গ্রীক মিথের নাম শুনলে যাদের মাথার নাট বল্টু লড়চড় শুরু করে তাদের জন্য আজকের এই পুষ্ট।।
গ্রীক মিথের উৎপত্তির কারণঃ
আপনি যদি প্রাচীন গ্রিকের একজন কৃষক হতেন তবে আপনার জীবনধারণের পদ্ধতি সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করত প্রাকৃতিক লীলাখেলার উপর। যে ফসল আপনি উৎপাদন করবেন তার জন্য দরকার হত সূর্যের আলো আর পর্যাপ্ত পরিমাণে বৃষ্টি । মাঝে মাঝে ঝড়ো বৃষ্টি আর বিদ্যুৎএর চমক আপনাকে ভীত করে তুলত। যখন আপনি রাতের আকাশের দিকে দৃষ্টিপাত করতেন , আপনি অন্ধকার আকাশে ঝিকমিক করা ছোটছোট তারকাগুলো দেখে বিস্মিত হতেন । আপনি জানতেন বছরের নির্দিষ্ট একটা সময় বৃষ্টি হবে, নির্দিষ্ট একটা সময় বন্যা হবে। একটা সময় শীত আসবে, সব ফসল বাদামী হয়ে উঠবে এবং এক সময় মারা যাবে। আবার নির্দিষ্ট একটা সময় ফসলে ফসলে সবুজ হয়ে উঠবে মাঠ।
এখন বলুন এসব প্রাকৃতিক ঘটনাসমূহকে আপনি কিভাবে ব্যখ্যা করবেন?
গ্রীকরা বসবাস করত আজ থেকে অনেক অনেক বছর আগে, যখন আজকের দিনের মত বিজ্ঞানের এতদূর অগ্রগতি হয়নি। তাদের কাছে এসব ঘটনা সমূহ ছিল এক একটি রহস্য। আজকে আমরা জানি এসব ঘটনার পিছনের কারণ। কিন্তু তারা এসব প্রাকৃতিক ঘটনা সমূহকে মনে করত এক একজন দেব-দেবীর শক্তির বহিঃপ্রকাশ। প্রাচীন গ্রীকরা অসংখ্য দেব দেবীতে বিশ্বাসী ছিল। এসব দেব-দেবীরাই হচ্ছে গ্রীক মিথলজির প্রাণ।
মিথলজি কি?
সোজা কথায় মিথলজি হচ্ছে এমন ধরণের গল্পকাহীনি যাতে কেবল দেব-দেবী এবং সমাজের বীরপুরুষদের কাহীনি বর্ণিত যা প্রাকৃতিক ঘটনা সমূহের পিছনে তাদের শক্তি বর্ণনা করে এবং প্রাকৃতিক ঘটনা সমূহের ব্যাখ্যা দেয়। প্রত্যেকটি মিথ বা গল্প প্রাকৃতিক অথবা ঐতিহাসিক ঘটনা সমূহের পিছনের কারণ বর্ণনা করে। এক কথায় দেব-দেবীদের নিয়ে যেকোন কাহীনিই হচ্ছে মিথ আর এ সম্পর্কিত বিদ্যা বা পড়ালেখাকে মিথলজি বলে।
গ্রীক দেব-দেবী পরিচিতিঃ
আজকের যুগে বন্যা, ঝড়, জলোচ্চ্বাস, বিদুৎচমকের কারণ বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে আমরা জানি। আমরা জানি এসব ঘটনা কেন ঘটছে। কিন্তু প্রাচীন গ্রীকের লোকেরা এসব ঘটনা সমূহকে সম্পূর্ণভাবে বিভিন্ন কল্পিত দেব-দেবীদের হস্তক্ষেপ বলে মনে করত। এবং তারা তাদের ঈশ্বরদের কৃতকর্মের ব্যখ্যা দিতে মিথ তৈরী করত। প্রাচীন গ্রীক মিথলজিতে অসংখ্য দেবদেবীর পরিচয় পাওয়া যায়। তার মাঝে প্রধান ১২ জন দেবতাকে অলিম্পিয়ান্স বলা হয় তা মোটামুটি সবাই জানি।
অলিম্পিয়ান্সদের পরিচিতিঃ
কোন আজাইর্যা প্যাচালে যামু নাহ খালি ১২জন অলিম্পিয়ান্সদের কাজের বিবরণ দিব। তাদের বংশলতিকায় গেলে বহুত কাহীনি চলে আসবে, ওদিকে অন্যকোনদিন যাব।
০১।জিউসঃ ০১।
জিউস হলেন মহাদেব বা দেবতাদের দেবতা অর্থাৎ সব দেব-দেবীর রাজা এবং অলিম্পাস পর্বতের সম্রাট। তিনিই মিথলজির প্রধান দেবতা। রোমানরা তাকে জুপিটার বলে ডাকে।
০২।হেরাঃ
হেরা জিউসের বোন এবং স্ত্রী অর্থাৎ দেবতাদের রাণী। তিনি বিবাহ ও পরিবারের দেবী। রোমানরা ডাকে জুনো।
০৩।পোসেইডনঃ
সমুদ্রের, ভুমিকম্পের এবং ঘোড়ার দেবতা। রোমানরা ডাকে নেপচুন।
০৪।ডিমেটারঃ
কৃষীর দেবী। একইসাথে জমির উর্বরতা, মৌসুমের প্রভাব, প্রকৃতি তিনিই নিয়ন্ত্রণ করেন। রোমানরা ডাকে চেরেস।
০৫।এথেনাঃ
জ্ঞানেরদেবী এবং হস্তশিল্প, প্রতিরক্ষা এবং কৌশলগত যুদ্ধবিগ্রহের দেবী। তিনি একজন কুমারী দেবী। রোমানরা ডাকে মাইনেরভা।
০৬।এপোলোঃ
সূর্যের দেবতা। এছাড়াও আলো, জ্ঞান, সঙ্গীত, কবিতা, ভাববাণী এবং ধনুর্বিদ্যার দেবতা।
০৭।আর্তেমিসঃ
চাঁদের দেবী। এছাড়াও শিকার, সতীত্ব, প্রসব, ধনুর্বিদ্যা, চাঁদ, এবং সমস্ত প্রাণীর দেবী । রোমানরা ডাকে ডিয়ানা।
০৮।আরেসঃ
যুদ্ধ, হত্যা, মারামারি খুনোখুনির দেবতা। রোমানরা ডাকে মার্স বলে।
০৯।এফ্রোদিতঃ
ভালবাসা ও সৌন্দর্যের দেবী। রোমান মিথে তাকে ভেনাস ডাকা হয়।
১০।হেফাসথুসঃ
লৌহকর্মের দেবতা। রোমানরা ডাকে ভলকান বলে।
১১।ডাইওনাইসাসঃ
উৎসবের দেবতা। রোমান মিথে তাকে বাচ্ছুস বলে ডাকা হয়। এবং
১২।হার্মেসঃ
বার্তাবাহক দেবতা। এবং ব্যাবসা বাণিজ্য ও চোরের দেবতা।রোমান দের কাছে তিনি মার্কারী নামে পরিচিত।
পারলে নামগুলা মুখস্ত করে ফেলুন। অনেক জায়গায় দেখবেন এই চরিত্রগুলো দ্বারা নামকরণ করা হয়।
আরো দুজন গুরুত্বপূর্ণ দেবতা হলেন,
হেডসঃ
পাতালের দেবতা।
হেসটিয়াঃ
আগুনের কুমারী দেবী।
মিথলজি এবং দেব-দেবীঃ
গ্রীকরা দেখত তাদের চারপশে দেবদেবীদের বিভিন্ন কৃতকর্ম। যেমন, গ্রীকরা এমন একটি উপত্যকায় বসবাস করত যেখানে আগ্নেয়গীরির অগুৎপাত ছিল খুব সাধারণ ঘটনা। এ অগুৎপাতের ঘটনা ব্যখ্যার্থে তারা লৌহকর্মের দেবতা হেফাসথুস কে নিয়ে গল্প বানালো। গ্রীকরা বলত যেসব আগুন এবং লাভা আগ্নেয়গীরি থেকে নিক্ষিপ্ত হয় তা দেবতা হেফাসথুসের কামারশালা থেকে বের হচ্ছে। এই কামারশালায় তিনি অন্য দেবতাদের জন্য অস্ত্র ও সরঞ্জামাদী তৈরী করেন।
কামারশালায় হেফাসথুস।
গ্রীকরা বিশ্বাস করতনা যে দেবতরা সবসময় দূর্যোগ তৈরীতে ব্যাস্ত। তারা বিশ্বাস করত যে তারা তাদের দৈনন্দিন জীবনের কার্যগুলিও তৈরী করে।
উদাহরণ হিসেবেঃ তারা বিশ্বাস করত কৃষীর দেবী ডিমেথার মৌসুমী আবহাওয়া সৃষ্টি করে। গ্রীক মিথ অনুযায়ী, ডিমেথারের একজন কন্যা ছিল যে অন্য দেবতা কর্তুক অপহৃত হয়েছিল। হতাশ দেবী দেবতার কাছে তার কন্যাকে ভিক্ষা চাইলেন, এবং শেষ পর্যন্ত দেবতা রাজী হল তার মায়ের কাছে তাকে প্রত্যেক ৬ মাস অন্তর অন্তর প্রেরণে। শীতকালে, ডিমেথার তার কন্যা থেকে আলাদা থাকে। এসময় সে তার কন্যাকে অনেক মিস করত (এই যায়গায় এসে বাধ্য হলাম আমি একটা পোষ্ট দিতে। কোন বাংলা যুতসই শব্দই পেলাম না লাইনটাকে পুর্ণ করতে। ) তার দুর্দশার কারনে তিনি এই মৌসুমটায় কোন ফসল জন্মাতে দিতেন নাহ। যখন তার মেয়ে ঘরে আসে, দেবী তখন অনেক অনন্দিত থাকেন এবং গ্রীচে গ্রীষ্ম আসে। গ্রীকদের কাছে, এই গল্প ব্যখ্যা করত কেন প্রত্যেক বছর পর্যায়ক্রমে শীত এবং গ্রীষ্ম আসে।
ডিমেটার তার কন্যার আগমনের অপেক্ষায়।
তাই দেবতাদের সন্তুষ্ট রাখার নিমিত্তে, গ্রীকরা গ্রীচব্যাপী বিরাট বিরাট মন্দির স্থাপন করা শুরু করল। যাইহোক, প্রত্যুত্তরে তারা কেবল এই আশা করত যে দেবতারা তাদের প্রয়োজনে তাদের সাহায্য করবে। উদাহরন হিসেবে বলা যায়, অনেক গ্রীকদের গ্রীচের প্রাণকেন্দ্র ডেলফিতে উপদেশ গ্রহন করতে যেত। সেখানে তারা দেবতাদের সাথে কথা বলত। একজন মহিলা ঋষী এপোলোর প্রতিনিধি হিসেবে তাদের সাথে কথা বলত এবং তারা ভাবত দেবতা তাদের উত্তর দিয়েছেন। ডেলফির দৈববাণী এতটাই শ্রদ্ধেয় ছিল যে, গ্রীক রাজনীতিবিদরা প্রায় কিভাবে শাসন কার্য পরিচালনা করতে হবে সে সম্পর্কে ঐ মহিলাকে জিজ্ঞেসা করত।
গ্রীচ জুরে ছড়িয়ে থাকা মন্দির।
গ্রীক মিথলজির নায়কেরাঃ
গ্রীক মিথলজির সব মিথ কেবল যে দেব-দেবীদের নিয়েই রচিত তা নয় বরং তাদের অনেক গুলোই গ্রীক বীরপুরুষদের বিভিন্ন অভিজান বর্ণনা করে। এসব বীরপুরুষদের কেও কেও ছিল বাস্তব কেও আবার কাল্পনিক। গ্রীকরা সেসব বীরদের কাহীনি বর্ণনা করতে পছন্দ করত যাদের বিশেষ ধরনের ক্ষমতা থাকত , যারা ভয়ংকার দানবের মুখোমুখি হয়েছিল। প্রত্যেক নগরে তাদের নিজস্ব এলাকার বীর পুরুষ ছিল। উদাহরণ স্বরূপ, এথেন্সের লোকদের ছিল বীর থিসিউস। গল্প অনুযায়ী তিনি ক্রিটের পথে রওনা দিয়েছিলেন এবং অর্ধ মানব অর্ধ ষাঁড় রুপী ভয়ংকর দানব মাইনোটরকে হত্যা করেছিলেন।
উত্তর গ্রীকের মানুষেরা জ্যাসন কে নিয়ে গল্প বলে।
সম্ভবত গ্রীকবীরদের মাঝে সবচেয়ে জনপ্রিয় হলেন হারকিউলিস। মিথ ব্যাখ্যা করে কিভাবে হারকিউলিস এতগুলো দানবের সাথে লড়াই করেছিল এবং কিভাবে প্রায় অসম্ভব একটি কাজ সম্ভব করেছিল। যেমন, সর্পচুল বিশিষ্ট নয় মাথাওয়ালা হাইড্রাকে তিনি হত্যা করেছিলেন। প্রত্যেকবার হারকিউলিস দানবীর একটা মাথা কাটেন, কাটা স্থান থেকে দুইটি মাথা বের হয়। (জীববিজ্ঞানের হাইড্রার নামকরণ এ কারণেই হাইড্রা করা হয়েছে কারণ হাইড্রাকে যতই টুকরা করা হক না কেন প্রত্যেক টুকরা থেকে নতুন আরেকটা হাইড্রা জন্ম নেয়)
সর্বশেষে, হারকিউলিস হাইড্রার ঘাড় পুড়িয়ে দেন যাতে নতুন করে মাথা বের হতে না পারে।
গ্রীকের সর্ব শ্রেণীর মানুষেরা এসব গল্প দারূন উপভোগ করত।
বিঃদ্রঃ অনেকেই হয়ত গ্রীক মিথের এসব ঘটনা ও চরিত্র সম্পর্কে জানেন। যারা জানেন না বা কম জানেন তাদের জন্যেই এটি লেখা।। কেও যদি গ্রীক মিথ সম্পর্কে সামান্য ধারণাও পায় তাতেই আমি আমার পরিশ্রম সার্থক বলে মনে করব।
মিথ নিয়ে আরেকটি পোস্টঃ নীরব নিলয় ফিচারিং থিসিউস, একটি প্রাচীন গ্রীক মিথোলজির গল্প
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ সকাল ১০:১৬