বর্তমান পরিস্থিতিতে আশঙ্কাজনকহারে চারপাশে মানুষ মৃত্যুবরণ করছেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমার ফ্রেন্ডলিস্টে প্রতিদিন অগণিত মানুষ ও তাঁদের আত্মীয় মৃত্যুবরণ করছেন। আমার ধারণে সবার ক্ষেত্রেই এটি ঘটছে। একথা দ্ব্যর্থহীনভাবে সত্য, প্রতিদিন বা প্রতি মাসেই দুর্ঘটনা বা অস্বাভাবিক কারণ বাদ দিলে স্বাভাবিক কারণে বেশ কিছু মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। সেটি আসলে খুবই নগণ্য সংখ্যক হয়ে থাকে, যেটা আবহমান কাল থেকে সবসময়ই হয়ে আসছে। তাঁদের কথা বাদই দিলাম না হয়। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতে সকল মৃত্যুর কথা শুনে এক্ষেত্রে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, তারা প্রত্যেকেই কি স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন?
একজন পাব্লিক হেলথ কর্মী হিসেবে আমার কাছে মনে হচ্ছে বর্তমানে চারপাশে যে মৃত্যু হচ্ছে তা অনেকাংশেই করোনা ক্রাইসিসের সাথে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে জড়িত বা কোন না কোন ভাবে করোনা সম্পর্কিত। হয়তোবা এটি সম্পূর্ণ আমার ব্যক্তিগত ধারণা, কিন্তু, আশা করি, সবাই এর সাথে একমত পোষণ করতে বাধ্য হবেন। 'করোনা সম্পর্কিত' বলতে, কয়েকটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করতে পারি,
১। করোনায় আক্রান্ত হয়ে, বা করোনা স্যাম্পল পজিটিভ হয়ে। (যেটি বাস্তবিক হিসাব মতে, আসলে মোট মৃত্যুবরণের খুবই ক্ষুদ্র একটি অংশ)। এই অংশটিই মৃত্যুহারের মাঝে ধরা হচ্ছে।
২। আরেকটি অংশ আছে যারা করোনা'র কোন উপসর্গ না দেখা দেয়ার ফলে, অ্যাসিম্পটিম্যাটিক থাকছেন। ফলে জানাও যাচ্ছেনা, তারা করোনা পজিটিভ, কিন্তু পরে করোনাতেই মারা যাচ্ছেন।
৩। এছাড়াও বিরাট একটি সংখ্যক মানুষ মারা যাচ্ছেন, যাদের আসলেই করোনা হয়নি, কিন্তু করোনা আক্রান্ত হবার বর্তমান পরিস্থিতিতে মৃত্যুভয় ও সাইকোলজিকাল ডিপ্রেশনের প্রেসারে।
৪। মৃত্যুর পর মৃতদেহ থেকে সময় মত স্যাম্পল কালেকশনে বিলম্ব ও প্রসিডিউরাল ফেইলিওর এর জন্য। যার ফলে, করোনা আক্রান্ত হয়েও তারা মূল মৃত্যুহার বা ডেথ ডাটার মাঝে ইনক্লুড হচ্ছেননা।
৫। কিংবা করোনা সাসপেক্ট ভেবে অন্য রোগে (যেমন, হৃদরোগ, শ্বাসনালীর প্রদাহ, স্ট্রোক, ডায়বেটিস রিলেটেড শক প্রভৃতিতে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিতে অনিচ্ছা বা ট্রিটমেন্ট এর জন্য বিলম্ব বা অভাবে।
সত্যিকার অর্থে, এই অংশ নিতান্তই কম নয়, বরং বেশিই বৈকি।
মৃত্যুহার ৫%, ১০% যতই থাকুক না কেন- আমাদের সকলের এটা মনে রাখতে হবে কোন পরিবারে যদি একজনও মারা যায় তাদের ক্ষেত্রে এটি ১০০% ই ক্ষতি। সংখ্যা দিয়ে মৃত্যুহার বিচার না করাই ভালো। এজন্য আমাদের এই ১০০% ক্ষতি প্রিভেন্ট করতে নিজেরই এগিয়ে আসতে হবে।
আমরা নিজেরা যেটা করতে পারি সেটা হচ্ছে:
* যতটা পারা যায় বাসার বাইরে প্রয়োজন না থাকলে বের না হওয়া। কিংবা একান্তই প্রয়োজনে বের হলে খুব স্ট্রিক্টলি সোশ্যাল ডিস্ট্যান্স মেনটেন করা, পাব্লিক প্লেইস এড়িয়ে চলে ও প্রটেকশন গ্লাভস, মাস্ক ব্যবহার করে চলা।
* আর বাসার ভেতর থেকে আমরা যেটা করতে পারি নিজের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কিভাবে বাড়ানো যায় সে নিয়ে কাজ করা
* প্রতিদিন নিয়ম করে খাদ্যাভ্যাস, বিশ্রাম ও কায়িক পরিশ্রম বা এক্সারসাইজের মাঝে ব্যালেন্স করা।
* রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে যেগুলো রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এমন খাদ্য খাওয়া যেমন প্রোটিন, ভিটামিন-এ-সি-ডি-ই, খনিজ পদার্থ ক্যালসিয়াম জিংক সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া। এবং তা খেতে হবে স্বাভাবিক থেকে কিছুটা অতিরিক্ত পরিমাণে।
* তাছাড়া কিছু ন্যাচারাল ইমেজ ইমিউন বুস্টার উপাদানগুলো যেমন মধু কালোজিরা এসব অল্প হলেও সেবন করা।
* নিয়মিত ৩০ মিনিটের মত ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করা যাতে শরীরের নর্মাল মেটাবলিজিম ঠিক থাকে।
* দৈনিক কমপক্ষে সাত থেকে আট ঘণ্টা বিরামহীন বিশ্রাম বা ঘুম।
* দৈনিক আড়াই থেকে তিন লিটার বিশুদ্ধ পানি পান এবং সম্ভব হলে উষ্ণ পানি পান করা।
* বয়স্কদের প্রতি বাড়তি দৃষ্টি দেওয়া।
* ব্যক্তিগত অভ্যাস পরিবর্তন বিষয়ে তথা ঘন ঘন প্রবাহমান পানির নিচে কমপক্ষে ২০ সেকেন্ড ধরে সাবান, হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে হাত ধোয়া বা স্যানিটাইজার ব্যবহার, কাশি হাঁচি দেয়ার সময় টিস্যু বা কনুইয়ের ভাঁজের ব্যবহার - এসব নিয়ে সকলেই এখন কম-বেশি জানেন। তাই এসব নিয়ে বলে কথা বাড়ালাম না।
বর্তমান এই মৃত্যুর মিছিলে এখন আসলে আল্লাহর উপর নির্ভর করতে হবে প্রবলভাবে। যেহেতু এখন পর্যন্ত, কোন দেশেই এই রোগের পরিপূর্ণ সুস্পষ্ট প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি, এগুলো নিয়ে ঘাটাঘাটি বা অন্ধভাবে না জেনে অনুসরণ না করে নিজে সচেতন হয়ে বেঁচে থাকাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা। Allah Helps Those Who Help Themselves। 'আল্লাহ কোনো জাতির ভাগ্য পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না সেই জাতি নিজেই নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করে'" (সুরা রাদঃ ১১)
আমরা জাতিগতভাবে নির্বোধ, কিন্তু নিজে যেন এই নির্বুদ্ধিতায় সামিল না হই। সবাই যে যা করুক, সরকার যে ডিসিশন দিক, তা নিয়ে মাথা আমরা কম ঘামাই। সরকারের দায়িত্ব সরকার করুক। আপনার দায়িত্ব আপনার। নিজের দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হবে। নিজেকেই সচেতন থাকতে হবে। নিজেকেই নিজের জীবনের জন্য কষ্ট করতে হবে।
ব্যক্তির সমন্বয়েই পরিবার, সমাজ এবং জাতি।
ব্যক্তি বাঁচলে পরিবার বাচবে,
পরিবার বাঁচলে সমাজ বাঁচবে,
সমাজ বাঁচলে, বাঁচবে জাতি।
-ডা. আবীর শাকরান মাহমুদ
সহকারী বিমান বন্দর স্বাস্থ্য কর্মকর্তা,
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর, ঢাকা।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মে, ২০২০ রাত ১০:৩৪