দাম-দস্তুর করে ক্যাসিনোর কুপন বাদ দিয়ে দুজনের সাড়ে চার হাজার রুপি(ভারতীয়)তে ফয়সালা করলা। সাথে জুড়ে দিলাম বেশ কিছু শর্ত; শর্তের প্রথমটা হল আমাদের প্যাকেজের যে সব সুযোগ সুবিধা দেয়া হবে তা এদের প্যাডে স্পস্ট করে লিখে দিতে হবে, আর যেসব হোটেলে থাকব তাদের করনীয় সবিস্তারে সেই হোটেল মালিক বা ম্যানেজারের উদ্দেশ্যে লিখতে হবে । যাতে করে তারা আমাদের সুযোগ বুঝে বৃদ্ধাঙ্গুলি না দেখাতে পারে।
এ কথা ঠিক যে সরাসরি হোটেলে গিয়ে উঠলে তাদের যে আতিথিয়েতা মেলে, প্যাকেজে গেলে তার মান অনেক নীচে নেমে যায় । ইন্টারকমে দুবার ডাকলেও অনেক সময় বয় বেয়ারার সাড়া মেলেনা। ওদের ভাবে মনে হয় ভীষন ব্যাস্ত তাই দেরী কিন্তু খোজ নিলে দেখা যাবে হোটেলের বোর্ডারের থেকে স্টাফ বেশী!
তবুও যেহেতু নেপালীদের আতিথিয়েতা সন্মন্ধে আমার জানা নেই সেজন্যই রিস্কটা নিলাম। যেহেতু এ দেশটার অর্থনীতি ট্যুরিজমের উপরে অনেকাংশে নির্ভরশীল সেহেতু ট্যুরিস্টদের সাথে এদের ব্যাবহার ভাল হবে বলেই ধারনা। এছাড়া মাওবাদীদের উত্থানে বর্তমানে ট্যুরিজমের যে হাল তাতে করে এরা মনে প্রানে চাইবে যে কোন ট্যুরিস্ট একবার আসলে যেন ফের আসার জন্য প্রলুদ্ধ হয়।
ওদেরকে কিছু টাকা অগ্রিম দিয়ে বিনিময়ে ভারী খাম হাতে নিয়ে বাইরে বেরুলাম। দুখানা খামের উপর কাঠমুন্ডু ও পোখরার দুটো হোটেলের নাম লেখা আর একটাতে আমাদের বাসের টিকিট রিসিপ্ট ভাওচার ও শর্তের দলিল। যা যা মনে আসে সব লিখিয়ে নিয়েছি।
সকাল থেকেই খুশখুশে কাশি হচ্ছে । ইচ্ছে ছিল কোন ডিসপেন্সারী নজরে এলে কাশির অষুধ কিনব। মাহমুদের সংগ্রহে অন্যসব অষুধ থাকলেও কাশি নিরাময়ের জন্য কিছু নেই ।সবে মাত্র রাত আটটার মত বাজে , ওকে অফার করলাম ডিসপেনসারী খোজার ছলে আসেন বাজারটা ভাল করে দেখে নেই। ছোট্ট বাজার আমাদের মফস্বল শহরের অনুরুপ। মিনিট বিশেকের মধ্যে এমাথা ওমাথা ঘুরে আসা যায় । এমনিতেই দেখার তেমন কিছুই নেই, তার উপরে প্রায় সব দোকানপাটই বন্ধ হয়ে গেছে। কিছুদুর এগুতেই একটা ডিসপেনসারী নজরে এল ভাঙ্গাচোরা গা গেরামের ডিসপেনসারী নজরে এল , সাদা চুলের বয়স্ক বিক্রেতার কাছে একবোতল পিরিটন চাইতেই তিনি যে অষুধের প্যাকেটটা এগিয়ে দিলেন তার গায়ে দেখি বাংলাদেশের নাম লেখা।
হোটেলে ফিরে গোসল সেরে ডাইনিংয়ে গেলাম । আগে থেকেই খাবার অর্ডার দেয়া ছিল। বেশ বড় সুসজ্জিত ডাইনিয়ং রুমের বড় একটা অংশ ইতিমধ্যে দখল করে রেখছে এক দঙ্গল পুরুষ মহিলা । ওদের চেহারা দেখে আর ভাষা শুনে মুহুর্তেই বলে দেয়া যায় বাংলাদেশী। আমাদের ডাইনিং রুমে ঢুকতে দেখেই সবাই যেন কেমন চুপসে গেলেন। বুঝতে পারলাম আমাদের আগমনে এদের রসভঙ্গ হয়েছে । বেয়ারাকে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম-অন্য কোন খাবার রুম আছে কিনা?
এতগুলো চেয়ার খালি থাকার পরেও কেন আমরা অন্য রুম খুজছি বুঝতে না পেরে বেয়ারাটা ক্যাবলার মত চেয়ে বলল -কেন স্যার এখানে কোন সমস্যা?
আরেকটু তার ঘনিষ্ঠ হয়ে নিচু কন্ঠে বললাম- সমস্যাটা আমাদের নয় । মনে হয় ওনাদের হচ্ছে। তুমি ইচ্ছে করলে রুমেও খাবার দিয়ে আসতে পার ?
-তাহলে বারে গিয়ে বসেন । আমি আপনাদের টেবিল সাজিয়ে দিচ্ছি ।
- ঠিক আছে -তাই দাও ।
খাবার রুমের সাথেই লাগোয়া ছোট্ট পরিচ্ছন্ন বার । একদম খালি । বারটেন্ডার বিরস মুখে মাথা নিচু করে টেবিলের উপর রক্ষিত খাতায় কি যেন লিখছিল । আমাদের পদশব্দে ও মুখ তুলে চেয়ে ভাবল তার খদ্দের এসেছে । সম্ভ্রমের সাথে উঠে দাড়িয়ে বলল - কি লাগবে স্যার?
- কিছুনা । আমরা এখানে খাবার খেতে এসেছি ।
- ও বসেন ।’ চেহারা দেখে মনে হল বেচারা বেশ কস্ট পেয়েছে।
স্যুপ চাপাতি ডাল মাখানি সজ্বি বেশ স্বুসাদু । পেট ভরে খেলাম। খাবার শেষে বেয়ারাকে দশটা রুপি বখশিষ দিয়ে বললাম - ভোর সাড়ে তিনটেয় ডেকে দিতে। সে সানন্দেই রাজী হল । ওর অতিরিক্ত আগ্রহ দেখে শংকিত হলাম ‘রাত দুটোর সময় ডেকে না বসে!
বিছানায় যাবার কিছুক্ষন বাদেই বেয়ারা এসে অনুরোধ করল -হোটেল ভাড়া আর খাবারের বিলটা দিয়ে দিতে।
-কেন -সকালে দিলে সমস্যা কি?
-স্যার আপনারা যাবেনতো খুব ভোরে অত সকালে ম্যানেজার থাকবেননা।
ও তাইতো । ঠিক আছে বিলটা নিয়ে এস।
বিলটা তার পকেটেই ছিল। সঙ্গে সঙ্গে সেটা বের করে মেলে ধরল।
বিলের কাগজে নেপালী কারেন্সির পাশাপাশি ইন্ডিয়ান কারেন্সিতে কনভার্ট করা। পরিবর্তনটার মধ্যে মনে হচ্ছে একটু গোলমাল আছে। তবু উচ্চবাচ্য না করে ভারতীয় রুপিতেই বিল মিটিয়ে দিলাম।
পিরিটনের প্রক্রিয়ায় ঘুম বেশ ভাল হল । দার্জিলিং এর মত আজও চোখ বোজার একটু পরেই মনে হল, কে যেন দরজা নক করছে। ঘুমজাড়ানো চোখে বিছানা থেকে উঠে আলো জ্বেলে ঘড়িতে দেখি,পৌনে চারটা বাজে।‘ অ্যা -এতক্ষন ঘুমিয়েছি !’ তারমানে দরজা সেই বেয়রাটাই নক করেছে। শালার উপর রাগ হল কেন এত দেরী করে ডাকল!
মাহমুদকে তড়িঘড়ি করে ডেকে দিয়ে বাথরুমে ঢোকার মুখেই আবার বেয়ারা এসে দরজা নক করল । দরজা খুলে গলায় একটু উস্মা এনে তাকে জিজ্ঞেস করলাম- দেরীতে ডেকেছ কেন?
সে একটু অবাক কন্ঠে বলল - কই নাতো স্যার আমি সাড়ে তিনটাতেই ডেকেছি ।
-কই নাতো । আমি তখন ঘড়িতে দেখি পৌনে চারটা বাজে ।
সে একটু ভ্যবাচ্যাকা খেয়ে বিষন্ন দৃস্টিতে আমার দিকে দু সেকেন্ড চেয়ে থেকে চোখ নামিয়ে ধীর পদক্ষেপে ফিরে গেল।
সবকিছু গুছিয়ে তাড়াহুড়ো করে নীচে নেমে দেখি কাউন্টারের দেয়াল ঘড়িতে সবে চারটা বাজে । কিন্তু আমার ঘড়িতেতো সোয়া চারটা।মাহমুদের ঘড়ির সময়ও একই । বেয়ারাটাও আমাদের পিছু পিছু এসেছিল বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত পৌছে দিবে বলে ।
ওকে জিজ্ঞেস করলাম- তোমাদের ঘড়ির টাইম কি ঠিক?
- জ্বী স্যার ।
ওফ ! ভুলটা আমারই । আহা বেচারাকে এমনি এমনিই বকাঝকা করলাম । পাছে তার সামনে নিজের অজ্ঞতার মুখোশ খুলে পরে এই আশংকায় বিজ্ঞের মত ওকে জিজ্ঞেস করলাম - ‘ভারতের সাথেতো তোমাদের সময়ের পার্থক্য পনের মিনিটইতো, নাকি আরো বেশী?
- জ্বী স্যার পনের মিনিট।
মাহমুদকে বললাম - আপনি এই ভুলটা কেমনে করলেন । এর আগে না একবার এসে ঘুরে গেছেন এই দেশে।
সে তার স্বভাব সুলভ হাসি দিয়ে একটু লজ্জিত ভঙ্গীতে বলল- ‘স্যরি ভুলে গেছি ।
বাইরে প্রচন্ড ঠান্ডা। মনে হচ্ছে এখুনি বরফ পড়বে ।বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে বাসের চেহারা দেখে খুব একটা পছন্দ হলনা । তবুও মনে মনে আগে থেকে প্রস্তুত ছিলাম বলে হতাশ হলামনা ।
বাইরে দাড়িয়ে গ্লাসে করে এককাপ গরম চা আর সিগারেট খেয়ে ধীরে সুস্থে ব্যাগ সমেত বাসের ভিতরে ঢুকলাম।
ভিতরটা আবছা অন্ধকার । বহুকস্টে টিকিট মিলিয়ে নির্ধারিত সিট নাম্বারে বসলাম । মোটামুটি আরামদায়ক সিট -তবে সেটা পিছনদিকে হেলাতে গিয়ে যে সব যন্ত্রপাতি ঘোরাতে হয় তা দেখে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে এরা এখনও প্রযুক্তিগত দিকে আমাদের থেকে বেশ খানিকটা পিছিয়ে আছে । দু-জানুর ফাঁকে সিটের নীচে মাঝবারাবর খাজকাটা জংধরা লোহার চাতকিটা ঘোরাতে গিয়ে হাত ব্যাথা হেয়ে গেল । তবুও ভাল -হেলানো যায়!
নির্দিস্ট সময়েই বাস ছাড়ল । এখনো কয়েকটা সিট খালি দেখে ভেবেছিলাম যাক সুযোগ বুঝে অন্য সিটে গিয়ে হাত- পা ছড়িয়ে আরাম করা যাবে ।
কিন্তু তখনো এদের মাকালু এক্সপ্রেসের নন-স্টপ ট্রাভেল সন্মন্ধে আমার অনেক কিছু জানতে বাকি। ঢাকার আল্লার কসম গেটলকের সাথে এর চরিত্রের অদ্ভুত মিল । কিছুদুর ঢিমে তালে এগিয়ে বাস থামল । দু- তিনজন যাত্রী উঠতেই ভাবলাম এরা হয়তো অগ্রিম টিকেট কিনে রেখেছে তাই এ বিরতি -এরকম আমাদের দেশেও ঘটে । যাত্রী ক’জন কে বাসের উদরে পুরে চালক মহোদয় কিছুদুর গিয়ে আবার বাস থামালেন - এবার উঠল পাচ - ছ’জন । মনে মনে প্রমাদ গুনলাম - কে জানে সারা রাস্তা এভাবে থেমে থেমে যায় নাকি । যাক যেভাবে এর ইচ্ছে - আমি চোখ বুজলাম অপূর্ণ ঘুমের কিছুটা পুষিয়ে নেবার আশায় ।
তন্দ্রার মত এসেছিল । কানের অতি কাছে একাধিক নারী কন্ঠের খুচরো কথাবার্তার শব্দে ঘুমের রেশ কেটে গেল । চোখ মেলে চেয়ে দেখি ঠিক আমার পাশের সিটেই আধুনিকা এক নেপালী তরুনী বসে আছে সাথে অল্প বয়েসি দুটো ছেলে । মেয়েটা বার বার মাথা ঘুরিয়ে পিছনে বসা অন্য এক কিশোরীর সাথে কথা বলায় মগ্ন । সেই কিশোরীর পাশে বসা ভাবলেশহীন মুখভঙ্গীর বয়স্কা ভদ্রমহিলাকে দেখে মনে হল এদের মা হবেন। কিন্তু ছেলেদুটো কার ? আমার পাশে বসা তরুণী যেভাবে জড়িয়ে ধরে ওরা ঘুমিয়ে আছে তাতে সন্দেহ হয় ।
নাহ এত অল্প বয়সে কি করে সম্ভব ? হতেও পারে । শুনেছি পাহাড়ীদের বয়স বোঝা যায়না !
চারিদিকে ততক্ষনে ফরসা হয়ে এসেছে । ধীরে ধীরে কুয়াশা কেটে যাচ্ছে । পূর্বাকাশে হলদেটে রক্তিম ছোপ। চারিদিকের প্রকৃতি পরিবেশ দেখে মনে হয়না দেশের বাইরে আছি। ঠিক তেমনি দিগন্ত জোড়া ফসলের ক্ষেত তার মাঝে গাছে ঘেরা ছোট্ট গেরাম । এদিকটা বেশ সমতল । তবে খটকা লাগে ধানের শীষ ছুয়ে মেঘ দলের ছুটে চলা দেখে ! ঘোর ভেঙ্গে যায় তখনই । এদৃশ্যতো কখনো আমি দেখিনি । মনে হচ্ছিল মেঘের সাথে আমিও যদি ছুটে যেতে পারতাম এমনি করে ! আমি শুধু আমার বাম পাশটা দেখতে পাচ্ছি -ডানদিক পুরোটা পর্দা দিয়ে ঘিরে থাকায় ইচ্ছে থাকা সত্বেও ওদিকটা দেখতে পাচ্ছিনা ।
৮ম পর্ব শেষ
আগের পর্বের জন্য ক্লিক করুন; Click This Link
পরের পর্বের জন্যঃ Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০২১ দুপুর ২:১৬