রাজনৈতিকভাবে আলোচিত ওই ব্যারাজের কারিগরি দিক খোলাসা করা যাক। স্থাপনাটিতে বাঁধ ও ফিডার ক্যানেল মিলিয়ে মোট ১২০টি লক গেট। তার মাত্র দুটি দিয়ে এ বিপুল জলরাশি বের হয়ে যাচ্ছে! মমতার এই দাবি নেহায়েত গর্দভও বিশ্বাস করবে না। অন্যদিকে ফারাক্কা পরিদর্শন শেষে রাজ্য সেচ সচিবের প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে যে ৪৬ হাজার কিউসেক পানি ব্যারাজ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বাংলাদেশের নির্ধারিত হিস্যার চেয়ে মাত্র ৬ হাজার কিউসেক বেশি! এই হিসাবও কতখানি সঠিক, পদ্মার ধু ধূ বালুচারের দিকে তাকালে সন্দেহ হয়।
তবে ফারাক্কা নিয়ে এতো জলঘোলা করার গোমর ফাঁস হয়ে যায় শনিবার মমতার সংঙ্গে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর দূত ও কেন্দ্রীয় পররাষ্ট্র সচিব রঞ্জন মাথাইয়ের বৈঠকে তিস্তার পানি বণ্টনের ক্ষেত্রে মমতার অনড় অবস্থান প্রকাশ হওয়ার মধ্য দিয়ে। আনন্দবাজার অবশ্য আগেই শঙ্কা প্রকাশ করেছিল, ফারাক্কার জলকপাট দিয়ে বেশি পানি বয়ে যাওয়ায় মমতা তিস্তার ক্ষেত্রে আরও বাগড়া দেবেন। অবশ্য পান থেকে চুন খসা নিয়ে যখন তুলকালাম কাণ্ড হয়, তখন পেছনের অসৎ উদ্দেশ্য বুঝতে কারোরই কষ্ট হয় না। বৃহস্পতিবারের টাইমস অব ইন্ডিয়াও বলেছে, প্রস্তাবিত তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরের সব সম্ভাবনা গোরস্থানে পাঠানোর পর মমতা ফারাক্কা নিয়ে হুজ্জতে নেমেছেন।
বস্তুত মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে মমতা বন্দোপাধ্যায় গঙ্গা-তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে যেসব কথা-বার্তা বলে আসছেন, তাতে করে অভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদের আন্তঃসীমান্ত অধিকার নিয়ে আন্তর্জাতিক আইন সম্পর্কে তার ধারণা ইতিমধ্যে প্রশ্নবিদ্ধ। এখন দেখা গেল তার মাথায় চেপে বসা ফারাক্কার ভূত। যদিও ফারাক্কা ব্যারাজ নির্মিত হয়েছিল বাংলাদেশের ন্যায়সঙ্গত অধিকার খর্ব করে; যদিও কয়েক সপ্তাহের "পরীক্ষামূলক" পরিচালনার নামে সাড়ে তিন দশক ধরে পানি প্রত্যাহার চলছে; যদিও উজানের গঙ্গায় আরও হাফ ডজন বাঁধ ও ব্যারাজ নির্মিত হয়েছে; যদিও গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি ও এর বাস্তবায়ন নিয়ে আমাদের অসন্তোষ রয়েছে; মিজ ব্যানার্জি এখনও ফারাক্কাকেই পানি ভাগাভাগির মানদণ্ড মনে করছেন।
অথচ এভাবে পানি প্রত্যাহার ভবিষ্যতের ফর্মুলা নয়, ভূতপূর্ব। কে না জানে যে বিশ্বজুড়েই এখন চলছে অভিন্ন নদীতে অভিন্ন অধিকারের যুগ। তিস্তা নিয়েও পানি বণ্টনের বদলে অভিন্ন ব্যবস্থাপনার দাবি কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ তুলছেন। কেবল কি ফারাক্কার মতো করে ভাগাভাগীর ফর্মুলা? খোদ ফারাক্কা ব্যারাজের ভবিষ্যৎ কী? এই স্থাপনার বার্ধক্যজনিত দুর্বলতা নিয়ে অন্যায্য অবস্থান নেওয়া মুখ্যমন্ত্রীজি কি তা জানেন? গলাবাজী আর গোঁ ধরা ছাড়া নদী বিষয়ে তার জানাশোনার নমুনা তো চোখে পড়ে না। তবে চাইলেই জানতে পারবেন। তিস্তার পানি নিয়ে তিনি যার নেতৃত্বে কমিশন গঠন করেছেন, ফারাক্কা ইস্যুতে রাজ্যের অবস্থান ঠিক করতে যার সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠকে বসছেন, সেই কল্যাণ রুদ্র ফারাক্কার বিষয়ে জানেন সবচেয়ে ভালো। নব্বইয়ের দশক থেকেই এই নদী বিশেষজ্ঞ হুশিয়ারি উচ্চারণ করে আসছেন যে ফারাক্কা ব্যারাজ অকেজো হয়ে পড়তে পারে। এ নিয়ে তার তথ্যসমৃদ্ধ অথচ সুখপাঠ্য একটি বই- গঙ্গার ভাঙন কথা- আমি কিনেছিলাম ২০০৩ সালে কলকাতা বইমেলা থেকে। এখন দেখছি বইটি বাংলাদেশের বাজারেও পাওয়া যায়। আগ্রহীরা আজিজ সুপার মার্কেটে খোঁজ নিতে পারেন।
ওই বইয়ে তো বটেই, কল্যাণ রুদ্র এবং আরো অনেকের সমীক্ষাতেই ফারাক্কার বিবর্ণ ভবিষ্যতের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি পরিষ্কার- প্রমত্ত গঙ্গার বুকে আজদাহা স্থাপনা তৈরির কারণে উজানে অস্বাভাবিক উচ্চতায় পানি জমছে। ২০০৫ এর জুনে ট্রেনে করে ফারাক্কা পার হওয়ার সময় বেদনার সঙ্গে দেখেছি, উজানে টইটম্বুর পানি, জমে থাকতে থাকতে নিলচে হয়ে গেছে। আর ভাটিতে হাড্ডিসার নদীতে চরাঞ্চল আর ঘোলা জলের মাখামাখি। প্রকৃতি এর প্রতিশোধ নিচ্ছে। গঙ্গা বছরে যে সাতশ' মিলিয়ন টন পলি বহন করে, স্রোত না থাকায় তার তিনশ' টনই ফারাক্কা পয়েন্টে জমা হচ্ছে তলানি হিসেবে। উচ্চতা বাড়ছে গঙ্গাবক্ষের। ওদিকে গঙ্গা থেকে পানি টেনে নেওয়ার মাধ্যম ভাগীরথী নদীবক্ষের উচ্চতাও বাড়ছে। কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, ভাগীরথি এক পর্যায়ে গঙ্গার চেয়ে উচু হয়ে যেতে পারে। এই পরিস্থিতির অনিবার্য ফল- প্রবল ভাঙনে মালদহ-মুর্শিদাবাদ এলাকার মাইলকে মাইল চলে যাচ্ছে গঙ্গার গর্ভে। বিপদ কেবল ভূমি ও ভূমিপুত্রদের নিঃস্ব হওয়াতেই সীমাবদ্ধ নয়। গঙ্গা ভাঙতে ভাঙতে তার সমান্তরালে প্রবাহিত নদী পাগলার কাছাকাছি চলে গেছে। ফারাক্কার উজানে দুই নদীর ব্যবধান ২০০৫ সালে জেনেছিলাম এক কিলোমিটারের মতো, এখন নাকি ১০০ মিটারও নয়। যদিও কর্তৃপক্ষ ভাঙন ঠেকানোর নানা কসরত করছে, গঙ্গা-পাগলার মিলন সুপ্রভাতের অপেক্ষামাত্র। তাহলে ভাগীরথীতে ঠেলে দেওয়া গঙ্গার মূল স্রোত ফারাক্কা এড়িয়ে পাগলা-মহানন্দা হয়ে অর্ধ শতকের বন্দিদশা কাটিয়ে পদ্মায় ফিরতে পারে।
হাজার বছরের ইতিহাসে গঙ্গা বেশ কয়েকবারই গতিপথ বদল করেছে; মমতার মতো রাজনীতিকদের মাথা এবং নিজের বুকের ওপর থেকে ফারাক্কার ভূত ঝেড়ে ফেলতে তার পুনরাবৃত্তিতে ক্ষতি কী?
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১২ সকাল ১১:২৭