somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

“ ভালোবাসার এবর্শন”

২২ শে এপ্রিল, ২০১৬ রাত ৯:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


মিথিলা আমার চাচাতো ভাইয়ের মেয়ে। সেই সুত্রে মিথিলা আমার ছোট বেলার বেস্ট ফ্রেন্ড বলা যায়। শুধু বেস্ট ফ্রেন্ড বললে ভুল হবে হয়তো, সে আসলে আমার জীবনের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ।
হুট করে ফোনটা ভাব্রেট করে কেপে উঠলো।আমি স্যারের পার্মিশন না নিয়েই ক্লাস রুম থেকে বের হয়ে আসলাম, ফোনটা পিক করতেই ওপাশ থেকে আন্টির কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলাম। কান্না জড়ানো কন্ঠে আন্টি আমাকে দ্রুত হাসপাতালে যেতে বললেন।
আমি মুহুর্তেই হাসপাতালের দিকে ছুটলাম।
হাসপাতালের সপ্তম তলায় লিফট এর বাম পাশের ৭১১ নাম্বার কেবিনটা মিথিলার। কেবিনের বাইরের সারি করা চেয়ারগুলোর একটিতে মাথায় হাত দিয়ে মাথা নিচু করে বসে আছেন আংকেল। আমি আস্তে করে উনার পিঠে হাত রেখে ডাকলাম, “আংকেল, ঠিক আছেন”?
আমি অবাক হয়ে লক্ষ করলাম মানুষটা কাদছেন। তিনি আমার দিকে মাথা তুলে তাকালেন, তার চোখগুলো লাল টকটকে হয়ে আছে, একজোড়া অশ্রুশিক্ত চোখ আমার দিকে অসহায়ের মত তাকিয়ে আছে, আমিও হতভম্ব হয়ে আছি, আমি নিজেও যে স্তব্দ হয়ে গেছি। হঠাৎ করে আংকেল আমার হাতগুলো জড়িয়ে নিয়ে হুহু করে কেদে উঠলেন, “আমার মেয়েটার এ কী হয়ে গেল রে আশিক? আমার মেয়েটার এ কী হয়ে গেল? কিসের পাপের এই সাজা পাচ্ছি বলতে পারিস”?
প্রশ্নগুলো শুধু শুনেই গেলাম কোন জবাব খুজে পাইনি আমি।
কেবিনে ঢুকতেই মিথিলা আমার দিকে তাকিয়ে অশ্রুসিক্ত চোখে হেসে দিলো। আন্টি আমার পাশ কাটিয়ে মুখে শাড়ির আচল চেপে ধরে বাইরে চলে গেলেন। আমি জানি আন্টিও এখন বাইরে গিয়ে আংকেল এর মত অঝোর ধারায় অশ্রু বিসর্জন দিবেন।
মিথিলার হাসিটা ক্রমেই বিষাদময় হয়ে উঠলো। এক সময় তার চেহারায় কষ্টের আসল ছাপটা ফুটে উঠলো। মিথিলা কাপা কাপা ঠোটে আমার বললো,
-আশিক…।
-হুম, বল।
-পাশে বসবিনা? খুব ঘেন্না হচ্ছে না রে আমার উপর?
-এসব কি বলছিস স্টুপিড? বাজে কথা একদম বলবিনা।
আমি মিথিলার মাথার কাছে গিয়ে বসতেই মিথিলা খপ করে আমার হাতটা ধরে ফেললো, হাতটা ধরেই আবার বলল,
-আশিক…
-বল। শুনছি।
-জানিস? আমার বাবুটা অনেক কিউট ছিল রে। আলট্রাসনোগ্রামের সময় আমাকে ডাক্তার দেখিয়েছিল বাবুটাকে, এট্টুকুন এট্টুকুন হাত-পা গুলো। কত্ত কিউট। জানিস আশিক, আমি প্রতি মুহুর্তেই ফিল করতাম সে আমার ভেতরে তার এট্টুকুন শরীরটুকু নিয়ে নড়ছে, আমি খুব বেশি ফিল করতাম রে। আমার খুব ইচ্ছা করছিল বাচ্চাটাকে রেখে দেই, সে আমার পেটে বড় হবে, একসময় সে পৃথিবীর মুখ দেখবে, আমি তার এট্টুকুন হাত পা গুলো ছুয়ে দিবো আলতো করে, তাকে কোলে নিয়ে সকালে ছাদে দাঁড়িয়ে সুর্যের আলো নিবো, তার সাথে কথা বলবো, অনেক কথা বলবো। তার বাবার কথা অবশ্য বলতাম না কখনো, কারন সে তো একটা শয়তান, বিয়ের আগেই বাচ্চাটাকে পেটে দিয়ে কেমনে ভেগে গেল। আশিক স্বপ্নগুলো এমন কেন রে? এভাবে কেন সব শেষ হয়ে যায় রে? আশিক তুই কি বলতে পারিস বাবার পরিচয় ছাড়া কি বেঁচে থাকা যাই না?
কথাগুলো বলেই হুহু করে কেদে উঠলো মিথিলা। হ্যা, দুনিয়ার সবচেয়ে করুন পরিনতির স্বীকার আজ মিথিলা, তার এবর্শন হয়েছে, মাস তিনেক আগে তথাকথিত অবৈধ সম্পর্কে জড়ানোর জন্য সে প্রেগনেন্ট হয়, তারপর ছেলে হারিয়ে যায়, সামাজিক সম্মান রক্ষার্থে কাউকে না জানিয়ে তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে।
মিথিলার কস্ট গুলো পুরোপুরি ফিল হয়তো করতে পারছিলাম না, কিন্তু কেন জানি তবুও বুকটা ফেটে যাচ্ছিল। তার প্রতিটা কথাই কানে বেজে যাচ্ছে। প্রতিটা প্রশ্ন বারবার রিপিট হচ্ছে, কিন্তু কোন উত্তর নাই।
মিথিলা আবার বলতে শুরু করলো,
-আশিক, আমার বাবুটা কি আমাকে ক্ষমা করবে? বলতে পারিস? কিরে!! কিছু বলছিস না কে? ক্ষমা করবে আমার বাবুটা আমাকে?
-মিথিলা তুই প্লিজ কথা বলিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে, সব। প্লিজ তুই ঘুমানোর ট্রাই কর। আমি তোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।
এই বলে আমি মিথিলার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম, সে আস্তে করে তার চোখগুলো বন্ধ করলো। আমি দেখতে পেলাম একটা অসহায়, পরাজিত, নিথর দেহ কেবিনের বেডে পড়ে আছে। সদা চঞ্চল, হাসি-খুশি মেয়েটি এই কয়েকদিনেই যেন কতটা বুড়িয়ে গেছে। হঠাৎ আমার চোখগুলো কেন জানি ঝাপসা হয়ে এল। হাত দিয়ে বুঝতে পারলাম, চোখে পানি এসে গেছে। অদ্ভুদ হয়ে গেছে ফিলিংস গুলো। নিজেই কান্না করি অথচ নিজেই বুঝিনা।
মিথিলা ঘুমিয়ে আছে প্রায় আড়াই ঘন্টা হলো, আমি স্টিল তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। আমার একটা হাত এখনো তার দুই হাতে চেপে ধরে আছে। ইতিমধ্যে আংকেল-আন্টিও কেবিনে এসে বসেছেন। আমি ভয়ে তাদের দিকে তাকাচ্ছিনা, যদি আমার কান্নাটা তারা দেখে ফেলেন। অদ্ভুদ হয়ে গেছে ফিলিংস গুলো। বড্ড জ্বালাচ্ছে আজকাল।
রাত আটটা বাজে। ঘুম থেকেই হঠাত তীব্র কাশি শুরু হলো মিথিলার। কয়েকটা কাশি দিতেই সে নেতিয়ে পড়লো প্রায়, আমি খেয়াল করলাম সাদা বেড কভারটা নিমিষেই লাল হয়ে গেছে। আমি ডাক্তার ডাকার জন্য উঠতে চাইলে দেখলাম মিথিলা আমার হাতটা এখনো শক্ত করে টেনে ধরে আছে, তার চোখগুলো ইশারা করছে বসতে। আংকেল তা বুঝতে পেরে আমাকে বসতে বলে নিজেই ডাক্তার কে ডাকতে ছুটে গেলেন।
হঠাত মিথিলা আমার হাতটা ঝাকি দিয়ে খুব কষ্ট জড়ানো কন্ঠে আমাকে বললো,
-আশিক…
-মিথিলা, প্লিজ চুপ কর। প্লিজ চুপ কর না রে, তুই অসুস্থ। প্লিজ রে।
-আশিক, কাদিস না মেয়েদের মত। শুধু আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিবি প্লিজ? উত্তরটা তোকে দিতেই হবে।
-বল।
-আমার বাবুটা এখন নিশ্চয় বেহেস্তে আছে নারে?
-হ্যারে রে। সে তো দুনিয়ার মুখও দেখেনি, মাত্র তিনমাস বয়স, আল্লাহ তাকে নিজের কাছে টেনে নিবেন।
-আর আমি মরলে তো সোজা দোজখে যাব। আশিক, আমি কি আমার বাবুটাকে দেখতে পাবোনা? মরার পরেও না? আশিক আমার খুব কস্ট হচ্ছে রে। কেন আমি তাকে মেরে ফেললাম? আশিক কিছু বল প্লিজ।
মিথিলা হঠাত করেই চুপ করে গেল। ডাক্তার এসে গেছেন, হাতের পালস চেক করলেন, স্টেথোস্কোপ লাগিয়ে তিনি মাথা নিচু করে নিলেন। আমাদের বুঝার বাকী থাকলোনা কিছুই। আন্টির দিকে তাকাতেই দেখলাম তার চোখে শ্রাবণের ধারা বইছে আর মুখে এক অপরিচিত হাসি। হয়তো সব ঝামেলা শেষ হয়ে যাওয়াই এক তৃপ্তির হাসি না কি অন্যকিছু???
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে এপ্রিল, ২০১৬ রাত ৯:১৬
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ্‌ সাহেবের ডায়রি ।। পৃথিবীকে ঠান্ডা করতে ছিটানো হবে ৫০ লাখ টন হীরার গুঁড়ো

লিখেছেন শাহ আজিজ, ৩১ শে অক্টোবর, ২০২৪ রাত ৯:০২




জলবায়ূ পরিবর্তনের ফলে বেড়েছে তাপমাত্রা। এতে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। তাই উত্তপ্ত এই পৃথিবীকে শীতল করার জন্য বায়ুমণ্ডলে ছড়ানো হতে পারে ৫০ লাখ টন হীরার ধূলিকণা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

অচেনা মানুষ আপনাদের দীপাবলীর শুভেচ্ছা

লিখেছেন আজব লিংকন, ৩১ শে অক্টোবর, ২০২৪ রাত ১০:২১



আমারই বুকে না হয় শিবেরই বুকে
নাচো গো... ও নাচো গো...
পবন দা'র গলায় ভবা পাগলার গানটা কারা জানি ফুল ভলিউমে বাজিয়ে গেল। আহ.. সে সুরের টানে বুকের মাঝে সুখের... ...বাকিটুকু পড়ুন

কোরআন পড়বেন, ফিকাহ জানবেন ও মানবেন

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৭:০০



সূরাঃ ৯৬ আলাক, ১ নং থেকে ৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
১। পাঠ কর, তোমার রবের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন
২।সৃষ্টি করেছেন মানুষকে ‘আলাক’ হতে
৩। পাঠ কর, তোমার রব মহামহিমাম্বিত
৪। যিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্নমর্যাদা!

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৩

রেহমান সোবহান একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তার বাড়ি থেকে বিদ্যালয়ের দূরত্ব প্রায় ৬ কিলোমিটার। রেহমান সাহেব এমন একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন যা খুব নির্জন এলাকায় অবস্থিত এবং সেখানে যাওয়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। অ্যাকসিডেন্ট আরও বাড়বে

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৫৯



এরকম সুন্দরী বালিকাকে ট্র্যাফিক দায়িত্বে দিলে চালকদের মাথা ঘুরে আরেক গাড়ির সাথে লাগিয়ে দিয়ে পুরো রাস্তাই বন্দ হয়ে যাবে ।
...বাকিটুকু পড়ুন

×