সুগন্ধীর ইংরেজি প্রতিশব্দ “পারফিউমস”। এর আসল অর্থ “ধোঁয়ার মাধ্যমে” গ্রহণ। সুগন্ধী দ্রব্যের প্রধান উৎস হচ্ছে প্রকৃতি। উদ্ভিদের লতা-পাতা,ফুল,ফল,মূল হতে যেমন সুগন্ধী সংশ্লেষিত হয় তেমনই হরেক প্রাণী থেকে বিভিন্ন রকমের সুগন্ধী জিনিস পাওয়া যায় । এ ব্যাপারে যথেষ্ট সুনাম আছে কস্তূরীর। এক ধরনের গন্ধযুক্ত রাসায়নিক বস্তু সহজেই জলেতে বা অন্য তরলে মিশে যায়। সেই দ্রবণীয় জিনিসটাই বাজারে বিক্রি হয় “ সুগন্ধী”হিসেবে।
‘কস্তুরী’ হচ্ছে মৃগনাভি যা প্রাচ্যে মহামূল্যবান সুগন্ধিরূপে পরিচিত।
পূর্বকথা —-
কস্তূরী বা মৃগনাভি ব্যবহার করলে তার গন্ধে নাকি রাজ-রাজড়ারা অন্দরমহলে খাস রানির কাছে বারবার ছুটে আসতেন,এমনটাই বলে কিংবন্তী!
নারীর কৃষ্ণকেশ কস্তূরিকার সদৃশ, তাহার হাসি মৃগনাভির ন্যায় – বিকাশ হইবা মাত্র সর্ব্বত্র আমোদিত করে, এবং তাহার সুগন্ধর পরিপূর্ণ সমাদৃত পত্রের প্রাপ্তি স্বীকার করিতে, রাজার সভাকবিরা লেখেন “ভবৎ শ্রীহস্ত নিঃসৃত লিপিমালার মদার গন্ধেপরিমোদিত হইয়াছি” ….
সুগন্ধ-দ্রব্যের মধ্যে কস্তূরী দেশে বহুকাল থেকেই প্রসিদ্ধ আছে । কবিরা ইহার সৌরভে সর্ব্বদাই মুগ্ধ এবং ইহার প্রশংসায় গদগদ চিত্ত হইয়া থাকেন । পারস্যদেশে উৎকৃষ্টতার প্রতিরূপ বলিয়া ইহার সহিত অন্যান্য সকল বস্তুর তুলনা হয় । যদিও ভারতবর্ষের কাব্যে কস্তূরীর সুবাসের প্রয়োগ আদি কাল হতেই পাওয়া যায় ।
কস্তূরী নামা ——
ইহা বহুগুন সম্পন্ন এবং ইহা বহু নাম সম্পন্ন , আবার গুণের প্রকাশে সকল নামও অপ্রসিদ্ধ নয় ।
ইহার এইরূপ খ্যাতি আশ্চর্য্যজনক নয়; যেহেতু ইহার গন্ধ প্রকৃত যোজনগন্ধা বলিলে কম বলা যায় । কথিত আছে- ইহা এক-তিল পরিমিত পদার্থ কোন বাড়িতে নিক্ষেপ করিলে বহুবৎসর সেখানে তাহার গন্ধ থাকে । তিন হাজার ভাগ নির্গন্ধ পদার্থের সহিত ইহার এক ভাগ মিশ্রিত করিলে ঐ সমস্ত দ্রব্যই সুবাসিত হয় কস্তূরী গন্ধে। কস্তূরী-সংগ্রহকারকেরা কস্তূরীকে প্রায় প্রকৃত অবস্থায় রাখে না; সচরাচর অন্য পদার্থের সহিত তাহা মিশ্রিত করিয়া বিক্রয় করে। ঐ অন্য পদার্থের মধ্যে রক্ত একটি বিশেষ উপাদান , যেহেতু শুষ্ক রক্তের সহিত কস্তূরীর বিশেষ সাদৃশ্য আছে । কস্তূরী ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত ও সুগন্ধিত , যেমন –
কস্তুরিকা, কস্তুরিকান্ডজ, মৃগনাভি, মৃগমদ, মৃগনাভিজ, মৃগনাভিজা, মৃগান্ডজা, মৃগ, মৃগী, নাভি, মদনী, বেধমুখ্যা, মার্জারী,সুভগা, বহুগন্ধদা, সহস্রবেধী, শ্যামা, কামান্ধা, মৃগাঙ্গজা, কুরঙ্গনাভী, শ্যামলা, মোদিনী, অন্ডজা, লাক্ষী, নাড়ী, মদ, দর্প,মদাহ্বা, মদার, গন্ধধূলী, গন্ধকেলিকা, যোজনগন্ধা, যোজনগন্ধিকা, গন্ধশেখর, বাতামোদ, মার্গ, ললিতা ।
কে তুমি যোজনগন্ধা ——–
সুগন্ধী ফুলের মতোই যুগ যুগ ধরে মানুষের দৃষ্টি কেড়েছে কস্তরী মৃগ। এটা এক ধরনের পুরুষ হরিণ। ইংরেজী নাম “মাস্ক ডিয়ার”। ওরা ভারী লাজুক স্বভাবের। তাই নিরিবিলি বাস করে। বিচরণ একান্ত নির্জনে।
কস্তূরীর জন্মস্থান পামির গ্রন্থি হতে নির্গত পর্বতমালার মাঝে যে সমস্ত উপত্যকা অঞ্চল রয়েছে তাতে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে স্থানে প্রকার অনুযায়ী পাওয়া যায় । তবে হিমালয় পর্বতমালার উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলে উৎকৃষ্ট কস্তূরীমৃগ পাওয়া যায় ।
ঐ স্থানে এক প্রকার ক্ষুদ্র হরিণ আছে, তারা ছাগলের চেয়ে বড় নয়, কিন্তু দেখতে অতীব সুন্দর ইহাদের পা অতি সরু,মাথা সুন্দর এবং চোখ চমৎকার উজ্জ্বল । এই কস্তুরীমৃগ বা হরিণ অন্য হরিণ হইতে আলাদা নয়, কিন্তু অত্যন্ত শীতল পার্বত্য পরিবেশে বাস করায় ইহাদের লোম সরু না হয়ে অত্যন্ত মোটা ও পালকের ন্যায় হয় অপর, প্রায় সকল হরিণ প্রজাতির উপর মাড়ির পুরোভাগে দাঁত গঠিত হয় না, কিন্তু কস্তূরী মৃগের উপর মাড়ি হইতে দুটি গজদন্তর মতো দাঁত নিঃসৃত হয় ।
ইহারা আত্মরক্ষায় পটু তবে এদের গোপণ না হওয়া প্রকৃতির এক বিচিত্র নির্মমতা; তা হল এদের দেহের তীব্র সুগন্ধ । তা স্বত্বেও এরা আত্মরক্ষা করে । পায়ের সাহায্যে কস্তূরীমৃগ যৎপরোনাস্তি গতিতে ছুটিতে পারে, এবং এক এক লাফে চল্লিশ ফুট স্থান অতিক্রম করিতে পারে। এই আশ্চর্য লাফের কথা বিশ্বাস হওয়া কঠিন, কিন্তু অতি বিখ্যাত শিকারিরা এই ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন ।
কস্তূরী; সুগন্ধ যখন মৃত্যু —
কস্তূরী এক বিশেষ ধরনের প্রাণীজ সুগন্ধি। কস্তূরী মৃগের নাভি থেকে এই সুগন্ধি দ্রব্যটি সংগ্রহ করা হয়। পুরুষ কস্তূরী মৃগের নাভি মুখের গ্রন্থিতে এক বিশেষ ধরনের কোষের জন্ম হয়। এই কোষ যখন পূর্ণতা লাভ করে তখন এর থেকেই সুগন্ধ বের হতে থাকে।
হরিণটির ১০ বছর বয়সে সুগন্ধি কোষ পূর্ণতা লাভ করে। তবে মজার ব্যাপার হল যে হরিণটির নাভিতে এই কোষের জন্ম সে নিজে কিছুই বুঝতে পারেনা। তার নাকে যখন এই সুগন্ধ এসে লাগে তখন সে পাগলের মতো ছুটতে থাকে এই সুগন্ধির সন্ধানে। অথচ সে বুঝতে পারে না,গন্ধটা তার দেহেই রয়েছে।
কস্তূরী হরিণের বয়স যখন দশ বছর তখন গ্রন্থিটি পরিপক্ব হয়। এ সময় হরিণটিকে শিকার করে তুলে নেয়া হয় পুরো গ্রন্থিটি। তারপর রোদে শুকানো হয়। একটা পূর্ণাঙ্গ কস্তূরী গ্রন্থির ওজন প্রায় ৬০/৬৫ গ্রাম। কস্তুরীকোষের বাইরের দিকটায় থাকে এলোমেলো কিছু লোম। সেগুলো ছাড়িয়ে শুকনো কোষটিকে যখন জলে ভেজানো হয়,তখন পরিষ্কার কস্তূরী বেরিয়ে আসে ।কোন কোন হরিণের মধ্যে পাওয়া যায় খুব কম পরিমাণে কস্তুরী। অপর এই জাতীয় সকল হরিণেও এক পরিমাণে কস্তূরী উৎপন্ন হয় না; হরিণের বয়স এবং পরিবেশ ভেদে কস্তূরীর পরিমাণের তারতম্য হয় । হিসেবে দেখা গেছে এক কিলোগ্রাম পরিমাণ কস্তুরী পাবার জন্য প্রায় দু’হাজার হরিণ শিকার করতে হয়।
শিকার করার পর এই কস্তূরী যখন সংগৃহীত হয় তখন এতটাই উগ্রগন্ধ হয় যে, যে শিকারীরা কস্তূরী সংগ্রহ করার জন্য নাভিকোষ কাটিয়া কস্তূরী লইবার সময় নিজ নিজ নাক মোটা কাপড়ের টুকরোতে বাধিয়া নেয় । তবুও ঐ গন্ধ সহ্য করিতে পারে না; কেউ কেউ গন্ধ দ্বারা বিহ্বল হয়ে পড়ে, এবং অনেকের চোখ, নাক, মুখ হইতে প্রচুর জল বেরিয়ে আসে। এই ঘটনার সময় কারো কারো জীবনহানি ঘটেছে ।
শুকনো হলে কস্তূরীর উগ্রতা কম হয় । শুকনো কস্তূরী ধোঁয়াটে কালো রঙের, ঈষৎ দানাবিশিষ্ট এবং স্বাদে তেঁতো । এবং গরম জলে কস্তূরীর ৯০ ভাগ গলিয়া যায় । স্পিরিটে অর্দ্ধেক মাত্র গলে কিন্তু ডিমের কুসুমে ইহার সমস্ত অংশ গলিয়া যায় ।
কস্তূরী সংস্থান ——
কস্তূরী চীন, রাশিয়া, মায়নমার, কাম্বোডিয়া, নেপাল, ভারত, কাজাখস্থান, কিরঘিজিস্থান, ও অন্যান্য রাশিয়ান সংলগ্ন দেশে পাওয়া যায় । এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মধ্যে পূর্ব দিকের কস্তূরী তুলনামূলক উচ্চ গুনমান সম্পন্ন হয় । পশ্চিমদিকের অংশে পাওয়া গেলেও তার মান খুব ভালো হয় না । এর মধ্যে চীনদেশের কস্তূরী সর্ব্বোৎকৃষ্ট ও রাশিয়ান কস্তূরী সর্ব্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট । প্রাচীন ভারতীয় বিভিন্ন গ্রন্থে ভারতের তিন প্রকার কস্তূরীর উল্লেখ পাওয়া যায়, যথা – কামরূপী, নেপালী, এবং কাশ্মীরী । তারমধ্যে কামরূপী উন্নত ও কাশ্মীরী অনুন্নত হয় ।
অমূল্য কস্তূরিকা —-
কস্তুরী ঝাঁঝালো, উষ্ণ এবং তীব্র সুগন্ধিযুক্ত এক প্রকার জৈব পদার্থ। সুগন্ধী হিসাবে এর ব্যবহার আছে তাছাড়া ঔষধি হিসাবে এর গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার দেখা যায় । আসল কস্তূরী ঔষধার্থেই অধিক ব্যবহৃত হইয়া থাকে । বর্তমান বাজার-দরে কস্তুরীর দাম একই ওজনের সোনার প্রায় তিনগুণ।
স্বাস্থ্য, শক্তি-উদ্যম ও যৌন উদ্দীপনায় কস্তুরী অনন্য। কস্তুরী ভগ্ন স্বাস্থ্য ও শক্তি পুনরুদ্ধার করে রক্ত উত্তেজক এবং বেদনানাশক হিসেবে কাজ করে। কস্তুরী জ্বরজনিত খিঁচুনী, সন্ন্যাস রোগ বা স্নায়ুবিক চেতনাহীনতা, পেটে তীব্র ব্যাথা,আঘাত জনিত ক্ষতের তীব্র ব্যাথা, স্পর্শজ্ঞান শূন্যতা বা অসাড়ত্ব, শারীরিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের তীব্র ব্যাথা সারাতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
শুধু হরিণ নয় আরো অনেক ধরনের প্রানীর মধ্যে এই সুগন্ধি উৎপাদনকারী কোষ রয়েছে। হরিণ ছাড়াও কস্তুরীর অস্তিত্ব রয়েছে বিড়াল,ইঁদুর বা গাছের মূলে। musk rat নামক ইঁদুর ও civet নামক বিড়ালের দেহে এই ধরনের কোষ আছে।
এই দুটি প্রাণী হতে পাওয়া পদার্থগুলোর রাসায়নিক নাম “মাস্ক-কোন” (Musk cone) ও “সিভেটোন” (Civeton) । বিজ্ঞানীরা আরো বলেছেন শুধু প্রাণী নয় কিছু কিছু গাছ আছে যাদের থেকেও এই কস্তূরী তৈরি করা সম্ভব।
ইদানিং গবেষণাগারে এগুলো কৃত্রিমভাবে সংশ্লেষিত হচ্ছে। জার্মানি ও সুইডেনের বিজ্ঞানীরা ল্যাবরেটরিতে কৃত্রিম উপায়েmusk cone নামে বিশেষ ধরনের কস্তূরী তৈরি করেছেন। আশ্ল ও কৃত্রিম পদার্থ দুটি আণবিক গঠন মোটামুটি একই রকম। সেটা কার্বন,হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের সমন্বয়ে তৈরি। সুগন্ধী দ্রব্যের মূল শিকলে ১৫-১৭টি কার্বন পরমাণু জোড়া বেঁধে থাকে।
শেষের কথা —-
সুগন্ধেই যে শরীর-মনের ক্লান্তি দূর হয়ে, রুক্ষ সময়েও চনমনে ভাব আনতে পারে তা কে না জানে ?
সারাদিনের রোজনামচা থেকে রাতের বিছানা-বিলাস, সবেতেই শরীর কেমন সুগন্ধে মাদকতার ঝড় তোলে চারপাশের পরিবেশে। সেই প্রাচীনকাল থেকেই হয়ে আসছে নানা রকম সুগন্ধীর ব্যবহার , বিলাসের অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে আমরা সুগন্ধি কমবেশি সবাই ব্যবহার করে থাকি। আর আমাদের ব্যক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটায় এই সুগন্ধি।
হরিণের যখন মৃগনাভির সৃষ্টি হয় তখন তা থেকে এত সূগন্ধ ছড়ায় যে হরিণ তাতে মোহিত হয়ে উদ্ভ্রান্তের মত ছুটে বেড়ায়,কোথা থেকে আসে এত ঘ্রাণ, এত সূগন্ধ! আকাশে বাতাসের সর্বত্র সে এই গন্ধ পায়, কিন্তু তার উৎস যে তার নিজেরই নাভি, তার নাভিতে উৎপন্ন মৃগনাভি বা কস্তূরী গন্ধ পাগল হরিণ তা কিন্তু বুঝতেই পারে না।
রবি ঠাকুরের কথায় – “সৃষ্টিকার্যের মধ্যে সৌন্দর্য সর্বাপেক্ষা আশ্চর্য রহস্যময়, কারণ, জগৎরক্ষায় তাহার একান্ত উপযোগিতা দেখা যায় না। সৌন্দর্য অন্ন নহে, বস্ত্র নহে, তাহা কাহারও পক্ষে প্রত্যক্ষরূপে আবশ্যক নহে।তাহা আবশ্যকের অতিরিক্ত দান, তাহা ঈশ্বরের প্রেম। এইজন্য সৌন্দর্য অতীব আশ্চর্য রহস্যময়।
মানুষ আপন সভ্যতাকে যখন অভ্রভেদী করে তুলতে থাকে তখন জয়ের স্পর্ধায় বস্তুর লোভে তুলতে থাকে যে সীমার নিয়মের দ্বারা তার অভ্যুত্থান পরিমিত। সেই সীমায় সৌন্দর্য,সেই সীমায় কল্যাণ। সেই যথোচিত সীমার বিরুদ্ধে নিরতিশয় ঔদ্ধত্যকে বিশ্ববিধান কখনই ক্ষমা করে না। প্রায় সব সভ্যতায় অবশেষে এসে পড়ে এই ঔদ্ধত্য এবং নিয়ে আসে বিনাশ।’’
তাই কস্তূরীর সৌন্দর্য যতই সুন্দর হোক, তার বিনাশের কারণই হল তার অলৌকিক সৌন্দর্য…
তথ্য সূত্র ————
সমস্ত তথ্য বিভিন্ন ইন্টারনেট ওয়েব সাইট ও উইকিপিডিয়া থেকে সংগৃহীত করে , তা সংক্ষেপিত আকারে তুলে ধরা হয়েছে ।
@@ এটি আমার দ্বারা শুধু মাত্র – সংগৃহীত, পরিকল্পিত, সংযোজিত ও গ্রন্থিত ……
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই এপ্রিল, ২০১৬ রাত ৮:১৭