কাছের এক বন্ধুকে নাট মন্ডলে ঢুকিয়ে দিয়ে আরেক বন্ধুকে ধরার জন্য শাহবাগে যাচ্ছি। আমার সেই কাছের বন্ধুর আবার অনেক আর্ট কালচার প্রীতি। তাকে সেই মধ্যবিত্ত ক্ষুন্নি নিবৃত্তির জন্য ছেড়ে দিয়ে, চারুকলা ছাড়িয়ে যেতে যেতে মনে হল চিত্রকলা বিক্রি করে সমুদ্রগুপ্তকে বাঁচানো যাবে তো। ঠিক তখনি দূর থেকে দেখতে পেলাম এক নতুন আলোয় উদ্ভাসিত শাহবাগ। জাদুর বাক্সের ছোঁয়ায় মুগ্ধ হয়ে পথচারী আর পথজীবিরা সম্মোহিত হয়ে আছেন। বিষয়টা আরো স্পষ্ট হল এজন্য যে পিছনের পুরো জায়গাটুকু সেই আলোতে অন্ধকার হয়ে গেছে।
শাহবাগের মোড়ে নতুন একখান চমক দেয়া যন্ত্র স্থাপিত হয়েছে। যেমন বিশাল তার বপু তেমনি তার রঙ-ঢং। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কর্পোরেট অনুপ্রবেশের এ যাবৎ কালের সবচেয়ে বড় স্মারক বলা যায় এটাকে। এটাকে রক্ষা করার প্রস্তুতিও লক্ষনীয়, চারপাশে কাঁটা গ্রীলের বেড়া, আর পিঠের দিকে সাদা আঁচিলের মত একটা এসি। পিঠ চুলকে দেবার জন্য একটা সিঁড়িও দেখা যায় খেয়াল করলে। ঠিক একই ধরণের লক্ষ্যনীয় বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বেগুনী নীল গুয়ের মত জাদুঘরের ঠিক বিপরীতে পুলিশ ফাঁড়িটা। রাষ্ট্র যেন নিজ হাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্ব শাসনকে রক্ষা করার ঠিকাদারি নিয়ে সদর্পে দাঁড়িয়ে আছে।
অত:পর আমি যখন সেই জাদুর আলোতে যেয়ে পৌছলাম তখন দেখা গেল দুজন ভিক্ষুক, একজন পতিতা, একজন বোবা মানুষ আর একজন ছটফট করা গাঁজাসেবী মুগ্ধ হয়ে সবচেয়ে মনোযোগী দর্শক হয়ে রাষ্ট্র্র্রের বয়ান গিলছে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী, নতুন আর্টকালচার জীবি, রাস্তা পার হবার আগে তড়িৎ বিশ্রাম নেয়া পথচারী, কয়েক জন টহল দেয়া পুলিশ, হাসপাতালে খাবার নিয়ে আসা দু চারজন আত্মীয় বন্ধু এমনো হরেক রকমের হরেক কিসিমের মানুষ জাদুর বাক্সের মোহে আটকা পড়ে গেছে। আমরা যতই আমরা আমরা চিৎকার করি না কেন, রাষ্ট্র যতই আমরা’র হেজেমনিতে বুদ করিয়ে রাখতে ইচ্ছুক হোক কা কেন, কেবল এই মুহুর্তিক স্ন্যাপশটেই স্পষ্ট যে আমরা আসলে আমরা নই।
হুমায়ুন ফরিদি থেকে মমতাজ একে একে এসে বলে যাচ্ছে তারা ভোটার আইডি করেছে আর প্রশ্ন করছে আমরা করেছি তো? আসলে রাষ্ট্র প্রশ্ন করছে আমাদের। সামরিকরা যে কত দ্বায়িত্ববান তা প্রমাণ করছে আইডি কার্ড লেমিনেটিং করার পাঁয়তারা দেখিয়ে। আর স্টক একচেঞ্জের মত স্ক্রীণের নীচে জানিয়ে দিচ্ছে রাজশাহীতে কত শতাংশ, খুলনা, দিনাজপুরে, বান্দরবানে কত শতাংশ মানবপাল রাষ্ট্রীয় ডিজিটাল নখের আওতায় চলে এসেছে। আর যারা আসেনি তারা যে কত বোকা সেটার কথাও মনে করিয়ে দিচ্ছে। কর্পোরেট আবার জানিয়ে দিচ্ছে বোকা হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আমাদের কি করতে হবে। আসলে আমাদের বিগ বস খেতে হবে আর তাহলেই আমাদের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। তাহলেই আমরা ভ্যাবদা বাঙাল হয়েও আরাধ্য নারীকে পেয়ে যাব, আমরা স্মার্ট হয়ে যাব। হয়ত খুবই কাকতালীয় মনে হতে পারে কিন্তু এখানে যে এন্টি হিরোকে আমরা মোটর বাইকে দেখি, তার বাইক হারলি ডেভিডসনের অনুরূপ, তার নাম স্যাম। অর্থাৎ শ্যাম চাচা অর্থাৎ আমেরিকা। তাহলে কি আমেরিকার ছিনিয়ে নেওয়া থেকে আমাদের তথাকথিত তেলগ্যাসস্বাধীনতা রক্ষা করবে বিগবস অর্থাৎ স্থানিক কর্পোরেট অর্থাৎ এই তত্বাবধায়ক সামরিক? কেমন যেন উদ্ভট শোনায়।
সড়ক দ্বীপের মাঝখানে বসে থাকা বোবা মানুষটা আমার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে সাহায্য চায়, আমি অপারগতা দেখালে হাসিমুখে মেনে নেয়। কিন্তু সে দুচোখ খুলে বিগবস আর নির্বাচন কমিশন গিললেও এ খাদ্য তার ভেতরে ঢোকে না। কেননা এর সাথে তার কোন যোগাযোগই হয় না। সে আবারো বিনয়ের সাথে অন্য কারো কাছে ইশারায় খাদ্য চায়, সাহায্য চায় কিন্তু সামনের দর্শনীয় বস্তুর আলোর ইতংবিতং সে বোঝেনা। তার পাশে হেলান দিয়ে থাকা পতিতাও সেটা বোঝেনা। সে বোঝেনা কেন নির্বাচন কমিশনের কর্মতৎপরতা প্রকাশের জন্য একটা আস্ত বিগস্ক্রীণ টিভির দরকার হয়। কেন আয় খুকু আয় বলে আর মৃত মায়ের কাছে বেলুন উড়িয়ে চিঠি পাঠানোর গল্পটা বলা এত দরকার। কেন প্রিয় সাথীর জন্য ইউরো লেমনই সমাধান। সে বড় জোর তৃষ্ণার্ত হলে বোতলের পানি সাফ করে দিতে পারে। কিন্তু বড় স্ক্রীণের বড় স্বপ্ন তার ভেতরে ঢোকে না।
তাহলে রাষ্ট্রর এই বৈধতা প্রদানের চেষ্টা, তথাকথিত জনগণকে জ্ঞাত করার চেষ্টা কিসের জন্য? মানুষজনকে তৎপরতা দেখিয়ে সম্মতি উৎপাদনের জন্য। কিসের জন্য এই সম্মতি? সেই পুরান ইউটোপিয়া, গণতন্ত্রের জন্য। যদিও পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী বনে সিটিসেলের এখন ছুটে চলা আমাদের কখনোই বলেনা যে নিয়ন্ত্রণ রক্ষার তাগিদ থেকেই এতদিন নেটওয়ার্ক পৌছায় নি, বিষয়টা অবকাঠামোর নয়। বড়; আরো আরো বড় পর্দায় আমরা বাঙলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ, দেশপ্রেম, স্বাধীনতা, রাজাকারের বিচার নিয়ে মগ্ন, দুর্নীতি দমন নিয়ে মগ্ন। যদি ভুল করে মনেও করি সেই “আমরা” আসলেই আছে তাহলে কই সেখানে যাওয়ার ট্রেনটা তো আমরা পাচ্ছি না। আমাদের বড় বড় স্ক্রীণে বারবার দেখানো হচ্ছে ট্রেনটা আসছে, তার আসার শব্দ আমরা পাচ্ছি, এই তো এসে গেল বলে। এবং আমি নিশ্চিত বলতে পারি এই দেশের অধিকাংশ মানুষ ট্রেনও বুঝছেনা রেল লাইনও বুঝছেনা। অন্তত রাষ্ট্রের মত করে বুঝছে না। আর আমরা যারা রাষ্ট্র ঘনিষ্ট বলে ভাবতে ভালবাসি এবং একটু সচেতন অহংকারও করি তারা দেখছি, ট্রেন আর লাইন কোনটারই কোন দিশা খুজে পাওয়া যাচ্ছে না। রাষ্ট্রের এই বিগ স্ক্রীণ মূলত আমাদের জন্য। আর স্ক্রীণের মুগ্ধ নির্বোধ এবং নিবেদিত দর্শক এই আমরা; বোবাদের, বোকাদের, পতিতাদের, ভবঘুরেদের, কৃষকদের,বস্তির মানুষজনদের, বাংলাদেশকে কেবল দ্রব্যমূল দিয়ে বোঝা মানুষজনদের বুঝদার টিভি বিশেষজ্ঞ হিসেবে টকশো, রকশো, লো-শো, হা-ই--শো, তানিয়া শো, ল-শো, মাহি বি শো, লীগ শো, ইসলামী টিভি শো, মিগ ২৯ শো, দুই বিএনপি শো, জোট শো, বিজ্ঞান শো, আলু শো দিয়ে বোঝাচ্ছি তোমরা সচেতন হও সামনে ট্রেন আসছে। সচেতন না হলে তোমরা ট্রেন ধরতে পারবা না। এই ট্রেন খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এই ট্রেন আমাদের জাতির, স্বাধীনতার, সার্বভৌমত্বের, তেল গ্যাসের, আমাদের নারীর, আমাদের পেশীর, আমাদের শিশ্নের, আমাদের স্তনের আমাদের যোণীর, আমাদের বুদ্ধীজীবিতার, আমাদের অ-বাক স্বাধীনতার, আমাদের প্রযুক্তির, আমাদের ব্লগের, আমাদের ব্যানের, আমাদের আনব্যানের, আমাদের উত্তর আধুনিকতার, আমাদের প্রকৃত আধুনিকতার, আমাদের নয়া উপনিবেশ বাদের, আমাদের নারীদের বাদের, আমাদের বেটাদের এসিড মারার অধিকারের, আমাদের পোলমাইয়ার ইয়াবা খাওনের, আমাদের এনজিওর সিডরের কোটিপতি হওনের, আমাদের মুক্তচিন্তার মুক্ত প্রশ্রাবের, আমাদের বোরখার পবিত্রতায় ইসলামীক সংগমের, আমাদের নিজামীর অ-রাজাকার গোয়ার, আমাদের প্রায় নষ্ট হতে বসা এতগুলো আমদানী করা গাড়ীর, আমাদের গেলমানদের শোক শোক কান্নার, আমাদের নিহত মুক্তিযোদ্ধার বিক্রি হওয়া সার্টিফিকেট, আমাদের ফ্ল্যাটি বাড়ীর, আমাদের গাড়ীর, আমাদের সিএনজির, আমাদের স্কলারশিপ, আমাদের ল্যাপটপ, আমাদের কম্পুমেলা, আমাদের মিলার বুক, আমাদের প্রথম আলো তারকা, আমাদের সংস্কৃতি হাতপাখা, আমাদের গামছা পোশাক, আমাদের সেলাই দিদিমনিদের শরীর আর ঘাম, আমাদের উন্নয়ন কর্মীদের নিদারূণ কর্ম উদ্যগ, আমাদের পার্লামেন্ট, আমাদের তত্ত্বাবধায়ক, আমাদের আইএমএফ, আমাদের হায়দার হোসেন, আমাদের সেরা কণ্ঠ, আমাদের সেরা দর্শকের জন্য খুবই জরুরী।
আমরা আমাদের সেরা দর্শকত্ব নিয়ে বিমোহিত তাই আরও বেশি চিন্তিত ট্রেনটা আসছে না কেন। কিন্তু যদি কোনদিনই প্রত্যাশিত ট্রেনটা না আসে তাহলে কি আমরা বিগস্ক্রীণটার সামনে যেয়ে আত্মহত্যা করব? কিন্তু দীর্ঘদিন দর্শক থাকার পর আমাদের কি মনে হবে না বিজ্ঞাপন বিরতির পর একটা ভালো নাটক শুরু হবে, আগে যেমন ছিল উর্দুতে এবার হয়ত ইংরেজীতে, হয়ত একটু সামরিক বাংলাতেই; আরেকটু অপেক্ষা করি। কিন্তু আমরা কি কখনোই টিভিটার পেছনে দেখবো না, টিভিটার পেছনে লুকিয়ে থাকা মানুষগুলোকে দেখবো না? ট্রেনের জন্য কেবল প্রতীক্ষা করলে আমরা আসলে কোনদিনই স্ক্রীণের পেছনের কিছু দেখবো না। এমনকি টিভি ভেংগে টুকরো টুকরো হয়ে গেলেও। এমনকি আমরা ভাঙ্গা টুকরো টুকরো টিভি হয়ে গেলেও।