একটু পিছন থেকে শুরু করছি..............
জুন ২০১২, আমার সংসারে তখন তুমুল ঝগড়া, আমার স্ত্রী রোজলিন আমাকে আলটিমেটাম দিয়েই বসলো, যেভাবেই হউক ওকে ১১ লাখ টাকা যোগাড় করে দিতে হবে। নতুবা সংসার হবে না, সে ডিভোর্স দিতে প্রস্তুত।
তখন আমি মাত্র হেপাটাইটিস বি ভাইরাস থেকে একটু নিরাময়ের দিকে, বিছানা থেকে উঠে একটু আধটু বাইরে যাওয়া আসা করতে পারি। ৭ই জুন সে (রোজলিন) জানান দিলো যে তার সাথে আমাকে কোট বিল্ডিং দাড়াতে হবে, তার হিয়ারিংয়ের ডেট পড়েছে। সে দুটি ব্যাংক থেকে ১০ লাখ টাকার মতো লোন নিয়েছিলো, অর্ধেক দেওয়া হয়েছে বাদ বাকী টাকার জন্য তারা মামলাও করেছে, রোজলিন ডিফল্টার তাই কোর্টে যেতে হয়। কিন্তু আমি সেইদিন যেতে পারিনি আমার শারীরিক অসুস্ততার জন্য। আমার কিইবা করার ছিলো। এতে সে ভীষন মাইন্ড করে। এদিকে সে ওয়াল্ড ভিশনের এক মেলায় ষ্টল দিয়ে বসে। সেখানে তাকে ত্রিশ হাজার টাকা যোগান দিতে হবে, বিষয়টা আমাকে আগে ভাগেই জানিয়ে রাখলো যা মাসের শেষ দিকে তাকে দিতে হবে, আমি আমার অসহায়ত্বতা নিয়ে কেবল দেওয়ালের মাকড়সার ঝুল দেখি। সময় কেটে যাই, আমি অসুস্ততা নিজের মাঝে রেখে রোজলিনকে সহযোগীতার জন্য টাকার সংগ্রহে প্রতিদিন বের হই, কিন্তু কে আমাকে টাকা দিবে?
একটি সমিতি যারা আমাকে চিনে, তারা ৫ লাখ টাকা দিতে রাজী হলেও সুদের হার এত বেশী যে আমার পক্ষে সে অফার গ্রহণ করা সম্ভব হয় না, আমি বাসায় এসে রোজলিনের সাথে আলাপ করি কিন্তু সে এই টাকা নিতে রাজী কিন্তু আমি রাজী হই না। এমএলএম টাইপের সুদ দিতে হবে যা কখনও সম্ভব না। ফলে সংসারে আমার শুরু হয় কুরুক্ষেত্র। প্রতিদিনই ঝগড়া ঝাটি। আমি বলি পারবো না, তার কথা এই টাকা আমার চাই। আমি সরাসরি তাকে বলে বসি, প্রয়োজনে সংসার ভেঙ্গে দাও, তবুও আর লোন করবো না। এতে রোজলিন ক্ষিপ্ত হয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। এবং সব ধরণের যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়ে সে বাসায় আসে না। এদিকে রাতে মেয়ে শুরু করে কান্নাকাটি। তার মাকে লাগবে, মা ছাড়া সে ঘুমাবে না। আমি কি করি?
রোজলিন দশটা বাজে ঘরে ফিরে এসে মেয়েকে বগলদাবা করে নিয়ে চলে যাই, আমার সাথে একটা কথাও বলে না, আমি তাকে বলি কোথায় যাচ্ছো মেয়েকে নিয়ে? সে কোনো উত্তর না দিয়ে বের হয়ে যায়।
এক সপ্তাহ আমার খুব খারাপ কাটে, মেয়ের জন্য, রোজলিনের জন্য। কিন্তু মন সায় দেয় না লোন করতে। এমনিতে নিজের সম্পূর্ণ ট্রিটমেন্ট করাতে পারিনি। বাইরে কতো লোন, রোজলিন দুটো ব্যংন্কের কাছে দায় নিয়ে আছে, আবার নতুন লোন? না, এটা নেওয়া যায় না।
৯ দিনের মাথায় রোজলিন মেয়েকে ছাড়া বাসায় আসে। আমি মেয়ের কথা জানতে চাই, সে জানাই মেয়ে ভাল আছে, কিন্তু কোথায় আছে জানাই না। আমি চুপ থাকি। সে আবার শুরু করে একই কাহানী এবং এক পর্যায়ে সে চলে যাই, প্রায় ঘন্টা খানেক পরে সে আবার বাসায় এমন ভাবে আসে মনে হবে নেশা করে এসেছে। আমি তাকে ধরতে গেলে সে এক ধাক্কায় আমাকে সরিয়ে দিয়ে নিজেই পড়ে যাই। নিজে নিজে বলতে থাকে কেনো এতগুলো ট্যাবলেট খেয়েও আমার মরণ হলো না, সব দুই নম্বর ট্যাবলেট ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি তাকে ধরে বিছানায় নিয়ে রেস্ট নিতে বলি কিন্তু সে বকর বকর করেই যাচ্ছে এবং এক পর্যায়ে ঘুমিয়ে পড়ে। আমি তার ভ্যানিটি ব্যাগ ঘেটে আরও ৫০টা সিডিল ট্যাবলেট বের করি। ঘুম ভাঙ্গার পর সে আমার সাথে রীতিমতো তর্ক করা যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং এক পর্যায়ে ব্যালেন্স হারিয়ে পড়ে গিয়ে চোখের নিচে ব্যাথা পেলে আমি ফ্রিজ থেকে বরফ নিয়ে লাগিয়ে দিতে থাকি, কিন্তু সে আমার এইসব তোয়াক্কা না করে ঘর থেকে বের হয়ে যায়্ এখানে জায়গার স্বল্পতার কারণে আমাকে অনেক
কিছু শর্ট করে লিখতে হচ্ছে।
তারিখ ১০ই জুলাই, ২০১২।
বসে বসে সব ভাবছিলাম। নিজে নিজে হিসাব মিলাতে চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু দেখলাম হিসাব মিলে না কোনো ভাবেই।
সিনক্রিয়েট কাকে বলে আমি খুব ভালো করেই জানি। রোজলিনের এইরুপ ভাইয়ের বাসায় চলে যাওয়া এবং টাকা বিষয়ক জটিলতায় আমি খুব ডিপ্রেসড হয়ে পড়ছিলাম। বিকেলের দিকে মাঠের দিকে গেলাম। বিকেলে মাঠে ক্রিকেট খেলার পাশাপাশি আড্ডা, বেশ লাগে। ঘন্টা খানেক পর বাসায় ফিরছি, বাসার সামনের দোকানে সিগারেট কিনছি, ঠিক তখন আমার ডান ও বাম পাশ দিয়ে তিনজন তিন জন করে ছয় জন যুবক টেনে হেচড়ে মাইক্রোতে তোলার চেষ্টা করা শুরু করলে, তাদের জিঙ্ঘাসা করেছিলাম 'আপনারা কারা?' তারা উত্তরে জানাই 'আমরা আর এ বি, কিন্তু কালো পোষাক ছাড়া, মাইক্রো আমাকে নিয়ে হালিশহরের দিকে রওনা হলে আমি বুঝতে পারলাম এরা সেন্টারের লোক।
অর্থাং রোজলিন আমার জন্য সেন্টার ঠিক করেছে তারই সুত্র ধরে চলছে সব কিছু, আমি অঙ্কুর নামে ভয়ানক এক মাদক নিরাময় ও পূর্নবাসন সেন্টারের দেখা পেলাম যেখানে কথায় কথায় শারীরিক নির্যাতন ও মানষিক শাস্তি চলে, চলে জঘন্য খাওয়া দাওয়া, অতিরিক্ত কাজ, মাত্র চার ঘন্টা ঘুমের এক আজব দমবন্ধ করা পরিবেশের একটি সেন্টার যেখানে রোজলিন আমাকে চার মাসের জায়গায় ছয় মাস আটকে রাখে। প্রথম প্রথম ভেবেছিলাম আমার ভালো করার জন্য সে এইসব করছে। কিন্তু সেন্টার থেকে বের হয়ে জানলাম সেন্টারে থাকাকালীন রোজলিন আমার ঘরের যাবতীয় ফার্নিচার বিক্রি করা শুরু করে। মেয়েকে সেন্ট মেরীস স্কুল থেকে ছুটিয়ে নিয়ে যায় এবং হোষ্টেলে ভর্তি করিয়ে দেয় যা সে আমাকে জানাই নি বা জানাবার প্রয়োজনও মনে করে নি।
গত জানুয়ারী মাসের ১২ তারিখে সেন্টারের পরিচালক জনাব পিন্টু ( ফলস নেম ) আমাকে অফিসে ডেকে বলে, আপনি আজ থেকে মুক্ত, ইচ্ছা করলে আপনি চলে যেতে পারেন? আমি জানতে চাইলাম, আমার স্ত্রী যিনি আমাকে এখানে ট্রিটমেন্টে দিয়েছে, তিনি আমাকে নিতে আসবেন না? পিন্টু ভাই সরাসরি বললো, না, উনি আপনাকে ছেড়ে দিতে বলেছে, পেমেন্ট ক্লিয়ার করে গেছেন, আপনি ইচ্ছা করলে সেন্টারে থাকতে পারেন অথবা কোনো যাবার জায়গা থাকলে যেতে পারেন। আমি অবাক হই নি, কেননা গতকাল একটা চিঠি পেয়েছি 'উকিল নোটিসের মতো আমার নামে যেখানে রোজলীন উকিল নোটিস দিয়ে জানিয়েছে সে আমার সাথে আর সংসার করবে না।
আমি হাটা ধরলাম। নিজ বাসায় এসে অবাক হলাম, সেখানে নতুন ভাড়াটিয়া। বাড়িওয়ালার সাথে কথা বললাম, তিনি জানালেন, আপনি হসপিটালে বলে এর মাঝে রোজলিন অনেক কিছু বিক্রী করে অত:পর ঘর ছাড়ার নোটিশ দেয়, এবং ডিসেম্বর ৩১, ২০১২ তারিখে বাকী মালামাল নিয়ে মেয়েকে নিয়ে অন্যত্র চলে যাই, আমি জানতে চাইলাম কোথায় গেলেন? কিন্তু উত্তর পেলাম না। আমি এক কাপড়ে সেন্টারে ঢুকেছিলাম, সেই কাপড়ই গায়ে ছিলো। পায়ে স্যান্ডেল। কোথায় যাবো এত বড়ো চট্টগ্রাম শহরে। আমার মেয়েটাকে যে এক নজর দেখতে ভীষন ইচ্ছা করছে। পিপাসায় গলা শুকিয়ে যাচ্ছে, বুঝতে পারছিলাম পাড়ার অনেকে আমাকে ডাকছে ঘটনা শোনার জন্য। কিন্তু আমি থামতে পারছি না। লুকাতে ইচ্ছা করছে খুব। ইচ্ছা করছে মাটি ফাক করে ঢুকে যাই সেখানে। জন্ম থেকে যে পাড়ার হাওয়া বাতাস খেলাম, বড় হলাম, নিজেদের আপন জায়গা নামমাত্র দামে বিক্রী করতে বাধ্য হলাম রাজনৈতিক গডফাদারের কাছি, এবং পাশেই ঘরভাড়া করে এতদিন থেকে এসেছি, সেই 'দামপাড়া-সাতকানিয়া কলোনি ছেড়ে চলে যাচ্ছি, কোথায় যাচ্ছি জানি না, রোজলিন আমাকে কিছু বলে নি, সেন্টার হয়তো জানতে পারে কিন্তু তারা কিছুই জানাবে না। আমি হাটছি আর করণীয় ভাবছিলাম, সেন্টার অংকুর মুখে যত কথা বলুক পুনরায় আবাসন বা পুর্নবাসন সম্পর্কে আসলে কোনো সেন্টারের পরিস্কার ধারণা নেই বলেই মনে হয়। অভিভাবক থেকে টাকা পেলে তারা সব্ কিছুই করতে পারে। আমি সেন্টারে এসেও কিছু জানতে পারলাম না। পাড়ার দোকান থেকে দু'শ টাকা ধার নিয়েছিলাম, সেখান থেকে রোজলিনকে ফোন করলাম তার মোবাইলে, সে ফোন ধরে না। অপরিচিত ফোন সে আগেই ধরতো না, এখনও তাই করলো। আমি কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার কাপড় চোপড়, জুতা স্যান্ডেল থেকে শুরু করে আমার নিত্য ব্যবহার্য প্রয়োজনীয় জিনিষ, গিটার, কিবোর্ড, হারমোনিয়াম, তবলা, মাউথঅর্গান, বাশী সহ সকল শখের জিনিষ তো আছেই, সাথে আছে ব্যাঙ্কের চেক বই, ব্যবসার যাবতীয় দলিল, ট্রেড লাইসেন্স, অফিসের চাবি ( পরে দেখি অফিস ফার্নিচারও সে সরিয়ে নিয়ে গেছে ) নগদ টাকা, স্বর্ণাল্ঙ্কার, একাডেমিক সার্টিফিকেট ইত্যাদি নিয়ে সে হারিয়ে গেলো। আমি রাস্তায় রাস্তায় হাটছি, ক্ষধার্ত আমি কোথায় যাবো? কি করবো রোজলিন আমাকে সেন্টার থেকে রিলিজ দেওয়ার সময় একবারও ভাবলো না? একজন মানুষও অন্য মানুষের কথা ভাবে, না হয় দিলো আমাকে সেন্টারে, আমি ভালো হয়ে কোথায় যাবো, কার কাছে যাবো - এইসব বিষয়ে সে একটা বার না ভেবে আমাকে সেন্টার থেকে রিলিজ দিয়ে দিলো?
অংকুর সেন্টারই বা কেমন? এর পরিচালনায় যারা আছেন তারা আমাকে ছাড়ছেন একবার জানতে চাইবেন না আমি কোথায় যেতে পারি? যেখানে তাড়া রোগীদের বেশীর ভাগকে আমার মতো রাস্তা থেকে ধরে আনেন অভিভাবকের পরার্মশে সেখানে তাদের কি ভূমিকা নেই? সেন্টারটি চট্টগ্রামের হালিশহরের আই ব্লকে অবস্তিত। পিন্টু ভাই ওরফে মোহাব্বত আলী নামের পরিচালক ভাইকে প্রশ্ন করা দরকার ছিলো সে হলে আমার জায়গায় কি করতেন?
আজ এই পর্যন্ত................গত তিন মাস ধরে আমি আমার মেয়ে ও রোজলীনকে পাগলের মতো খুজছি, আগামীকাল থানায় যাবো প্রয়োজনীয় ব্যবস্হা নিতে, আমার বিগত কর্মকান্ডের জন্য আপনারা আমাকে ক্ষমা করবেন।