somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বৃষ্টি ছায়া

২৩ শে এপ্রিল, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এমন মেঘলা বৃষ্টির দিনে আমি কোথাও ঝিম মেরে বসে মানুষ দেখি, প্রকৃতি দেখি। ভিজে যাওয়া মানুষ আর ধুয়ে যাওয়া প্রকৃতি দেখতে খুব সুন্দর হয়। মানুষ ভিজে গেলে বিশুদ্ধ লাগে, প্রকৃতিও তাই। মনে হচ্ছে পাপ ধুয়ে যাচ্ছে, তারপর সেই পাপ রাস্তায় গড়িয়ে নানান খাল, নালা-নর্দমা পেরিয়ে মিশে যাচ্ছে কোন এক সমুদ্রে। সমুদ্রের মন বিশাল, যার কারনে সে সবার পাপকে নিজের বুকে ধারন করতে পারে।

এমনই এক বৃষ্টি মাখা সন্ধ্যায় আমি বসে আছি শাহবুদ্দিন পার্কের বেঞ্চে। রঙিন আলোয় বৃষ্টির পানি দেখতে সুন্দর লাগে। মানুষগুলো ছুটছে, ভীষণ তাড়া-অফিস ছুটি, বাড়ি ফিরতে হবে। আমার কোন তাড়া নেই। আমি মানুষের ছুটে চলা দেখি, ভিজে যাওয়া দেখি। কত চেহারার কত রঙের মানুষ। একেকজনের একেক রকম চোখ, নাক, মাথার চুল সবকিছু আলাদা। মানুষের কত চিন্তা, কত আনন্দ, কত হতাশা তবুও মানুষ এভাবে ছুটে যায় জীবনের জন্য।

এক মধ্যবয়সী ছেলে এসে আমার পাশে দাঁড়ালো। আমাকে বললো;
- ভাইজান কি কাউরে খুঁজছেন?
আমি লোকটার দিকে সরাসরি না তাকিয়ে উত্তর দিলাম,
- হুম।
- কারে খুঁজেন? এই এলাকায় থাকেন আপনি?

আমি লোকটার দিকে তাকালাম। কালো গেঞ্জি পরা, মাঝবয়সী এক যুবক। চুলের ভঙিতে মনে হলো বেশ সখের চুল। বারবার হাত দিয়ে নাড়াচ্ছে। আমি বসে থেকেই উত্তর দিলাম,
-এই এলাকায় থাকিনা। আমি কাউকে খুঁজছিও না।

এবার সে পকেট থেকে একটা চাকু বের করে বলে,
-ভাইজান, আপনে যা খুশি করেন এখন আপনের কাছে যা যা আছে দিয়া দেন। এরপর সারারাত বইয়া থাকেন।

আমি কোন কথা না বলে পকেট থেকে ফোন বের করে দিলাম, মানিব্যাগ বের করে দিলাম। আর হাতের ঘড়িটাও দিলাম। ছিনতাইকারী লোকটাকে মহা খুশি মনে হলো। বিনা পরিশ্রমে এরকম কাজ সে বোধহয় কমই করেছে। সে আমার দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছিলো। আমি সবকিছু দিয়ে লোকটাকে বললাম;
- এগুলো এখন থেকে আপনার। সব আপনার জিনিস। আপনি পরেন, ঘড়িটা লাগান আর মানিব্যাগ প্যান্টে রাখেন। মোবাইল হাতে রাখলেও রাখতে পারেন।
লোকটা কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে উত্তর দিলো,
- ক্যান?

আমি বললাম,
- আমার পাশে বসেন। আপনার সাথে খুব গল্প করতে ইচ্ছা করছে। জিনিসপত্র নিয়ে চিন্তা কইরেন না। এসব আপনাকে দিয়ে দিলাম।

লোকটা কিছুটা দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে আমার পাশে বসলো। আমি জিজ্ঞেস করলাম কি নাম আপনার ভাই?
- জনি মিয়া।
- চা খাওয়াতে পারবেন? খুব চা খেতে ইচ্ছা করছে৷ বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে চা খাওয়ার অন্যরকম মজা আছে।

জনি মিয়া চিন্তায় পড়ে গেলো। সে চলে যেতে চায়। কিন্তু চা খেতে চাওয়ায় না করতেও পারছে না। সে দ্বিধা নিয়ে উত্তর দিলো;
-দেখি পাওয়া যায় কিনা। পাইলে আমি নিয়া আসুম।

জনি মিয়া একথা বলে হন হন করে উঠে চলে গেলো। তার তাড়া আছে এখন। আমার থেকে নেয়া মালগুলো রেখে আসতে হবে। তবে আমার ধারনা জনি মিয়া একটু পরেই দুইকাপ চা নিয়ে ফেরত আসবে। সে এই পার্কেই ছিনতাইয়ের কাজ করে। যার ফলে আবার এসে সে আমাকে বসে থাকতে দেখলে চা দিয়ে যাবে এটা মোটামুটি বলা যায়। ঢাকা শহরে রাত বিরাতে ঘুরে আমার একটা অভিজ্ঞতা হলো যে কোন রাস্তার খেটে-খাওয়া ভবঘুরে আর ছিনতাইকারীর কাছে যদি আপনি চা খাওয়া আর সিগারেট খাওয়ার আবদার করেন তারা কখনো তা ফিরিয়ে দিতে পারেনা।

প্রায় ঘন্টা খানেক পর দেখি সত্যি সত্যি জনি মিয়া দুই কাপ দুধ চা নিয়ে হাজির। আমাকে বলে;
- আপনে এহনো এইখানে বইসা আছেন? আমি তো ভাবছি চইলা গেছেন। এই লন চা খান, আমি দুধ চা খাই তাই আপনার জন্যেও লইয়া আইলাম।
- অনেক ধন্যবাদ জনি ভাই। আপনি যে আসবেন তা আমি জানতাম। এজন্য অপেক্ষা করছি চা খেতে।

জনি আমার পাশে বসে আয়েশ করে চা খাচ্ছে। জনির চেহারা সুন্দর। গাল ভাঙা, নেশাটেশা করে বলে মনে হয়। চা খায় আর আমাকে দেখে। আমি দূরে তাকিয়ে বেশ খুশি মনে চা খাই। জিজ্ঞেস করলাম,
- জনিভাই আপনি মানুষটা ভালো। মন বড়, বড় মনের মানুষের এই কাজ করা উচিত না। বড় মানুষ বড় বড় কাজ করবে, ভালো কাজ করবে। এটা ছোটলোকের কাজ, আপনার হৃদয়ের সাথে এই কাজ যায়না।

জনি আমার কথা শুনে খুশি হলো মনে হয়। নিজের সম্পর্কে ভালো কথা শুনতে সবার ভালো লাগে। সে আমার দিকে একটা সিগারেট এগিয়ে দিয়ে বললো,
- ভাইজান বিড়ি খান? আমি খামু এখন। আপনি আমারে এত ভালো ভালো কথা কইছেন, বিড়ি না খাইলে হইতো না।

আমি সিগারেট হাতে নিয়ে দেখলাম বেনসন সিগারেট! সে আস্তে করে বললো,
- এই সিগারেট আমি কিনিনাই, আপনের আগে আরেকটা কাম করছিলাম তার পকেট থেইকা লইয়া লইছি।

আমরা পাশাপাশি বসে চা খাই, সিগারেট ধরাই। চারপাশে শহরের ব্যস্ততা, বৃষ্টির ঝরঝর, আর আমাদের দুজনের মাঝখানে গাঢ় নীরবতা। এই শহর হাজাররকম মুখোশ পরে, কিন্তু কিছু কিছু সন্ধ্যা সেই মুখোশ ছিঁড়ে সত্যি হয়ে ওঠে।

আমি জনির দিকে তাকিয়ে বললাম,
—জানেন, এই শহর আমাদের মতো মানুষকে বড় সহজে ভুলে যায়। যে দিন আপনার পকেটে কিছু থাকবে না, আপনার খবর কেউ রাখবে না।

জনি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর আস্তে করে বলল,
—ভাইজান, আমি ছোটবেলায় ফুটপাতে ঘুমাইছি। এখনো মাঝে মাঝে ফুটপাতে ঘুমাই। কিন্তু মনে হয়, এই শহরের ফুটপাতও আমারে ভুলে গেছে।

তার কণ্ঠে একরাশ বিষণ্নতা। সে কাঁপা হাতে সিগারেট মুখে দেয়, আবার নামিয়ে রাখে।
—জানেন, আমিও চাইছিলাম লেখাপড়া শিখি। আমার ভাই পড়ত, আমি দোকানে কাজ করতাম। একদিন ভাইটা হারাই গেলো। কেউ জানে না কোথায়। আমি অনেক খুইজাও পাইলাম না। এরপর আমিও হারায়া গেলাম—মানুষের ভিড়ে।

আমি ওর দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকলাম। কী বলব জানি না। এই শহরে কতজন জনি মিয়া হারিয়ে গেছে, কেউ কখনো খোঁজ নেয়নি।

জনি চা-এর শেষ চুমুক দিয়ে বলল,
—ভাইজান, আপনের মতো কেউ আগে কথা কয় নাই। সবাই ডরে, কেউ থামে না, কেউ ভাবে না।

আমি হেসে বলি,
—ভয় না পাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। ভালো থাকার চেষ্টা করবেন, ভালো মানুষ হওয়ার চেষ্টা করবেন। এই শহরে ভালো থাকাটাই সাহস।

সে এবার সত্যি হাসল। তার হাসিতে ক্লান্তি, কিন্তু একফোঁটা শান্তিও।
—ভাইজান, আবার দেখা হইবো?

আমি উত্তর দিলাম না। শুধু বললাম,
—হয়তো। দেখা না হোক, মনে রাখবেন—আপনার ভিতর এখনো ভালো কিছু বেঁচে আছে। সেটাকে মরতে দিবেন না।

জনি মাথা নিচু করে চুপ করে বসে রইল। তারপর হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
—আমি যাই ভাইজান। কাল আবার কামে নামতে হইবো।

আমি তাকিয়ে রইলাম তার চলে যাওয়া পেছনে। কাঁধটা একটু ঝুঁকে আছে, কিন্তু পায়ের হাঁটায় এখন একটুখানি ভারসাম্য। যেন কথাগুলো কিছুটা ভার কমিয়েছে তার।

তিন চার মিনিট পর সে দৌড়ে এসে আমার ঘড়ি, মোবাইল, মানিব্যাগ আমার হাতে দিয়ে বলে
- ভাইজান, এই লন আপনের সব জিনিস। এগুলান আমি নিতে পারুম না। আপনের জন্য আইজকা থেইকা সাহাবুদ্দিন পার্ক ফ্রী। দিন রাইত বইয়া থাকবেন কেউ কাছে আইবো না। এটা জনি মিয়ার এলাকা।

কথাগুলো বলেই জনি মিয়া আবার চলে গেলো। যেতে যেতে সে আরেকটা সিগারেট ধরালো। মাথায় হাত ঘুরালো কয়েকবার। সে খুব ধীর পায়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ছায়ায় হারিয়ে গেলো।

বৃষ্টি তখনো ঝরছে। শহরের আলোয় পানির ফোঁটা ঝলমল করছে। আমি জানি, জনির মতো আরও কতজন ছায়া হয়ে ঘোরে এই শহরে। হয়তো কারও জীবনে আমি এক কাপ চা হতে পারি, এক চিমটে সাহস। আমি উঠে ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করলাম, বৃষ্টির ভেতর দিয়ে—নীরবে, নিঃশব্দে।

(গল্প: বৃষ্টি ছায়া © শামীম মোহাম্মদ মাসুদ)


সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৯
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার কথা: দাদার কাছে—একজন বাবার কিছু প্রশ্ন

লিখেছেন সুম১৪৩২, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৫



দাদা,
কেমন আছেন? আশা করি খুবই ভালো আছেন। দিন দিন আপনার ভাই–ব্রাদারের সংখ্যা বাড়ছে—ভালো তো থাকারই কথা।
আমি একজন খুবই সাধারণ নাগরিক। ছোটখাটো একটা চাকরি করি, আর নিজের ছেলে–মেয়ে নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্টেরিম সরকারের শেষদিন : গঠিত হতে যাচ্ছে বিপ্লবী সরকার ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:২২


ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়াকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার আন্তঃদেশীয় প্রকল্পটা সফল হতে অনেক দিন লেগে গিয়েছিল। বাংলাদেশে সে তুলনায় সংশ্লিষ্ট শক্তিসমূহের সফলতা স্বল্প সময়ে অনেক ভালো। এটা বিস্ময়কর ব্যাপার, ‘রাষ্ট্র’... ...বাকিটুকু পড়ুন

মব সন্ত্রাস, আগুন ও ব্লাসফেমি: হেরে যাচ্ছে বাংলাদেশ?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:৫২


ময়মনসিংহে হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন মানুষকে ধর্মীয় কটূক্তির অভিযোগে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। মধ্যযুগীয় এই ঘটনা এই বার্তা দেয় যে, জঙ্গিরা মবতন্ত্রের মাধ্যমে ব্লাসফেমি ও শরিয়া কার্যকর করে ফেলেছে। এখন তারই... ...বাকিটুকু পড়ুন

তৌহিদি জনতার নামে মব সন্ত্রাস

লিখেছেন কিরকুট, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৪




ছবিঃ অনলাইন থেকে সংগৃহীত।


দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মের নাম ব্যবহার করে সংঘটিত দলবদ্ধ সহিংসতার ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে তৌহিদি জনতা পরিচয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুখ গুজে রাখা সুশীল সমাজের তরে ,,,,,,,,

লিখেছেন ডঃ এম এ আলী, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০৫


দুর্যোগ যখন নামে আকাশে বাতাশে আগুনের ধোঁয়া জমে
রাস্তা জুড়ে কখনো নীরবতা কখনো উত্তাল প্রতিবাদের ঢেউ
এই শহরের শিক্ষিত হৃদয়গুলো কি তখনও নিশ্চুপ থাকে
নাকি জ্বলে ওঠে তাদের চোখের ভেতর নাগরিক বজ্র
কেউ কেও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×