একসময় বঙ্গ দেশীয়রা ভর্তা ঝুড়ি চচ্চরি আর মাছের ঝোলেই বেজায় খুশী ছিল। মুজতবা আলী সাহেব বলেছিলেন বাঙ্গালী মাংস রাঁধতে জানে না। জানবে কেমনে বাঙ্গালী তো মাংসই খেত না প্রায় এক সময়! কচু-ঘেচু শাক-সব্জী আর স্বাদু পানির মাছ এসব খেয়েই এক জীবন এমনিতেই পার হয়ে যেত। আর এখন কত শত খাবারের রঙ্গ! তবুও কোন কিছুতেই আর আশ মেটে না। পোলাওয়ের সাথে কোপ্তা টিকিয়া কোর্মা রেজালা না রোস্ট নাকি বিশাল গলদা চিংড়ি নারকেলের দুধের ঝোল সেটা কোনটা রেখে কোনটাকে প্রিয় তালিকায় রাখি নাকি তেহারি অথবা কাচ্চি কিংবা পাক্কি বিরিয়ানি আমার প্রিয় বুঝি না। এক সময় একটা ভাল লাগে। ওদিকে দম মাংস, কালা ভুনা, চুই ঝাল মাংস, মেজবানী গোস্ত ও সাতকরার ঝোল সহ হাজারো বাহারি কাবাব আর কত লোভনীয় খাবার।সর্ষে ইলিশ-এর স্বাদ নেবার জন্য মানুষ এখন পুরো দেশ দৌড়ে বেড়ায়।
কি কি খেলেন? কি খাওয়াল- আর কি খাবার আছে? এই ভাবনা দিন রাত আমাদের মাথার ভেতরে ঘুরে বেড়ায়। বাঙ্গালী বাই ডিফল্ট খাদ্য ছাড়া অন্য কোন আলাপে এখন আর মজা পায় না। যেখানে ভ্রমণে যাবে আগেই খোঁজ নেয় কি স্বাদের আর কি পদের খাবার আছে?
সেদিন দেখি সুন্দরবন দুই রাতের ভ্রমণে ১৭ বেলা আহার, তাও আবার বুফে!!! তারা ঘোরাঘুরির গল্প ছবি বাদ দিয়ে শুধু খাবারের মেন্যু আর ছবি দিয়ে তাদের ফেসবুক পেইজ ভর্তি করে ফেলেছে। আমি নিশ্চিত নব্বুইভাগ ভ্রমনার্থীরা ওই খাবারের লোভে সুন্দরবনে যাবে।
কেউ কোথাও থেকে বেড়িয়ে আসলেই প্রথম প্রশ্ন থাকে কি কি খাইলা? কেউ বাড়িতে বেড়াতে আসলে দু'মিনিট পরেই বাড়ির কর্তা আর কথা খুঁজে না পেয়ে বলেন খাইতে আসেন?
খাবার সময় না হলে হালকা স্ন্যাক্স কিছু একটা অফার করেন- না হয় নিদেন পক্ষে শরবত অথবা পান। এরপর যতক্ষন গেস্ট থাকে শুধু ঘুরে ফিরে খাবারের অফার। কেউ কোন ভ্রমন সেরে আসলে এমনকি হজ্জ করে আসলেও সবার এক প্রশ্ন; খাবার দাবার কেমন ছিল? বাঙ্গালীর ঘুরে ফিরে যেন ওটাতেই শান্তি। আমাদের সব ধরনের এন্টারটেইন যেন খাবারেই লুকিয়ে আছে।
এবার আপনি একটুচোখ বন্ধ করে কল্পনা করুন( না চোখ বন্ধ কইরেন মা, তা হলে আবার পড়বেন কেমনে- শুধু কল্পনা করেন) একটা জাতি যারা জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি কোনদিন গাছের সবুজ, পাতার সবুজ দেখেনি হয়তো শ্যাওলার সবুজ কিংবা মাছ পাখির অথবা অরোরার সবুজ দেখেছে। তুষারের মধ্যেই জন্ম তুষারের মধ্যেই মৃত্যু। এক জীবনে কোনদিন শাক সব্জি ফল মুল খায়নি- হাজারো বাহারী স্বাদের মশলা চেখে দেখেনি। পৃথিবীতে কতই না টক ঝাল মিষ্টি খাবার আছে তারা জানেই না এই স্বাদ কাকে বলে। ছানা মিষ্টি ঘোল মাখন চিজ কেক পেস্ট্রি বিস্কুট থেকে শুধু করে মানুষের কত দুর্দান্ত স্বাদযুক্ত আবিস্কারের গল্পও পৌছায়নি তাদের কাছে। এমনকি গাঁজা মদ ভাং থেকে শুরু করে সিগারেটের নেশা বলেও কোন নেশা আছে তারা জানত না।
জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তারা শুধু কাঁচা না হয় সিদ্ধ, ঝলসানো, শুকনো কিংবা বড়জোর চর্বিতে ভাজা সিল, হরিন, সি লায়ন, তিমি হাঙ্গর, মেরু ভল্লুক, মাছ আর পাখির মাংস খেয়ে কাটিয়ে দেয়। সেখানে গেলাস ভরে পানি খাবার বালাই নেই। দাত মাজার হ্যাঁপা নেই, গোসল নামে শরির ধোয়ার একটা বিষয় আছে সেটা তারা বাপের জন্মে শোনেনি।
~ বরফের চাঁই দিয়ে ইগলুর ঘর তৈরি।
জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তারা যোদ্ধা আর সংগ্রামী। সূদীর্ঘ ছয় মাসের নির্মম শীতল অন্ধকার জীবন তাদের কেটে যায় একই গল্প করে একইভাবে আড্ডা দিয়ে ভয়ঙ্কর একঘেয়েভাবে যা আমরা এই আধুনিক জীবনে ভাবতে গেলেও শিউড়ে উঠব! তবুও তারা হতাশ হয়না- হয়না মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত! তাদের ভেতরের রক্ত যেন শিকারের জন্য সবসময় টগবগ করে ফুটতে থাকে- কি যাদুকরি মন্ত্রে তারা উদ্দীপ্ত থাকে তাঁর নাগাল আধুনিক মানুষ আজও পায়নি।
ভাবছেন বুঝি অবসরে তারা যৌন উন্মত্ততায় মেতে ওঠে?
মোটেও তা নয়। মাইনাস ৬০ ডিগ্রীতে সেই বরফের ঘরে সারাক্ষন ফায়ারপ্লেস জ্বালিয়ে রাখা অসম্ভব! যেখানে নিজেকে গরম রাখাই ভীষন কষ্টকর এক কর্ম! সেখানে সেখানে পোষাক খুলে শরিরের বিপরিত লিঙ্গের স্পর্শ নেবার স্পর্ধা দেখানোর দুঃসাহস সেই মেরু ইনুইতদের'ও নেই।
ইনুইত নারীদের শরিরের গড়ন আর চেহারা প্রায় পুরুষদের মতই। এদের স্তনের আকৃতি প্রায় ফ্লাট- যা ভারি পোষাক পড়লে বোঝাই যায় না। সন্তান হবার পরে খুব কম সময়ের জন্য তারা স্তন্য পান করতে পারে। সর্বোচ্চ তিন থেকে চার মাস - তাও সেটা পর্যাপ্ত নয়। ইনুইত বাচ্চারা একেবারে শুরু থেকে নাকি বিকল্প খাবারে অভ্যাস্ত হয়ে ওঠে।
ওদের সেক্সচুয়াল এক্টিভিটিস একেবারেই কম। বিবাহিত কোন পুরুষ হয়তো বছরে দু'চারবার তাঁর স্ত্রীর সাথে মিলিত হয় - তাও কোন লুকোছাপা ছাড়াই। সবার সামনেই তারা স্ত্রী সঙ্গম করে। অবশ্য এ ছাড়া উপায় কি-ই বা?
পরিবারের ২০/২২ ত্রিশ জন থাকে একটা কিংবা দুটো কুড়েঘরে বা ইগলুতে- সেখানে কোন আড়াল আবডাল নেই। রাতে নারী পুরুষ সব একসাথে ঘুমায়। গায়ের ভারি পোষাক আর প্রায় মুখ ঢেকে রাখা টুপিতে চেহারায় বোঝার উপায় নেই কে নারী কে পুরুষ ( কোন যৌন অনুভুতি আসার সম্ভাবনা নেই)।
সামারে ( মানে ছয় মাস দিন- তখনো চারিদিকে বরফ থাকে। তাপমত্রা মাত্র মাইনাস ১৫-২০ ডিগ্রীতে নেমে আসে) ওরা কেউ কেউ প্রেম করে জুটি বাঁধে, বিয়ে করে, তখন একটু আধটু শারিরিক লেনদেন হয়। এক আধবার নেংটা হয়ে গড়াগড়ি খায় বরফের উপরে- এটাই নাকি তাদের গোসল!!!
~ একজন পুরুষ শিকারির সিল শিকারের দৃশ্য( অঙ্কন)
মোবাইল নেই, কম্পিউটার নেই, টিভি নেই, রেডিও মায় একখান লুডু দাবার কোর্ট নেই, তাদের সময় কাটে কেমনে?
প্রতিদিন বিকেলে তাদের গল্পের আসর বসে । পরিবারের সবচেয়ে প্রবীন মানুষটা দারুণ অঙ্গভঙ্গী করে তাঁর শিকারের গল্প করে য়ার সবাই হেসে হেসে গড়িয়ে পড়ে। দুই তিন ঘন্টা তাঁর এই গল্প চলে-আর সবাই মিলে উচ্চকন্ঠে হাসতে থাকে এই পুরোটা সময় ধরে।
আপনি ভাবছেন; গল্পটা খুব হাসির? মোটেও তেমন নয়। এখন নিশ্চয়ই ভাবছেন বুড়ো নিত্যদিন নতুন নতুন গল্প করেন তাই ছেলে বুড়ো সবাই এত মনযোগ দিয়ে গল্প শুনতে আসে আর হাসে?
সেটাও নয়। বুড়োর গল্প বড় একঘেয়ে। একই গল্প সে দিনের পর দিন মাসের পর মাস বছরের পর বছর করে। দলের প্রত্যেকটা সভ্য প্রতিদিন একইভাবে মনযোগ দিয়ে উৎসাহ নিয়ে সেই গল্প শোনে। আমারতো ভাবতে মাথা ঘুরছে!! আপনার ঘুরছে না।
ইনুইত বা এস্কিমোদের নিয়ে অনেক অনেক গল্প করে গেছেন আমাদের এক বাঙ্গালী ভু পর্যটক 'বিমল দে'। তিনি সুদীর্ঘ ছয় মাস তাদের পরিবার হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন আইসল্যান্ড ও গ্রীনল্যান্ডের মেরু অঞ্চল। তাঁর মত করে সম্ভবত অন্য কোন বাঙ্গালী এত গভীরভাবে এস্কিমোদের পর্যবেক্ষন করেনি। বিশ্ব ইতিহাসে ইনুইতদের নিয়ে তাঁর পর্যবেক্ষন অত্যান্ত দামী একটা নথি!
এবার আসি দারুণ একটা ইন্টারেস্টিং বিষয়। এস্কিমোদের মৃত্যু নিয়ে।
আকস্মিক রোগ শোকে কিংবা দুর্ঘটনায় যে কোন সময় মানুষ মারা যেতে পারে। এস্কিমোরা খুব কম ক্ষেত্রেই রোগে আক্রান্ত হয়। ওরা কিছু ক্ষেত্রে শিকার করতে গিয়ে শিকারের আক্রমনে মারা যায়। একজন ইনুইত সদির্ঘ সময় সুস্থ সবল দেহে বেঁচে থাকে। ইনুইত সমাজে অকর্মণ্যদের কোন স্থান নেই! হোক সে বয়স্ক কিংবা নারী। ইনুইত বৃদ্ধরা যখন এত বেশী শারিরিকভাবে সুস্থ থাকে যে, তাদের বার্ধক্যজনিত কারনে বিভিন্ন অর্গ্যান দুর্বল হয়ে পড়লেও মৃত্যু এসে সহজে হানা দেয় না। একজন বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা যখন বুঝতে পারে যে সে প্রায় অক্ষম হয়ে যাচ্ছে তখন সে স্বেচ্ছা মৃত্যু বেছে নেয়।
~ পুরুষেরা শিকারে গেলে মহিলারা কাজ না থাকলে বসে না থেকে মাছ মেরে শুকিয়ে প্রিজার্ভ করে শীতকালের জন্য।
কোন এক কঠিন শীতের রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে- সে ধীরে ধীরে তাঁর প্রিয় কম্বলখানা ছেড়ে উঠে পড়ে। শেষবারের মত 'তিমির তেলে'র পিদিমের আলোতে ইগলু ঘরখানা আর তাঁর অতি প্রিয় ও আপনজনদের ভাল করে দেখে নেয়। তাঁরপর ধীরে ধীরে লাঠি হাতে বের হয়ে যায় অজানার উদ্দেশ্যে... তাঁর এই শেষ প্রস্থান কেউ হয়তো দেখে- কিন্তু আটকায় না। এইটাই ওদের নিয়তি!
যে দেখে সে একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবে তাকেও বেঁচে থাকলে একদিন নিশ্চিত এমন নির্মম সিদ্ধান্ত নিতে হবে!
~ আধুনিক সাজসজ্জার ইনুইত।
* এটা সত্তুরের দশকের ঘটনা! বিমল এইসব স্মৃতি বুকে ধারন করে এখনো বেঁচে আছেন। এস্কিমোদের অধিকাংশ এখন আধুনিক জীবনে অভ্যাস্ত হয়ে পড়েছে- সেই সাথে তারা আধুনিক অভ্যাস, রোগ শোক, বেধ ব্যাধি, লালসা লোলুপতা, যৌনতা, বিকৃতকাম, নেশা থেকে শুরু করে অনেক কিছুতেই অভ্যাস্ত হয়ে পড়েছে। তবুও কিছু ইনুইত আজো সবকিছু উপেক্ষা করে তাদের সেই পুরনো সাংস্কৃতিকে বুকে ধারন করে সব আধুনিকতাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ভয়ঙ্কর শীতল মৃত্যুর হাতছানির সেই মেরুর মাঝে বুক চিতিয়ে লড়াই করে দেখিয়ে দিচ্ছে মানুষ অদম্য!
~ বিখ্যাত ভু পর্যটক বিমল দে।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জানুয়ারি, ২০২৪ রাত ৮:২৮