বিদেশে বাংলাদেশ
ঢাকা থেকে ইস্তানবুল ফ্লাইটে টিভি জাতীয় বস্তুটা কোনভাবেই কাজ করছিল না সেটাতো আগেই বলেছি। কিন্তু মেজাজটা খিঁচে ছিল আরো কয়েকটা কারণে। এক. সম্প্রতি ট্রাভেল ট্যাক্স বৃদ্ধি করা হয়েছে এই অজুহাতে, টিকিট কাটার পরও ঢাকা এয়ারপোর্টে যাত্রীদের কাছ থেকে আলাদা এক হাজার টাকা করে আদায় করছিলেন গলায় এয়ারপোর্ট কতৃপক্ষের আইডি ঝোলানো এক ভদ্রলোক। পরে প্লেনে উঠে বোঝা গিয়েছিল যে সেটা ছিল পরিষ্কার দুর্নীতি। যদিও আমি সেই টাকা দেইনি তবুও সহযাত্রীদের কাছ থেকে কনফার্ম হয়ে বাংলাদেশের উপর অভিমান হচ্ছিল ভীষণ। দুই. ইস্তানবুল থেকে টেজেল এর ফ্লাইটে সেই বহু আকাঙ্খিত টিভি জাতীয় বস্তুটির দেখা মিললেও সেটি ব্যক্তিগত ছিলনা, ছিল পাব্লিক।
তবে মিডিয়ার ভাষায় যাকে ন্যারো কাস্টিং বোঝানো হয়ে থাকে তাতে একটা ডকুমেন্টরি শুরু হয়েছে। পরিবেশ বিপর্যয় নিয়ে এই ন্যারো কাস্টিং এর বিষয় বাংলাদেশের চামড়া ও ট্যানারী শিল্প। এটা প্রকৃতির জন্য কতটা খারাপ, মানুষের জন্য কতটা খারাপ তা নিয়ে বিশাল বর্ননা। এই বাংলাদেশকে বিশ্ববাসী দেখছে?
একটু মনোযোগ দিয়ে দেখবেন স্ক্রীণে, সেটি বাংলাদেশ।
তিন. ডিনার টেবিলেই বাংলাদেশ কি কেন সে সর্ম্পকে বলতে যেয়ে অনেকেই কমেন্ট করেছিল যে, “বাংলাদেশ তো বন্যা ও ঝড়ের দেশ, যেটা অতি দ্রুত তলিয়ে যাবে বঙ্গোপসাগরে”। আমি স্পষ্ট করে বললাম যে, “পঞ্চাশ বছরের পুরোনো স্টেরিওটাইপে আটকে থাকলে তো বাংলাদেশকে বোঝা যাবে না। চেনা যাবেনা। গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর কারণ হলে তোমরা আর ডুবে মরছি আমরা, অদ্ভুত তাই না?“ চার. সকালে বিড়ি খেতে খেতে যে জর্ডানী যুবকের সাথে পরিচয় হল সে আলাপ শুরু করল এভাবে, “আমার পরিচিত বন্ধুর কারখানায় সাত হাজার বাঙ্গালী শ্রমিক কাজ করে। তারা খুব টাফ। জর্ডানে কস্ট অফ লিভিং এত হাই, তারপরও তারা এত অল্প আয়ে কীভাবে সারভাইব করে তা বিষ্ময়।“ সে আরো যুক্ত করেছিল, “তবে তারা প্রতিবাদীও, যা চায় তা আদায় করে নিতে পারে।“ আমি উত্তর দিয়েছিলাম, “এই শ্রমিকেরাই বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান উৎস। চিন্তা করে দেখো কতটা কষ্ট করে তারা সেখানে সারভাইভ করে এবং দেশেও টাকা পাঠায়।“ নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন পাঠক ভেতরে ভেতরে বাংলাদেশ নিয়ে ধ্বিক ধ্বিকি শুরু হয়ে গিয়েছিল। জিদ চেপে গিয়েছিল, প্রতিটা মিটিং এ বাংলাদেশকে নতুনভাবে উপস্থাপন করতে হবে। মিথ্যা দিয়ে নয়, সত্য দিয়ে। বাংলাদেশেরও অনেককিছু আছে দেখানোর, অনেককিছু।
আমাদের মিটিং হয়েছিল এই বিল্ডিং এ
জার্মান ডিজিটাল মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়া
গত পর্বে আলাপ করেছিলাম বার্লিনের সাথে প্রথম মোলাকাতের এবং জর্মন গণতন্ত্রের কেন্দ্র বুন্দেসটাগ নিয়ে। দিনটা ৪ঠা আগস্ট, সোমবার। আমরা বৃহত্তর বুন্দেসটাগ বিল্ডিং এ। আমাদের প্রথম মিটিং জেরল্ড রেইশেনবাখ এর সাথে। ভদ্রলোক মেম্বার অফ পার্লামেন্ট, জর্মান বুন্দেসটাগের ডিজিটাল এজেন্ডা কমিটির ডেপুটি চেয়ারম্যান। বয়স ষাটের কোটায়। বাগ্মী এবং সত্যিকারের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। সহজেই মিশে যেতে পারেন যে কারো সাথে। তবে আলোচনার জন্য এবার তিনি ট্রান্সলেটরের এর সাহায্য নিলেন। সেটা ভালৈ হল।
প্রাইভেসি ও রাজনীতি
“বার্লিন নিজেকে ইউরোপের কেন্দ্র বলে ভাবতে পছন্দ করে”, বলছিলেন ড. ওডিলা। জার্মানীতে, বোধকরি সমগ্র ইউরোপেই প্রাইভেসি সবচেয়ে বড় আলোচিত ইস্যু এখন। পুরো জার্মানী এখন এই ইস্যুতে ভীষণ উত্তপ্ত। বিশেষত এঞ্জেলা মার্কেলের ফোন ট্যাপের ঘটনার পর।
ডিজিটাল প্রযুক্তি এবং সোশ্যাল মিডিয়া যে একটি রাজনৈতিক বিষয় সেটা খুব চমৎকার করে অনুধাবন করতে শুরু করেছে ইউরোপ। তবে সম্ভবত একটু দেরীতে। আমেরিকার ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সী, এনএসএ তথাকথিত সিকিউরিটির নামে যেভাবে অন্য দেশের প্রাইভেসিতে ইন্টারেভেইন করছে তা ভয়াবহ। সেটা কি তার নিজের দেশের জনগণের জন্য ভয়াবহ নয়? আগে এই সব তথ্য এবং খবরের জন্য অন্য একটা দেশকে আক্রমণ করতে হোত। আর এখন সেটা তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমেই সম্ভব। জার্মানরা তাদের প্রাইভেসির বিষয়ে ভীষণ স্পর্শকাতর। গুগল যখন প্রথম তাদের গাড়ী নিয়ে স্ট্রিট ভিউ এর জন্য ছবি তোলা শুরু করল তখন প্রবল আপত্তি উঠেছিল। পরে গুগলের কাছে হাজার হাজার রিকোয়েস্ট যায়, তাদের বাড়ী/দোকান/নাম/ছবি মুছে ফেলার। এবং গুগল সেটা করে। এডওয়ার্ড স্নোয়েডেন হুইসেল ব্লোলার হিসেবে সারা বিশ্বের রাজনৈতিক প্রেক্ষীতকেই মৌলিকভাবে বদলে দিয়েছেন। তার কাজকে জুলিয়ান আসাঞ্জের কাজের ধারাবাহিকতা হিসেবেই দেখতে চাই আমি। ফলে স্নোয়েডেন ও আসাঞ্জ উত্তর বিশ্বে রাজনীতি কেবল ভূ-রাজনীতিতে আবদ্ধ নেই। দেশ দখলের কি আর প্রয়োজন আছে?
গুগল ও ফেইসবুক আপনার কি জানে না?
যখন সারা বিশ্বে গুগল ও ফেইসবুক একটি মহাগুরুত্বপূর্ণ, এড়িয়ে যাওয়া যায়না এমন একটি মহা আন্ত:মহারাষ্ট্রিক প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে তখন প্রশ্ন ওঠা দরকার এই দুটো প্রতিষ্ঠান কোন রাষ্ট্রে অবস্থিত। এর অর্থনীতি ও রাজনীতি কোথায় কোথায় ভূমিকা রাখছে? পুরো আলোচনার মূল সুরে এই শংকা নানাভাবে উপস্থাপিত হল। না হবার কারণ কি আছে? খেয়াল করে দেখেছেন কি, ফেইসবুক আপনার কতটুকু জানে? নাকি প্রশ্নটা হবে ফেইসবুক আপনার কি জানেনা? আমি প্রায়ই বলি যে মানব ইতিহাসে প্রথমবারের মত ফেইসবুক এমন বিপুল সংখ্যাক মানব প্রোফাইল তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে যা আগে কখনো সম্ভব হয়নি। এখানে আমরা নিজেরা উৎসাহী হয়ে, নিজের পছন্দ, অপছন্দ, সর্ম্পক, গোপনীয়তা, প্যাটার্ণ, পরিবার, নিকটজন, দূরের জন সবকিছুর তথ্য দিয়ে রেখেছি।
অন্যদিকে “বিগ ডাটা”
প্রযুক্তির অগ্রসরতার সাথে সাথে এই ডাটা প্রসেস করাও সহজতর হয়ে উঠছে। একটু খোঁজ নিলেই জানতে পারবেন ফেইসবুক কীভাবে আপনার ডাটা মানসিক নিরীক্ষার কাজে ব্যবহার করে। কীভাবে ক্রেতার প্রোফাইল তৈরি করে এবং কোম্পানীর কাছে বিক্রী করে। মজার বিষয় হল, টার্মিনেটর সিরিজের “স্কাইনেট” কে আমরা চিনতে পারি সহজেই কিন্তু ফেইসবকু বা গুগল কি “স্কাইনেট” হতে যাচ্ছে না?
একটি একক প্রতিষ্ঠান যা সোশ্যাল মিডিয়া ছাড়াও আরো নানান দিকে পুঁজি বিনিয়োগ করছে সেটির একচ্ছত্র্যত্ব এবং সর্বগামীতা সর্ম্পকে সতর্ক হবার সময় বোধহয় এসেছে। কেননা আর কদিন পরেই জার্মানীর সব গাড়ীতেই জিপিএস যুক্ত করা হবে। “আমি আমার ব্লেন্ডারে ইন্টারনেট চাইনা” বলছিলেন আরেকজন। আমিও কি চাই, আমরাও কি চাই?
একদিকে ইন্টারনেটের অধিকার ও এক্সেস নিয়ে লড়াই, অন্যদিকে ক্রমবর্ধনশীল রাষ্ট্রীয় ও বৈশ্বিক সার্ভেইল্যান্স। আমরা কিন্তু আছি মাইনকার চিপায়। আমাদের সোশ্যাল মিডিয়া আচরণ যদি লক্ষ করি তাহলে দেখবো যে সারা বিশ্বের মতই, আমরা ফেইসবুকে সেলফি আর সেলিব্রিটি হবার জন্য পাগল প্রায়। আপনার প্রেমিকার বুকের তিল থেকে শুরু করে আপনার গোপনতম অসুখ (যার কারণে আপনার চাকরী হবে না) সবকিছূর ধারাবাহিক তথ্য আপনি নিজে দিয়ে চলেছেন। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মটিভেশন কি? লাভ এবং পুঁজি বৃদ্ধি।
বৈশ্বিক অর্থনীতি ও রাজনীতির অর্থাৎ বিশ্ব ক্ষমতা বিন্যাসে ইন্টারনেট কেবল হাতিয়ার নয় বরং এটাই ক্ষেত্র।
তাহলে জার্মান গোয়েন্দারা কি অন্য দেশের তথ্য জানতে সার্ভেইল্যান্স, ট্যাপিং করেনা? প্রশ্নটা খুব ক্লাসিক ছিল। উত্তরটা মোটামুটি স্বচ্ছভাবেই এল। জাতীয় নিরাপত্তা এবং আত্মরক্ষার জন্য এটা যে করা হয় তা অস্বীকার করা হলনা। বরং প্রসঙ্গ উঠলো ডাটা প্রোটেকশনের। জার্মান জনগণের ডাটা প্রোটেকশনের জন্য অন্তত সতেরোটা প্রতিষ্ঠান আছে। তারা নানাভাবে জনগণের তথ্য কোথায় কি যাচ্ছে কতটুকু যাচ্ছে তার খেয়াল রাখেন। জনগণ সেখান থেকে সাপোর্ট পান। আর গোয়েন্দাগিরির জন্যও অনেকগুলো জবাবদিহিতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় সে কথাও জানা গেল।
খুব ইন্টারেস্টিং আরেকটা প্রশ্ন এসেছিল তা হল, “সিরিয়াতে যুদ্ধে যোগদানের জন্য, সম্প্রতি অনেক জার্মান নাগরিক যুক্ত হচ্ছেন, যারা মোটিভেটেড হচ্ছেন অনেক অনলাইন সাইট ও সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে, এ সর্ম্পকে জার্মান সরকারের ভূমিকা কি?”। প্রশ্নটা এসেছিল মিশরের আহমেদের কাছ থেকে। (আমি খুবই ইম্প্রেসড হয়েছিলাম, এবং পরবর্তীতে মানে সেদিনই আমাদের মতবিরোধ তীব্র হয়েছিল, সেও এক মজার ইতিহাস।) অর্থাৎ “জঙ্গীবাদ”, “বিস্তারেও” ইন্টারেনট ব্যবহৃত হচ্ছে তখন বাক স্বাধীনতা/ব্যক্তি স্বাধীনতা কীভাবে রক্ষা হবে? প্রশ্নটার ভিত্তি খুঁজতে যেতে পারেন সাম্প্রতিক আপডেটে, “সিরিয়া ফেরত জার্মান জিহাদিরা বিপজ্জনক: সার্ভেইলেন্সের পক্ষে যেসব যুক্তি দেখানো হয় তার অন্যতম প্রধান যুক্তি কিন্তু এটাও। উত্তরটা রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে ব্যক্তির অধিকার এবং তার বাক স্বাধীনতার অধিকার এ দুটির মধ্য দিয়ে এল। অর্থাৎ শেষমেষ রাষ্ট্র কতটা উদার ও কতটা জবাবদিহিমূলক এবং গণতন্ত্র কতটা পোক্ত তার উপরই নির্ভর করবে এ বিষয়ক উত্তর।
আমার প্রশ্ন ছিল, “তাহলে সোশ্যাল মিডিয়ায় যেখানে বৈশ্বিক ও স্থানীয় চলক (মোটিভেশন) অর্থনীতি সেখানে ইন্টারনেট কিংবা সামগ্রিকভাবে মানুষের অধিকার কীভাবে নিশ্চিত হবে? এটা কি কেবল রাষ্ট্রই নিশ্চিত করবে নাকি অর্থনীতি?”। উত্তরটা প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ অত্যন্ত সৎভাবে দিলেন, “শেষ পর্যন্ত যে জিতবে, অর্থনীতি কিংবা গণমানুষের ইচ্ছা।“
গণমানুষ কোথায়, গ্রাফিতিতে?
লাঞ্চে উচ্চশিক্ষা, ডায়স্পোরিক সোসাইটি, মাইগ্রেশন বিষয়ক
হিলটন হোটেলে দুপুরের লাঞ্চ সারতে সারতে কথা হচ্ছিল বার্লিন নিয়ে। বার্লিন অনেক ইয়ং এবং পর্যটকে ভরপুর। মানে বার্লিনে প্রচুর তরুণ তরুণী লেখা পড়া করে। সম্প্রতি বার্লিন মোস্ট ভিজিটেড সিটিগুলোর একটি। মানে পর্যটন থেকে প্রচুর আয়। শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে কথা হল। আগে তো উচ্চশিক্ষা অনেক সহজ হল। শিক্ষার্থীরা প্রায় বিনা পয়সায় ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে পারতেন এবং শিক্ষাজীবন শেষ করে একটা ডিসেন্ট চাকরী পেলে সেখান থেকে ঋণ শোধ করতেন। আর এখন উচ্চশিক্ষা পুরোপুরিই ঋণ নির্ভর অর্থাৎ আগে থেকেই ঋণ নিয়ে শিক্ষা নাও আর সাথে সাথে ঋণ শোধ কর। অর্থনৈতিক মন্দায় ইউরোপে সবচেয়ে কম আক্রান্ত রাষ্ট্রের একটি জার্মানী। তবে সেখানেও উচ্চশিক্ষা ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠছে। এদিকে ২য় বিশ্বযুদ্ধে পুড়ে যাওয়া বার্লিনকে পুর্নগঠনে তুরষ্ক থেকে প্রচুর শ্রমিক আমদানী করা হয়। এখন সেখানে তৃতীয় প্রজন্ম চলছে। এছাড়া নতুন ইমিগ্র্যান্টও আছে। বার্লিন শান্তিপূর্ণ হলেও গভীরে গভীরে সুক্ষ এবং কখনো প্রকাশ্য এক দ্বন্দ্ব খুব ক্রিয়াশীল। সাংস্কৃতিক মিল এবং অমিলের রাজনীতিটা ডিল করা সহজ নয় মোটেও। খাবার টেবিলে আমার প্রশ্ন ছিল, “অধিকাংশ বার্লিনার কি বাইরেই খাবার খায়?” উত্তরটা ছিল, “না, যাদের দেখছি তাদের বেশির ভাগই টুরিষ্ট।“
বাংলাদেশ আছে, বাংলাদেশ থাকতেই হবে
প্রথম মিটিং এ আলাপটা শুরু হয়েছিল, লাঞ্চে আলাপটা আরো জোরদার করলাম। ফেডারাল ফরেন অফিসে সেটা পূর্ণতা পেল। বিষয় বাংলাদেশ, আমাদের বাংলাদেশ। লাঞ্চ শেষ করে আমরা গেলাম হেঁটে পৌছে গেলাম একটা পুরোনো ব্যুরোক্র্যাটিক বিল্ডিং এ। পরে জানলাম ফেডারেল ফরেন অফিসে পরিবর্তিত হবার আগে এটি আসলে একটি ব্যাংক বিল্ডিংই ছিল। কড়া নিরাপত্তা পেরিয়ে আমরা ঢুকে পড়লাম ফরেন অফিসে। একটি লম্বা এ্যালি ধরে আমরা হেঁটে চলেছি। উপরে উঁচু ছাদ, ডানে বামে খোপ খোপ অফিস, পুরো আয়তকার এবং সরু। বেলারুশের ভিটালি ইতোমধ্যে রাশান ও জার্মান খোঁচাখুঁচির বিষয়টা টেনে এনে ফোঁড়নবাজ হিসেবে রেপুটেশন অর্জন করা শুরু করেছিল। যেমন বুন্দেসটাগে ভীষণ সিরিয়াস রাশভারী মহিলার প্রতি তার কমেন্ট ছিল, “পুরোনো ইতিহাসের দেয়াল সুরক্ষা করে লাভ কি হবে, সেটাতো আসলে পরাজয়ের ইতিহাস”। ২য় বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল ছিল তার কথার ইঙ্গিত। হিটলার যেখানে সতর্কভাবে চেষ্টা করে ভুলে যাওয়া একটা নাম সেখানে সে নানাভাবে হিটলারকে আনার চেষ্টা সে করেই চলেছিল। তো ভিটালি আর আমি একসাথে বিষয়টা নোটিশ করলাম, প্রায় একই সময়ে বললাম, “বিল্ডিংটা একেবারে কাফকার উপন্যাসের মত।“ ওখানে তখনো দরজাবিহীন কাঠের লিফট সচল ছিল।
অফিস অ্যালি ধরে সবাই হাঁটছি, তখনি ডানদিকে চোখে পড়ল, সেই অফিসের কোন একজন তার দরজায় ড. ইউনূসের পোষ্টার টাঙ্গিয়ে রেখেছে, নিচে লেখা “গরীবের ব্যাংকার”। আমি বললাম উনাকে দেখেছো? উনি একজন বাংলাদেশী, উনি নোবেল লরিয়েট। ড. ইউনূসের কাজের সাথে অনেক বিষয়ে তীব্র মতবিরোধ থাকলেও সেই সময়ে তাঁকে ধন্যবাদই দিলাম। সবাই ঘুরে তাকালো, ভিটালি মনে করতে চেষ্টা করল তার দেশ থেকে কোন নোবেল লরিয়েট আছে কিনা। বাকীরাও যেন নতুন করে জানলো বাংলাদেশ বলে একটা দেশ আছে। সেখানে কেবল বন্যা হয়না, দেশটি কেবল ডুবে যাচ্ছে না। নোবেল প্রাইজ নিয়ে আমার বিশেষ মাতামাতি নেই তবে কখনো কখনো সেটা কাজের।
আকাশ তুমি কার?
ডিপ্লোমেসি+সাইবার স্পেস= আর্ন্তজাতিক সাইবার পলিসি
আগের আলাপেই নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন সাইবার ফরেন পলিসি এখন জর্মনদের জন্য প্রথাগত ফরেন পলিসির মতই গুরুত্বপূর্ণ। এজন্যই এই গ্লোবাল ডায়ালগকে আয়োজন করা। নিজেদের শেখার জন্য এত বিনিয়োগ করা। এবার আমি আমার সাইবার ডিপ্লোমেসি শুরু করলাম। নিজের ভাষার জন্য এদেশের মানুষ যে আত্মত্যাগ করেছে, লড়াই করে স্বাধীনতা এনেছে সেটা তো আগেই বলেছি। এবার জরুরি ছিল, ব্লগের নানান ভূমিকার কথা জানানো। পাইয়োনিয়ার কমিউনিটি ব্লগ হিসেবে “সামহ্যোয়ারইন ব্লগ” সহ সকল বিশেষায়িত ব্লগ, ফোরাম ইত্যাদি সর্ম্পকে জানানো। কীভাবে মাতৃভাষা ও মুক্ত মত প্রকাশে ব্লগার এবং সমগ্র ব্লগ পরিমন্ডল ভূমিকা রাখছে সেটার কথা। জাতীয় স্বার্থে, মানবিক বিপর্যয়ে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়, সাহিত্যে, ভাষা চর্চায়, মুক্তমত প্রকাশে, শাহবাগ প্রতিরোধ, গণজাগরণে অর্থাৎ বিগত সাড়ে আট বছরে আমার অভিজ্ঞতার কথা, ব্লগারদের অর্জনের কথা সর্বপোরি বাংলাদেশের কথা।
ইন্টারনেট পেনিট্রেশন রেইট নিয়ে কথা তুলতেই মোবাইল ইন্টারেনেটে এই দেশের সম্ভাবনার কথা সামনে আনলাম। হয়ত তারা বুঝতে পারলেন বিশ্বের সোশ্যাল মিডিয়ার যা কিছু ঘটে বা ঘটেছে তা বাংলাদেশের সোশ্যাল মিডিয়া সমান তালেই অর্জন করেছে এবং এখানকার ব্লগার, অনলাইন এক্টিভিস্টরা অনেকক্ষেত্রে সেগুলো ছাড়িয়েও গেছে। ক্লাসিফাইড বিজ্ঞাপনে বাংলাদেশের বিশাল, সম্ভাবনাময় বাজারের কথাও তারা স্পষ্ট বুঝতে পারলেন। ইন্টারনেট গর্ভনেন্স নিয়ে তাদের কনসার্ন যে কেবল তাদের একার নয়, সেটাও স্পষ্ট হল।
Protecting cyberspace whilst safeguarding internet freedom
পুরো ইউরোপ আসলে সাইবার ডিপ্লোমেসির সাথে খাপ খাইয়ে নেবার চেষ্টা করছে, ইন্টারনেট নিজেই স্বয়ং নতুন গর্ভনিং বডি হয়ে উঠছে। আর তাই জরুরী প্রশ্ন, ইন্টারেনেটের মালিকানা আসলে কার কাছে? কতৃত্ব কার কাছে?
বাংলাদেশের জন্য সাইবার ডিপ্লোমেসি উইং খোলাটা কতটা দরকার তা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। কেননা ইন্টারনেটই অর্থনীতি আর রাজনীতি হয়ে উঠছে বা অন্যভাবে বললে, অর্থনীতি-রাজনীতি এবং ক্ষমতা ইন্টারনেটে শিফট করছে। এই পরিবর্তনেও আমাদের ভূমিকা কি কেবল রিসিভার এন্ডে হবে? সার্ভেইল্যান্স ও মানবাধিকার কিভাবে মোকাবিলা করবে? একদিকে ট্রেড ইনভেস্টমেন্ট, অন্যদিকে মানবাধিকার, একদিকে নিরাপত্তা আরেকদিকে ইন্টারনেট গর্ভনেন্স। আমার প্রশ্ন ছিল, যদি ডাটা প্রোটেকশনের নামে ম্যানিপুলেটিভ গণতন্ত্রে ইন্টারনেটকে ব্যবহার করা হয় তাহলে সেটা কীভাবে প্রতিরোধ করা যাবে? এটার কোন নির্জলা উত্তর ছিলনা।
Cyber Dialogue: Safeguarding Freedom and Security
ফরেন অফিসের ভেতরে।
রিপোটার্স উইদাউট বর্ডারে শেষ মিটিং এবং বচসা
টানা মিটিং এ ক্লান্ত ছিলাম বেশ। সারা বিশ্বে ওয়ার্লড ফ্রিডম ইনডেক্সে বাংলাদেশের অবস্থা আগে থেকেই জানা ছিল।
ব্লগার হত্যা, ব্লগারের উপর মারণঘাতি আক্রমণ, সাগর-রুনি হত্যাকান্ড কোনকিছুই বাংলাদেশের অবস্থানকে খুব সুখকর জায়গায় রাখেনি। বিশ্ব র্যাংকিং এ ১৪৬, দুই ঘর পিছিয়েছে। কঠিন অবস্থা। রাখার কথাও নয়। তর্কটা জমে উঠেছিল তখনি যখন চায়নার চং ওয়াং খুব জোর গলায় বলে উঠলো, “কিন্তু চীনকে কালো দেশ হিসেবে চিহ্নিত করার কারণটা কি?” রাশানরাও প্রায় কাছাকাছি প্রশ্ন তুলেছিল। পুতিনের আমলে বাক স্বাধীনতার কি অবস্থা? যে বিশ্ব-মানদন্ড তৈরি করা হয়েছে তা কতটা যৌক্তিক? ওখানে যার যার নিজের দেশের রিপোর্ট করার ব্যক্তিও ছিল। পদ্ধতিটা জটিল এবং খুব সূক্ষ নাম্বারের জন্য দেশের স্ট্যাটাস পরিবর্তিত হতে পারে। এই পদ্ধতিরও নিজস্ব সমস্যা রয়েছে। তবে এটাও সত্য এটা জেনেরিক ধরণের হলেও গড় একটা আইডিয়া দিতে পারে। এশিয়া প্যাসিফিক, বাংলাদেশের অবস্থা
মিশরের আহমেদ যখন বলে উঠলো, “হ্যা আজকে মুসলমান বৌদ্ধ মারবে, কালকে বৌদ্ধ খ্রীষ্টান মারবে, এটা চলতেই থাকবে, এটার সাথে জার্নালিজমের অবজেক্টিভিটির কোন সর্ম্পক নেই”, তখন আর চুপ থাকতে পারলাম না, বললাম, “মাউ ডিয়ার ফ্রেন্ড আই স্ট্রংলি ডিসএগ্রী”। পোষ্ট নাইন ইলাভেন সময়ে, মুসলমানদের “জঙ্গী” বানানোর যে রাজনীতি সেটাকে গণ্য না করলে, প্যালেস্টাইনে শিশু মারার বৈধতাও বের হয়ে যাবে। সবকিছুকে “গিভেন” হিসেবে ধরে নেবার এই প্রবণতা খুবই সমস্যাজনক। রিপোটার্স উইদাউট বর্ডার খুব প্রয়োজনীয় একটি প্রতিষ্ঠান সন্দেহ নেই তবে দোষ ধরার সাথে সাথে প্রোটেকশনের ব্যবস্থাটা জোরদার করার জরুরুৎ আছে।
সেদিন রাতের ডিনারে কয়েকজনকে বললাম নেটে কক্সবাজার, সেইন্ট মার্টিন আর সুন্দরবনের ছবি দেখতে। বাংলাদেশ বেড়াতে যাবার জন্যও খুব খারাপ জায়গা নয় সেটাও বলা হল চামে।