[পূর্ব প্রকাশের পর]
৩
ভোর হচ্ছে হচ্ছে, ঠিক এই সময় ঘুম থেকে জেগে উঠলাম আমি। পর্দা সরিয়ে তাকালাম আশেপাশে। বৃষ্টি মনে হয় এইমাত্র থেমে গিয়েছে, কারণ সবকিছুকেই লাগছে ভেজাভেজা। পূবের মেঘগুলো দ্রুত একদিক থেকে ভেসে যাচ্ছে আরেকদিকে। ওগুলোর চারপাশে দিয়ে ঠিকরে পড়ছে ভোরের আলো। এক মুহূর্তে ভয়ঙ্কর লাগছে আকাশটাকে, আরেক মুহূর্তে মনে হচ্ছে তা নয়। তা আসলে নির্ভর করছে কিভাবে আমরা তা দেখি এর উপর।
সুষম গতিতে মহাসড়ক ধরে এগিয়ে চলেছে বাস। কানে আসছে চাকার মৃদু গুঞ্জন। ওখানেও এক স্থির ছন্দ। ইঞ্জিনের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। ইঞ্জিনের গুঞ্জন শুনে মনে হচ্ছে যেন কোনো মর্টার মেশিন মসৃণ গতিতে গুঁড়ো করছে সময় আর বাসে থাকা লোকদের চেতনাকে। অন্য যাত্রীরা তাদের সিটের ভিতর ডুব মেরে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ওদের জানালার পর্দাগুলোও সব তটেনে দেওয়া। জেগে আছি কেবল চালক মহাশয় আর আমি। অসাড় কিন্তু ঠিকঠাক গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চলেছি আমরা।
হঠাত তৃষ্ণা অনুভব করলাম। আমার ব্যাকপ্যাকের পকেট থেকে মিনারেল পানির বোতল বের করে এক ঢোক খেলাম কুসুম কুসুম গরম পানি। পকেট থেকে বের করলাম সোডা ক্র্যাকারের একটা বাক্সও। খানিকটা নিয়ে মজা করে চিবুতে লাগলাম। আমার ঘড়িতে সময় দেখাচ্ছে ৪:৩২। নিজেকে নিরাপদে রাখতে সপ্তাহের বার ও তারিখটা চেক করলাম। বাড়ি ছেড়েছি তের ঘণ্টা হতে চলল। সময় তো বয়ে চলেছে স্বাভাবিক গতিতেই। এখনও সময়টা আমার জন্মদিনের মধ্যেই আছে। এখনও তা আমার ব্র্যান্ড নিউ জীবনের প্রথম দিন। চোখ বুজে আবার খুলে দিলাম। ঘড়িতে আবারও চেক করে দেখলাম সময় আর তারিখটা। রিডিং লাইটটা চালু করে, একটা পেপারব্যাক বই বের করে পড়তে শুরু করলাম এরপর।
পাঁচটার ঠিক পরে, কোনো সতর্কবার্তা ছাড়াই মহাসড়ক থেকে নেমে রাস্তার পাশের বিশ্রামের স্থানে এসে থামল বাসটা। বাতাসের হিঁসহিঁস শব্দ তুলে খুলে গেল সামনের দরজাটা। ভিতরে আলো জ্বলে উঠল আর বাস চালক সংক্ষিপ্ত ঘোষণা দেওয়ার মতো করেই বলল, “সুপ্রভাত সবাইকে। আশা করি ভালোই হয়েছে আপনাদের বিশ্রাম। আমাদের স্ক্যাজিউল অনুসারে এক ঘণ্টার ভিতরই আমরা পৌঁছে যাব আমাদের চূড়ান্ত গন্তব্যস্থল তাকামাতসুতে। এখানে বিরতি দিলাম ২০ মিনিটের জন্য। ৫:৩০’র দিকে রওয়ানা দেব আবার। আশা করি এর আগেই আপনারা কাজ সেরে ফিরে আসবেন।’
ঘোষণা শুনে জেগে গেল বেশিরভাগ যাত্রীই। ঘুমের ঘোরে, হাত পা টানটান করে প্রস্তুত হয়ে হাই তুলতে তুলতে বাস থেকে নেমে গেল তারা। এখানে থেমেই তাকামাতসুর জন্য লোকেরা নিজেদেরকে ভালো করে ফিটফাট করে নেয়। নেমে গেলাম আমিও। গভীর করে কয়েকবার শ্বাস নিয়ে ভোরের নির্মল বাতাসে হাত-পা টান টান করে একটু স্ট্রেচিং করে নিলাম। পুরুষদের বাথরুমে গিয়ে মুখে ছিটিয়ে দিলাম কিছু পানি। ভাবছিলাম কোথায় আছি। বাইরে গিয়ে তাকালাম চারপাশে। বিশেষ কিছু চোখে পড়ল না। কেবল মহাসড়কের পাশের রাস্তার চিরচেনা দৃশ্য। হয়তো আমি একটু কল্পনাপ্রবণ। তবে পাহাড়ের আকৃতি আর গাছপালার রঙ টোকিওর থেকে মনে হলো ভিন্ন।
ক্যাফেটেরিয়ার ভিতর বসে আমি আরামসে ফ্রি গরম চা উপভোগ করছি। তখনই এই তরুণী এসে আমার পাশের প্লাস্টিকের সিটে বসে পড়ল। তার হাতে ভেন্ডিং মেশিন থেকে কেনা কফি। কাগজের কাপ থেকে ধোঁয়া উঠছে। তার বাম হাতে ধরা একটা ছোট্ট কন্টেইনার, যেটার ভিতরে স্যান্ডউইচ। দেখে মনে হচ্ছে এটাও কেনা ভেন্ডিং মেশিন থেকে।
তার বেশভূষা বা দর্শন বেশ মজার! চেহারায় কোনো ব্যালেন্স বা সুসমতা নেই। চওড়া কপাল, বোতামের মতো নাক, দাগপড়া চোয়াল আর খাড়া কান। সবকিছু মিলিয়ে এমন রুক্ষ চেহারা যা আপনি চাইলেও এড়িয়ে যেতে পারবেন না। তারপরও মোটের উপর দেখে খারাপ লাগছে না। দেখে মনে হচ্ছে নিজের লুক নিয়ে উদ্বিগ্ন নয় সে। নিজে যা, তা নিয়েই স্বাচ্ছন্দ্য। সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। তবে ওর চেহারার ভিতর এমন শিশুসুলভ একটা ভাব রয়েছে, যেটাকে আমার কাছে মনে হলো প্রশান্তিদায়ক কিছু। খুব লম্বা নয় সে, কিন্তু পা গুলো দেখতে ভালোই। আর হালকা-পাতলা শরীরের তুলনায় বেশ বড় বুকটা ।
ডুরালুমিনের মতো ঝিকমিক করতে লাগল তার ধাতব কানের ঝুমকাটা। কাঁধ পর্যন্ত ছড়ানো গাঢ় বাদামী চুল। রঙ করা এই চুলে কিছুটা লালাভ ভাব। পরনে চওড়া স্ট্রাইপওয়ালা, বড় হাতার ক্রো-নেক শার্ট। এক কাঁধে ঝুলছে ছোট একটা চামড়ার ব্যাকপ্যাক। ঘাড়ে জড়িয়ে আছে পাতলা একটা সোয়েটার। তার বাকি শরীর ঢেকে রেখেছে একটা ক্রীম কালারের একটা মিনিস্কার্ট। অবশ্য কোনো মোজা বা টাইটস পরেনি সে। বোঝা গেল, কেবলই মুখ ধুয়েছে সে। ভেজা চুলের পাতলা আস্তরণ লেগে আছে তার কপালে। অবাক করার মতো বিষয় হলো, সেই আলগা চুলের গোছাই তার দিকে টানল আমাকে।
“আপনি বাসেই ছিলেন, তাই না?’ আমাকে জিজ্ঞাসা করল সে। একটু হাস্কি মার্কা মানে কর্কশ তার কণ্ঠ।
“হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন।”
কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে ভ্রুকুটি করল সে। “বয়স কত আপনার?”
“সতের,” মিথ্যা বললাম আমি।
“তাহলে আপনি এখন হাই স্কুলে পড়ছেন।”
মাথা ঝাকালাম আমি।
“যাচ্ছেন কোথায়?”
“তাকামাতসু।”
“আমিও,” বলল সে। “বেড়াতে যাচ্ছেন, নাকি আপনি সেখানে থাকেনও?”
“বেড়াতে যাচ্ছি,” জবাব দিলাম।
“আমিও, ওখানে আমার এক বন্ধু থাকে। আমার এক মেয়েবন্ধু। আপনার?”
“আত্মীয়।”
আচ্ছা, যেন মাথা ঝাকিয়ে বলল সে। আর কোনো প্রশ্ন করল না এই ব্যাপারে। “আপনার মতো বয়সের এক ছোট ভাই আছে আমার।” হঠাৎ করেই বলল সে। যেন সেটা তার হঠাৎ করেই স্মরণে এসেছে। “অনেক কিছুই ঘটে গিয়েছে...আর আমরা একে অপরকে অনেকদিন দেখিনি...আপনি কি জানেন? আপনাকে দেখে অনেকটা ওর মতোই লাগে। কেউ কি কখনো সেটা বলেছে আপনাকে?”
“কার মতো?”
“জানেনই তো, যে ছেলেটা ওই ব্যান্ডে গান গায়! যখনই বাসে আপনাকে দেখলাম, মনে হলো আপনি ওরই মতো দেখতে। কিন্তু ওর নামটা মনে করতে পারলাম না আমি। মনে করার অনেক চেষ্টা করলাম। কখনও কখনও এরকমটা হয়, তাই না? তা প্রায় জিবের ডগায় চলে আসে, তবে মনে আসে না। কেউ কি আগে আপনাকে বলেছে – আপনি কারো কথা স্মরণ করিয়ে দেন?”
মাথা নাড়লাম আমি। কেউই বলেনি আমাকে। এখনও আমার দিকে চোখ সরু করে তাকিয়ে রয়েছে সে। “কোন ধরনের ছেলের কথা বলছেন আপনি?” জানতে চাইলাম।
“একজন টিভির ছেলে।”
“টিভিতে দেখায় এমন কেউ?”
“হ্যাঁ,” হ্যাম স্যান্ডউইচটা তুলে তাতে বিচ্ছিরি এক কামড় দিতে দিতে বলল সে। এরপরই গলা ভিজিয়ে নিলো কফিতে চুমুক দিয়ে। “যে ছেলেটা একটা ব্যান্ডে গান করে। ডার্ন – মনে হয় এটাই ব্যান্ডের নাম। লম্বা এই ছেলেটা কথা বলে কানসাই উচ্চারণে। কার কথা বলছি, তা কি বুঝতে পারছেন না?”
“সরি, টিভি দেখি না আমি।”
ভ্রুকুটি করে আমার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে চাইল সে। “একেবারেই দেখেন না?”
ধীরে ধীরে মাথা নাড়লাম আমি, যাতে হ্যাঁ বা না কিছুই বোঝায় না।
“আপনি কথা বলেন না খুব বেশি, তাই না? একবারে বলেন না একটা বাক্যের বেশি। এটাই মনে হয় আপনার স্টাইল। সবসময়ই কি আপনি এরকম চুপচাপ?”
একটু লজ্জা পেলাম। শুরুতে কম কথাই বলি। কিন্তু আংশিকভাবে এর কারণ হলো। আমি বুঝতে দিতে চাই না আমার গলা বেশ খানিকটা ভাঙ্গা। বেশিরভাগ সময় অবশ্য আস্তেই কথা বলি আমি। তা জোরে করতে গেলে তীক্ষ্ণ কিঁচকিচ ছাড়া কিছুই বেরোয় না। তাই ছোট করে, সুন্দর করেই সবকিছু সারতে চাই।
“যাই হোক,” চালিয়ে গেল সে। “আসলে সেই কানসাই উচ্চারণের গায়কের সাথে অনেকটাই মিলে যায় আপনার লুক। যদিও কানসাই উচ্চারণ বা এরকম কিছুই আপনার নেই। কেবল আপনার ভিতর এমন কিছু আছে যা ওর সাথে মিলে যায়। ও আসলে খুব ভালোই একটা ছেলে।”
এক মুহূর্তের জন্য তার হাসিটাকে একটু বেখাপ্পা লাগল, তবে তা আবার হয়ে গেল স্বাভাবিক। আর আরক্ত হয়েই থাকল আমার গালটা। “”যদি আপনি চুলের ধরনটা বদলে ফেলতেন, তবে আরও বেশি মিল থাকত ওর সাথে,” বলল সে। “আর একটু বড় হলে, এতে যদি জেল লাগিয়ে একটু খাড়াখাড়া করতেন। ওতে ভালোই লাগবে আপনাকে। চেষ্টা করলে আমিও ওরকম করে দিতে পারব আপনাকে। আসলে...আমি একজন হেয়ারড্রেসার।”
মাথা ঝাকিয়ে আমি চা পিলে চললাম। ক্যাফেটেরিয়াটা একেবারেই নিরব। যেমনটা থাকে, তেমন ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিউক ভেসে আসছিল না। আমাদের দুজনের গলা ছাড়া পাওয়া যাচ্ছিল না আর কারো আওয়াজ।
“মনে হচ্ছে কথা বলতে আপনার ভালো লাগছে না?” একহাতের উপর মাথাটা ভর দিয়ে আর আমার দিকে সিরিয়াস একটা লুক দিয়ে বলল সে।
“মাথা নাড়লাম আমি। “না, তেমন কিছু না।”
“মানুষের সাথে কথা বলতে কি খারাপ লাগে আপনার?”
আরেকবার মাথা নাড়লাম আমি।
সাথে থাকা আরেকটা স্যান্ডউইচটা উঁচু করল সে। এটা হ্যাম বা শুকরের মাংসের নয়, স্ট্রবেরি জ্যামের। এরপর আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রুকুটি করল। চোখে যেন অবিশ্বাসের দৃষ্টি।
“আমার বদলে এটাকে কি খাবেন আপনি? স্ট্রবেরি জ্যামের স্যান্ডউইচ খুবই বাজে লাগে আমার। সেই ছোটবেলা থেকেই।”
তার হাত থেকে নিলাম ওটা। যদিও আমার পছন্দের খাবারের তালিকায় শীর্ষ দশে অবশ্যই নেই স্ট্রবেরি জ্যাম স্যান্ডউইচ। কোনো কথা না বলেই খেতে থাকলাম।
টেবিলের অন্যপাশ থেকে একেবারে শেষ টুকরো পর্যন্ত আমার খাওয়াটা দেখতে লাগল সে। “আমাকে কি একটু সাহায্য করবেন?” বলল সে।
“একটু সাহায্য?”
“আপনি তাকামাতসু যাওয়া পর্যন্ত আমি কি আপনার পাশের সিটে বসতে পারি? একা একা বসে থাকা আমার ভালো লাগে না। মনে হয় অচানক কোনো মানুষ আমার পাশে বসে আছে। ঘুমোতে পারি না আমি। টিকিট কেনার সময় ওরা আমাকে বলল, সব সিটই নাকি সিঙ্গেল। কিন্তু উঠে দেখলাম সব সিটই ডাবল। আপনাকে ভালো একজন মানুষ বলেই মনে হচ্ছে। কিছু মনে করবেন এতে?”
“সমস্যা নেই।”
“ধন্যবাদ,” বলল সে। “যাত্রাপথে পেয়েছি একজন সঙ্গী’ যেমনটা বলা আছে আরকি!”
মাথা ঝাকিয়ে গেলাম আমি। মনে হলো এতেই আমি দক্ষ। কিন্তু কি আর বলতে পারি আমি?
“শেষে কি আছে ওটার?” জানতে চাইল সে।
“কোনটার শেষে?”
“সঙ্গীর পরে? আমার মনে পড়ছে না। জাপানিতে খুব একটা ভালো নই আমি।”
“জীবনে আছে অনেক চৌরঙ্গি,” বললাম।
“‘যাত্রাপথের পেয়েছি একজন সঙ্গী, জীবনে আছে অনেক চৌরঙ্গি’,” বিড়বিড় করল সে। যদি তার কাছে কাগজ আর পেন্সিল থাকত, আশ্চর্য নয় যে সে তা লিখে ফেলত। “তাহলে এর অর্থটা কী? সহজভাবে বললে?”
আমি বিষয়টা এড়িয়ে যেতে চাইলাম। কিন্তু ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করে গেল সে।
“আমার মতে,” অবশেষে বললাম আমি। “সামনে বিভিন্ন সুযোগ আমাদের এগিয়ে যেতে বাধ্য করে। সহজ অর্থ এটাই।”
কয়েক মুহূর্ত ঝিম মেরে বসে রইল সে। এরপর ধীরে ধীরে টেবিলের উপর হাতদুটো নামিয়ে এনে কিছুক্ষণের জন্য ওভাবেই রেখে দিল। “মনে হয় ঠিকই ধরেছেন – সামনের বিভিন্ন সুযোগ আমাদেরকে এগিয়ে যেতে বাধ্য করে।”
ঘড়ির দিকে তাকালাম। ইতোমধ্যে ৫:৩০ বেজে গিয়েছে। “মনে হয় ওঠা দরকার।”
“হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হয়।” বলল সে। তবে ওঠার কোনো লক্ষণ দেখাল না।
“আচ্ছা, আমরা এখন আছি কোথায়?”
“ধারণা নেই,” বলল সে। গলা উঁচু করে দেখে নিলো চারিদিক। দুলে উঠল তার কানের ঝুমকা। মনে হলো, মহা মূল্যবান কোনো পাকা ফল রয়েছে পড়ে যাওয়ার অপেক্ষায়। “কত বাজে তা থেকে অনুমান করছি, কুরাশিকির কাছাকাছি রয়েছি আমরা। অবশ্য তা কোনো ব্যাপার না। কোনো হাইওয়ে রেস্ট হলো এমন একটা জায়গা যা অতিক্রম করেই আপনাকে যেতে হবে। এখান থেকে সেখানে যেতে। ডান হাতের তর্জনি থেকে বারো ইঞ্চি দূরত্বে বাম হাতের তর্জনীটা রেখে দূরত্বটা বোঝাল সে।
“নামে কি-বা আসে যায়?” বলা চালিয়ে গেল সে। “এখানে আপনি বাথরুম সারতে আর খাবার খেতে পেরেছেন। আর এখানে থাকা ফ্লোরেসেন্ট বাতি আর প্লাস্টিকের চেয়ার, কড়া ম্যাকফি, স্ট্রবেরি জ্যাম স্যান্ডউইচ – সবকিছুই আসলে নিরর্থক। আমরা এসেছি একখান থেকে, যাচ্ছি আরেকখানে। সেটাই জানা দরকার আমাদের, তাই না?’
মাথা ঝাকিয়েই গেলাম আমি।
বাসে উঠে দেখলাম, আমাদের আগেই উঠে বসেছে বাকি সব যাত্রী। চালক বয়সে তরুণ। তার প্রখর দৃষ্টির কথা আমাকে কোনো সদা-সতর্ক পাহারাদারের কথাই মনে করিয়ে দেয়। আমাদের সবার দিকে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকাল সে, কিন্তু বলল না কিছুই। মেয়েটা তার দিকে তাকিয়ে ‘সরি, আমরা দেরি করে ফেলেছি’ ধরনের একটা হাসি ছুঁড়ে দিল। একটা লিভার টেনে দিল ড্রাইভার আর হিসহিস করে বন্ধ হয়ে গেল বাসের দরজা। তার ছোট্ট স্যুটকেসটা নিয়ে এসে আমার পাশের সিটে বসে পড়ল মেয়েটা। মনে হয় কোনো ডিসকাউন্ট প্রাইসে এই অতি সাধারণ স্যুটকেসটা কিনেছে সে। আমি ওটা তার কাছ থেকে নিয়ে তুলে রাখলাম মাথার উপরের র্যাকে। সাইজের তুলনায় দেখলাম ভালোই ওজন ওটার। আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে সিটে হেলান দিয়ে ঘুমোবার প্রস্তুতি নিলো সে। স্থির হয়ে থাকা কত কঠিন, সেটা বোঝাতেই যেন গুঞ্জন তুলে আগে বাড়ল বাস। যেখান থেকে ছেড়ে গিয়েছিলাম, সেখান থেকে আবার পড়া ধরলাম আমার পেপারব্যাক বইটা নিয়ে।
দ্রুত ঘুমে তলিয়ে গেল মেয়েটা। বাসটা বাঁক নেওয়ার সাথে সাথে তার মাথাটা বাড়ি খেতে লাগল আমার কাঁধের সাথে। অবশেষে স্থির হয়ে গেল আমার কাঁধে। মনে হলো আমার কাঁধে মাথা রেখেছে সে। মুখ বন্ধ তার, শ্বাস-প্রশ্বাস পুরোটাই নিচ্ছে নাক দিয়ে। আমার কাঁধকে ছুঁয়ে যাচ্ছে তার ছন্দময় নিঃশ্বাস। তাকিয়ে দেখলাম, তার ক্রো-নেক শার্টের উপর দিয়ে বেরিয়ে এসেছে ব্রায়ের স্ট্র্যাপ। পাতলা, ক্রীম রঙয়ের স্ট্র্যাপ। স্ট্র্যাপের শেষ প্রান্তে থাকা পাতলা সুতোর কাজ করা জায়গাটা আমার কল্পনায় ভেসে উঠল। ওর নিচে থাকা নরম বুকটার ছবিও। আর আমার আঙ্গুলের নিচে তার গোলাপি স্তনের বোঁটাটা। এমন না যে আমি তা কল্পনা করার চেষ্টা করছি। কিন্তু তা না করেও পারছি না। কল্পনা করে যেন শক্ত হয়ে যেতে লাগল আমার পুরুষাঙ্গটা।
তখনই একটা চিন্তা আমার মাথায় খেলে গেল। হতে পারে স্রেফ সম্ভাবনা; কিন্তু হতেও তো পারে এই মেয়েটাই আমার বোন। দুজনের বয়স একেবারে কাছাকাছি। তার এখনকার আজব চেহারা অবশ্য ছবির সাথে মেলে না। কিন্তু এভাবে তো সবসময় সবকিছু মেলানো যায় না। ছবির চেয়ে সামনের মানুষটাকে অনেক সবময়ই লাগে একেবারেই আলাদা। সে তো বললই যে আমার বয়েসি তার একটা ভাই আছে, যাকে অনেকদিন ধরে দেখে না সে। অন্তত, তত্ত্বমতে, সেই ভাইটা তো হতেও পারি আমিও!
তার বুকের দিকে তাকালাম। গোল বুকদুটো ওঠানামা করছে সাগরের ঢেউয়ের মতোই। তা আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে সাগরের বুকে ঝরে পড়া বৃষ্টির কথা। জলযানের ডেকের উপর দাঁড়িয়ে থাকা কোনো একাকী যাত্রী যেন আমি। আর সমুদ্রটাই হলো সে। আকাশটা ধূসর, যা দূর দিগন্তে মিশে গিয়েছে সাগরের সাথেই। সাগর আর আকাশের মধ্যে পার্থক্যই করা মুশকিল! নাবিক আর সাগরের মাঝেও। বাস্তবতা ও হৃদয়ের কর্মপ্রক্রিয়ার মধ্যেও।
আঙ্গুলে দুটো আঙ্গুঠি পড়ে আছে মেয়েটা। যেটার কোনোটাই বিয়ে বা এনগেজমেন্টের রিং না। এরকম সস্তা আঙটি দেখা যায় বুটিক শপের মেয়েদের হাতেই। তার আঙ্গুলগুলো লম্বা, পাতলা, কিন্তু মনে হচ্ছে শক্তিশালী। নখগুলো খাটোই, রাঙানো হয়েছে হালকা গোলাপী রংয়ের নেলপলিশে। তার হাতটা আলতো করে রাখা হাঁটুর উপর। মন চাইল হাত দুটো স্পর্শ করতে। কিন্তু তা করলাম না আমি। ঘুমে আচ্ছন্ন তাকে দেখে মনে হচ্ছে বাচ্চা একটা মেয়ে। ওর চুলের গোছা থেকে বের হওয়া কানগুলো দেখে মনে হচ্ছে আজব কোনো মাশরুমের মতোই।
বইটা বন্ধ করে জানালা দিয়ে বাইরে দৃশ্য দেখতে থাকলাম। কিন্তু দ্রতই, কিছুই বুঝে ওঠার আগে ঢলে পড়লাম ঘুমে।
(চলবে...)
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে এপ্রিল, ২০২০ সকাল ১০:৫৯