শেয়ারবাজার নিয়ে প্রথম আলোর রিপোর্ট্ এবং মাসুমের চ্যালেঞ্জ
শওগাত আলী সাগর
আমাদের বন্ধু শওকত হোসেন মাসুম সম্ভবত: খুবই ত্যাক্ত বিরক্ত। আর সেই বিরক্তিটা তিনি প্রকাশ করেছেন সামাজিক যোগাযোগের নেটওয়ার্ক ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে। মাসুম লিখেছেন,“শেয়ারবাজার নিয়ে প্রথম আলোর রিপোর্টটির জন্য নাকি আমাকে গালি দেয়া হচ্ছে? রিপোর্টটা নাকি সঠিক না? চ্যালেঞ্জ জানালাম। আর দাতা সংস্থার রিপোর্টের ধরণ নিয়ে যাদের কোনো ধারণা নেই তাদের কম কথা বলাই ভাল। না জেনে মন্তব্য বা সিদ্ধান্ত দেয়া খুবই হাস্যকর। প্রায় ২০ বছর সাংবাদিকতা করার পর এখন দেখি কেউ কেউ সংবাদ কী তা শিখায়।“ মাসুমের স্ট্যাটাসটা চোখে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমি তাতে একটা মন্তব্য করি। তখন পর্যন্ত সত্যি বলতে কি, মাসুমের স্ট্যাটাসটাকে হালকাভাবেই নিয়েছিলাম। দ্বিতীয়দফা বক্তব্যটা পড়ার পর ভুল ভাঙলো।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাংবাদিকতায় শওকত হোসেন মাসুমের তারকাখ্যাতি আছে। দেশের সর্বাধিক প্রচারিত জাতীয় দৈনিকের বার্তা সম্পাদক তিনি।কোনো রিপোর্ট বা লেখা নিয়ে ক্ষোভ বিক্ষোভ,হূমকি এমনকি শারীরিক আক্রমনের ঘটনাও বাংলাদেশে নতুন নয়।শেয়ারবাজার নিয়ে প্রথম আলোর সাম্প্রতিক একটি রিপোর্ট নিয়ে বাড়াবাড়ি রকমেরই তোলপাড় হয়েছে। রিপোর্টটির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে, চট্টগ্রামে প্রথম আলোর কপিতে আগুন দেওয়া হয়েছে। এগুলো সবই একধরনের প্রতিক্রিয়া। ঢাকার মিডিয়া জগতের ‘দূবৃত্তায়িত নোংরা রাজনীতি’ প্রতিক্রিয়াটিকে উসকে দিয়েছে, ডিএসইর শাকিল রিজভীর সাক্ষাতকারও পড়েছি পত্রিকায়,সেটিও একই সূত্রে গাথা।
এই সব প্রতিক্রিয়ার বিপরীতে প্রথম আলো সংযত থেকেছে,পেশাদারিত্বের সঙ্গে তাদের খবর পরিবেশন করেছে। পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। কিন্তু পত্রিকাটির বার্তা সম্পাদক যখন সামাজিক যোগাযোগের নেটওয়ার্কে ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে চ্যালেঞ্জ ছুড়েন, তখন পত্রিকাটির নিবিড় একজন পাঠক হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই কৌতূহল বোধ করি।
মাসুমের স্ট্যাটাসটায় কয়েকটা দিক আছে।(১)বিশ্বব্যাংক আইএমএফএর উদ্ধৃতি দিয়ে প্রথম আলোর রিপোর্টটি যে সঠিক তার চ্যালেঞ্জ।(২)’দাতা সংস্থার রিপোর্টের ধরণ নিয়ে যাদের কোনো ধারণা নেই তাদের কম কথা’ বলার পরামর্শ।(৩)’প্রায় ২০ বছর সাংবাদিকতা করার পর এখন দেখি কেউ কেউ সংবাদ কী তা শিখায়’- বলে তার বিরক্তি। তৃতীয় পয়েন্টটিতে মনে হয়েছে,রিপোর্টটি নিয়ে সমালোচনা মাসুম হজম করে উঠতে পারেননি, হয় অতিমাত্রায় উত্তেজিত হয়ে গেছেন নতুবা বিপন্নবোধ করছেন। মাসুমকে বরাবরই শান্ত,ধীরস্থির স্বভাবের বলেই জানি।সে জন্যেই তার এই উত্তেজনা বিস্ময়কর ঠেকছে।
একটা সময় ছিলো দেশের শেয়ারবাজার নিয়ে কোনো রিপোর্ট বা লেখা পত্রিকায় জায়গা পেতে অনেক কাঠ পুড়াতে হতো। এখন সময় বদলেছে। শেয়ারবাজারের রিপোর্ট এখন পত্রিকাগুলোর হটকেক। একসময় বিশ্বব্যাংক- আইএমএফ এর তৈরি করা নানা প্রতিবেদন অনেক পত্রিকারই স্ট্যাটাস সিম্বল হিসেবে বিবেচিত হতো।‘বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ’ শব্দগুলো থাকলেই কোনো কোনো পত্রিকায় নিতান্তই সাদামাটা রিপোর্টও লিড,ব্যানার হেডলাইন হয়ে যেতো্। ‘দাতা সংস্থা’ থেকে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফর ‘উন্নয়ন সহযোগি’ সংস্থা হয়ে উঠার মতোই তাদের রিপোর্টের ‘কদর’ এবং ‘স্ট্যাটাস’ এরও বদল ঘটেছে।আর নাগরিক তথা পাঠকদের সচেতনতাবোধ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বব্যাংক আইএমএফ এর নানা প্রেসক্রিপশনের ‘নিউজ ভ্যালু’ও কমতে কমতে ‘বিরক্তিকর প্যানপ্যানানি’তে রুপান্তরিত হয়েছে। এই সব তথাকতিথ উন্নয়ন সহযোগিদের মতামত,মূল্যায়ন ক্রমশ:ই গ্রহনযোগ্যতা হারিয়েছে তার আরো একটি বড় কারন বোধ হয় এই সংস্থাগুলো সংশ্লিষ্ট দেশের স্বার্থের চেয়েও নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়নকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছে।
‘শেয়ারবাজার বাঁচাতে ব্যাংকের তহবিল :উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদটি যে সঠিক তার চ্যালেঞ্জ দিয়েছেন বার্তা সম্পাদক শওকত হোসেন মাসুম। তিনি এও বলেছেন,’দুটো প্রতিবেদনই তার কাছে আছে।‘ এই ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জে মাসুমই জিতবেন। বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফ এর নিদেনপক্ষে কোনো ‘কাগজ’ হাতে না থাকলে প্রথম আলোর মতো পত্রিকা এই ধরনের সংবাদ পরিবেশন করতো না। তবে সংবাদটির ‘নৈতিক’ জায়গা নিয়ে আমার কয়েকটি কথা বলার আছে। প্রথমত: বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে শুরু করে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মতোই বিশ্বব্যাংক আইএমএফও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরি করে। বাংলাদেশ যেহেতু এই দুটো সংস্থার ‘খদ্দের’ ফলে তাদের আর্থিকখাত সহ বিভিন্নখাত নিয়ে তাদের নানা ধরনের অবস্থানপত্র থাকা স্বাভাবিক।আজকাল অনেক প্রতিবেদন বিশ্বব্যাংক নিজেই মিডিয়ার কাছে সরবরাহ করে। সেগুলো তাদের আনুষ্ঠানিক অবস্থান। এর বাইরে কিছু কিছু প্রতিবেদন তারা সরাসরি সরকারের কাছে পাঠায়।সেগুলো নিতান্তই সংস্থার আর সরকারের অভ্যন্তরীন করসেপন্ডেন্স মাত্র।আর কেবলি নিজেদের জন্যও তাদের কিছু রিপোর্ট তৈরি হয়। অবশ্য সেগুলোতেও যে খবরের উপাদান থাকে না তা নয়। রিপোর্টারের দায়িত্ব যেই নথিটিকে তিনি উদ্ধৃত করছেন সেটি কোন ক্যাটাগরির তা পাঠকদের অবহিত করা।
তবে আলোচ্য রিপোর্টটি নিয়ে নানা কারনেই আলোচনা করার সুযোগ আছে।প্রথম আলোর মতো পেশাদার এবং প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্বশীল একটি পত্রিকায় পরিবেশিত সংবাদ হিসেবে এর বেশ কিছু ক্রুটির দিকও আছে। রিপোর্টটির বিষয়বস্তু- লাখ লাখ বিনিয়োগকারীকে হতাশার অতলে নিমজ্জিত করে প্রায় ডুবতে বসা দেশের শেয়ারবাজার সম্পর্কে সরকারি কিছু পদক্ষেপ সম্পর্কে দুই উন্নয়ন সহযোগির উদ্বেগের আর্ত চিতকার। রিপোর্টটির বড় ব্যর্থতা হচ্ছে ভঙ্গুর শেয়ারবাজারকে বাচাতে অতি বিলম্বে নেওয়া সরকারি কিছু পদক্ষেপের সমালোচনায় দুই সংস্থার বক্তব্যকেই ‘বাইবেল বাণী’ হিসেবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে,কিন্তু দেশজ কোনো বিশেষজ্ঞ দিয়ে এই বক্তব্য যাচাই করে নেওয়া হয়নি। সবাই জানে, আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংক দেশের, জনগনের চেয়েও নিজেদের স্বার্থটাকেই বড় করে দেখে,ফলে সরকারের পদক্ষেপ যখন তাদের উদ্বিগ্ন করেছে,তখন যে কোনো কৌতূহলী রিপোর্টারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে এর কাউন্টার একটি ভার্সন সংগ্রহ করা। কোনো রিপোর্টার হয়তো বলতে পারেন, আমি তো বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট থেকে উদ্ধৃত করেছি, আমার অতো দায় কি? জবাবে বিনীতভাবে বলবো,এটি বিশ্বব্যাংক মিডিয়াতে পাঠায় নি, আপনি সংগ্রহ করেছেন, আর সে কারনেই আপনি এই বক্তব্যের উল্টোপিঠটাও জেনে নেবেন।
এই প্রসঙ্গে সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এমএস কিবরিয়ার সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের একটি টানাপড়েনের কথা উল্লেখ করতে চাই। সে সময়ে ব্যাপক বন্যার পর বিশ্বব্যাংক থেকে বলা হয় নতুন করে কৃষিঋণ বিতরন বন্ধ রাখতে হবে। কারন বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকরা ঋণ শোধ করতে পারবে না। ফলে খেলাপি ঋণ বাড়বে। কিবরিয়া সাহেব বিশ্বব্যাংকের এই প্রস্তাবের বিরোধীতা করে বলেছিলেন, বরং এখনই কৃষকদের ঋণের দরকার। এখন ঋণ না দিলে এই কৃষকদের বাচানো যাবে না। এখন বাংলাদেশের একজন মিডিয়াকর্মী কোন অবস্থানটাকে সমর্থন করবে?
প্রথম আলোর রিপোর্টে আই্এমএফকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে “শেয়ারবাজার এখনো অস্থিতিশীল। শেয়ারের বড় ধরনের দরপতনের আশঙ্কা এখনো রয়ে গেছে।“ আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি আইএমএফ তো নয়ই,ঢাকার নিয়ন্ত্রক বা বড় ধরনের কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানই ‘অন রেকর্ড’ এই বক্তব দেবে না। প্রথমত; পুরো বক্তব্যটিই আতংক ছড়ানোর মতো এবং মূল্যসংবেদনশীল। আইএমএফএর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থা যখন এই ধরনের বক্তব্য দেয় তখন বাজারে সঙ্গতকারনেই বড় ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়। বাস্তবে হয়েছেও তাই। এখানেই রিপোর্টারের জাজমেন্টাল ডিসিশনের প্রশ্ন আসে।বাংলাদেশে সম্ভবত সিকিউরিটজ আইনে মিডিয়ার ব্যাপারে কিছু উল্লেখ নাই, তবে পশ্চিমা দেশগুলোর অনেক জায়গায়ই কিন্তু সিকিউরিটিজ আইন মিডিয়াকে পর্যন্ত তাড়া করতে পারে। এই তথ্য পরিবেশনের ক্ষেত্রে ‘নিউজ ঠিক কি বেঠিক’ সেটি গুরুত্বপূর্ণ নয়, ‘জাজমেন্টাল প্রেজেন্টেশন’ এবং ‘প্রেজেন্টেশনাল অনেষ্টি’ হচ্ছে বিবেচ্য।প্রথম আলো এই বিবেচনা দেখাতে সফল হয় নি।
অর্থনৈতিক সাংবাদিকতা একটি স্পেশালাইজড বিষয়। শেয়ারবাজার সাংবাদিকতা আরো বেশি স্পেশালাইজড। সারা দুনিয়ায়ই শেয়ারবাজারের রিপোর্টারদের শেয়ারবাজার নিয়ে রিপোর্ট করার ক্ষেত্রে প্রচলিত ‘সিকিউরিটিজ আইন’কে মাথায় রাখতে হয়। বাংলাদেশই সম্ভবত একমাত্র ব্যতিক্রম যেখানে কোনো আইন বা বিধি বিধানকে পাত্তা না দিয়েও সাংবাদিকতা করা যায়।