নেপালের পথেঃ
এখান থেকে জিপ স্ট্যান্ড বেশ খানিকটা দুরে। ভারি ব্যাগ নিয়ে পাহাড়ি পথে উঠতে নামতে কস্ট হচ্ছিল। স্ট্যান্ডে গিয়ে টিকেট কেটে জিপে উঠে বসে রইলাম আধাঘন্টা কিন্তু ছাড়ার নাম নেই । অপেক্ষা করতে করতে অথৈর্য হয়ে সব আরোহীরা চেঁঁচামেচি করে যখন নেমে যেতে চাইল, তখন ড্রাইবার হাতে পায় ধরে তাদের আবার বসতে অনুরোধ করে গাড়ি ছেড়ে দিল । টার্মিনালে কি ঝামেলার কারনে নাকি গাড়ি ছাড়তে দেরী হয়েছিল । এদিকে আমরা টেনশন করছি- নেপাল বর্ডারে পৌছুতে যদি সন্ধ্যে হয়ে যায় আর ততক্ষনে ওদের কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যায় তখন ...?
দার্জিলিংকে পিছনে ফেলে বহু উচু পাহাড়ী আকা-বাকা ঢালু পথ দিয়ে নামতে নামতে উপভোগ করছিলাম অপরুপ নৈসর্গীক দৃশ্য। সমতলের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে অনুভব করলাম শীতলতাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করে নিচ্ছে উষ্ণতা । চিরটা কাল সমতলে কাটিয়ে দেয়া এই আমার শিলিগুরিতে এসেই যেন মনে হল নিজের দেশে এসে গেছি । তবে সব কিছুতেই আমার দেশের সাথে কমবেশী মিল থাকলেও শিলিগুড়িতে যে ব্যাপারটা সবচেয়ে শ্রতিকটু লাগে সেটা হচ্ছে রিক্সার টুং টাং রিং এর বদলে বিরক্তিকর তীক্ষè পক্ পক্ শব্দ। দুপুর দুটোর দিকে ফের সেই ‘রাজদরবারে’ উঠলাম একটু ফ্রেস হয়ে লাঞ্চটা সেরে নিতে ।
হাতমুখ ধুয়ে স্বুসাদু খাবার খেয়ে কাকা বাবুর সাথে গল্পোচ্ছলে পরামর্শ নিলাম, নেপাল বর্ডারে কিভাবে গেলে ভাল হয়?
তিনি বললেন অযথা ট্যক্সিতে পয়সা না করচ করে বাসে করে চলে যাও ।’ পরামর্শটা ভাল তবে জার্নি কেমন হবে কে জানে ? পশ্চিমবঙ্গের বাসের যে প্রশংসা শুনেছি!
মাহমুদ অতীতের জংধরা অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে বহু কষ্টে খানিকটা ইনফর্মশন বের করে বলেছিল অটোরিক্সায় -রানীগঞ্জ ‘পানির ট্যাঙ্কি’( ভারত সীমান্ত) যেতে নাকি মাত্র ২৫/ত্রিশ রুপি লাগে । যদিও তিন চার বছর আগের কথা -তবুও এখন বড়জোড় পঞ্চাশ রুপিই হবে। তাহলে বাসে কে যায় ।
হোটেল থেকে বের হতেই একটা অটোরিক্সা পেয়ে গেলাম। যাক বাঁচা গেল বেশী দুর হাটতে হবে না ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিয়ে এগিয়ে গিয়ে ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম, যাবেন নাকি -পানির ট্যাঙ্কি?
‘যাব।’
‘কত নিবেন?’
‘দু’শ টাকা ! যাবেন?’
কি বলে ‘দু’শ টাকা (রুপী)! ভুল শুনলাম নাকি । ‘কত বললেন ?’
‘এক’শ আশি টাকা হলে যেতে পারেন ?’
তার মানে ঠিকই শুনেছি । পানসে মুখে মাহমুদের দিকে তাকিয়ে বললাম ‘কি মিয়া -কি বুঝলেন । কবে গিয়ে ছিলেন পচিশ /ত্রিশ রুপি দিয়ে । সপ্নে ?’
প্রতি উত্তরে সে আত্মপক্ষ সমর্থন করে কনফিডেন্টলি বলল ,‘অবশ্যই গেছি । এই ব্যাটা পানির ট্যাঙ্কি চেনেনা।’
মোক্ষম যুক্তি , আমাদের দেশেও অনেক স্কুটার ( এখন সি এন জি অটোরিক্সা)চালক জায়গা না চিনে উল্টা পাল্টা ভাড়া চায় ।
অগত্যা প্রমান পেতে হলে ঠিক আছে চলেন -সামনে যাই অন্যটা দেখি ।
যাকেই জিগ্যেস করি সে-ই অমন ভাড়া দাবি করে । দু-য়েক জন দু’শর গন্ডিও ছাড়িয়ে যায় ! কি আর করার
বিকল্প যান যখন আছে তবে দরকার কি এতগুলো টাকা খরচ করার । এছাড়া ভারতের লোকাল বাস সার্ভিস সন্মন্ধেও একটা কিছুটা বাস্তব ধারনা হয়ে যাবে। বাস স্ট্যান্ড কাছেই। সামনে ‘পানির ট্যাঙ্কি’ বোর্ড ঝোলানো দেখে একটা বাসে ভীড় ঠেলে উঠে পড়লাম । সিট ছিলনা তাই বাধ্য হয়ে পায়ের সামনে ব্যাগ রেখে রড ধরে দাড়িয়ে রইলাম ।
মাহমুদ আমাকে ধারনা দিয়েছিল এখান থেকে পানর ট্যাঙ্কি যেতে বড়জোড় আধাঘন্টা সময় লাগে । কিন্তু একঘন্টা চলে গেল তবু বাগডোরাই এলামনা ! যদিও আমরা শুধু লোকাল নয় ঝিমানো লোকাল বাসে চড়েছিলাম । দশহাত পর পর বাস থামছে আর ভীড় ঠেলে গাদাগাদি করে লোক উঠছে ওদিকে কন্ট্রাকটরের উৎপাত তো আছেই । অটোরিক্সায় এর অনেক আগে গিয়ে পৌছুতাম ঠিক কিন্তু তা বলে বাসের দুঘন্টার পথ আধাঘন্টায় .. কি করে সম্ভব । নক্সাল বাড়ি ছাড়িয়ে অনেকখানি ভাঙ্গা চোরা পথ ধরে এগিয়ে মহা ক্লান্তিকর জার্নি শেষে আমরা যখন পানির ট্যাঙ্কিতে পৌছুলাম তখন ঘড়ির কাটায় সাড়ে চারটা প্রায় ।
এখান থেকে রিক্সায় করে নেপাল সীমান্ত ‘কাকড়ভিটা’ যেতে লাগে দশ রুপি । সেই ভাড়াতেই রিক্সায় চড়ে ভারতীয় ইমিগ্রেশনে থামতে বলতেই ওর রেট বেড়ে গেল । ও ভেবেছিল আমরা পশ্চিমবঙ্গের । ভারতীয়তের নেপালে প্রবেশের জন্য পাসপোর্ট ভিসা ইমিগ্রেশনের কোন ঝামেলা নেই । নামে মাত্র পাচ রুপি ফি দিয়ে এরা যখন তখন ঢুকে যায় ! আমরাও ইচ্ছে করলে পরিচয় ভাড়িয়ে ওদের মত ঢুকে যেতে পারি।
বাংলাদেশী পরিচয়ে অনেক ঝামেলা । ভিসা পাসপোর্টের ব্যাপার আছেই ,ভারতীয়রা আবার সন্দেহ করে ওদের সব গোপন তথ্য থেকে শুরু করে সম্পত্তি পাচার করে নিয়ে যাচ্ছে কিনা ।
ইন্ডিয়া ইমিগ্রেশনের কাছে রিক্সা থামতেই দুজনে ব্যাগ হাতে নিয়ে নেমে পরলাম । মুল রাস্তা থেকে একটু ঢালুতে নেমে যাওয়া ইট সুরকিতে ছাওয়া একটা পথ দিয়ে হেটে কিছুটা এগুলেই- ইটের দেয়াল আর টিনে ছাওয়া ছোট্ট একটা অফিসঘর । এটাই নাকি ইমেগ্রশন অফিস অব ইন্ডিয়া! দুধাপ সিড়ি বেয়ে উঠে বারান্দার নোংরা মেঝেতে ব্যাগটা রেখে ভিতরে ঢুকলাম । অপরিসর রুমটাতে স্তুপাকৃত ফাইলের ওপাশে তিনজন বয়স্ক লোক জমপেশ আড্ডা দিচ্ছেন । আমাদের আগমনে যেন তাদের রসভঙ্গ হল । প্রথম টেবিলের উপবিষ্ঠ ভদ্রলোক কড়া চাহনী দিয়ে একটু রাগী কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন ‘কি চাই?’
‘জ্বী , বাংলাদেশ থেকে এসেছি । নেপাল যাব ।’
তিনি তেমনি কন্ঠের ভাব পরিবর্তন না করে হাত বাড়িয়ে বললেন ‘পাসপোর্ট দেখি ।’
আমরা দুজনে তার দিকে পাসপোর্ট এগিয়ে দিতেই তিনি নিতান্ত অনাগ্রহভরে উল্টেপাল্টে দেখলেন । অবশেষে দুখানা ফর্ম এগিয়ে দিয়ে বললেন, এটা পুরন করুন ।
আমরা ফর্মটা হাতে নিয়ে তার সামনে পাতা বেঞ্চিতে বসতে যেতেই তিনি বললেন,‘ এখানে না বাইরে গিয়ে লিখে আনুন ।’
তিনি যেখানে যেতে ইশারা করলেন বারান্দার সে কোনাটায় গিয়ে দেখি লেখার জন্য একটা টেবিল মত পাতা।
ইমেগ্রেশন ফর্মতো নয় যেন পরিক্ষার প্রশ্নপত্র । তিনপাতার সে ফরম পুরন করতে গিয়ে পদে পদে হোচট খেতে হয় । মাথা চুলকে ভাবতে হয় সঠিক উত্তর !
বড় বিপদ হল ‘প্রেজেন্ট এড্রেস’ এর ঘরে গিয়ে । কোন ঠিকানা লিখব নাকি খালিই রাখব। লেখা শেষে ওনার কাছে সেটা এগিয়ে ধরতেই চোখ বুলিয়েই খিঁচে উঠলেন ‘ এ ঘরটা ফাকা রেখেছেন কেন?’
‘আমর তো বাংলাদেশ থেকে এসেছি । এখানকার ঠিকানা কেন লিখতে হবে ?’
তিনি যেন অপেক্ষা করেছিলেন আমাদের উপর তার সারাদিনের জমিয়ে রাখা রাগ প্রকাশ করার জন্য’। রাগের পারদটা আরেকটু বাড়িয়ে বললেন‘ লিখতে বলেছে লিখবেন । ব্যাস।’
আমি কলমের খাপটা খুলে বললাম ,‘ আমি এখানকার কোন ঠিকানা জানিনা । আপনিই বলুন কি লিখতে হবে ।
প্রতিউত্তরে তিনি আমার কাছ থেকে ফরমটা কেড়ে নিয়ে বাকি ঘরগুলো নিজেই পুরন করলেন । লেখালেখি শেষে ওনার সাথে কিছুক্ষন কথা বললাম । ধীরে ধীরে বরফ গলল। ভদ্রলোককে যতটা খারাপ ভেবেছিলাম তিনি ঠিক ততটা নন । একটু বেশী মাত্রায় রাগী এই যা ।
সেখান থেকে বের হয়ে ফের রিক্সায় চড়ে সামনে এগোলাম । কিছুদুর গিয়ে আরেকখানা অফিসের সামনে গিয়ে সেটা ভিড়ল । রাস্তা লাগোয়া তুলনামুলক বেশ বড় সেই অফিসটাতে ব্যাগসমেত ঢুকতেই সামনের টেবিলে বসা সুদর্শন এক ভদ্রলোক দৃস্টি আকর্ষন করে বললেন ,-From where?
-বাংলাদেশ ।
-এদিকে আসেন । নেপালে যাচ্ছেন । দেখি পাসপোর্ট?
সামনে এগিয়ে পাসপোর্ট বাড়িয়ে ধরলাম তার দিকে ,’ তিনি সেটা হাতে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখে আমাদের হৃস্টপুস্ট ট্রাভেল ব্যাগের দিকে চেয়ে আঙ্গুল উচিয়ে বললেন ,’ ওর মধ্যে কিছু আছে ?’
তার চাহনী দেখে কেন যেন মনে হল ডান চোখে কোন সমস্যা আছে । সেটা কেমন স্থির ।
- জ্বী না , তেমন কিছুই নেই । দেখবেন ।
-‘দ্যাখান।’
-টেবিলের উপর ব্যাগ রেখে তাকে খুলে দেখালাম।
-সাথে কত ডলার আছে ?
- পাসপোর্টে যত এন্ট্রি করা আছে তত । পথে কিছু খরচ হয়েছে ।
- অতিরিক্ত কিছু নেইতো ।’ তিনি যেন সন্দেহের দৃস্টিতে তাকালেন । সবার দিকেই এনারা এমন দৃস্টিতে তাকান -এ আমি জানি । তাছাড়া একচোখে তার সন্দেহজনক চাহনীটা ঠিক জমছেনা । ততক্ষনে আমি বুঝে গেছি বাকী চোখটা কৃত্তিম ।
- না নেই ।
একটু দুরে মলিন পোষাকে দাড়িয়ে থাকা একজনকে ডেকে বললেন ,
- পাশের রুমে নিয়ে ইনাকে চেক কর ।
লোকটা কাছ এসে আমকে ইশারা করলে আমি তার সাথে পাশের রুমে গিয়ে ঢুকলাম । সে পর্দা টেনে দিয়ে বলল,-স্যার কাছে কিছু থাকলে বলে দেন ? খুজে পেলে সমস্যা হবে ।
প্রতিউত্তরে স্মার্ট ভঙ্গীতে আমি কাধ শ্রাগ করে বললাম,
- কিছু নেই- ভাই আপনি দেখতে পারেন ।’ চেকিং শেষে ফের রেুমে আসতেই সে মাহমুদকে যেতে বলল ।
ভদ্রলোকের হাতে তখনও আমার পাসপোর্ট । তিনি পাসপোর্টের পাতা উল্টাতে উল্টাতে একখানে থমকে গিয়ে হঠাৎ উচ্ছসিত কন্ঠে বললেন- আপনি রাশিয়া ছিলেন ?
- কত সালে ?
- ১৯৯১ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত । দ্বীতিয়বার ১৯৯৮তে।’ একটু দুরে বসা আরেক অফিসার তখন দেখি উৎসুক দৃস্টিকে আমার দিকে তাকালেন ।
-পেরেস্ত্রেইকার সময় ছিলেন আপনি ?
- ভাঙনের শুরুটা দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি তবে শেষটা দেখেছি ।
- কোনটা বেটার মনে হয়েছে আপনার কাছ কম্যিউনিজম না ক্যাপিটালিজম ।
পশ্চিমবঙ্গে কম্যিউনিস্ট সরকার ক্ষমতায় । যদিও রুশ কম্যুনিজমের মুল নীতির সাথে এদের দুস্তর ব্যাবধান। তবুও ভাবলাম কম্যুনিজমের কথা বললে হয়ত এরা খুশী হবে । তাই আমি ওদের দিকে পাল্লাটা ভারী রেখে অতীত ও বর্তমান অবস্থার বর্নণা করছিলাম ।
আমার কথায় ইনি বেশ মজা পেলেও পাশে বসা অন্য অফিসার মহোদয় সম্ভবত নাখোশ হলেন । কথার মাঝখানেই বাগড়া দিয়ে তিনি একটু কড়া স্বরেই প্রথমজনকে বললেন ,
‘সন্ধ্যে হয়ে আসছে- এদেরকে যেতে দিন।’
...ষষ্ট পর্ব সমাপ্ত
আগের পর্ব পড়তে চাইলে নিচের লিঙ্কে চাপুনঃ Click This Link
পরের পর্বের জন্যঃ Click This Link
ছবিঃ নেট থেকে সংগ্রহকৃত
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০২১ দুপুর ২:১০