আসাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র , জীবনের সব ধাপে প্রথম বিভাগে উর্ত্তীর্ণ। প্রাইভেট চাকরিতে আজ প্রায় আট-দশ বছর ধরে কাজ করছে। যে গতিতে শিক্ষাজীবনের সবকটি ধাপে এগিয়ে ছিল তার চেয়ে অনেক ধীর গতিতে তার ক্যারিয়ার এগুচ্ছে। প্রায়ই হতাশায় আচ্ছন্ন থাকে মন । স্থির করতে পারে না কি করবে- সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। সরকারি, কর্পোরেট , ব্যাংকিং, জব এবং বিদেশ যাওয়া সব কিছুর পেছনে সময় ব্যয় করতে করতে নির্দিষ্ট কোনো জায়গায় স্থির হতে পারেনি। তারই আরেক বন্ধু জিয়াদ কোনোরকমে টেনে টুনে বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পেরিয়েছে। এখন একটি প্রাইভেট কোম্পানির উচ্চ পদে কর্মরত। উচ্চ বেতনের সাথে সাথে ব্যক্তিগত গাড়িসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে । এরকম হাজারো আসাদ এবং জিয়াদের গল্প ছড়িয়ে -ছিটিয়ে আছে বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে। এই দুইজনের পার্থক্যটা আসলে তৈরী হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই। জিয়াদ পড়াশুনাটা কোনোরকম চালিয়ে গেছে- সাথে সাথে বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ডে জড়িত ছিল এবং বিভিন্ন ধরনের প্রোগ্রামের অর্গানাইজার ছিল। যার ফলে সে বিভিন্ন ধরনের মানুষের সাথে পরিচিত হ্ওয়ার সুযোগ পেয়েছে, তাদের সাথে কাজ করার সুযোগ পেয়েছে । যেটা তার জড়তা কাটাতে সহযোগিতা করেছে এবং একেকটা প্রোগ্রাম অর্গানাইজ করতে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রতিকূলতা টপকে সেটাকে সফল করতে গিয়ে সে অটোমেটিকেলি অনেক প্রায়োগিক জ্ঞান অর্জন করেছিল- যেটা তার চাকরি জীবনে সে কাজে লাগাতে পেরেছে। এ ব্যাপারগুলোয় আসাদ এবং জিয়াদের চাকরি জীবনে তাদের মধ্যে বিরাট পার্থক্য তৈরী করে দিয়েছে। যে জিনসিগুলো জিয়াদ ছাত্র-জীবনে হাসতে - খেলতে শিখে নিয়েছে সেটা আসাদকে কর্মক্ষেত্রে এসে কষ্টের সাথে মানিয়ে নিয়ে শিখতে হয়েছে। শিক্ষাজীবন আর কর্মজীবন যে এক নয় সেটা বুঝানোর জন্য কোনো আলাদা প্রতিষ্ঠান নেই এবং সেটার কোনো প্রয়োজনও নেই। এরজন্য দরকার বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই একজন শিক্ষার্থীকে প্রায়োগিক শিক্ষাদান। প্রতিবছর আমাদের দেশে সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে ডাক্তারী, ইঞ্জিনিয়ারিং, কৃষি, বিবিএ, এমবিএ এবং বিভিন্ন বিষয়ের উপর অনার্স, মাষ্টার্স করা শিক্ষার্থী তাদের শিক্ষাজীবন শেষে কর্মজীবনে প্রবেশ করছে। তাদের অনেকেরই একাডেমিক পোর্টফলিওটা অনেক সমৃদ্ধ কিন্তু বাস্তব কাজের নেই কোন প্রাতিষ্ঠানিক অভিজ্ঞতা। উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেহেতু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পার্ট-টাইম জবের ব্যবস্থা চালু আছে তাই তারা শিক্ষাজীবন থেকেই জবের সাথে পরিচিত। আমাদের মতো দেশে যদিও কিছু কিছু পার্ট-টাইম জব আছে কিন্তু এখনও সেটা সীমিত ঢাকা এবং বিভাগীয় শহর পর্যায়ে। এখন আসা যাক প্রায়োগিক শিক্ষাটা যেভাবে বিশ্ববিদ্যালয় দিতে পারে সে প্রসংঙ্গে। যেহেতু বাংলাদেশ ধীরে ধীরে ইন্ড্রাস্ট্রিয়ালাইজেশনের দিকে ঝুকছে এবং অর্থনীতির উন্নয়নের জন্য ইন্ড্রাস্ট্রিয়ালাইজেশনের কোনো বিকল্প নেই, সেজন্যই ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল সেক্টরে ডেভেলপ করতে পারলে সামগ্রিক অর্থনীতির একটা শক্ত ভিত তৈরী হবে।
আর ইন্ড্রাস্ট্রির মানেই হচ্ছে মেশিনারিজ আর যার অপারেশন থেকে শুরু করে প্রডাক্টটিভিটি, রক্ষণাবেক্ষণের সাথে ্ওতপ্রোতভাবে বিভিন্ন ক্যাটাগরির প্রকৌশলীরা জড়িত - যার মধ্যে যান্ত্রিক, বিদ্যুৎ, টেক্সটাইল, প্রডাকশন ইঞ্জিনিয়ারের সংখ্যাটাই বেশি। আর একজন যান্ত্রিক , টেক্সটাইল, প্রডাকশন বা বিদ্যুৎ প্রকৌশলীর স্বভাবতই চাকরি করতে হয় ফ্যাক্টরী লেভেলে। এসব প্রকৌশলীরা স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় থাকাকালীন যে পরিবেশে , এবং যে চিন্তা ধারায় জীবন অতিবাহিত করেছেন - ফ্যাক্টরীতে চাকরি করতে এসে সেটার সাথে খাপ খাওয়ানো তাদের কাছে কিছুটা কষ্টকরই বটে। বাংলাদেশে বেশিরভাগ টেকনিশিয়ান থেকে শুরু করে দক্ষ শ্রমিক সবাই হয় অশিক্ষিত না হয় অর্ধ-শিক্ষিত। এসব অশিক্ষিত - অর্ধ শিক্ষিত লোকদের নিয়েই একজন প্রকৌশলীর কর্ম পরিচালন, কর্মধারা প্রয়োগ সবই করতে হয়। বছরের পর বছর এসব টেকনিশিয়ানরা একই কাজ করতে করতে দক্ষ হয়ে উঠে- যাকে বলে গাইতে গাইতে গায়েন । এদের মগজ, চিন্তাধারায় নতুন কোন বিষয় যেমন কাজ করে না তেমনি কোনো কিছু ঢুকানোও যায় না। উপরন্ত এসমস্ত লোক দীর্ঘদিন লোহা-লক্কর নিয়ে কাজ করতে করতে একরকম যান্ত্রিক মানবে পরিণত হয়। থীওরিটিক্যালি এব্যাপারে কোনো সমাধানে য্ওায়ার সহজ উপায় নেই- যা করতে হয় সেটা উদ্ভুত পরিবেশ - পরিস্থিতি বিবেচনা এনে কাজ করতে হয়। সদ্য পাশকৃত যেকোন প্রকৌশলীর জন্য যেটা একটা বিশাল চাপই বটে- যার জন্য প্রয়োজন অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান। এইতো গেল একটা দিক। এবার আসা যাক আরো কিছু ব্যাপার নিয়ে। ফ্যাক্টরীর ইউটিলিটি - বয়লার, জেনারেটর এবং বিভিন্ন ধরনের ইন্সট্রমেন্ট যেগুলো নিয়েই একজন ফ্যাক্টরী ইঞ্জিনিয়ারের কাজ করতে হয়। একাডেমিক সিলেবাসে হয়তো বয়লার, জেনারেটর এবং বিভিন্ন ধরনের ইন্সট্রমেন্টের প্রকারভেদ, ব্যবহারবিধিসহ বিভিন্ন থ্ওীরীটিক্যাল বিষয়ের সন্নিবেশে ইন জেনারেল সব বিষয়ের আলোকপাত থাকে - যেটা অবশ্যই প্রয়োজনীয়। কিন্তু কিভাবে বয়লার লাইসেন্সিং, জেনারেটর লাইসেন্সিং , নতুন গ্যাস লাইন সংযোগ, ইন্সট্রমেন্ট ক্যালিব্রেশন করতে হয় , কোথায় গিয়ে করতে হয়, কি কি ডকুমেন্টের প্রয়োজন - টোটাল প্রসিডিউরটা একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনে না তার জানার ইচ্ছে থাকে, না তাকে শেখানোর কোনো ব্যবস্থা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় আছে। যার ফলে এসব বিষয়ে সদ্য পাশকৃত একজন প্রকৌশলীকে গোড়া থেকে শুরু করতে হয়- যেজন্য শুরুতে সে তার কাজের বিরাট একটা সময় এ কাজে ব্যয় করে। এ বিষয়গুলো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একাডেমিক সিলেবাসে থ্ওীরী ক্লাসের পাশাপাশি সংযুক্ত করতঃ যা একজন শিক্ষার্থীর প্রায়োগিক জ্ঞান বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে এবং ভবিষ্যত কর্মজীবনে তারা উপকৃত হবে। এবার আসা যাক আরেকটি বিষয়ে- ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে, অপারেশন ম্যানেজমেন্ট, ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল ম্যানেজমেন্ট প্রভুত সাবজেক্ট আছে যেখানে বিভিন্ন ধরনের স্ট্যান্ডাইজেসন এবং এসবের অথরিটির ব্যাপারে আলোচনা থাকে। একাডেমিক সিলেবাসে যদি এসব স্ট্যান্ডাইজেসন অথরিটির সাথে শিক্ষার্থীদের সরাসরি যোগাযোগ করিয়ে দেয়া যায় তাহলে কর্মক্ষেত্রে খুবই সহজে যা এধরনের কাজে ডকুমেন্টেশনসহ এ সংক্রান্ত কাজে অনেক সহায়ক হবে। আমরা সবাই কমবেশি ওঝঙ সনদের ব্যাপারে জানি। এ জানাকে আরোকটি বিস্তুৃত করে আমাদের ইন্ড্রাস্ট্রি লেভেলে কি ধরনের ওঝঙ সনদ নেয়া হয় এবং কিভাবে তারা এর ইমপ্লিমেন্টেশন করে - এসব পাঠ্যক্রমে ব্যবহারিক হিসেবে অর্ন্তভুক্তি শুধু ব্যক্তি পর্যায়ে নয় সামষ্টিকভাবে দেশেরই উপকার হবে। আমাদের দেশে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াশুনাটা অনেকটাই ম্যানুকফ্যাকচারিং ইঞ্জিনিয়ারিং রিলেটেড। যেহেতু আমাদের দেশে ম্যানুফ্যাকচারিং প্লান্ট সে আকারে নেই প্রায় নবীন প্রৃকৌশলীদের কাজ করতে হয় মেইনটেনেন্স ডিপার্টমেন্টে- যেটা আরেকটা গোলকধাধা। এটা একটা হাত-পা বেধে নদীতে ঝাপ দেওয়ার মতো অবস্থা। আসলে শিক্ষাটা হ্ওয়া উচিৎ কর্মক্ষেত্র কি সেটার উপর বিবেচনা করেই। ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সপ্তাহ দুয়েক ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল এটাচমেন্ট বলে একটা ব্যবহারিক বিষয় আছে যেটা আসলে খুবই অপর্যাপ্ত। প্রয়োজনে ডাক্তারির মতো ইঞ্জিনিয়ারিংয়্ওে একটা ইন্টার্নী সিস্টেম চালু করা উচিৎ- যেটা তিন মাস, ছয় মাস বা এক বছর মেয়াদী হতে পারে। সর্বশেষ একটি অতি গুরুত্বপূর্ন বিষয় যেটা আলোকপাত না করলেই নয় - সেটা হলো ইনকাম ট্যাক্স। দেশের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে ইনকাম ট্যাক্সের সীমার মধ্যে আয় হলেই ইনকাম ট্যাক্স দেয়া উচিৎ। অনেক সচেতন নাগরিকই সেটা দিয়ে থাকেন। আমাদের দেশে অনেকের ইচ্ছে থাকলেও শুধুমাত্র কিভাবে ইনকাম ট্যাক্স দিতে হয়, কিভাবে ই-টিন খুলতে হয় এসব বিষয় না জানা এবং এটা নিয়ে একটা ভীতির কারণে আয়কর দেন না। শুধুমাত্র একটা সিদ্ধান্তই দেশের আয়কর দাতার সংখ্যা বাড়িয়ে দিতে পারে কয়েকগুণ। প্রত্যেকটা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্যেক সাবজেক্টে আয়কর নিয়ে ২০-২৫ নম্বরের একটা ব্যবহারিক ক্লাসের বাধ্যতামূলক করে দিতে হবে। কেউ যখন জানবে কখন তাকে আয়কর দিতে হবে, কোথায় দিতে হবে, আয়কর দিলে কি কি সুবিধা প্ওায়া যায় এবং এই আয়করের টাকা দিয়ে সরকার কি করে তখন অবশ্যই আশা করা যায় সে আয়কর দিতে উৎসাহী হবে। এ ধরনের হাজারো ছোট ছোট ব্যাপার আছে যেগুলোর প্রায়োগিক শিক্ষাই হল আসলে যুগোপোযোগী শিক্ষা। শিক্ষা ব্যবস্থাটাকে কেরানী টাইপ থেকে কর্মমুখী শিক্ষা-ব্যবস্থা ই রুপান্তর করতে পারলেই দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন সহজতর এবং দ্রুত হবে। একটা জাতির উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা এবং সে সংক্রান্ত দীর্ঘ মেয়াদি প্লানিং না থাকলে তার অর্থনীতি সাময়িক ফুলে-ফুপে উঠলেও চোরাবালির মতো একসময় তা তলানির দিকেই চলে যাবে।
পুনশ্চঃ লেখাটার ব্যাপারে পাঠকদের মতামত আশা করছি।