কলাবাগানে হুট করে পুরোনো বন্ধুর (এককালে যাকে/যাদের বেস্ট ফ্রেন্ড অভিধায় অলঙ্কৃত করার চল ছিল এমন একজন) সাথে রাস্তায় দেখা; তাকে বগলদাবা করেই এলিফ্যান্ট রোড থেকে ধানমন্ডি লেক। রোযা রাখসস যখন ইফতারী খাওয়াইতেই হইব, এই বলে জোর করে আদায় করা ইফতারীর দাওয়াত। সঙ্গে বান্ধবী ছিল বলে তার প্রেস্টিজ কনসার্ণ (বাণ্ধবী আমার আর কনসার্ণ তার...এরই নাম খারার উপরে বাটপারী)। আমার ভালো মানুষ বন্ধুটা আর বান্ধবীরে নিয়া লেকের পাশে জমজমাট ইফতার সেরে আজিমপুর, তারপর ল্যাবএইড। অপরিকল্পিত আপ্যায়ণে চাকুরীজীবি বন্ধুটিরও দীর্ঘ রিকশা ভ্রমণের ফলে সৃষ্ট মোটা ধরণের ভাড়ায় উসখুস এবং আমার উদ্ধার প্রকল্প (বেচারারে আর কি দোষ দিব)। ফলাফল, পকেটে কেবল বাস ভাড়ার টাকা। ফিল সেইফ কৌশল অবলম্বন করে অবশেষে তার ঔদার্য্যের পুরোটুকু কব্জা করে আরো দশ টাকা আদায় এবং সেইসাথে উল্টা ঝাড়ি কিসের চাকরী যে করস, রিকশা ভাড়াও থাকেনা। কম বাজেটে বন্ধু বান্ধবীর সঙ্গ, জমজমাট আড্ডা; পুরোটাই উঠতি মধ্যবিত্ত পেশাজীবি দলের একটি অকষ্মাৎ ভালো সন্ধ্যার বয়ান।
বাসে চেপে ফুরফুরে মেজাজে ফিরছি। শুক্রাবাদে এসে যখন বাসটা থামল তখন রাস্তা জুড়ে ঈদের ক্রেতার ভীর। অথচ বাসে ওঠার ঠেলাঠেলি নেই। জানালার পাশে বসে নতুন যাত্রীদের ওঠা দেখছি। ছোটখাট গড়ণের একটি মেয়ে অনিশ্চিত গলায় বাসের হেলপারের কাছে গন্তব্য সর্ম্পকে নিশ্চিত হয়ে বাসে উঠল এবং আমার পাশের সিটেই বসল। আলাপটা শুরু হল কন্ডাকটর যখন ভাড়া চাইতে এল তখন। মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, আমি ১০ নাম্বার যাব; ভাইয়া ভাড়া কত? আমি বললাম ১৫ টাকা, সে আরো অপ্রস্তুত হয়ে উঠল। মেয়েটার সেই সময়ের অপ্রস্তুতিতে সহজেই অনুমেয় যে সেই পরিমাণ ভাড়া তার কাছে নেই। মেয়েটির ইতস্তত ভাব দেখে বললাম যে বাকী টাকাটা আমি দিয়ে দেই। আবারো বেশ কিছুটা অস্বস্তি নিয়েই সে রাজি হল। ভাড়া মিটিয়ে চুপচাপ বসে আছি, এই ত্বড়িৎ সহায়তার (৫ টাকাও একটা সহায়তা) জের ধরে আলাপ বাড়ানোর ইচ্ছা আমার নেই, খুবই ভিন্ন ও অসম্মানজনক অর্থ পরিবেশিত হতে পারে (এই যেমন কৃতজ্ঞতা সূত্রে আলাপ, নারী হিসেবে বিশেষ আগ্রহ, মেয়েটির ইচ্ছা না থাকা স্বত্ত্বেও কথা বাড়ানো ইত্যাদি)। বাস আসাদগেট পৌছাতে পৌছাতে মেয়েটি নিজ উদ্যগেই সচ্ছন্দে কথা বলা শুরু করল। ওর সাথে আমার যোগাযোগও শুরু হল। এই প্রথমবার আমি একটু ভালোভাবে ওকে লক্ষ্য করলাম, ছোটখাট গড়নের একটা মেয়ে, ১৮/১৯ বছর বয়স। নামধাম স্কুল কলেজ পর্যন্ত যেয়ে যখন জিগ্গেস করলাম শুক্রবাদে বেড়াতে এসেছিল কিনা তখনি একটু হোঁচট খেলাম।
ও একটা শপে সেলস গার্ল এর চাকরী করে সেখানে কাজ শেষ করেই বাসায় ফিরছে। সেপ্টেম্বরেই জয়েন করেছে রাস্তাঘাট কিছুই পরিষ্কার করে জানে না (আগে ফার্মগেট থাকতো এখন মিরপুর থাকে, এজন্যই)। তার বাবারই তাকে নিয়ে যাওয়ার কথা কিন্তু সেদিন বাবা আসতে পারেনি। আলাপের প্রথম থেকেই লক্ষ্য করছিলাম যে ও বেশ স্বতষ্ফূর্ত, কথাবার্তা জমে ওঠার এক পর্যায়ে ও ওর বন্ধুর কথা, বান্ধবীদের কথা বলল, আমি মজা করে জিগ্গেস করলাম তোমার বয়ফ্রেন্ডের খবর কি? ও বলল প্রেমটেম আমার ভালো লাগে না। ও এমনভাবে কথাগুলো বলছিল যে আমি অনুমান করছিলাম গল্পটা সরল নয়। এছাড়া আমার মাথায় ঘুরঘুর করছিল ওর চাকরী করার কথা। আবার এও ভাবছিলাম এখন তো অনেক পোলাপানই এরকম জবে ঢোকে। কিন্তু ওর পোশাক যে শ্রেণীর কথা বলছিল তাতে অস্তিত্বের লড়াই যতটা প্রবল ততটা টুকটাক আয়ের বা এডভেঞ্চারের নয়। আমি ভাবলাম আরেকটু খতিয়ে দেখা যাক (নৃবৈজ্ঞানিক ট্রেনিং এর বাজে ফলাফল, আমার দোষ না)। আলাপের এক পর্যায়ে ও বলল ভাইয়া আমার কথা শুনলে আপনি বুঝবেন না, অনেক সমস্যা অনেক। আমি আমার ক্লোজ বান্ধবীকেও এগুলা বলিনা। কি দরকার ওকে চাপ দেয়ার। আমি বললাম তাই নাকি!! দেখা যাক আমার ১৮/১৯ এ যে স্ট্রাগল সেটার কাছাকাছিও তোমারটা যেতে পারে কিনা। ও আমার এই চ্যালেঞ্জটা নিল, কিন্তু ততক্ষণে বাস ১০ এর কাছাকাছি চলে এসেছিল। তাড়াহুড়ার মধ্যেই ও আমার ফোন নাম্বার নিল। আমি কাগজে লিখে দিলাম। ও বাস থেকে নেমে যাবার পর, দেখলাম অনেক পুরুষ যাত্রীই (আমার আশপাশে অন্য কোন মহিলা যাত্রী ছিলনা) দ্বন্দসন্দেহঈর্ষার চোখ নিয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছে। এই চোখগুলো আমার চেনা, এই প্রতিক্রিয়া অস্বাভাবিকও নয় কিন্তু এগুলোকে মোকাবিলার রাস্তাও আমার জানা। আমি চোখগুলোর দিকে তাকিয়ে কেবল মৃদু হাসলাম।
ও ফোন করবে কিনা এ নিয়ে আমার কোন সন্দেহ ছিল না। দুদিন পর ও দোকান থেকে ফোন করল, আমার সেই ৫ টাকা ফেরত দেয়া এবং চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলাপ হল। কিন্তু দেখা করার জন্য কিছুতেই সময় মিলছিলনা, দোকানের জন্য ওকে সকাল ১০টায় বেরিয়ে যেতে হয় আর ফিরতে হয় রাত দশটায়। মাসিক ঐ ৩৫০০৳ ওর দরকার, কতটা দরকার তা আরো পরে বুঝেছি। একদিন সময় হল, প্রখর রোদে হাঁটতে দাঁড়াতে আমরা আলাপ শুরু করলাম। ওরা তিন ভাই বোন ও মেঝ। রিকশায় করে আসতে আসতে ওর বাবা কি করেন জানতে চাইলে ও বলল এর উত্তর দিলে হয়ত আমি ওর সাথে রিকশায় বসতেও চাইবো না (ওর শ্রেণী মর্যাদার সতর্ক হিসাব আমাকে নতুনভাবে ভাবাতে শুরু করল)। । ওর বাবা ট্যাক্সি ড্রাইভার, প্রাথমিক টাকাটা ধারদেনা করে মাসিক ৮০০০৳ কিস্তিতে ট্যাক্সি কিনেছেন কিন্তু প্রায়ই তার কিস্তির টাকা বাকী পড়ে যায়। ওদের পরিবার কয়েক বছর আগেও যেমন সচ্ছল ছিল কিন্তু এখন আর তা নেই। ওর বড় ভাই মোবাইল দোকানের কর্মচারী। ছোটভাই পড়াশুনা করছে না। মায়ের একদা বহুগামীতার কারণে পারিবারিক অশান্তি খুবই তীব্র। বাবার কর্মবিমূখতা ও পরিবার বিমুখতা এমন যে পারিবারিক দ্বায়িত্ব পালনে সে প্রায় অসমর্থ। কয়েক মাস আগেও তারা ফার্মগেটে থাকতো কিন্তু ভাড়া বাকী পড়ায় সেখান থেকে বের করে দিয়েছে। এমনকি তাও নয়, এরও আগে বাড়ী ভাড়ার জন্য বাড়ীওয়ালা তাকে বাসায় আটকে রেখেছে এবং তার এসএসসি পরীক্ষার একটি বিষয়ে অংশ নেয়া হয়নি। টাকা না পেয়ে বাড়ীওয়ালা তাকে ও তার মাকে বেশ্যাবৃত্তিতে নেমে যাওয়ার উপদেশ দিয়েছে। এবং এখন তারা যে বাসায় থাকছে সেখানেও ২ মাসের ভাড়া বাকী পড়ে গেছে এবং অনুমান করছে এখান থেকেও চলে যেতে হবে। তার প্রায় মনোবিকলনগ্রস্থ মায়ের সাম্প্রতিক প্রবণতা হল তার বাবা এবং তার মধ্যে অবৈধ যৌন সর্ম্পক নিয়ে সন্দেহ করা।
যে বন্ধুটির প্রতি ওর সত্যিকার দূর্বলতা আছে, যাকে সে ভালোবাসে তার কাছ থেকে সে সরে এসেছে। যে ১৫০০টাকা তার কাছ থেকে ঋণ করেছিল (বকেয়া বাড়ী ভাড়া দেবার জন্য) তার কাছ থেকেই এজন্য অপমানিত হয়েছে। আবার অন্য ধর্মের সেই ছেলেটিকেই সে সবচেয়ে ভালোবাসে, কেননা সবকিছুর পরও ছেলেটি তাকে সত্যিকার! পছন্দ করে। মোবাইল যেটা ছিল সেটা পারিবারিক কলহে শহীদ হয়েছে । আগে যে দোকানে চাকুরী করত সেই দোকানের মালিক ও ম্যানেজার তাকে নানা বাজে ইঙ্গিত করে। তারা তাকে সহ অন্য নারী কর্মচারীদের আয়নার ফাঁক দিয়ে দেখতো। তবে মোদ্দা কথা তার ৩৫০০৳ দরকার, নিজের পরিবারকে উদ্ধার করা দরকার। সে অন্য ধর্মের ছেলেকে পছন্দ করলেও বিয়ে করতে পারবে না। কেননা তার বিয়েতে ৫০০০০টাকা খরচের যে ওয়াদা তার চাচা করেছে বিধর্মী বিয়ে করলে সেটাও সে পাবে না। আবার সে কেবল একা বাঁচতেও চায় না। অর্থাৎ ওর আব্রুর মূল্য জানে, পারিবারিক সদস্যপদের মূল্য জানে, ভালোবাসার মূল্যও জানে। তবুও পুঁজি হিসেবে শরীর, শ্রম, সম্পর্ক এসবের লেনদেন সে খুব ভালোভাবে জেনে ফেললেও সে আব্রু রক্ষা করতে চায়, তবুও সে অন্তত সচ্ছল ও আন্তরিক পুরুষের স্বপ্ন দেখে।
অনেক কষ্টে আমি আমার স্তম্ভিত অবস্থা তার কাছ থেকে লুকাই এবং আরেকটা মন খারাপ করা উপকারী কথা বলি। আমি বলি কোন সহৃদয় পুরুষের কল্পনা করার চাইতে তুমি স্বাবলম্বী হবার নতুন নতুন রাস্তাগুলো খোঁজ। নিজেকে ভালোবাস। যখন থেকে তুমি টাকা পয়সা কামাচ্ছো, দেখবে তোমার সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে, তুমি তোমার মত জীবন যাপণ করতে পারবে। দৃশ্যত ওর পরিস্থিতির ক্ষেত্রে প্রথাগত উপকারী চোখগুলো এত ঘোলাটে যে; কোন পকেটে রাখাই কষ্টকর মনে হয়। ও একেবারে দরিদ্র না ও গার্মেন্টস কর্মীও না, ও শিক্ষিত কিন্তু এসএসসি পাশ না। ও এখন যেই শ্রেণীতে সেটাই তার আদি শ্রেণী না। তাহলে ও কি? ও হল মহানগরে বিদ্যমান এরকম অসংখ্য বাস্তবতার একটি। যার প্রতিটিই এত তীব্র যে কোন তুলনা চলেনা। তুলনা দিয়ে হয়ও না। ওকে দিয়ে ছোটগল্প হয়, নাটক হয়, ইদানীং এনজিও হয়, গবেষণা হয়, অথবা সবচেয়ে অবধারিত গল্পে আপোষ হয়, যৌনবৃত্তি হয় (বৈধ বা অবৈধ উভয় অর্থেই)। ওকে দিয়ে কি হয় এই কথা বলার সাহস অন্যদের হয় ওকে জানতে পারলে। ওর ভাঙ্গা কাঠামোগুলোকে চিহ্নিত করতে পারলে। ও যদি আজ বা কাল যৌনকর্মী হিসেবে নামও লেখায় তাতে আমার তীব্র কষ্ট থাকলেও অসম্মান থাকবে না।
কিন্তু আমি ওর এই হয়ে ওঠাটাকে দেখতে চাই না। যদিও অন্ধ বাস্তবতা; সুবিধাভোগী বাস্তবতা বলে যে ওর জন্য কিছু করাই সবচেয়ে দুরুহু, এমনকি সরাসরি আক্রান্ত, রোগগ্রস্থের চাইতেও। ও হয়ত পঙ্গু হলে আরো সহজ হোত। সোজা চাঁদা দিয়ে আসতাম। কিন্তু শ্রেণী, লিঙ্গ, সামাজিক মতাদর্শ আর ধর্মের পঙ্গুত্ব ওর বাস্তবতাকে আরো ভয়ঙ্কর আরো নি:শ্বাসহীন মারাত্মক করে তোলে।
নামপদহীন এই অসংখ্য ও দের ভীরে কোন না কোনভাবে রাস্তা খুঁজে নেওয়া বা হারিয়ে যাওয়ার জটিল পরিক্রমণে মুখ ও মুখোশের খেলাটা যে এত নগ্নভাবে সামনে আসবে সে জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না মোটেই। আলাপ শেষ করে ওকে বাসে তুলে দেই। ও আমার কাছে কিছুই চায় না বরং আত্মসম্মানার্থে ধারের ৫ টাকা পরিশোধ করতে চায় খাইয়ে, বা অন্তত রিকশা ভাড়া দিয়ে। আসলে ভাই বা বন্ধুর মত ও কেবল ওর বাস্তবতা শেয়ার করতে চায়। আমি জোরালো স্বরেই ওর সাথে কথা বলি, কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমি বোবা বিমূঢ় থাকি।
এই ও, কে নিয়ে কি আপনাদের কৌতুহল হয়? তাহলে নিশ্চিত জানুন, আজ-কাল-পরশু এই ঈদের মরশুমেই আপনাদের কারো কাছেই সে হয়ত হাসিমুখে পোশাক বিক্রী করছে। এবং আপনি আরেকটি সুদৃশ্য প্যাকেট আর মুখোশ আঁটা হাসি নিয়ে ঘরে ফিরছেন, আপনি পোশাকগুলো দেখছেন, মুখগুলো দেখছেন না, মুখ দেখায় আনন্দ নেই। মুখগুলোকে প্রথার সমাজ সুদৃশ্য প্যাকেটের মতই আড়াল করে রেখেছে।
বি:দ্র: ও র সম্মানের খাতিরেই আমি কোন নাম ব্যবহার করিনি। আমার কাছে মনে হয়েছে যে ওর সম্মানজনক কোন মাসিক আয়ের ব্যবস্থা হলে সমস্যা অনেকখানি দূরীভূত হয়। এ বিষয়ে ব্লগের দুই তিন জনার সাথে কথাও হয়েছে। আমি মনে করি ব্লগে এরকম যোগাযোগ বা ক্ষমতার ব্যক্তিও আছেন অনেকে। ব্লগেরই এক বন্ধু আগ্রহও দেখিয়েছেন। আমি সংবেদনশীল মানুষদের কাছ থেকে আরো জোরালো ও অর্থবহ প্রতিক্রিয়া প্রত্যাশা করছি। অন্তত একজন ও, একটি পূর্ণাঙ্গ নামে আনন্দময়ী হয়ে উঠুক।