্বামী একটা নিষ্টুর মানুষ তার অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে মেয়েটি খুব ভোরে আমার কাছে এসেছে। লোকটা পাষন্ড,মেয়েটিকে তাড়িয়ে দিয়েছে অথচ সে জানে কায়রোতে মেয়েটির কেউ নেই।
আমার মা মেয়েটির জন্য খুবই চিন্তিত।
:কত অসহায় মেয়েটি!আমি আফসোস করলাম। মা জানালেন,
:মেয়েটি আমার শৈশবের বান্ধবীর মেয়ে। আমি চাই সে আমাদের সাথে আনন্দে থাকুক।
হঠাৎ করে তিনি বেশ জোর দিয়ে বললেন,
:হাসুনা! মনে রাখবে তুমি তার ভাইয়ের মত।
আমি অপ্রস্তুত হয়ে বললাম,:নিশ্চয়,নিশ্চয়।
সেদিন কলেজে গিয়ে বারবার মনে পড়ল আমার মায়ের শেষকথাটি, যা তিনি বলেছিলেন দৃঢ়তার সাথে।আমি লজ্জা পেলাম আবার প্রচন্ড রাগও হল। সেই মহিলার সাথে আমার আচরণ কিরূপ হবে তা নিয়ে কি মা চিন্তিত ? হঠাৎ আমার কৌতুহল হল, মেয়েটি কি খুব সুন্দরী যে কারনে আমার মা ভয় পাচ্ছেন? কলেজ থেকে ফেরার পথে নতুন শহর থেকে গীজা পর্যন্ত এই ভাবনা আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখল।আমার মায়ের কাছে তার কথা শুনে আমি প্রথম থেকেই তার প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলাম।
আমাদের বাড়ীর পরিবেশটা ছিল শান্ত আর নিরিবিলি।আমার বাবা সে সময় তান্তা শহরে বিচারক পদে ছিলেন। তিনি কিছুদিন কায়রো আবার কিছুদিন তার কর্মস্থলে অবস্থান করতেন। আমার এক ভাই আলী সামরিক স্কুলে আরেক ভাই আদেল নামসাতে মেডিকেল কলেজে পড়ত।বাড়ীতে থাকতাম শুধু আমি আর মা।এমন নির্জন পরিবেশে যয়নব হানুমের সাথে আমার সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। সে ছিল অতি সুন্দরী এক পরিপূর্ণ নারী যদিও তার আচরণ ছিল চঞ্চল এক বালিকার মত। তার চাহনিতে ছিল সরলতা আর পবিত্রতা। মাঝে মাঝে তাকে উদাস মনে হত যা তার আচরণের সঙ্গে মানানসই ছিল না।এই নিষ্পাপ নারীটি সবসময় নিজেকে গুটিয়ে রাখত,তারপাশে ছিল এক প্রাচীর যা কখনোই অতিক্রম করা যেত না। নির্লজ্জতা আর অবাধ মেলামেশা প্রেমের পবিত্রতা নষ্ট করে দেয়। আর এ প্রেমের পরিণতি হয় স্বেচ্ছাচারিতা আর পাগলামী।প্রেমের উদয় হলে মনে কত আশা আকাংখার জন্ম হয়,প্রেম বিবেক-বুদ্ধিকে পরাভূত করে কল্পনা আর স্বপ্নের সৃষ্টি করে।প্রেমে পড়ে মানুষ কত অবাস্তব কল্পনা করে তাকে নানা রং এ সাজায়।
যয়নবের অপরূপ সুন্দর মুখের দিকে তাকিয়ে আমার মন প্রান জুড়িয়ে যেত।স্বপ্নে জাগরণে সর্বত্রই ছিল তার উপস্থিতি। তাকে দেখে এক দূর্লভ সুখ অনুভব করতাম সারাক্ষণ।বসন্তকালে যেমন চারিদিক নানা রং এ সুশোভিত হয়ে উঠে তেমনি আমার জীবনটাও তখন রঙ্গীন হয়েছিল।শুধু দৃষ্টি বিনিময়ে আমরা সন্তুষ্ট থাকতাম না মাঝে মাঝে কথাও বলতাম। কখনো কাগজ কেটে খেলতাম আবার কখনো পাশা খেলতাম, তখন আমার দুষ্টমী করতে ইচ্ছে হত,মনে হত ভাগ্যকে একটু পরীক্ষা করেই দেখি না কেন, কেন আমি তার সুন্দর পরিপুষ্ট আঙ্গুলগুলো একটু ছুঁয়ে দেখি না?অথবা তাকে কোন শ্রেষ্ঠ প্রেমের উপন্যাস উপহার দিই, তবে এ নিয়ে আমাদের যে গল্প শুরু হবে তার কোন শেষ নেই। কিন্তু কিছুই আমি করতে পারিনি। প্রচন্ড দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগতাম।কিছুতেই আমার সাহস হত না,অথচ পরবর্তীতে আমি কত কিই না করেছি। এভাবেই দিন যাচ্ছিল,একদিন বাসায় ফিরে দেখি মা বাড়ীতে একা।যয়নব নেই তার পাশে। ভীষণ নি:সঙ্গতা অনুভব করলাম। কৌতুহল দমন করে নীরব থাকলাম আমার ভয় হল বেশী আগ্রহ প্রকাশ করলে আমার মনের কলুষতা প্রকাশ পাবে। মা কে তার ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞাসা করা লজ্জাজনক মনে হল। কিন্তু মা আমাকে বেশীক্ষণ এই কষ্টের মধ্যে রাখেননি। তিনি বললেন,
:আল্লাহর অশেষ কৃপায় আমাদের প্রতিবেশী সামরিক অফিসার এসেছিলেন, তার স্ত্রীর কাছে ক্ষমা চেয়ে তাকে নিয়ে গেছেন।তিনি আসয়ূত শহরে বদলী হয়ে গেছেন। সে যাবার সময় তোমাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে গেছে।
আমার মনের অবস্থা হল ঐ চাকুরী প্রার্থীর মত যে পরীক্ষায় অংশ নিলে ফেল করে অথচ স্বপ্ন দেখে একটি উপযুক্ত চাকুরী পাবার। সেদিন থেকে আমার মনটা সংকুচিত হয়ে গেল। বাড়ীতে থাকতে আর ভালো লাগত না,বাইরে চলে যেতাম মায়ের চোখকে ফাঁকি দেয়ার জন্য। ছোটবেলা থেকেই আমি আমার দুঃখ কষ্টকে গোপন করে রাখতাম।সময়ের ব্যবধানে একদিন ভুলে গেলাম আমার কষ্ট,আশাÑআখাংকাকে যা আমার অন্তরে গভীর ছাপ ফেলেছিলো। যেমন জ্বর সর্দি হলে মানুষ খুব কষ্ট পায়,জীবনের সব আনন্দ নষ্ট হয়ে যায় তারপর যখন সে সুস্থ হয় তখন সে সব কিছু ভুলে যায় যেন সে কোন কষ্টই পায় নি।
সময় গড়িয়ে যায়। আমি কৃষি কলেজ থেকে ডিপ্লোমা ডিগ্রী অর্জন করি এবং কৃষি বিভাগে চাকুরীতে যোগদান করি ১৯২৫ সালে। এর পাঁচ বছর পরে আমি আলেকজান্দ্রিয়া শহরে অফিসিয়াল কাজে যাই। সেখানে পৌঁছে আমি একটা ভালো হোটেল খুঁজছিলাম,দীর্ঘ সফরে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম।অবশেষে একটা হোটেল পেলাম আমার মনের মত,সেটা ছিল “হোটেল রীশ”। এটি সমূদ্র তীরেই অবস্থিত। তখন ছিল সেপ্টেম্বর মাস,আলেকজান্দ্রিয়াই এটি সুসময়। এসময় আবহাওয়া যেমন ভালো থাকে তেমনি সাগরও থাকে শান্ত আর স্বচ্ছ। এই হোটেলের দ্বিতীয় তলার একটি কক্ষে আমি উঠি। একটু পরেই আমার রুমে কেউ নক করল,খুলেই দেখি আমার বন্ধু ডক্টর আহমদ শিবলী।তাকে দেখে যেমন অবাক হলাম তেমনি আনন্দিতও হলাম। বললাম,
:আমি ভুল দেখছি না তো?সত্যিই কি তুমি শিবলী?
:পাশেই আমার কক্ষ,আমার দরজা খোলা ছিল,দেখলাম হোটেল বয়ের পিছনে তুমি যাচ্ছ। তাই সংগে সংগেই এলাম।
:এটা খুবই আনন্দের কথা।
:কত সৌভাগ্য তোমার! সে আমাকে বলল।
:তুমি আমার কোন সৌভাগ্যের কথা বলছ?তুমি জান আমি কৃৃষি বিভাগের কর্মকর্তা।এটা কি হিংসে করার মত কোন পদ? সে হেসে বলল,
:আমি তোমার পদমর্যাদার কথা বলছি না। তুমি ভাগ্যবান এজন্য যে তুমি এই কক্ষটি পেয়েছ।
:এই হিংসের কি কারণ? শুধু এই রুম কেন সব রুমেই তো সাগরের দিকে জানালা আছে তাই না?
:সেটা ঠিক আছে। কিন্তু তোমার ডানে ২৪ নং রুম। সে রুমের বারান্দা এখান থেকে দেখা যায়।
:এই ২৪ নং রুমের বিশেষত্ব কি?
সে ফিসফিস করে বলল,
:সেখানে এক সুন্দরী একা থাকে।
:একা থাকে!
:হ্যাঁ,আর এ কারনেই দ্বিতীয় তলাই সবসময় লোকের ভীড় থাকে।
:সে মনে হয় কোন অভিনেত্রী বা নৃত্যশিল্পী?
;২৭ নং রুমের লোকটিও এমন মনে করে।
:২৭ নং রুম মানে?আমি জানতে চাইলাম।
:সেখানে আমার এক বন্ধু ডক্টর সাওয়াফ উঠেছেন।কিন্ত আমার এরকম মনে হয় না। আমি এখানকার সব নাট্য-নৃত্যমঞ্চে খোঁজ নিয়েছি।কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার,তিনি সম্ভ্রান্ত নারীদের মত। কারো সাথেই তার ঘনিষ্ঠতা নেই। সত্যিই তিনি নিষ্কলুষ।
আমি হেসে বললাম,
:পরীক্ষায় মানুষ সন্মানিত হয় অথবা অপমানিত হয়।
:উহ..সবরুমের লোকেরাই তার কাছে গেছে এবং নিরাশ হয়েছে।
:কেউ ই সফল হয়নি!
: না,আল্লাহই জানে এর রহস্য কি?
আমার বন্ধুটি মিনিট পনের ছিল,আরো কিছু কথা বলে সে বিদায় নিয়ে চলে গেল।আমি খুবই ক্লান্ত ছিলাম তাই গভীর ঘুমে তলিয়ে যাই। বিকেলে ঘুম থেকে উঠে আমি বারান্দাতে যাই সমূদ্রের মৃদমন্দ বাতাস উপভোগ করার জন্য। আমি তাকাই আমার ডানদিকের বারান্দার দিকে। আমার মনে পড়ল বন্ধুর কথা,কৌতুহল বশত আমি সেদিকে তাকিয়ে থাকি বেশ কিছুক্ষণ। একটু পরেই সে বারান্দার দরজা খুলে কাউকে বের হতে দেখা গেল আমি সংগে সংগে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলাম এবং কোন আগ্রহ দেখালাম না। কিন্তু আমি বেশীক্ষণ এভাবে থাকতে পারলাম না,তার হাঁচির শব্দে বুঝলাম সে একটি নারী,আমি বাধ্য হলাম আমার প্রতিবেশীর দিকে তাকাতে। মেয়েটিকে দেখে আমার চেনা চেনা মনে হল এবং একসময় আমি নিশ্চিত হলাম একে আমি আগেও দেখেছি। আমি স্মৃতি হাতড়িয়ে দেখলাম এ সেই আমাদের পুরোনো প্রতিবেশী,যে কিছুদিন আমাদের বাড়ীতে ছিল এবং আমার নিঃসঙ্গ একঘেঁয়েমী জীবনে আনন্দের জোয়ার এনেছিল।যে আমার মধ্যে বিস্ময় এবং আগ্রহের সৃষ্টি করেছিল। মেয়েটি যখন আমার দিকে তাকাল আমার অন্তর কেঁপে উঠল অথচ তার চেহারাতে কোন পরিবর্তন হল না।আমি তার সাথে কথা বলতে চাইলাম কিন্তু নিরাশ হয়ে দেখলাম তার দৃষ্টিতে কোন প্রাণের ছোঁয়া নেই। মৃতব্যাক্তির মত স্থির,শীতল সে দৃষ্টি।পরক্ষণেই সে ফিরে গেল। আমি খুবই দুঃখ পেলাম।নিঃসন্দেহে সে আমাকে ভুলে গেছে,অথচ আমি নিশ্চিত সে আমাদের পুরোনো প্রতিবেশীনি যে এখনো চমৎকার দেহসৌষ্ঠব এবং কমনীয়তার অধিকারী। কিন্তু সে কেন একাকী এখানে? কেন সে এমন নিঃসঙ্গ জীবন যাপনে বাধ্য হয়েছে? আর তার স্বামীই বা কোথায়? তার কথা ভাবতে ভাবতেই বাইরে বের হই। আমাকে চমকে দিয়ে সেও একই সময় কক্ষ থেকে বের হয় এবং আমার সাথেই নীচে নামে। আমার খুব আগ্রহ হল তার সাথে কথা বলতে।নিজেকে কিছুতেই বিরত রাখতে পারলাম না,তাকে বললাম,
:মাফ করবেন মিসেস, আপনি কি আমাকে চিনতে পারছেন?
কিছুটা বিরক্তি নিয়েই সে আমার দিকে সরাসরি তাকাল। সে হয়ত ধারণা করল আমি তার সাথে কথা বলার অজুহাত খুঁজছি। দ্রুত পদক্ষেপে কিছু না বলেই সে চলে গেল,আমি আবার তাকে হোটেলের দরজায় বললাম,
:সত্যিই কি আপনি আপনার প্রতিবেশীদের এত তাড়াতাড়ী ভুলে গেছেন? আপনার মনে নেই বিচারক হারেম হাসান বেগ এর পরিবারের কথা?
সে আমার দিকে তাকিয়ে কিছু মনে করার চেষ্টা করে বলল,
:আদালাত হানুম......যাকাযীক রোড?
আমি আনন্দিত হয়ে বললাম,
:জ্বি,তিনিই আমার মা আর এখানেই আমাদের বাড়ী।
সে হাসল,আমার পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলল,
:সত্যিই আপনি তাঁর ছেলে? হ্যাঁ,আমার মনে পড়েছে। কেমন আছেন আদালাত হানুম?
:মা ভালোই আছেন। আপনার খবর বলুন।
:ভালো,আপনি কি এখানে একা এসেছেন?
:হ্যাঁ, আমার স্ত্রী আমাদের বাড়ীতেই আছে। বাবা তাকে খুবই স্নেহ করেন, আমার সাথে সে আসেনি আর আমি আমার অফিসের কাজে এখানে এসেছি।
:দুঃখিত,আমি আপনার নাম ভুলে গেছি।
:হাসুনা।
আমিও তার নাম ভুলে গেছি স্বাভাবিক ভাবেই কিন্তু আমার তখন ইচ্ছে হল না তার নাম জিজ্ঞাসা করতে। তার পাশে হাঁটছিলাম নীরব হয়ে। আমার অনুভূতি প্রবল কিন্তু আমি ঐ পুরুষদের মত যারা একাকী কোন সুন্দরী নারীর সংস্পর্শে এসে অপ্রস্তুত হয়ে যায়। যদিও নারীদের প্রতি আমার স্বাভাবিক আকর্ষন আছে। বিশ বছর বয়সে হয়ত আমি প্রেমের জন্য পাগলামী করেছি কিন্তু আমি এতদিনে প্রেমের অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি,অবাধ মেলামেশা আর বহুনারীর সান্নিধ্যে প্রেমের পবিত্র অনুভূতিও হারিয়েছি বহুকাল আগে।অনেক নারীর মধ্য থেকে আমার জীবনসঙ্গী বেছে নিয়েছি কিন্তু কেন জানি আমি সন্তুষ্ট হতে পারিনি । অথচ সেদিন এ নারীর সাথে স্বল্পসময়ের ঘনিষ্ঠতায় এক অপ্রতিরোধ্য কামনা আমার মধ্যে জেগে উঠে,বললাম,
:আপনি এখানে একা থাকেন?
সে কোন সংকোচ না করেই বলল,
:হ্যাঁ।
:আর আপনার স্বামী?
:তিনি সুলুমে থাকেন।
:একা কেন থাকেন?
সে জোরে হেসে উঠল।
:আপনি কি আমার ব্যাপারে তদন্ত করতে এসেছেন আর তাই জেরা করছেন?
অনধিকার চর্চার জন্য বিব্রত হলাম,কিন্তু তা গোপন করে আমিও হাসলাম,আগ্রহ থাকলেও এ ব্যাপারে আর কথা বলিনি।তাকে বললাম,
:কথা বলার জন্য আমরা কি ভালো কোন জায়গাই বসতে পারি না।
সে অসন্মতি জানিয়ে বলল,
:না,আমি হাঁটতেই পছন্দ করি।আমার এ স্বাস্থ্যের জন্য হাঁটা জরুরী।
আমি তাকে দেখলাম,অদ্ভুত আকর্ষনীয় দৈহিক গঠন তার। সুযোগ পেয়ে আমি বললাম,
:আপনি ঈর্ষনীয় ফিগারের অধিকারী,কেন অযথা এজন্য চিন্তিত হচ্ছেন?
:না,আগের দিনে এটা ঠিক ছিল কিন্তু বর্তমানে এটাকে সুন্দর ফিগার বলে না।
:এটাই যথেষ্ঠ। আমার কাছে এই ফিগারকেই আকর্ষনীয় এবং সুন্দর মনে হয়।
:কিন্তু সবাই কি এরকম মনে করে?
:সব মানুষের দৃষ্টিভঙ্গী তো এক নয়।
তার সাথে কথা বলতে বলতে আমি এক অদ্ভুত ভালো লাগায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম।নিজেকে ভাগ্যবান মনে হল,আমিই শুধুমাত্র এই নারীর কাছাকাছি আসতে পেরেছি। তার সুন্দর কথা তার চেয়েও সুন্দর তার হাসি আমাকে মোহগ্রস্থ করে ফেলল। তার প্রতি আমি কামনা কাতর হয়ে পড়লাম দারুনভাবে।আমি বললাম,
:আপনি সেই আগের মতই আছেন। এই দীর্ঘসময়ে আপনি এতটুকু বদলে যাননি।মনে হচ্ছে দশ বছর পূর্বের মত ই সেই সুন্দরী যে আচমকা উদয় হয়েছিল আমাদের বাড়ীতে আবার সেরকম আচমকা হারিয়েও গিয়েছিল।আমি যাকে স্বপ্নে দেখেছি বহুদিন।দুষ্টমী ভরা চোখে সে আমার দিকে তাকাল,
:তুমি তো দারুন লোক। তোমার মনে এই ছিল!
আমি হেসে বললাম,
:এতে আশ্চর্য হবার কি আছে? যেই এই সুন্দরকে দেখবে সেই একে কামনা করবে।
:সত্যি কথা বলতে কি আমি তোমাকে ছেড়ে গিয়েছিলাম তোমার কামনা বাসনার কাছে ধরা দেব না বলেই।
:হ্যাঁ,আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলে....যদি না যেতে..যাক কতদিন পরে আবার তোমার দেখা পেয়েছি।এটা যে আমার কত সৌভাগ্য!
:তুমি এমনভাবে কথা বলছ যেন আমরা প্রেমিক প্রেমিকা ছিলাম,তারপর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলাম আবার মিলিত হয়েছি..
:নিশ্চয়,তুমিও এরকম ভাবছ।
: এটা তো শুধুই কল্পনা।
:আমি মনে করি না এটা অসম্ভব কোন ভাবনা।
:কিন্তু আমি মনে করি এটা অবাস্তব ভাবনা।
সে বলছে এটা সম্ভব নয় কিন্তু জোর দিয়ে বলছে না। সে কথা বলছিল আকর্ষনীয় ভঙ্গিতে,যা আমাকে উত্তেজিত করছিল।সে হাসছিল আর তার হাসি এতই মধুর যে তা ছড়িয়ে পড়ছিল আমার সমস্ত দেহ মনে।কথা বলতে বলতে সেও আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়েছিল তাই আমি অবাক হইনি যখন সে নিজেকে সমর্পন করে আমার বুকে।আমার মনে পড়ল বন্ধু শিবলীর কথা তাই আবার বললাম,
:আমি খুব অবাক হয়েছি কেন তুমি একা এই হোটেলে আছ?
:তুমি আবার জেরা শুরু করলে?
:না.না..আমি মোটেও জেরা করছি না। কিন্তু আমি শুনেছি দোতালার যারা থাকে তারা নাকি তোমাকে বিরক্ত করে?
:হ্যাঁ,প্রায় সবসময়ই।এখন তারা তোমাকেও বিরক্ত করবে।
আমি দীর্ঘনিশ্বাস ফেললাম ইচ্ছে করেই যেন সে শুনতে পায়।
:তাহলে,তোমার কি মনে হয় না আমাদের এই “হোটেল রীশ” ছেড়ে চলে যাওয়া উচিৎ।
:হোটেল ছেড়ে দিব..?
:হ্যাঁ,আমার তাই মনে হয়। আমি লুরানে একটি ভাল নিরিবিলি হোটেল চিনি। তোমার কি মত?
সে কোন উত্তর দিল না,চুপ করে থাকলো কিছুক্ষণ। তার চেহারাতে প্রকাশ পেল চিন্তার ছাপ।আমার অন্তর কেঁপে উঠল। অজানা আশংকায় ভীত হলাম,অস্থির হলাম তার মত জানার জন্য। হঠাৎ অনুভব করলাম আমার হাতের উপর তার হাতের স্পর্শ। আমরা আনন্দিত হলাম প্রেমিক প্রেমিকার মত অথবা স্বামী-স্ত্রীর মত।আমার হৃদয় প্রশমিত হল,তীব্র সুখ আর খুশীতে আমি ভেসে গেলাম।আমি সত্যিই প্রকৃত সুখ পেয়েছিলাম। সেদিন আমরা একসাথে ডিনার করি।তারপর হোটেল রীশ থেকে আমাদের লাগেজ নিয়ে আসি। আমরা লুরানে ”হোটেল এক্স লাশাবেল” এ উঠি। সাগর তীরের এ হোটেলটির পরিবেশ খুবই শান্ত আর নিরিবিলি। মনে হয় এটি যেন একজন দরবেশ যে দুনিয়ার সমস্ত কোলাহল থেকে মুখ ফিরিয়ে অনন্তের দিকে চেয়ে আছে। বেশকিছুদিন সে হোটেলে থাকলাম আর এখনো সেই সুখের দিনগুলোর স্মৃতি রোমান্থন করি যেমন অসুস্থ ব্যাক্তি স্মরণ করে তার সুস্থ অবস্থাকে। সেখানে আমাদের প্রেম এত প্রবল ছিল যেন সে কায়রোর প্রশাসক। স্বেচ্ছাচারী আর পরাক্রমশালী যে এতটুকু ছাড় দিতে রাজী নয়।আমাদের বিবেক,আমাদের অন্তর সবজুড়েই ছিল সে প্রেমের উপস্থিতি। আমাদের মনে হত দিনগুলো খুব সংক্ষিপ্ত আর দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে।আমি তার কাছে যেতাম প্রবল কামনা নিয়ে। এক দুর্নিবার আকর্ষণ অনুভব করতাম তার প্রতি। তার অপার সৌন্দর্য আমার তৃষার্ত মনপ্রানকে পরিতৃপ্ত করে দিত,তবুও আরো চাইতাম। বুভুক্ষের মত উপভোগ করতাম পরস্পরকে। আমরা কিছুই রেখে দিতাম না আগামীর জন্য। প্রেমকে আস্বাদন করেছি পরিপূর্নভাবে। আর আমার সঙ্গীনিটিও ছিল খুব সুখী এবং সন্তুষ্ট। প্রেমের নেশায় সে মাতাল হয়েছিল।মাতালের যেমন সংগীতের তালে তালে মাতলামী বেড়ে যায় তেমনি তার নেশাও দিনে দিনে বৃদ্ধি পেয়েছিল।
আমাদের কামনা বাসনার মধ্যে সামান্য পার্থক্য ছিল,আমি তখন বর্তমান ছাড়া কিছুই চিন্তা করতাম না, তাকে ভালোবাসতাম এমনভাবে যেন তার মধ্যে যত সুখ আছে এক চুমুকেই তা শুষে নেব।কিন্তু সে ভবিষ্যতের কথা ভাবত। তার অন্তরে ছিল সত্যিকারের প্রেম আর সে চাইত স্থায়ী সুখ। আমি এজন্য বিস্মিত হতাম আর সত্যি বলতে কি এই নারী কে আমি বুঝতে পারতাম না। কখনো তাকে মনে হত দায়িত্বজ্ঞানহীন ,খেয়ালখুূশী মত চলা এক নারী,যে স্বামী ছাড়া দূরদেশে থাকে তার লোভ লালসা চরিতার্থ করার জন্য। আবার কখনো তাকে শান্তশিষ্ট এক নারী মনে হত যার অন্তরে ছিল অনেক প্রেম ভালোবাসা। সে এমন ভূলসিদ্ধান্ত নিত না যা তাকে বিপদে ফেলে। আমাদের দিনগুলো ছিল নিখাঁদ ভালোবাসাময় দিন। আমার মনে কোন কলূষতা ছিল না শুধু আমার অতিরিক্ত বাড়াবাড়ির জন্য আমার চেতনা লোপ পেয়েছিল। এই প্রেম ছাড়া আর কিছুই আমার চিন্তাতে ছিল না কিন্তু একসময় আমার বোধদয় হয়।আমার মনে হয়েছিল এই প্রথমবারের মত আমি আমার দাম্পত্য জীবনের পবিত্রতা নষ্ট করেছি। এমন নিষিদ্ধ পাপকাজ এর পূর্বে আমি করিনি। তীব্র মনোকষ্টে আমি ক্ষতবিক্ষত হচ্ছিলাম,ভয় পাচ্ছিলাম। আমার এত কষ্টের কারন আমি বিবাহিত।নিজের কাছে জবাবদিহিতা করলাম,আল্লাহ কি এজন্য আমাকে শাস্তি দিবেন না। অন্যদের যে দোষ দিয়েছি সে দোষে কি আমিও দোষী নয়।গল্পের এ পর্যায়ে এসে আমাদের মধ্যে একজন বলল,এরপরে কি আপনার আশংকা সঠিক হয়েছিল? আমাদের বক্তা কথার মধ্যে বাধা দেয়াতে বিরক্ত হলেন। তিনি আবার বললেন,এই অনুশোচনা বাদ দিয়ে আমি অন্য বিষয় নিয়ে পড়লাম। আমি ভাবলাম ওর স্বামীর কথা।আশ্চর্য মানুষ তিনি স্ত্রীকে একাকী থাকতে দিয়েছেন এত দূরে।কি কারনে তারা আলাদা থাকে।এমন অদ্ভুত দাম্পত্যজীবন নিয়ে এরা কি সুখী? হঠাৎ করে যদি তিনি উপস্থিত হন আমাদের মধ্যে তবে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে তা কি শোভনীয় হবে? এতসব এলোমেলো চিন্তাতে বিপর্যস্ত হয়ে আমি হোটেল ছেড়ে,তার সঙ্গ এড়িয়ে দূরে চলে যেতাম। বাধ্য হয়ে একদিন তাকে বললাম।
:তোমার স্বামীর কথা বল।
আমার কথা শুনে তার উজ্জ্বল মুখ ম্লান হয়ে গেল,দৃষ্টি নামিয়ে সে বলল,
:এ প্রসঙ্গ বাদ দাও।
আমি জোরাজুরি করলাম কিন্তু সে চুপ করে থাকল আমি বারবার সে একই কথা জানতে চাইলাম যা আমাকে কষ্ট দিচ্ছে। কিন্তু সে এড়িয়ে যেত এবং পালাতে চাইত এ প্রসঙ্গ থেকে। আমি অধৈর্য্য হয়ে একদিন দৃঢ়ভাবে তাকে বললাম,
:তোমার জানা উচিৎ কেন আমি একই প্রশ্ন বারবার করছি। এটা নিছক কৌতুহল নয়,আমি এমন একটা মানুষের সবকথা শুনতে চাই,যাকে আমি সম্মান করি এবং ভালোবাসি। আমি চাই সে আমার কাছে তার মনের সবকথা বলুক। আমার কথা শুনে সে আনন্দিত হয়ে বলল,কি সৌভাগ্য আমার! সবসময় আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই এজন্য যে তিনি আমাকে এমন একজন দয়াবান,সহানুভুতিশীল প্রেমিক দিয়েছেন।
আমি তার রেশমী কালো চুলগুলো নিয়ে খেলতে খেলতে বললাম,
:যদি তাই মনে কর তবে সবকিছু আমার কাছে কেন খুলে বল না।
:কিন্তু এটা যে খুব কষ্টের এবং ঘৃণার কথা।
:যদি তুমি বলতে না চাও তবে আমি জানতে চাই না। কিন্তু আমার প্রায়ই মনে হয় দাম্পত্য জীবনে তুমি সুখী নও। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে কেন তোমার স্বামী তোমাকে এভাবে ছেড়ে দিয়েছেন?
:সত্যি বলতে কি সে আমার বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে জানে না।
:এটা তো আরো আশ্চর্যের কথা। আমি বুঝতে পেরেছি তোমরা পরস্পরকে ভালোবাস না কিন্তু আমি এটা বুঝতে পারছি না এরপরেও তোমরা স্বামী-স্ত্রী হয়ে আছ কেন?
:আমার স্বামী আমাকে তালাক দেয়নি, কারন আমার প্রয়োজনীয় অর্থ পরিশোধ করতে সে অক্ষম। আর সত্যিকার অর্থে সে শুধু নামেই আমার স্বামী। স্বামী হবার কোন যোগ্যতা তার নেই। আর সবচেয়ে বড় কথা আমি তালাক চাই না। আমি অবাক হয়ে বললাম,
:কি আশ্চর্য! কেন চাও না?
:এতে বিস্ময়ের কিছু নেই তো। তুমি দেখছ আমি সম্পূর্ন স্বাধীন। আমি যদি তালাকপ্রাপ্তা হতাম তবে কি যেখানে খুশী যেতে পারতাম? আহ্ যদি আমার এমন কেউ থাকত যে আমাকে নিয়ে ভাববে,আমাকে অন্তর দিয়ে ভালবাসবে। তাহলে আমার জীবনটাই বদলে যেত। আমি যে খুব একা,এত বড় পৃথিবীতে আমি কত নিঃসঙ্গ! তুমি কখনো বুঝবে না একাকীত্ব কি,আমি সারাজীবন এর রস আস্বাদন করছি। বাবা-মা মারা যাবার পর আমার একমাত্র ভাই গ্রীস দূতাবাসে যোগ দিয়ে চলে যায়। তারপর আমার স্বামীও আমাকে ত্যাগ করে। একটু আশ্রয় দেবার মত,একটু ভালোবাসার মত কেউ নেই আমার। আমি এক পরিত্যক্তা,বিতাড়িতা নারী।
আমি নির্বাক হয়ে গেলাম, তার কথাগুলো আমার মনে গভীর রেখাপাত করল। তার সুন্দর মুখটা রাগে দুঃখে এক টুকরো অঙ্গারের মত লাগছিল। অশ্র“তে টলমল তার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম,
:তুমি হৃদয়কাড়া সুন্দরী,বিত্তবান। সবকিছুই আছে তোমার। তোমার বোকা স্বামী আর কি চায়?
:সে অসভ্য, ইতর, নিষ্ঠুর আর অবিশ্বস্ত। অল্প কিছুসময় তার সঙ্গে থেকেছি তারপর বাধ্য হয়েছি এমন ভবঘুরে ভোগের জীবন বেছে নিতে। আল্লাহ যদি আমাকে একটা সন্তান দিতেন তাহলে হয়ত আমি তার জন্য সবকিছু সহ্য করতাম কিন্তু আমি সে সুখ থেকেও বঞ্চিত।
তার কথায় আমি এতটাই প্রভাবিত হয়েছিলাম যে তার মত আমার চোখ দিয়েও অশ্র“ গড়িয়ে পড়ছিল। তার এই দুঃখজনক অসুখী জীবন আমাকে ব্যথিত করল। আমি চিন্তিত হয়ে বললাম,তুমি তো এখন তোমার ভাগ্যের বিপর্যয়গুলো সংশোধন করে নিতে পার,তাই না?
সে জোরে হেসে উঠল,তার মনোবেদনার বহি:প্রকাশ ছিল সেই তিক্ত হাসি।
:এই দূর্ভাগ্যের কোন প্রতিকার নেই আমিও একে বদলাতে চাই না। আমি তোমাকে বলছি আমি আমার স্বামীকে ভালবাসতাম আর এখনো এই বিয়ে টিকে আছে কারন এখনো আমি তাকে ভালোবাসি। বিয়ের কয়েকদিন পর থেকেই সে বাইরে রাত কাটাতে শুরু করে। ভোর হবার একটু আগে বাসায় ফিরত। যখনি আমি তাকে সংশোধন করতে গেছি আর আমার দূর্ভাগ্যকে দূর করতে চেয়েছি তখনই সে আমাকে উপহাস করত।আমার সবধরনের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। একসময় সে আমার কথা আর হালকাভাবে নিত না। আমি তাকে কিছু বললে আমার সাথে অভদ্র আচরণ করত,কঠোর হয়ে যেত। কথা বলতে বলতে সে কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে গেল ।কষ্টকর জীবনের স্মৃতিচারণ করতে করতে সে যেন হারিয়ে যেত তার অতীত জীবনে।তারপর আবার কথা বলত ভারী গলায়,মলিন মুখে। তার বিষন্নতা আমার মধ্যেও সংক্রমিত হয়েছিল। সে বলল,
:আমার বিয়ের প্রায় মাসখানেক পর এমন একটা ঘটনা ঘটেছিল যা তোমাকে না বলে পারছি না। এটি আমার আত্মসম্মানের প্রতি বিরাট আঘাত। দীর্ঘ অনিদ্রার পর একরাতে আমি ঘুমিয়েছিলাম। কারো চিৎকারে আমার ঘুম আচমকা ভেঙ্গে যায় দেখি আমার স্বামী এসে বিছানায় বসেছে।আমি কষ্ট পেলাম তার এই রূঢ় আচরণে কিন্তু তাকে কিছু বলতে পারলাম না। সে তখন বদ্ধমাতাল। তার চোখমুখ লাল হয়ে ছিল আর মুখ দিয়ে বিশ্রী গন্ধ বের হচ্ছিল। আমার জন্য আরো বিস্ময় অপেক্ষা করেছিল,দেখলাম সে আজ একা আসেনি তার সাথে একটি মেয়ে এসেছে। সেও তার মতই মাতাল। তারা অপেক্ষা করছে আমারই বিছানায় শোয়ার জন্য। আমার বিস্ময় আর ঘোর না কাটতেই শুনতে পেলাম স্বামীর জড়ানো অস্পষ্ট কথা “অনুগ্রহ করে বাইরে যাও। মেয়েটিও বসে পড়ল তার পাশে।আমি মেনে নিতে পারলাম না,খুব রাগ হল তাকে গালি দিলাম,অভিশাপ দিলাম।কিন্তু সে আমার কোন কথাই শুনল না।আমি পাগলের মত ঘর থেকে বের হয়ে আসি।বাড়ী ছেড়ে চলে আসা ছাড়া সেই মূহুর্তে আমি আর কিছুই ভাবতে পারছিলাম না। সেই রাতে এক কাপড়েই আমি বের হয়ে পড়ি।মোরগের ডাক শুনে বুঝলাম তখন রাত প্রায় শেষ। কায়রোতে সব কিছুই আমার অচেনা। শুধু একটি বাড়ীই আমার চেনা,সেটা ছিল তোমাদের বাড়ী। তোমার তো মনে আছে কিছুদিন আমি তোমাদের বাড়ীতে ছিলাম। আমি কখনোই ভুলতে পারব না সে রাতের কথা।সে রাতের সবকিছু এখনো আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল। যদিও তা প্রায় এক যুগ আগের কথা। আমার অবশ্যই মনে পড়ে সে দিনগুলোর কথা। কিন্তু আমি একটুও বুঝতে পারিনি কত দুঃখ কষ্ট সে গোপন রেখেছিল। একটু পরে আমি বললাম,
:এরপরও তুমি তার কাছে ফিরে গেলে?
:সেই রাতেই আমার দাম্পত্যজীবনের ইতি ঘটেছে।কিন্তু আমার যে কোন আশ্রয় ছিল না,ছিল না সাহায্য করার মত কোন আপনজন।এ অবস্থায় তার কাছে ফিরে যাওয়া ছাড়া আমি আর কিই বা করতে পারতাম।এরপর ভাগ্য আমাকে সহায়তা করল,তার অর্থের প্রয়োজন পড়ে,আমি তাকে সাহায্য করি আমার টাকাদিয়ে।বিনিময়ে তার কাছ থেকে নিয়েছি আমার মুক্তি,আমার স্বাধীনতা। এখন আমি যেখানে ইচ্ছা যাই,যা মন চায় তাই করি। আমার কোন ব্যাপারেই সে মাথা ঘামায় না।
:তুমি কি সুখী এই জীবনে? আমি শঙ্কিত হয়ে জানতে চাইলাম।
সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
: আহ সত্যিই যদি আমি সুখী হতে পারতাম। আল্লাহর কাছে কত প্রার্থনা করেছি তিনি যেন আমার এই অবাধ স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেন।যে স্বাধীনতার বিনিময়ে আমি উপভোগ করছি সীমাহীন সুখ,যে সুখের স্বপ্ন দেখতাম।আর পেয়েছি এমন ভালোবাসা যার জন্য দগ্ধ হতাম।আমি সবসময় প্রস্তুত আমার এই স্বাধীনতা এমন কাউকে যৌতুক দিতে,যে আমাকে দান করবে তার হৃদয় আর যে হবে সৎ। কত খুঁজেছি আমি এমন কাউকে।আমি ক্লান্ত,অবসন্ন হয়ে পড়েছি তবু পাইনি কারো দেখা।
আমি জানলাম তার সবকথা। এই দুঃখীনি নারীটি দীর্ঘ দশবছর ধরে সুখের সন্ধান করছে।সে কি পাবে যা সে কামনা করে ।কখনোই না,সে পাবে না তার মনের মত মানুষ।এতে সন্দেহের অবকাশ নেই। যদি সে এমন কাউকে পায় তবে সে বড়জোর আমার মত হবে। দশবছর সে পার করেছে তিক্ত কষ্ট আর যন্ত্রণাদায়ক প্রতারণার মধ্য দিয়ে। নিঃসন্দেহে বহুমানুষ তাকে ভালবেসেছে,কিন্তু তারা ভালবেসেছে লোভ এবং কামনার বশবর্তী হয়ে,যেমন এখন আমি তার সাথে করছি। সবাই তাকে ভোগ করার পর ছুড়ে ফেলে দেয় তার ঘৃনিত স্বাধীনতার দিকে। আর এভাবেই তার স্বাধীনতা তাকে নীচু করে,সস্তা বানায় আবার কখনো তাকে স্বেচ্ছাচারীতে পরিণত করে। যয়নব তার জীবনের গল্প বলার পর আমার দিকে তাকাল প্রশান্তি আর আত্মসমপর্নের ভঙ্গীতে। সে আমার কপালে তার কপাল ঠেকাল তারপর আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল,
:এরপর কি?
আমি বুঝলাম সে কি বলতে চায়। তার দুঃখের জীবন কাহিনীতে আমিই এখন শেষ আশা। আমি তাকে ভালবাসি আর এমন কারো স্বপ্নই সে দেখে। আমি হয়ত তাকে আরো গভীর দুঃখের মুখোমুখী করলাম। অনুভব করলাম তার জন্য আমারও কিছু করনীয় আছে। আমি ভাবলাম, কি তার স্বপ্ন? সে কি চায় এই সম্পর্ককে স্থায়ী করতে? কিভাবে একে স্থায়ীত্ব দিব আমি? আমি তাকে বিয়ে করতে পারব? তার দুঃখময় জীবন আমাকে ভীষন আলোড়িত করেছে। আমি অনেক ভেবেছি,নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা করেছি আমাদের সম্পর্কটাকে। নিষ্ঠুর আর দুঃখজনকভাবে বলতে চাই স্বার্থপরের মত আমি এ থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছি। শুধু কামনা-লালসার বশবর্তী হয়ে যে তাকে অনুভব করে,ভালবাসে তার পক্ষে এর চেয়ে বেশী আর কিই বা করা সম্ভব। বাস্তবতা হল,আমাদের এই সমাজটা বড়বেশী নিষ্ঠুর। বেঁচে থাকার জন্য,আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য এই সমাজ শুধু নিষ্ঠুরতার দিকেই আহবান করে।
একটা বিষয়ে আমি প্রায়ই অস্বস্থি বোধ করতাম,তা হল যয়নব খুব ভালো করেই বুঝতে পারত তার প্রতি আমার কি অনুভুতি। যদিও কখনো আমি তা স্পষ্ট করে বলিনি। আমি এটা বুঝেছি তার নীরবতা,শীতলতা আর হতাশার দ্বারা।আমি কিছুতেই গোপন করতে পারিনি আমার অন্তরে যা গোপনীয় ছিল।
আমি তার প্রতি এমন করুনা অনুভব করতাম যা আমার অন্তরকে ক্ষতবিক্ষত করত এবং তার জন্য এমন চিন্তা হত যা আমাকে সবসময় দগ্ধ করত। তাকে আমি ভালোবাসতাম কারন তার জন্য আমার দুঃখ হত,কষ্ট হত। কিন্তু সহানুভূতি আর প্রেম তো আলাদা বিষয়।আমি আশংকা করতাম হয়ত সে তার সন্দেহের কথা আমাকে বলবে। যা শুনে আমার কষ্টই শুধু দিগুন হবে।আশা করতাম সে যেন আমার উপর থেকে সন্দেহ দূর করে,এজন্য কোন দুঃখ কষ্ট না পায় এবং কখনো যেন আমাকে এজন্য দোষারোপ না করে। একসময় আমাদের একসংগে থাকাটা অসহনীয় হয়ে উঠল। আমরা বুঝতে পারতাম আমাদের পরস্পরের মনোভাব।কিন্তু আমরা দুজনেই দুজনকে কিছু বুঝতে দিতাম না। কেন সে তার উপলব্ধি,অনুভূতি আমাকে স্পষ্ট করে বলেনি আর কেনই বা সে তার কল্পনার সুখকে স্থায়ী করতে কোন পদক্ষেপ নেয়নি তা আমি জানি না।
এক দুপুরে অফিসিয়াল দায়িত্ব শেষে হোটেলে ফিরে দেখি আমাদের রুমটা ফাঁকা। আমি দেখলাম আলনাটা শূন্য যেখানে তার পোষাক ঝুলে থাকত,টেবিলের উপর তার ব্যাগটাও নেই। আমি আলমারী খুলে দেখলাম সেখানে শুধু আমার পোষাক।আমি হোটেল বয়কে ডেকে তার কথা জানতে চাই।সে জানাল,যয়নব সকাল দশটায় হোটেল থেকে চলে গেছে আর সে তাকে ট্যাক্সি ডেকে দিয়েছে। আমি রুমের সর্বত্র হন্য হয়ে খুঁজলাম তার একটি চিঠি অথবা কোন চিরকুট।কিন্তু আমি তেমন কিছুই পেলাম না। সে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে কোন কথা না বলেই।আর এভাবেই সবকিছু শেষ হয়ে গেল। আমি নীরব,নিশ্চল হয়ে গেলাম। নিজের সাথে অনেক যুদ্ধ করলাম। বিনা কষ্টে যে মুক্তি আমি না চাইতেই পেলাম তা আমাকে এতটুকু সুখ দিল না। আমি লজ্জা পেলাম আর ভয়ঙ্কর নিঃসঙ্গতা আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হল না সেই নির্জন কক্ষে রাত কাটানো। তাই আমি নতুন আশ্রয়ের খোঁজে চলে আসি।কিছুক্ষণের জন্য নীরব হলেন আমাদের বন্ধুটি। আবার বললেন,এরপর কয়েকবছর আমি তার দেখা পাইনি। বেশ কিছুদিন আগে আমি তাকে এক ষ্টেশনে হাটতে দেখেছিলাম। এখনো সে যথেষ্ঠ সুন্দরী। কিন্তু আমি জানতে পারিনি সে এখনো ভালবাসার প্রত্যাশী নাকি দুঃখ কষ্টের কাছে নিজেকে সঁপে দিয়েছে।
অনুবাদঃ তাসনীম আলম