একজন ক্ষুধার্ত মানুষ তৃপ্তি সহকারে খাচ্ছে, জগতে এরকম সুন্দর দৃশ্য খুব কমই আছে- হুমায়ুন আহমেদ স্যার।
জগতে আসলেই এমন সুন্দর দৃশ্য খুব কম আছে। ইনফ্যাক্ট আমি নিজেই অনেকদিন তৃপ্তিসহকারে খাইনা। আমার সমস্যাটা অভাবের জন্য না, ব্যাচেরল জীবনে সব সময় তৃপ্তি সহকারে খাওয়ার সুযোগ হয়না। তো যাই হোক মূল ঘটনায় আসি। হুমায়ূন ভক্ত হিসেবে তার বেশকিছু উক্তির মত এই উক্তিটাও মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি। মাঝে মধ্যে চেষ্টা করি সীমিত সাধ্যে এরকম দৃশ্য দেখার। সৌভাগ্য হয় কখনো কখনো।
আমার বাসার পাশে একটা মাজার আছে ছোটোখাটো। কার মাজার জানিনা, জানার চেষ্টাও করিনা কোনোদিন। মানুষের আনাগোণাও নেই খুব বেশি। প্রতি রাতে ঐ পথ ধরেই আমাকে বাসায় ফিরতে হয়।
এমনই এক বৃষ্টির রাতে বাসায় ফিরছিলাম। রাস্তাঘাট ফাঁকা। চোখ পড়ল মাজার গেটের সিঁড়িতে, একটা ছেলে হাঁটুতে মাথা গুঁজে বসে আছে। পাশেই একজোড়া ক্রাচ রাখা। ছেলেটার উপর চোখ আঁটকে গেল। ওকে ক্রস করে যাবার পরও ফিরলাম কি মনে করে যেন! কাছে গিয়ে ডাক দিলাম। শুনলোনা। আবার একটু জোরে ডাক দিলাম। ছেলেটা হতচকিয়ে তাকালো, ভয়ার্ত এবং বিব্রত চোখ। ছেলেটা আমার বয়সী। পোশাক পরিচ্ছন্ন। ফুলপ্যান্টের সাথে ফুলহাতা শার্ট। চোখে-মুখে বিষন্নতা। আস্তে করে জিজ্ঞেস করলাম, রাতে খাইছৈা? ও মাথা নেড়ে জবাব দিল, খায়নি। আমি বললাম, এখানে থাকো, আমি আসতেছি।
আমার বাসার আশেপাশে কোনো খাবার হোটেল নাই। কাছেই একটা ফাস্টফুডের চেইন শপ আছে। মাঝে মাঝে খোশ মেজাজে থাকলে সেখান থেকে আমি খাবার কিনি। দুই প্যাকেট রুটি কিনলাম, পাশের দোকান থেকে ১২ টা কলা কিনলাম। হিসাব হলো, এক প্যাকেট রুটি আর ছয়টা কলা আমি রাখবো সকালের জন্য। আর এক প্যাকেট রুটি আর বাকি ছয়টা কলা ওর জন্য।
অবাক করা ব্যাপার হলো, রুটির প্যাকেট দিলাম, কলা দেয়ার পর সে কোনোভাবেই ৬ টা নিবেনা। আমি বলতেছি, নাও। ও বলে, না না, একটা কলাতেই হবে। আমি কোনো রকম জোর করে ৪ টা কলা দিলাম। খুব বিব্রত এবং লজ্জিত ভঙ্গিতে সে নিল। চোখে ততক্ষণে পানি চলে আসছে ওর। ওকে বিব্রত না করে দ্রুত আমি চলে আসলাম সেখান থেকে। বুঝলাম, এই পথে সে নতুন। এর পর বেশ কয়েকদিন আমি ওকে একই জায়গায় দেখেছি, খাবার কিনে দিয়েছি। সে চুপচাপ নিয়েছে, বরাবরের মতই লজ্জিত এবং বিব্রব ভঙ্গিতে।
আজ অনেক দিন পর ওকে আবার দেখলাম একই জায়গায়। আজ আর কোনো জড়তা নেই ওর মাঝে। পোশাক-আশাকে পরিচ্ছন্ন ভাবটা নেই মোটেও। দিব্যি মাটিতে বসে আছে। দুই হাতে মানুষের দান গ্রহণ করছে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে। রাস্তায়ও আজকে মানুষজন আছে বেশ। আমি কাছে গিয়ে শুধু জিজ্ঞেস করলাম, রাতে খাইছো? সে আমাকে চিনলো, হাসলো এবং জবাব দিল, না। কাছের ফাস্টফুডের দোকানে গেলাম, মিষ্টি ছাড়া টাটকা কিছু নেই সেখানে। অবরোধের কারণে এই সমস্যা। আমি আবার ফিরে গেলাম ছেলেটার কাছে এবং বললাম, খাবার তো নাইরে, অবরোধ। ও বলল, সমস্যা নাই। আমি সাহায্য যতটুকু করার করে আসলাম।
ফিরতি পথে একটা কথা ভেবেই মন খারাপ হলো খুব, আজকের পর থেকে কারো সাহায্য নিতে ছেলেটা আর কোনোদিনই হয়তো বিব্রত হবেনা। এই জীবনকে সে মেনে নিয়েছে এবং এভাবেই সে অভ্যস্ত হয়ে যাবে। সময়ে মানুষের সবই সয়ে যায় আসলে। জীবনমানকে ডাউনগ্রেড করতে প্রথম প্রথম একটু কষ্ট হয়, বিব্রত হয় মানুষ। কিন্তু একটা সময় পরে মানুষ আপস করতে শেখে নিজের সাথে, বেঁচে থাকার জন্য। নিজের সাথে নিরন্তর আপসের নামই জীবন।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ রাত ১:৩৯