শেকলে বাঁধা ময়না
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
ঘরে ঢুকেই আসিফ চমকে উঠল । ব্যালকনিতে ঝুলানো খাঁচায় ময়না পাখিটি নেই । খাঁচার দরজা খোলা। সে বুঝে উঠতে পারছেনা কি করে এমনটি হল। শায়লাও তাকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে দরজা খুলেই ভিতরে চলে গেছে।
সে এক দৃষ্টে খাঁচার খোলা দরজা দিয়ে তাকিয়ে আছে। অর্পার কত প্রিয় ছিল এই পাখি । রুপকথার গল্পে কথা বলা তোতা পাখির কথা শুনে মেয়ে বায়না ধরেছিল তাকেও অমন একটা পাখি কিনে দিতে হবে। সে কি কান্নাকাটি মেয়ের। শেষে বাধ্য হয়েই এই ময়না পাখি কিনে এনেছিল সে।
পাখি দেখে মেয়ের উচ্ছাস ছিল দেখার মত। মেয়ের চাওয়া পূরন করে আসিফ ও খুশি হয়েছিল অনেক। কত কথা অর্পার এই পাখি নিয়ে। কবে থেকে কথা বলা শুরু করবে সে নিয়ে তার কত টেনশন।
স্কুল থেকে ফিরার পর এই পাখিই ছিল তার সব কিছু। তাকে খাওয়ানোর আগে এই পাখিটিকে খাওয়াতে হবে, নিয়মিত গোসল করাতে হবে। ইট পাথরের দেয়ালল ঘেরা জীবনে এই পাখিই ছিল মেয়ের খেলার সাথী, কথা বলার সঙ্গী। নিজে নিজেই পাখির সাথে মেয়ে কথা বলে যেত।
স্কুলের গল্প, বাইরে ঘুরে এসে ঘুরার গল্প, সবই হত এই পাখির সাথে। পাখির একটি নামও দিয়েছিল সে "টুনি"। গল্পের বই এ পড়া নাম। সময়ে অসময়ে সে পাখিটির পাশে বসে বলত "আমার নাম টুনি" । হাজার বারের উপরে বলা হয়ে গেছে তার, তবুও পাখিটি এখন পর্যন্ত কোন কথা বলেনি। অর্পার অতি আল্লাদে মাঝে মাঝে সে নিজের স্বরে ডেকে উঠত। আর মেয়ে তার প্রতিবাদ করে বলত, না না, বল- আমার নাম টুনি । টুনি কি আর অত সহজে পোষ মানে। বাসায় যেই আসুক তার একবার টুনির সাথে কথা বলে যেতে হবে। মেয়ের এহেন কান্ডে আসিফ আর শায়লা মজায় পেত। মেয়েত আর তার মত বনে বাঁদারে ঘোরার সুযোগ পাইনি, খোলা আকাশে মুক্ত পাখিও সে দেখেনি এক কাক ছাড়া। এই পাখি নিয়ে মেয়ের সময় কেটে যায় এতেই খুশি তারা।
মজা হত যখন মেয়ের দাদু এসেছিল তখন । দাদী আর নাতনী মিলে সারাক্ষন টুনির সাথে গল্প করত । সে গল্প জুড়ে পুরোটা ছিল আসিফের দুরন্তপনার গল্প। গুলতি নিয়ে পাখি শিকারে বের হবার গল্প। পেপার পড়তে পড়তে সে গল্প শুনে আসিফ ও স্মৃতিকাতর হত। দাদী দেশে বেড়াতে চলে যাবার পর এখন এই পাখিই অর্পার একমাত্র সাথী।
এইসব ভাবতে ভাবতে আসিফ ঘরের ভিতরে ঢুকে। শায়লা টেবিলে ভাত রেডী করছিল। হালকা উচ্চস্বরে আসিফ বলে উঠে, একটা পাখিও দেখে রাখতে পারনা, কি করে কেমন করে পাখিটা উড়ে গেল, কে দরজা খুলে দিল। আমার মেয়ের কত শখের এই পাখি ।
শায়লা একবার আসিফের দিকে তাকাল। শোন সবকিছুতেই না বুঝে হাউকাউ করা তোমার স্বভাব। এ স্বভাব বদলাও। আগে জান তারপর চিল্লাফাল্লা করতে হলে করবা। তোমার মেয়ে নিজেই তার শখের পাখি ছেড়ে দিয়েছে। কাউকে বিনা কারনে আঁটকিয়ে রাখা ঠিকনা, তাই ছেড়ে দিয়েছে। আরও কিছু জানার ইচ্ছা হলে মেয়ে ঘুম থেকে উঠলে সকালে জিজ্ঞাসা করো, এখন হাত মুখ ধুয়ে এসো।
আসিফ ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। মেয়ে তার নিজ ইচ্ছাতেই পাখিটিকে ছেড়ে দিয়েছে , কি কারনে সে কিছু বুঝতে পারলনা। বেডরূমে গিয়ে দেখে মেয়ে ঘুমাচ্ছে। পরীর মত লাগছে মেয়েকে হালকা ডিম লাইটের আলোয়।
সে আর এ নিয়ে কথা বাড়ালনা।
সকালে মেয়ের ডাকে ঘুম ভাঙ্গল তার। বাবাকে জড়িয়ে ধরে অর্পা বলল , বাবা আমি টুনিকে ছেড়ে দিয়েছি । ঘুম জড়ানো কন্ঠে সে জানতে চাইল কেন মা, তুমি না ওকে কথা বলা শিখাবে। না বাবা এটা ঠিক না। কাউকে জোড় করে অন্যের ভাষা শেখানো ঠিক না। ও তাতে খুব কষ্ট পেত। ও কিছু বলতে পারতনা, তাই মাঝে মাঝে নিজের মত করে চিৎকার করত। স্কুলে মিস যখন ২১ শে ফেব্রুয়ারির কথা বলেছে আমার তখনই মনে হয়েছে টুনিকে জোড় করে আমাদের ভাষা শেখানো ঠিক হবেনা। আর কাউকে বন্দী করাও ঠিক না। তাই বাসায় এসে ওকে ছেড়ে দিয়েছি।
আসিফত মেয়ের কথায় হতবাক। এতটুকু মেয়ে বলে কি, তার চোখ থেকে ঘুম উধাও। জানতে চাইল স্কুলে মিস কি বলেছে।
অর্পা বলে চলে, মিস বলেছে- পাকিস্তানীরা আমাদের উপর জোড় করে বলেছিল ওদের ভাষায় কথা বলতে হবে। আমাদের দেশের মানুষ ওদের কথা শুনেনি। সবাই রাস্তায় নেমে এসেছিল। ওরা গুলি করে। আমাদের সালাম বরকতরা গুলি খেয়ে শহীদ হয়। তারপর ওরা বাধ্য হয় আমাদেরকে আমাদের ভাষায় কথা বলতে দিতে । আমাদের জয় হয়, আমরা বাংলায় , আমাদের ভাষায় কথা বলতে পারি এখন। ওরা খুব শয়তান ছিল, কথায় কথায় আমাদেরকে আঁটকে রাখতে চাইত, কস্ট দিত। তাই একদিন আমরা কষ্ট সহ্য করতে না পেরে ওদের সাথে যুদ্ধ করি। আমাদের অনেকে শহীদ হয়, অনেক ক্ষতি হয় আমাদের। তারপর আমরা আমাদের একটা দেশ পাই। মিস বলেছেন এই কথা বলতে না দেয়ার কারনেই আমরা রাস্তায় নেমে আসি, আর ধীরে ধীরে স্বাধীনতা আসে, আমরা একটা নিজের দেশ বাংলাদেশ পেয়েছি এই ভাবে।
আসিফ মুগ্ধ চোখে মেয়ের কথা শোনে। আসিফ কে ডাকতে এসে শায়লাও চুপ করে মেয়ের কথা শুনে যায়।
অর্পা বলে চলে, টুনির বন্ধুরাত কেউ ওর সাথে নেই, তাই ও কিছু বলতে পারেনা , মাঝে মাঝে নিজের মনে চিৎকার করে। এজন্য ওকে ছেড়ে দিয়েছি। কাউকে জোড় করে অন্যের ভাষা শেখানো ঠিকনা, তাই না বাবা। ওকে ওর মত, ওর বন্ধুদের সাথে , বাবা মার সাথে থাকতে দেয়া ভাল তাই না বাবা।
আসিফ নিজেও কখনও অমন করে ভেবেছে কিনা সে জানেনা। মেয়ের এই বোধদয়ে, মেয়ের এই মমত্ববোধে তার চোখ আদ্র হয়ে উঠে। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে আসিফ বলে উঠে তুমি খুব ভাল কাজ করেছ মামনি। খুব , খুবই ভাল কাজ, কাউকে জোড় করে অন্যের ভাষা শেখানো ঠিকনা, কাউকে বিনা কারনে বন্দী করে রাখা উচিৎ না। মেয়েকে বুকের গভীরে চেপে ধরে আসিফ পরম মমতায়।
ওয়ার্ডোবে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো শায়লা এক দৃষ্টে চেয়ে থাকে বাবা আর মেয়ের দিকে , ভাবছে সে ও গিয়ে জড়িয়ে ধরবে কিনা মেয়েকে !
৪৭টি মন্তব্য ৪০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
কমলার জয়ের ক্ষীণ ১টা আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে।
এই সপ্তাহের শুরুর দিকের জরীপে ৭টি স্যুইংষ্টেইটের ৫টাই ট্রাম্পের দিকে চলে গেছে; এখনো ট্রাম্পের দিকেই আছে; হিসেব মতো ট্রাম্প জয়ী হওয়ার কথা ছিলো। আজকে একটু পরিবর্তণ দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন
বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?
সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী
বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন
জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন
=বেলা যে যায় চলে=
রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।
সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন