১৯শে ডিসেম্বর পালিত হচ্ছে ৫ম বাংলা ব্লগ দিবস। সামাজিক কল্যাণ থেকে জাতীয় স্বার্থ রক্ষায়, মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় নিরন্তর কাজ করে চলেছে বাংলা ব্লগ, বাংলা ব্লগাররা। ব্লগ পরিমন্ডল এখন জাতীয় এবং আর্ন্তজাতিক পরিসরের গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ মাধ্যম, স্বাধীন মতপ্রকাশ ও অধিকার আদায়ের হাতিয়ার। বিকল্প গণমাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবার সাথে সাথে এটি বিকশিত করে চলেছে নাগরিক সাংবাদিকতা, মানব কল্যাণে যূথবদ্ধতা, অন্যায়ের প্রতিরোধ এবং সাধারণ মানুষের স্বাধীন মত প্রকাশের উর্বর ক্ষেত্র।
বিজয়ের মাস ডিসেম্বর, বাংলা ব্লগিং এর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ২০০৫ সালের এ মাসে সামহোয়্যারইন...ব্লগের মাধ্যমে বাংলা কমিউনিটি ব্লগের যাত্রা সূচিত হয়। অনেকটা পথ পেরিয়ে বাংলা কমিউনিটি ব্লগ এবার ৮ম বছরে পা দিয়েছে। এই ধারা অব্যহত রেখে বর্তমানে বাংলা কমিউনিটি ব্লগের সংখ্যা ৩০টির ওপর।
বাংলা ভাষা ও স্বাধীনতার ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতকে সামনে রেখে ২০০৯ সালের ১৯শে ডিসেম্বর প্রথমবারের মত বাংলা ব্লগ দিবস পালিত হয়। বিগত বছরগুলোতে ব্লগিং এর শক্তি ও সম্ভাবনা নানাভাবে বিস্তৃত হয়েছে । দেশের সকল বিভাগীয়, গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলো সহ বিশ্বের বেশ কিছু দেশে বিপুল উদ্দীপনা নিয়ে বাংলা ব্লগ দিবস পালিত হচ্ছে। পারস্পরিক যোগাযোগ বৃদ্ধিতে, বিভিন্ন ব্লগ প্ল্যাটফর্মের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে, ব্লগ পরিমন্ডলের ভবিষ্যৎ রূপরেখা নির্ণয়ে দিবসটি ইতিমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে শুরু করেছে। সাইবার পরিসরে বাংলা ভাষাকে বিশ্বব্যাপী পরিচিতিকরণ, তর্কমূলক সহাবস্থানের দৃষ্টান্ত, অনলাইন অ্যাক্টিভিজম, সমাজ সংস্কারমূলক উদ্যোগ গ্রহণ করে ব্লগসমূহ সমালোচনামুখর জনপ্রিয়তা পেয়েছে। পুরো বাংলা ব্লগ কমিউনিটির সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত রয়েছেন ৫ লাখের উপরে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী। কেবল সামহোয়্যারইন...ব্লগেই এখন রেজিস্টার্ড ব্লগারের সংখ্যা ১৬২,০০০। এই সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধিও পাচ্ছে।
আট বছরের এই পথ চলায় ব্লগারদের অর্জন অনেক, বিশেষভাবে মানব কল্যাণমূলক কর্মকান্ডে ব্লগারদের অংশগ্রহণ ভীষণ উজ্জ্বল ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। এর শুরুটা হয়েছিল ২০০৬ সালে লিউকেমিয়া আক্রান্ত শিশু প্রাপ্তীকে বাঁচানোর মধ্য দিয়ে। এরপর আমরা দেখি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শ্বাশত’র জীবন বাঁচানোর চেষ্টায় ব্লগাররা কিভাবে তাঁদের সর্বস্ব নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, এভাবে উপমা, রুশান এবং আরো অনেকে। মহৎ কাজের ধারাবাহিকতায় ব্লগাররা নিবেদিত রয়েছেন।
বিভিন্ন জাতীয় দূর্যোগে যেমন চট্টগ্রামের পাহাড় ধ্বসে, ভয়াবহ সিডরে, শীতে, বন্যায় এবং ক্ষরায় আক্রান্ত মানুষের পাশে বাংলার ব্লগাররা ছুটে গেছেন তাদের সমস্ত সামর্থ্য নিয়ে। পুরনো ঢাকার নিমতলিতে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে আক্রান্তদের সহায়তায় ব্লগাররা একত্রিত হয়েছেন। নানান ব্লগ প্ল্যাটফর্ম থেকে নিজস্ব উদ্যোগে মানব কল্যাণে ছুটে গেছেন।
সামাজিক অনিয়ম এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছেন ব্লগাররা। বাংলাদেশের জনমানুষের বন্ধু সিআরপির ভেলরি টেইলরের অন্যায় অপসারণের বিরুদ্ধের গর্জে উঠেছেন বাংলার ব্লগাররা। এভাবে রূপগঞ্জে অবৈধ জমি দখল, লালন মূর্তির অন্যায্য অপসারণ, তিতাসের নাব্যতা, পরিবেশ বিপর্যয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতন ভাতা বৃদ্ধি, রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরুদ্ধে, জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় বারবার সোচ্চার থেকেছেন, সক্রিয় থেকেছেন। ব্লগাররা হয়ে উঠেছেন জনমত তৈরির পথ নির্দশক।
বাংলা কমিউনিটি ব্লগের একেবারে প্রথম পর্যায় থেকেই স্বাধীনতা বিরোধী সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছেন ব্লগাররা। অন লাইনে অফ লাইনে ক্রমাগতভাবে লড়াই করে গেছেন সকল প্রকার মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী অপপ্রচারের বিরুদ্ধে। তৈরি করেছেন মুক্তিযুদ্ধের অনলাইন আর্কাইভ। যুক্ত থেকেছেন নিরলস গবেষণায়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে গণ সচেতনতা বৃদ্ধিতে তৈরি করেছেন স্টিকার, লিফলেট, বুকলেট। বিচারের আইনী রূপ রেখা নিয়ে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের কাজটিতে নিবেদিত থেকেছেন অনেকে । এই লড়াই কেবল অনলাইনেই সীমাবব্ধ থাকেনি, মানববন্ধন, প্রতিরোধ সমাবেশ, মিছিল প্রভৃতি; দেশের সীমানা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে। দেশে বিদেশের প্রচলিত গণমাধ্যমে বারংবার উচ্চারিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে ব্লগারদের ন্যায্যতার অদম্য দাবী। এরই উৎকৃষ্ট উদাহরণ ৫ই ফেব্রুয়ারির গণজাগরণ।
মানবিক কল্যাণে ব্লগারদের কার্যক্রম নিয়মিত চর্চায় রূপান্তরিত হয়েছে। উত্তরাঞ্চল সহ অন্যান্য অঞ্চলে শীতে পর্যুদস্ত মানুষদের শীত নিবারণে সাধ্যমতো কাজ করছেন ব্লগাররা। ২০০৮ থেকে নিয়মিত প্রতি বছর প্রতিটি বাংলা ব্লগের ব্লগারদের উদ্যোগে এমন অনেক মানবিক কর্মকাণ্ড সম্পন্ন হচ্ছে ব্লগারদেরই তত্ত্বাবধানে। তারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে স্বেচ্ছাসেবী হয়ে অসহায় দুঃস্থ মানুষদের পাশে দাঁড়াবার চেষ্টা করছেন। উৎসবের সার্বজনীন খুশি ছড়িয়ে দিতে সামাজিক দায়বদ্ধতার পালনে সচেষ্ট থাকেন ব্লগাররা। শহরের পথ-শিশু, দুঃস্থ ছিন্নমূল শিশুদের জন্য সংগৃহিত পোশাক বিতরণ করেন। বেশ কিছু জেলায় পথ-শিশু এবং এতিমখানায় মৌসুমী ফল বিতরণ করেন ব্লগাররা।
সাভারে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ ভবন ধ্বসের ঘটনায় সাধারণ মানুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে উদ্ধার কাজে নিযুক্ত থেকেছেন ব্লগাররা। তহবিল সংগ্রহ থেকে শুরু করে রক্ত-প্রদান, জরুরী ঔষধ প্রদান, আহতদের পুনর্বাসন, চিকিৎসা ইত্যাদি সকল কাজে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছেন বাংলা ব্লগাররা। কেবল সরাসরি সহায়তা নয় একই সাথে নাগরিক সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য ও সংবাদ সরবরাহ করেছেন। মানবিক কর্মকান্ড ও ন্যায্যতার প্রশ্নের তৈরি হয়েছে ব্লগারদের জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক নেটওয়ার্ক।
গত কয়েকবছর থেকে অমর একুশে বইমেলায় ব্লগারদের লেখা গল্প/উপন্যাস/কবিতা সহ ব্লগ সংকলন প্রকাশ হচ্ছে নিয়মিত। ব্লগারদের সম্পাদনায় প্রকাশিত হচ্ছে বেশ কিছু ছোট কাগজ/সাহিত্য-পত্রিকা। উঠে আসছেন নতুন গল্পকার, প্রাবন্ধিক, ছবি শিল্পী প্রমূখ। মৌলিক ছবি এবং ভিডিওতে সম্মৃদ্ধ হচ্ছে বাংলা ব্লগ আর্কাইভ।
ব্লগারদের এসব অসামান্য অর্জনের মধ্যেও দৃশ্যমান হয়েছে ব্লগারদের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি। ক্ষমতা যন্ত্র দ্বারা নিপিড়ীত হবার ঘটনাও নিয়মিত হয়ে উঠছে। যে মুক্ত মত প্রকাশ ও গণতান্ত্রিক চর্চা বাংলা ব্লগের প্রাণ, সেটাকে দমিয়ে দিতে তৈরি হয়েছে আইসিটি এ্যাক্ট ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৩) এর মত কালো আইন। একদিকে ব্লগারদের নিরাপত্তাহীনতা, অন্যদিকে ক্ষমতাযন্ত্রের অন্যায্য হস্তক্ষেপ, উপর্যুপূরি রাজনৈতিক চাপ বাংলা ব্লগ পরিমন্ডলের বিকাশে কঠোর প্রতিবন্ধক হিসেবে উপস্থিত। যে ব্লগ পরিসর এবং ব্লগারদের অক্লান্ত পরিশ্রমে একটি সম্ভাবনাময় পরিমন্ডল তৈরি হয়েছে, তার উপর নেমে এসেছে ক্ষমতার খড়গ হস্ত।
এই প্রতিবন্ধকতার অবসান হবে, ব্লগারদের নিরাপত্তা ও মানবাধিকার রক্ষিত হবে; মানবীয় সংস্কৃতিতে প্রাণবন্ত গতিশীল থাকবে বাংলা ব্লগ। ৫ম বাংলা ব্লগদিবস এই সুদৃঢ় প্রত্যয় পূরণে সক্ষম হবে।
লেখকদ্বয়ঃ শরৎ চৌধুরী, এস এম মাসুদুল ইসলাম নীল