গোয়ালন্দ স্টিমারে রান্না করা মুরগির কারি বাঙালির লোককাহিনীতে ঢুকে গেছে। যারা এই পথে ভ্রমণ করেছেন তারা এখনও স্বাদ রোমন্থন করেন। তারা আফসোস করেন; হারিয়ে যাওয়া সেই গোয়ালন্দী জাহাজের মুরগীর ঝোলের স্বাদ আর কি ফিরে পাওয়া যাবে?
বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট লেখকের এবং পণ্ডিত সৈয়দ মুজতবা আলী। তার আকর্ষণীয় রম্য সাহিত্য প্রবন্ধ ও নিবন্ধে সর্বদা বাঙ্গালীর হেঁশেলের খাবার-দাবার আর রন্ধন প্রণালী নিয়ে আলচনা করেছেন।অন্য সব বিষয়ে প্রশংসা করলেও একদম স্পষ্টভাবেই,একটি ভাল মাংসের তরকারি রান্না করতে বাঙালি অক্ষমতার সমালোচনা করে তিনি তাঁর একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন: বিক্রমপুরের রমণীদের রান্না এক সময় সুনাম কুড়িয়েছিল;বিক্রমপুরের মহিলারা পুরো বাংলার সেরা রাধুনি হিসাবে খ্যাতি পেয়েছিলেন। ভোজন রসিক আলী সাহেব বলেছিলেন “আমি অবাক হয়েছি যে বিক্রমপুরের রমণীরা নিয়মিত গোয়ালন্দী স্টিমারে কলকাতায় তাঁর কলেজ-হোস্টেলে যাতায়াত করে,যাওয়া আসার পথে তারা সেই স্টিমারেই আহারাদি সারে। তবুও- সাধারণ নৌকাওয়ালার রান্না করা স্টিমারের অতি মামুলি মুরগীর তরকারি কখনও রান্না করতে পারেনি! ”
তাঁর পর্যবেক্ষণের আরও একটু ছিল - "৩০ বছর ধরে আমি গোয়ালন্দ স্টিমারে ভ্রমণ করেছি। সেখানে অনেক কিছুই পালটে গেছে আর আগের মত নেই । কিন্তু পাল্টায়নি সেই খালাসিদের মুরগীর ঝোলের গন্ধ। রান্নার স্টাইল পাল্টেছে- ঝোলের ঘনত্ব, অতি রন্ধন, একটু মিষ্টি স্বাদ, কিন্তু ঘ্রাণটা রয়ে গেছে সেই আগের মতই। আমি প্রায়শই পুরো স্টিমারটিকে কল্পনা করেছিলাম যে, পুরো জাহাজ জুড়ে একটা দৈত্যাকৃতির মুরগি রান্না হচ্ছে, চাঁদপুর থেকে নারায়ণগঞ্জ হয়ে গোয়ালন্দো পর্যন্ত পুরো পথটা সে ঘ্রানে মৌ মৌ করত ”।
উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে, পূর্ববাংলা, আসাম বা বার্মা ভ্রমণকারীরা পদ্মা এবং ব্রহ্মপুত্রের সংযোগস্থল একটি ছোট অথচ গুরুত্বপুর্ন স্টেশন গোয়ালন্দ থেকে স্টিমার নিয়েছিল, যেখানে শিয়ালদা থেকে পূর্ববঙ্গ এক্সপ্রেসের যাত্রা শেষ হয়েছিল।
গোয়ালন্দ ঘাট থেকে স্টিমারে চড়ে যেতে হোত নারায়ণগঞ্জ। সেখান থেকে লোকেরা সেখান থেকে ঢাকা সিলেট বা চট্টগ্রাম কিংবা আরও কিছুদুরে বার্মায় এবং অন্যদিকে আসামের চা বাগানে চলে যেত।
এক রাত ভ্রমনে, স্টিমারের পরিবেশন করা, জাহাজের মুসলমান খালাসীদের রান্না করা মুরগীর ঝোল বাংলার উত্তম পান-ভোজন সংক্রান্ত ইতিহাসে ঢূকে গেছে যা কিংবদন্তীতুল্য। এটি ঐতিহ্যবাহী ‘ডাক বাংলোর চিকেন কারি’ বা ‘মাদ্রাজ ক্লাব কোরমা’ অথবা প্রসিদ্ধ্ব ‘রেলওয়ে মাটন কারি’র মতো অন্যান্য ঐতিহাসিক খাবারের সাথে ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় খাবারে জায়গা করে নিয়েছে। অতি সাধারন মশলা সহযোগে সাধারণ মাঝি মাল্লাদের রান্না করা এই খাবারের স্বাদ যারা পেয়েছে এবং এখনও এ সম্পর্কে কথা বলতে জীবিত রয়েছেন, তারা জোর দিয়ে বলছেন যে তারা আর কখনও কোথাও এর মতো সুস্বাদু তরকারি স্বাদ পাননি। "কেন?" একজন বিখ্যাত ভারতীয় লেখককে জিজ্ঞেস করে উত্তর পাওয়া যায়নি।
পৃথা সেন নামে একজন বিখ্যাত রন্ধন বিশেষজ্ঞ এবং খাদ্য ইতিহাসবিদ;এই খাবারটা রান্নার জন্য চ্যালেঞ্জ গ্রহন করেছিলেন। তিনি খুঁজে খুঁজে গল্প করেছিলেন সেই সময়কার জাহাজে ভ্রমন করা বিখ্যাত ও সাধারন মানুষদের সাথে। তাদের মধ্যে দাদী- নানীর বয়েসী উল্লেখযোগ্য পরিমান মহিলাও ছিলেন। তিনি সম্ভবত গোয়ালন্দ থেকে বিক্রমপুর চষে বেড়িয়েছেন!
তিনি বেঙ্গল গেজেটে, ইম্পেরিয়াল গেজেট, চা রোপনকারী এবং বন রেঞ্জারদের পুরাতন জার্নাল, ইম্পেরিয়াল রেলপথ এবং জয়েন্ট স্টিমার কোম্পানির সাথে সম্পর্কিত নথিগুলিতে এবং অবশ্যই বাংলা সাহিত্যে এ বিষয়ক আলোচনা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েছেন।
সবাই এক কথা বলেছেন যে " তেলের উপরে ভাসমান লাল মরিচের পাতলা তরকারি"।কিন্তু কেউ বলেননি যে, এটা কখনো ডিম বা আলু দিয়ে রান্না করা হয়েছে।
তিন বছর ধরে যে যে সমস্ত তথ্য পেয়েছেন তা যাচাই বাছাই করে দেখলেন যে-"এটি পাটায় পেষা পেঁয়াজ, রসুন, আদা এবং প্রচুর মরিচ এবং সরিষার তেল দিয়ে তৈরি একটি দেহাতি তরকারি ছাড়া কিছুই ছিল না।"
গোটা গ্রাম বাংলায় মাংসের তরকারি ঠিক আজ অবধি এইভাবে রান্না করা হয়। কিন্তু দেশ বিদেশের অনেক স্বাদের রান্না করা মুরগীর মাংসের বিভিন্ন পদ আস্বাদন করা ভোজন রসিক সাহিত্যক সৈয়দ মুজতবা কেন এই অতি সাধারন মুরগীর ঝোলকে সবার উপরে রেখেছেন? এর ওম্প ফ্যাক্টরটি কী ছিল?
তিনি গোয়ালন্দী জাহাজের আরো কিছু বিখ্যাত খাবারের উপরে গবেষনা করে আবিষ্কার করলেন – এই সকল জাহাজে বিখ্যাত স্মোকড ইলিশ বা ভেটকি রান্না করতেন অত্যন্ত দক্ষ মগ বড়ুয়া কুক; কলকাতার রাজকীয় রান্নাঘরে যা পরবর্তিতে সফলভাবে জায়গা নিয়েছিল। অথবা সেই প্রথম-শ্রেণীর যাত্রীদের 'মুরগীর কারি' যা অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের সৃষ্টি! কান্ট্রি ক্যাপ্টেনের যা ভীষন পছন্দ ছিল এবং নাফ রিভার স্টিমার, চট্টগ্রাম এবং বার্মার মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত,অতি উচ্চবংশীয় যাত্রীদের বেশ প্রিয় খাবারের তালিকায় ছিল।
তবে এসব ছাপিয়ে কেন গোয়ালন্দী জাহাজের এই মুরগীর ঝোল অনন্য সাধারন হয়ে উঠেছিল?
সেই দিনগুলিতে, বেশিরভাগ হিন্দু রান্নাঘরে ‘মুরগির মাংস’ বা মুরগি নিষিদ্ধ ছিল। তাদের পছন্দের তালিকায় ছিল সম্ভবত খাসির মাংস। সেজন্য ধারনা করা হয় যে, মাঝি-মাল্লাদের রান্না করা এই মুরগীর ঝোল সম্ভবত বাঙালি মুসলমানের খাবার ছিল- এবং এর রাঁধুনি ছিল মুসলমান। সীমিত মশলা দিয়ে রান্না করতে ব্যবহৃত নৌকাওয়ালারা একটি সাধারণ মুরগির তরকারি তখন গোয়ালন্দো স্টিমার কারি ও গোয়ালন্দো ঘাটের মুরগি'র ঝোল হিসাবে জনপ্রিয় ছিল। এটি মুরগির মুরগির তরকারীগুলির একটি সহজতম রূপ।
গোয়ালন্দ স্টিমার চিকেন কারির গল্প!
"গোয়ালন্দ-নারায়ণগঞ্জ" স্টিমারেএক রাতের ভ্রমণ ছিল। জাহাজের খালাসীরা তাদের নিজেদের খাবার জন্য এই মুরগির ঝোল রান্না করত। সেই তরকারিটি কোন ভাবে ভ্রমণকারীদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়েছিল। অতি উপাদেয় এই পাতলা ঝোলের মুরগির তরকারি তখন গোয়ালন্দী নৌকার মাঝিদের খাবা হিসেবে খ্যাত ছিল। তবে কালের বিবর্তনে এই খাবারের রন্ধন প্রণালী বা রেসিপি একেবারে হারিয়ে গেছে!
এই মুরগির তরকারিটির বৈশিষ্ট্য হ'ল সাধারন মসলা ব্যবহার। বেশ স্বাভাবিকভাবেই, মাঝি মাল্লাসের দামী মশলা ব্যাবহারের সক্ষমতা ছিল না। এটি ছাড়াও, খুব বেশি রান্নার জন্য সময় দেওয়ার সম্ভব ছিল না। সুতরাং তারা মুরগির একটি সহজ রেসিপি তৈরি করেছিল গোয়ালন্দ স্টিমার কারি বা বোটম্যান স্টাইলের চিকেন কারির রেসিপিটির জন্য সরিষার তেল আবশ্যক ছিল। এতে কোন গরম মসলা ব্যাবহার করা হোত না।
গোয়ালন্দ স্টিমার চিকেন কারির স্বাদঃ
আপনি যখন এই খাবারটির দিকে প্রথম চোখ বুলাবেন- দেখবেন; সরিষার তেলে ভাসমান শুকনো মরিচের গুঁড়া -আগুন রাঙ্গা লাল ঝোল। একটি চামচ নিন এবং গরম ধোয়া ওঠা সেই ঝোল গরম ভাতের উপর ছড়িয়ে দিলে মনে হবে লালচে হলুদ রঙের পানি ছড়িয়ে দিয়েছেন! যদিও সেখানে রশুন পেয়াজ আর বাটা লাল মরিচের উপস্থিতিও টের পাবেন।
তবে সবকিছু ছাপিয়ে এক অজানা লোভনীয় সুগন্ধ আপনাকে মাতাল করে দিবে। ধারনা করা যায়; আপনার ঘ্রানেন্দ্রিয় এর আগে কখনোই দুর্দান্ত ঘ্রানের স্বাদ পায়নি!
আপনি বুভুক্ষের মত ঝাঁপিয়ে পড়বেন সেই স্বাদ নেবার জন্য। যদিও পাটায় পেষা শুকনো মরিচের ঝালের তীব্রতা আপনার নাখ মুখ দিয়ে লালা ঝড়াবে তবুও আপনি এই স্বাদ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতে চাইবেন না।
গোয়ালন্দী চিকেন কারি টাটকা গরম গরম পরিবেশন করা হোত। এটা সংরক্ষন করলে বা ঠান্ডা করে খেলে তার মুল স্বাদ ও গন্ধ হারিয়ে যেত।
সেই সময়কালে এদেশে পোল্ট্রি ফার্মের অস্তিত্ব ছিল না। পুর্ববঙ্গের মানুষ লোকাল চিকেন বা গৃহপালিত মুরগী (দেশী মুরগী) রান্না করে খেত এবং প্রতিটি স্টিমারেই শীল-নোড়া ( ফ্ল্যাট মর্টার এবং পেস্টেল,যা সাধারণত ওড়িশায় ব্যবহৃত হয়) ব্যাবহার করা হোত মশলা পেষার জন্য। তারা শিল-নোড়ায় মরিচ, হলুদ, রসুন, আদা পিষে রান্নায় ব্যাবহার করত।
অন্য একটা সুত্র থেকে জানা যায়;
যে বিশেষ উপাদানটি তরকারিটিকে তার যাদু দিয়েছিল তা হ'ল শুটকি মাছ। তারা সেই শুটকি মাছ শিল-নোরায় পিষে একটি পেস্ট তৈরি করত এবং সেই পেষ্ট মুরগী রান্নায় ব্যাবহার করত।
কিছু কিছু রেসিপি রয়েছে যা কেবলমাত্র অনির্বচনীয়ভাবে আশ্চর্যজনক, তার প্রতিটি প্রতি উপাদান বা ডিশ নিজেই নয়, বরং এর ঐতিহ্যের কারণে আরও বেশি। গোয়ালন্দো স্টিমার চিকেন, বা বোটম্যান-স্টাইলের চিকেন কারি স্বাধীনতার পূর্বের একটি অন্যতম আইকন যার ইতিহাস ভারতীয় আইকনিক খাবারের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ন স্থান দখল করে নিয়েছে।
শেষ কথাঃ পৃথা সেন দাবি করেন যে, অবশেষে তিনি এই রান্নার মুল রেসিপি( প্রায়) আবিষ্কার করেছিলেন। তার সেই মুরগীর কারি খেয়ে পুরনো দিনের অনেকেই বলেছেন; স্বাদ অবিকল তেমনই হয়েছে( আমি তার কৃতিত্বকে কোনভাবেই খাটো করে দেখছি না)।। তবে আমার কেন যেন মনে হয় দীর্ঘ প্রায় অর্ধ শতকের পরিক্রমায় সবাই গোয়ালন্দী জাহাজের সেই মুরগীর ঝোলের স্বাদ বিস্মৃত হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে তার রান্না করা মুরগীর ঝোল সেটার কাছাকাছি ছিল তা নির্দ্বীধায় বলা যায়।
গোয়ালন্দের পদ্মায় ইলিশ আহরণকারী নৌকায় মাঝি মাল্লার রান্না করা তাজা ইলিশের পাতলা গরম গরম ঝোল( শুধু হলুদ, কাচামরিচ, লবন আর পেয়াজ দিয়ে) দিয়ে আউস চালের গরম ভাত যারা খেয়েছে- তারা এজীবনে আর ভুলতে পারেনি সে খাবারের স্বাদ আর গন্ধের কথা।
আপনি বাড়িতে যেভাবেই সে রান্নার চেষ্টা করে থাকেননা কেন – নিশ্চিতভাবে তার তার ঘ্রান আর স্বাদ সেই ইলিশের ঝোলের ধারে কাছে পাবেন না।
কেন?
শুনেছিলাম শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ের বাতাস না পেলে নাকি মুসলিন শাড়ি বুননের সুক্ষ সুতা তার স্বকীয়তা পায় না।
তেমনি সেই রান্নায় পদ্মার জল দু'ঘটি না দিলে যে স্বাদ-গন্ধের হেরফের হতে পারে সেটা কেউ এখনো আবিষ্কার করেননি।
সুত্রঃ গুগোল, উইকি
টাইমস অফ ইন্ডিয়া
কিচেন অফ দেবযানী
• সৈয়দ মুজতবা আলীর বচনটুকু সরাসরি তার বই থেকে নেয়া নয়। ভাষান্তর হয়েছে- অতএব লেখায় আলী সাহেবের নিজস্ব ঢং আসেনি।
ছবির মুল সোর্সঃ নেট
* আমার 'মুরগির ঝোল' লেখায় অনুপ্রাণিত হয়ে প্রিয় ব্লগার মরুভুমির জলদস্যু 'কেমন টানলাম' শিরোনামে গোয়ালন্দী ফেরির একটা গল্প বলেছেন। তার প্রতি রইল আমার আন্তরিক ভালবাসা
লেখাটার জন্য ক্লিক করুন; Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুন, ২০২১ সকাল ৯:৪৮