এতক্ষনে ইনি যেন সম্বিৎ ফিরে পেলেন। একটু যেন চুপসে গেলেন! পরক্ষনেই সহাস্যে হাত বাড়িয়ে বললেন,- জ্বী আসুন।
ওখান থেকে বেরিয়ে সে রিক্সাতেই ‘মেচী’ নদী যাকে নেপালী ভাষায় বলে ‘মাসা’ যেটা নেপাল ও ভারত সীমান্তের নোম্যান্স ল্যান্ড হিসেবে স্বীকৃত। রিক্সাতে করেই সেই নদী পেরিয়ে নেপালে ঢুকলাম।
কথায় কথায় জেনেছিলাম রিক্সাচালক বাংলাদেশী। জন্ম হয়েছিল বগুড়ায় । যুদ্ধের সময় সে এপারে চলে আসে । আর ফিরে যায়নি নিজের বাস্তভিটায়। আমরা বাংলাদেশী জেনে তাই সে হয়তো আমাদের সাথে অতি আপনজনের স্বরে কথা বলছিল। এই সীমান্ত শহরে সে রিক্সা চালাচ্ছে প্রায় সাতাশ বছর । তিনচাকা ঠেলে ঠেলেই জীবনটা পার করে দিল বলে তার কন্ঠে ছিল আক্ষেপ। জন্মভুমিতে থাকলে হয়তো এর থেকে ভাল থাকত!
কাকড়ভিটায় নেপালী সীমান্তে সীমান্তরক্ষীরা পথরোধ করে দাড়ালে বাংলাদেশী জেনেই ছেড়ে দিল। এই প্রথম কোন ভিন দেশে ঢোকার মুখে বাংলাদেশী পরিচয়ে একটু খাতির পেলাম।
ইমেগ্রেশন অফিসে ঢুকে দেখি একদম ফাঁকা! একজন দারোয়ানও নেই!
তবে ভারতীয় অফিসগুলোর থেকে বেশ গোছানো পরিপাটি। রিক্সা চালকই আমাদের সেখানে নিয়ে চেয়ার দেখিয়ে বসতে বলে অপেক্ষা করতে বলল।
ইতিমধ্যে দুচারজন দালাল এসে ভীড় করেছে । আধো বংলা হিন্দী আর নেপালীতে তারা আমাদের দৃস্টি আকর্ষন করতে চাইছে । হোটেল ও বাস ট্রাভেলে তাদের কি কি সহযোগীতা পাব সেইসব বয়ান করছে।
একটু পরে ইমেগ্রেশন অফিসার নেমে আসতেই ওরা একটু দুরে সরে গেল । অফিসার ভদ্রলোক নেপালী টানে বাংলা বেশ ভালই বোঝেন । দুজনের হাতে দুখানা ফরম ধরিয়ে দিয়ে বললেন - ‘কতদিন থাকবেন এখানে?
- দিন পাঁচেক। ভাল লাগলে কিছুদিন বেশীও থাকতে পারি।
আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম - ‘প্রতিদিন ক’জন বাঙ্গালী এ রুট দিয়ে যাতায়াত করেন?
-দশ পনেরজন। মাঝেমধ্যে কম বেশী হয়।
ফরম পুরন করতে করতে ফের জিজ্ঞেস করলাম - ‘নেপালী ভিসা ফি এত বেশী কেন? ফি টা কমালেতো আরো বেশী পর্যটক আসত এখানে বেড়াতে।
তিনি সামান্য হেসে বললেন- ‘এটা উর্দ্ধতন কতৃপক্ষের সিদ্ধান্ত। তবে এখান থেকেও বাংলাদেশী ভিসা ফি তিরিশ ডলারের কমনা। তারপরে ভিসা দিতেও ঝামেলা করে। আপনাদের কমালে হয়তো আমাদেরও কমাবে।’
‘তাই নাকি বাংলাদেশী ভিসা ফিও এত বেশী!’ তবুও আমি তার সাথে একমত হতে পারলাম না। নেপালের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের একটা মুল মাধ্যম পর্যটন। আমাদের নয়। দেখার কিছু নেই তদুপরি মাথাভারী সব লোক বসে আছে বড় বড় রাস্ট্রীয় পদে। পর্যটন কর্পোরেশনের যেন দায়িত্ব দেয়া হয়েছে পর্যটক ঠেকানোর! কিন্তু এদের যত বেশী পর্যটক আসবে তত বেশী লাভ । তারপরে মাওবাদীদের অত্যাচারে এদেশ এখন পর্যটক শুন্য ।এখন আমরাইতো এদের নিদানের সম্বল।
ফরম পুরন করে তার হাতে দিতেই তিনি পাসপোর্টে সিল দিয়ে জনপ্রতি পঞ্চাশ রুপি চাইলেন। ফি না ঘুষ বুঝলাম না।
‘এখানে ডলার কোথায় ভাঙ্গানো যাবে তাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন - কত ডলার?
- আপাতত পঞ্চাশ হলেই চলবে ।
-আমাকে দিন !
ডলার ভাঙ্গিয়ে কিছু আই সি( ইন্ডিয়ান কারেন্সী) কিছু এন সি(নেপালী কারেন্সী) নিলাম। নেপালী রুপির মুল্যমান বাংলাদেশ থেকে কম। একডলারে সাতাত্তুর রুপি।
ভদ্রলোককে ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় নেবার সময় উনি জিজ্ঞেস করলেন,-আজ রাতেই কি কাঠমুন্ডু যাবেন?
মাথা নেড়ে জানালাম -ইচ্ছেতো সেটাই ।
-রাতের বাসে না গেলে ভাল হয়। কিছুদুর পর পর আর্মি চেক পোস্ট। উঠতে নামতে অসুস্থ হয়ে যাবেন।
ভাল হয় রাতটা এখানে থেকে ভোরে গেলে ।
- রাতে থাকার জন্য ভাল কোন হোটেল আছে ।
- হ্যা আছে বাইরে বেরিয়ে একটু সামনে এগুলেই পাবেন।
ভদ্রলোককে আরেকবার ধন্যবাদ দিয়ে আমরা বের হলাম।
তখুনি আবার সেই দালালের দল ঘিরে ধরল। ওদের বেশীর ভাগের চেহারা দেখে ফেরেব্বাজ মনে হচ্ছিল । বিশ্বাস করতে ভরসা হচ্ছিলনা।
রিক্সাওয়ার ভাড়া চুকাতে গিয়ে মনে হল দেশী বলেই হয়ত আবেগের ধাক্কা দিয়ে কড়া সিল দিল। বিশ রুপির ভাড়া পঞ্চাশেও সন্তুস্ট নয়!
ভাড়া দিয়ে ব্যাগ নিয়ে সামনে এগুতে গিয়ে দালাল একজনের হাতে ধরা দিলাম নাকি ধরা খেলাম ঠিক তখন বুঝিনি। তবে এতগুলো অশিক্ষিতের ভীড়ে তার সুন্দর চেহারা আর স্মার্ট ভঙ্গী সেই সাথে ইংরেজীর দক্ষতা দেখেই হয়তো ফাঁদে পা দিলাম। আমাদের সম্মতিতে তার বিজয়োল্লাস দেখে বাকী সবাই যে বেশ মনঃক্ষুন্ন হয়েছিল বলাই বাহুল্য। স্থানীয় ভাষায় হয়তো দু চারখানা গালিও দিল তাকে - সেও উল্টো তেড়ে গিয়ে উচ্চস্বরে কিছু বলল।
বেশ কিছদুর হাটিয়ে নিয়ে ছেলেটা আমাদের একটা ট্রাভেলস অফিসে নিয়ে গিয়ে বসাল। নেয়ার কথা হোটেলে- এখানে বসানোর কারনটা বুঝলাম না?
ওকে সে কথা জিজ্ঞিস করতেই বলল -পিছনেই হোটেল । আপনারা বসুন আমি দেখে আসি ভাল কোন রুম খালি আছে কিনা!
-তার মানে? তুমি আরো কয়েকজনের সাথে ঝগড়া করে আমাদের ডেকে নিয়ে এলে - আর এখানে এসে কিনা বলছ দেখতে হবে রুম খালি আছে নাকি!
-স্যরি বস।’ একটা অপরাধীর হাসি দিয়ে কথাটা বলেই সে দ্রুত কেটে পড়ল।
ছোট্ট অফিসরুমটাতে অন্য কেউ ছিলনা। ছেলেটা বেরিয়ে যেতেই অন্য একজন এসে ঢুকল, এরও বয়েস ওরই মত ২২/২৩ হবে। রুমে ঢুকে বেশ ভারিক্কি চালে এক্সিকিউটিভ চেয়ারটাতে বসে - নিজেকে এ চেয়ারে বসার উপযোগী করার ব্যার্থ চেস্টা করে হাস্যকর গম্ভীর কন্ঠে বলল ,- হোয়ার আর ইউ ফ্র?
-বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ শুনে সে যেন একটু উৎফুল্ল হয়ে উঠল ,-ও বাংলাদেশ। তাহলে আপনারা নিশ্চই বাংলা জানেন।? মুহুর্তেই তার গাম্ভীর্যের নকল দেয়াল ভেঙ্গে পড়ল।
কথা বলতে বলতে আরো দু-চার জন এসে জুটল। এরা সবাই হয়তো বন্ধু বান্ধব হবে। শেষ সন্ধ্যায় ওরা এমন দুজন ক্লায়েন্ট পেয়ে মনে হল বেশ উৎফুল্ল। প্রত্যেকেই বেশ আগ্রহ নিয়ে আমাদের সাথে গল্প করছিল।
ইতিমধ্যে প্রথমজন এসে জানাল যে ,রুম খালি নেই। যেগুলো আছে তা আমাদের পছন্দ হবার না।’
- তাহলে বিকল্প কি ব্যাবস্থা?
-সমস্যা নেই আমাদের আরো হোটেল আছে। এর থেকেও ভাল। ওখানে গিয়ে থাকবেন।
মেজাজ খারাপ হয়ে গেল ,আমি রাগী গলায় বললাম ,
-এর থেকেও ভাল হোটেল থাকলে তোমরা এখানে নিয়ে এসেছ কেন?
কথার খেই হারিয়ে প্রতিউত্তরে সে নিচু স্বরে বলল,- ‘বস এটা আমাদের নিজস্ব হোটেল-। আর ওটা আমাদেরই মানে বন্ধুদের-।
- নিজের হোটেল হলে কেন জাননা এখানে সিট আছে কিনা?
ওর বিব্রতকর অবস্থা দেখে অন্য ক’জন তাকে উদ্ধারের চেস্টায় একযোগে বেশ ক্ষমাটমা চেয়ে তার নির্বুদ্ধিতার জন্য'বেশ খানিক্ষন বকাবকি করে অবশেষে অনুরোধ করল - নতুন হোটেলে যেতে ।
কি আর করার অগত্যা যেতে হল-। হোটেলের নাম নদীর নামেই -হোটেল মাসা’। বাইরে থেকেই বোঝা গেল এর ব্যাবস্থা ওদের থেকে ভাল হবে।
রুম দেখে পছন্দ হল। মাঝারী মানের -এক রাতেরইতো ব্যাপার। তবে ভাড়া দার্জিলিংয়ের হোটেলগুলোর তুলনায় একটু বেশী এই যা! ভাড়া বেশীর কারন হয়তো দালালদের কমিশন যোগ হয়েছে। পরে বিজয়কে( সেই স্মার্ট দালাল) জিজ্ঞেস করেছিলাম -এরমধ্যে তোমার কমশিন কত? প্রতিউত্তরে ও চোখমুখ লাল করে বলেছিল, ছি কি যে বলেন স্যার! এটা হল আমার ভায়ের হোটেল (তখন বলেছিল বন্ধু)। আর আমি নেব এর থেকে কমিশন!
আমি মনে মনে হাসলাম। মিথ্যে কথা বলাটাও একটা আর্ট যেটা সে এখনো রপ্ত করে উঠতে পারেনি ।
রুমে গিয়ে পোশাক ছেড়ে হাতমুখ ধুয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে দু-কাপ চা খেয়ে ফের বের হলাম। উদ্দেশ্য বিজয়দের ট্রাভেল এজেন্সি। ভোরের বাসের টিকেটটা কনফার্ম করতে।
ওরা যেন আমাদের অপেক্ষাই বসে ছিল। ট্রাভেল অফিসে গিয়ে দাড়াতেই সসন্মানে চেয়ার এগিয়ে দিল বসার জন্য। কাকড়ভিটা থেকে কাঠমুন্ডুর উদ্দেশ্যে প্রথম বাস ছাড়ে সকাল সাড়ে চারটায়। পরেও আছে তবে ওখানে পৌছুতে অনেক রাত হয়ে যাবে নাকি! ওদের কথায় মাকালূ এক্সপ্রেসের বাসই নাকি সবচেয়ে দ্রুতগামী বিলাসবহুল -এর থেকে ভাল কোন সার্ভিস এ রাস্তায় নেই। অগত্যা ওদের কথায় বিশ্বাস করে মাকারলু’রই দু’খানা টিকেট কিনে নিলাম।
বিজয় গেল টিকেট কাটতে। সেই ফাঁকে বাকী ক’জন মিলে আমাদের সামনে প্যাকেজ ট্যুরের দারুন আকর্ষনীয় কিছু অফার পেশ করল। কাঠমুন্ডু ও পোখরায় থ্রিস্টার হোটেলে পাচ রাত্রি থাকা যাওয়া আসা, সাইট সিন থেকে শুরু করে বড় অংকের ফ্রি ক্যাসিনো কুপন সহ জনপ্রতি তিনহাজার ভারতীয় রুপি সস্তাই মনে হল! যেসব হোটেলে রাখা হবে তার বাইরে ভিতরের যে ছবিগুলো দেখাল তার আশিভাগ সত্যি হলেও যথেষ্ঠ।
ওদের অতশত ভিন্ন অফারে আমরা দুজনেই ধন্ধে পড়ে গেলাম। এদেরকে বিশ্বাস করতে মন সায় দেয় না আবার না করারও কোন কারন খুজে পাইনা । প্রতারনা করলে এখানে আর ব্যাবসা করে খেতে হবেনা। ট্যুরিস্টদের ব্যাপারে নাকি নেপালী আইন বেশ কড়া। আমাদের দ্বীধার ভাব টের পেয়ে ওরাই অফার দিল - কাঠমুন্ডু বা পোখরাতে গিয়ে যদি আমাদের প্যাকেজ ভাল না লাগে তাহলে আপনি যখন খুশি ক্যান্সেল করতে পারেন, আর এখানেতো অল্প কিছু টাকা দিচ্ছেন বাকী সবতো আপনাদের হাতেই থাকছে।
এতগুলো অল্পবয়েসী হাসিখুশী বন্ধু ভাবাপন্ন ছেলের অনুরোধ ঠেলে না করতে খারাপ লাগছিল । তবুও হায়দারকে বললাম,প্যাকেজ ছাড়া গেলে কতটাকা লাগবে তার একটা হিসেব করতে । ওদের প্যাকেজ অফার থেকে আমাদের হিসাবটা যে একটু বেশী বড় হল তা বলাই বাহুল্য -তাছাড়া সবখানেই অনিশ্চায়তা ।
পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকার জন্য ফের মাহমুদের দিকে তাকিয়ে তার মতামত জানতে চেয়ে প্রশ্ন করলাম, কি করব?
প্রতিউত্তরে সে একটু দ্বীধান্বিত কন্ঠে বলল,-‘কি আর হবে নিয়ে নেন।
৭ম পর্ব সমাপ্ত
আগের পর্ব পড়তে চাইলেঃ Click This Link
পরের পর্বের জন্যঃ Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০২১ দুপুর ২:১৩