ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছি, পিকনিকের বাসটা আমাকে ফেলে চলে যাচ্ছে। এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল, দেখি বন্ধু নাঈমের ফোন।
“কই তুই? তাড়াতাড়ি আয়”। আমি লাফ দিয়ে বিছানা থেকে উঠি।দেখি ৯.০০ বাজে, বাস ছাড়ার কথা ৮.০০টায়। তাড়াতাড়ি করে হাত মুখ ধুয়ে, কিছু না খেয়ে,সামনে যা পাইসি, তাই পরেই বেরিয়ে পরলাম। স্কুলটা, মানে বাস যেখান থেকে ছাড়বে, ঐটাআমার বাসার কাছেই ছিলো, তাড়াতাড়ি পৌঁছে গেলাম। গিয়ে দেখি মোটামোটি সবাই হাজির,শুধু আমিই লেট লতিফ। পরে অবশ্য মনে হলো যে, আমি না গেলে তারা কেউই যেতে পারত না।কারন, সকালের নাস্তার টাকার রসিদটা।
অনেকদিন পর বেশ কিছু বন্ধুর সাথে দেখা। আরাফাত, মিথিলা,মহুয়া, এহসানা, রাজর্ষি, আনিকা, স্বর্ণা, শারমিন এদের সাথে এইচ.এস.সি. এর পর আর দ্দেখা হয় নাই। সবাই বাসের কাছেইআছে। যে যার যার মত ব্যাস্ত। ইয়ামিন ছবি তোলায় ব্যাস্ত, আমি, তুহিন, হিমেল, জাকিরছবিতে পোজ দিতে ব্যাস্ত। অপু দূরে দাঁড়িয়ে একা একা খেতে ব্যাস্ত, বরাবর যা হয় আরকি, রাজর্ষি মেয়েদের সাথে দুষ্টামি নিয়ে ব্যস্ত। একামত্র শ্রদ্ধেয়ও শ্যামল স্যারএকা একা বসে আছে, উনিই আমাদের এই পিকনিকের অভিভাবক।
যাইহোক ৯.৩০ এর দিকে আমরা রওয়ানা দিলাম। অনেক পরিকল্পনারপর আজকে আমাদের যাত্রা শুরু। যাত্রার শুরুতেই পিছনে গিয়ে বসলাম। কারন খুব ভাল করেইজানি, সামনে বসলে মজা করা যাবে না। তখন একটা রোগ খুব বেশি ছড়িয়ে পরেছিলো, আর তাহলো “সেলফি”। আমাদের মধ্যেও রোগটা প্রকট আকারে দেখা দিয়েছিলো। সবাই সেলফি তুলছে,আমার চাঁদবদনখানা মোটামোটি সব সেলফিতেই ছিল। ও আমাদের আরেকজন বন্ধু মিসিং, সাদিভাই। উনি রাস্তা থেকে উঠবেন, জমিদার আরকি।
সাদিকে রাস্তা থেকেতুলে নেওয়ার পর, নাঈম আর হিমেল বেয়ারার কাজ আরম্ভ করল, মানে নাস্তা আর কোলড্রিংসদেয়া আরম্ভ করল(স্যান্ডউইচ আর মোজো)। পুরো বাসটাই জমিয়ে রেখেছিলো আমাদের আনিকা বেগম।উনি একাই একশ। আর তার সাথে ছিল আমাদের বিশিষ্ট পিসি মিজান ভাই। ছোটখাট মানুষ, কিন্তুজিনিস একখান। আমি বসা ছিলাম আনিকার ঠিক পিছনের সিটে। আনিকা তার স্যান্ডউইচ হাতেনিয়েই আমার দিকে তাকালো, আমার আর বুঝতে বাকি রইল না, খপ করে তার হাত থেকেস্যান্ডউইচটা নিয়ে আমার কছে সামলিয়ে রাখলাম। খাবার দেওয়ার সাথে সাথে সবাই গপগপ করেগিলতে আরম্ভ করল, ভাবখানা এমন যেন এই প্রথম জীবনে খাচ্ছে। খাওয়ার পরে যে যার মতমজা করছে। আমদের ফোটগ্রাফার ইয়ামিন সাহেব বাসের এই মাথা থেকে ঐ মাথা পর্যন্ত ছবিতুলতে ব্যাস্ত। আর আনিকা আপা একটু পরপর “আমার একটাছবি তুলিয়া দেও না নে”। মাঝখানে আবার আমি আর ইয়ামিন আইয়ুব বাচ্চুর “সেই তুমি”গানটা গাইলাম। মাম্মা সেই টান দিসিলাম গানটার মাঝে।
সবাই সবার মত মজাকরছে। আমাদের শ্যামল স্যারও তার একজন সঙ্গী পেয়ে গেলেন। আর তিনি হলেন, আমাদের অন্যতম একজনভবিষ্যতের ডাক্তার আরাফাত রহমান ভাই। একেবারে যেন সোনায় সোহাগা।
আমি অনেকক্ষণ পিছিনেথেকে এবার সামনের দিকে অগ্রসর হলাম। অনেকদিন ক্লাসের মেয়েগুলার সাথে দুষ্টামি করিনা। দুষ্টামির জন্য স্কুল জীবনে আমার নামই দেয়া হয়েছিলো “অসুর”। এখানে একটা কথাবলে রাখি মেয়রা সবাই কিন্তু একই ডিজাওনের ড্রেস পরেছিলো, ম্যাচিং করে। সামনে গিয়েদেখি সবাই সালোয়ার কামিজ পরলেও, মিথিলা আপাশুধু ঐ ডিজাইনের বোরখা পইরা এসে পড়ছে, চিন্তা করেন।ওনাকে দেখতে
অনেকটা পীর সাহেবদেরমত লাগছিলো। আমিত তার নামই দিয়ে দিলাম "পীর সাব" (পরে অবশ্য সে যখনআমাকে হোয়াটস আপ এ ম্যাসেজ দিয়েছিলো তখন লিখেছিলো আমি পীর সাব চিনসস)। সামনে গিয়েদুষ্টামি
করার সময় খেয়াল করলাম সামনে একটা স্যান্ডউইচ পরে আছে। ঐটা ইলমির স্যান্ডউইচ। সে আসতে পারে নাই। আমি মুচকি হাসি দিয়ে স্যান্ডউইচটা হাতে নিলাম, কিন্তু একা একা সাবাড় করতে পারলাম না,
অভিদাকেও ভাগ দিতে হলো। এক সময় শুনি আমাকে শ্যামল স্যার ডাকছে,"খই বা সিয়ান ওবায়দি আও তে"। ত স্যারের পাশে গিয়ে কিছুক্ষণ গল্প গুজব করে আবার পিছনে ফিরে গেলাম। যাওয়ার সময় একটু বাসের
হেল্পারগিরি করসিলাম(ভাড়া তুলসিলাম আর কি) ফইন্নিরার কাছে টাকাও ছিলো না।
হটাত মনে হলো আমরা কোথায় যাচ্ছি? কারণ যে জায়গায় যাচ্ছি, ঐখানে এর আগে আমরা কেউ যাই নাই। নাঈম আর হিমেল গুগল ম্যাপ এ দেখা আরম্ভ করল রাস্তাটা কোনদিকে। দেখা গেল আমরা প্রায় একঘন্টা ধরে
ভুল পথে যাচ্ছি। আমারা বাস থামিয়ে আশেপাশের লোকজনকে জিজ্ঞাসা করতে থাকি যে রাতুলগর বা মিনি সুন্দরবন কিভাবে যাওয়া যায়। যেই বাস থেকে নামলাম আরো একবার ফোটো তুলার হিরিক পড়ে গেল। অবশ্য
জায়গাটা সুন্দর ছিল।পিছনে পাহাড়, ছোট নদী আর আমরা ব্রীজের উপরে। পরিশেষে জানা গেল, আমাদের যেতে হলে এখন নৌকা করে যেতে হবে কারন, সড়ক পথে গেলে অনেকটা রাস্তা ঘুরে যেতে হবে। তাই
অগ্যতা কি আর করা, গোয়াইনঘাটের দিকে রওয়ানা হলাম। আমি কিন্তু মনে মনে খুশিই ছিলাম। অনেকদিন নৌকা চড়া হয় না। আর এই দিকে নৌকা চড়তে হবে মিথিলা দেখে বেঁকে বসল। ও নাকি নৌকায় উঠতে ভয় পায়।
গোয়াইনঘাট পৌঁছুতে পৌঁছুতে দুপুরের খাবারের সময় হয়ে গেল। ঠিক হল দুপুরের খাবার খেয়ে আমরা রওয়ানা দিব।সিলেট বিভাগের বিখ্যাত "পানসী রেস্টুরেন্ট " এর বিরিয়ানি খেয়ে আমরা দুইটা মাছ ধরার ট্রলার নিয়ে আমরা রাতারগুলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। মিথিলা প্রথমে বেঁকে বসলেও, পরে নৌকায় উঠে।
ট্রলার দিয়ে যেতে বেশ মজাই লাগছিলো। মেয়েরা প্রথমে ভিতরে বসলেও পরে নৌকার উপরে উঠে আসে। আর আমি আর রাজর্ষি এই সুযোগে নৌকা দুলাতে থাকি। যদি আমি নিজেও সাঁতার জানি না, তাই নৌকা যদিও ডুবে যায়, তাহলে আমার সলিল সমাধি হবে।
প্রায় এক ঘন্টা ট্রলারে করে যাওয়ার পর আমরা রাতারগুল পৌঁছলাম। দামদর ঠিক করে, ৩০ জন আমরা ৬ টা ডিঙি নৌকায় উঠলাম। সবাই উঠলেও মিথিলা, স্বর্ণা, রাজর্ষি আর স্যার উঠেন নাই। তারা ট্রলারেই ছিলেন। আমার নৌকায় আমি, শাওন, আকাশ আর সাদি উঠলাম। আমি আগে থেকি কিছুটা নৌকা চালাতে পারতাম। তাই মাঝি ভাই একদিকে আর আরেকদিকে আমি নৌকা চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলাম।রাতারগুলের ভিতরটা বেশ সুন্দর। টিভিতে যেমন সুন্দরবন দেখি, অনেকটা তেমনি। তাই এর নাম দেয়া হয়েছে "মিনি সুন্দরবন"।
মিনি সুন্দরবন ঘুরে যখন ট্রলারে উঠতে গেলাম, তখন মিজান ভাই ইয়াহু বলে এক লাফ দিয়ে নদীতে পরে গেল। তার দেখাদেখি ইয়ামিন, তুষার সহ আরো অনেকে নদীতে ঝাঁপ দেয়।পোলাপানরা মনে করেছিলো এটা ফাইভ স্টার হোটেলের সুইমিংপুল। কিন্তু না রে মুমিন, এটা একটা খরস্রোতা নদী। একেকজন একেকদিকে ভেসে গিয়েছিলো। পরে অনেক কষ্ট করে নৌকার বৈঠা ধরে ট্রলারে উঠেছিলো। (এর বেশ কিছু ফুটেজ আনিকার মোবাইলে আছে)। আমি শুধু পাড়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছি, সাঁতার জানলে আমিও নেমে পরতাম।
ফিরে যাওয়ার সময় আমাদের ট্রলারে স্যার উঠেন নাই অন্য ট্রলারে উঠেছিলেন। আমি তাকিয়ে দেখি স্যার ট্রলারের ছাদে বসে আছেন, স্যার কিভাবে ট্রলারের ছাদে উঠেছেন আল্লাহ মালুম (স্যরি স্যার, বেয়াদবি নিবেন না)। অবশ্য ট্রলারের ছাদে উঠাকে কেন্দ্র করে আমাদের তুহিন ভাই একটি ঘটনা ঘটিয়েছিলেন, সেটা এখানে না বলাই শ্রেয়। ফিরে যাওয়ার সময় সবাই মোটামোটি ক্লান্ত ছিল। তবে আমি, মিজান, আর রাজর্ষি নদীর পাড়ের মানুষদের সাথে বেশ মজা করতে করতে গিয়েছিলাম। একবার ত একটা ফুটবল আমাদেরনৌকায় এসে পড়েছিল। ও আরেকটি কথা, আমি যে ট্রলারে ছিলাম সেটা আগে আগে এসে পড়েছিলো। কিন্তু দ্বিতীয় ট্রলারের দেখা নাই। পরে ফোন করে জানা যায়, আমাদের অপু ভাই এর বড়টা পেয়েছিল। তাই নৌকা পাড়ে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তিনি জঙ্গলে ঢুকে যান (যদিও তিনি এটি অস্বীকার করেন)।
যাইহোক আমরা নয়টার দিকে মৌলভীবাজার পৌঁছলাম। বাস থেকে নেমে সবাই সবার সাথে বিদায় নিয়ে যে যার বাসায়গেলাম। এত আনন্দের মাঝেও আমার মনটা খারাপ ছিল, কারণ ঐটা ছিল মৌলভীবাজারে আমার শেষ দিন। আমরা পরের দিন ফ্যামিলি সহ ঢাকা চলে যাব।
এই পিকনিকটায় অসম্ভব মজা হয়েছিলো। কোন বিশৃঙ্খলা হয় নাই। এটা ভুলার মত না। যারা যাইতে পাড়ে নাই আমি বলব তারা অনেক মিস করছে।
-সমাপ্ত-
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে নভেম্বর, ২০১৪ রাত ১:০৯