জামশেদ চৌধুরী প্যারেড কর্ণারে চারিপাশে মনিং ওর্য়াকে বেরিয়েছেন বেশ কিছুক্ষণ হল । মুডটা আজ তার বেশ ভালো তবে বেশিক্ষণ রইলো না । নোংরা মানুষটা তার পা মাড়িয়ে দিয়েছে । মুহুর্তের মধ্যে তার স্যান্ডেল ছিটকে পড়ে নালাতে । জামশেদ চৌধুরী বিরক্ত মুখে দিলেন কষে একটা চড় । এক কালের পেটানো এই শরীরের জোর এখনো সাংঘাতিক । চড় খেয়ে হালকা পাতলা মানুষটি ছিটকে পড়ে গেলো । জামশেদ চৌধুরী অবশিষ্ট স্যান্ডেলটিও ফেলে দিয়ে সোজা হাঁটা দিলেন । স্যান্ডেল গেলে যাক এই সব নোংরা মানুষগুলোকে উনি হাঁড়ে হাঁড়ে চেনেন । পরে হয়তো হাতে পায়ে ধরে ভিক্ষা খোঁজা শুরু করবে । ফিরে যাওয়ার সময় এক পলকের জন্য জামশেদ চৌধুরী পিছনে তাকালেন । নোংরা মানুষটি নালা থেকে তার স্যান্ডেলটি তুলছে ।
.
কাকতালীয় ভাবে পড়ে যাওয়া মানুষটির নামও জামশেদ । জামশেদ মিয়ার ঘরে ৫টা মেয়ে ১টা ছেলে । আর ৭ নাম্বারটা যেকোন দিন হতে পারে । সামনে অনেক খরচ । সেজন্য প্রতিদিনই তার কাজে বেরুতে হয় । আজকেও বেরিয়ে ছিল কিন্তু ভূলবশত এক ভদ্র (!) লোকের পায়ে পাড়া দেওয়াতে তার হাসিখুশি মুর্হুতের ছন্দপতন হল ।
.
জামশেদ মিয়া এর আগে বসতবাড়ি বিক্রি করে একখানা মোটর রিক্সা কিনছিলো । ভালোই ইনকাম হচ্ছিল কিন্তু সুখ বেশি দিন কপালে সইলো না । সরকার মোটর রিক্সা তুলে নিবার আদেশ দিলো । রাতারাতি সব গায়েব । একদিন লুকিয়ে চালাতে গিয়ে ধরা পড়লো আর রিক্সাখানা চালান হয়ে গেলো । তার মনে আছে বহু বছর পর সে অনেক কেঁদেছিল । কিন্তু করার কিছুই ছিল না । সে এখনো বুঝে উঠতে পারে না যদি মোটর রিক্সা নিষেধই থাকে তাহলে এতগুলো রিক্সা নামানোর আগে কেউ কিছু বলল না কেন । মাঝে মাঝে সে রূপকথার স্বপ্ন দেখে যেখানে হঠাৎই তার প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা । তার সমস্যা কথা , দুঃখের কথা বলতে চায় কিন্তু কিছু বলতে গেলেই গলা আটকে যায় ।
.
জামশেদ মিয়া কিছুদিন আগে একটি সরকারী কনট্রাকশনের লেবারের কাজ পেয়েছিল । আজও সেখানে সারাদিন গতর খেটে রোদে পোড়ে ঘরে এসে ডাক ছাড়লো '-রওশন ?' জামশেদ মিয়া অবাক হয়ে দেখলো যে তার ঘরে কেউ নাই । পুরো ঘর খাঁ খাঁ করছে । পাড়াপড়শীর মাঝে তার বন্ধু কিসমতের স্ত্রী থেকে জানতে পারলো যে আজ বিকেলে হঠাই তার স্ত্রী যমুনার প্রসব বেদনার উঠে । এই কারণে সে এখন সরকারী হাসপাতালে । জামশেদ মিয়া পড়িমড়ি করে ছুটলো ।
.
তার এই ছোট্ট জীবনে বছরের ১২টা মাস রোগে শোকে ভোগা এই মেয়েটাই তার কাছে সব । এই তার আনন্দের উৎস আর প্রশান্তির ছায়া । ডাক্তারের মতে এবারের অবস্থা খুব খারাপ । যে কোন কিছু হয়ে যেতে পারে । খরচও কম না । জামশেদ মিয়া কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না । অল্প কিছু টাকা হাতে আছে আশা করছে কালকের আরো কিছু টাকা হয়ে যাবে । তাই সকাল হতেই জামশেদ মিয়া সরকারী কাজে দৌড়ালো । গিয়ে থ । জায়গা আজ খাঁ খাঁ করছে । কি ব্যাপার !
.
তারমত এই রকম দু একজন থেকে জানলো আজ নাকি শ্রমিকের অধিকার রক্ষার দিবস । মে ডে । সরকারী ছুটি দিন । তাই কাজ বন্ধ । জামশেদ মিয়ার অশিক্ষিত মাথা এটা বুঝতে পারছে না যে তাদের না খাইয়ে রেখে শ্রমিকদের কি অধিকারটা পালন করা হচ্ছে ? একজন একটা বুদ্ধি দিল । শ্রমিকদের মিছিল মিটিং হচ্ছে । সেখানে গেলে কিছু টাকা পয়সা পাওয়া যাবে । তার টাকা দরকার । তার বউ হাসপাতালের বেডে । এখন যা করতে বলবে তার সবই সে করবে ।
.
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে । নেতার পিছে পিছে স্লোগান দিতে দিতে সে ক্লান্ত । মাথার উপরে আগুন , নিচে আগুন । তপ্ত রাজপথে নতুন স্যাডেল ফুঁড়ে যেন আগুনের আঁচ লাগছে । হঠাৎ তীব্র শব্দ । সবার সাথে জামশেদ মিয়াও দৌড়ালো । দৌড়াতে দৌড়াতে প্যারেড কর্ণারের মোড়ে এসে শরীর টলতে লাগলো । টের পেলেন তার কিছু যেন হচ্ছে । এরপর হঠাৎই শরীর সম্পূর্ণ অনুভূতিশূন্য হয়ে গেলো । নিচের পিচঢালা কালচে চাদরটা যেন ছ্যাশ করে তার মুখে আছড়ে পড়লো ।
.
.
.
.
পরের দিন খবর বেরুলো । "শ্রমিক দিবস পালন কালে একই দলের দুপক্ষের ক্যাডারদের গোলাগুলিতে জামশেদ নামে ১ জন শ্রমিক নিহত এবং ২ জন গুরুতর ভাবে আহত । মেয়র নিহতের পরিবারের জন্য ১ লাখ টাকা আর আহতদের জন্য ৫০ হাজার টাকা সাহায্য ঘোষণা করেছেন"
.
.
পার্কে বসে সাত সকালে খবরটা পড়লেন । নামটি খেয়াল জামশেদ চৌধুরী যাইপরনাই বিরক্ত হলেন । তার রাশভারী নামটাও এখন সস্তা হয়ে গেছে । একটা ফকিরন্নীর নামও তার নামে রাখা হয় । জামশেদ চৌধুরী উঠে দাড়ালেন , বাসায় যেতে হবে , এই বয়সে বেশি হাঁটা চলা করাও উচিত নয় । এতে শরীরের ফিটনেস বাড়ে না , উল্টো কম । দ্রুত হাঁটতে গিয়ে অদ্ভুত ভাবে জামশেদ চৌধুরী একজোড়া স্যান্ডেলের উপর ভীষণভাবে হোঁচট খেলেন । অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখেন স্যান্ডেলগুলো আসলে সেদিনের ফেলে আসা স্যান্ডেল জোড়া !!
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মে, ২০১৬ রাত ৯:৩৮