চরম টাকা পয়শার অভাব মানুষকে অর্থনীতিক, সামাজিক ও মানষিকভাবে কতটা দূর্বল করে দেয় তার বিমূর্ত প্রমান আমি। আবার আমিই দেখেছি টাকা পয়শার আধিক্য কিভাবে মানুষকে বদলে দেয়। সামান্য একশ টাকার জন্য আমার বাবাকে গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঘুরতে দেখেছি। মাকেও। শুধু আমি কারো কাছে হাত পাতার আগে অন্তঃত দশ বার ভাবতাম, আর কত ছোট হতে আমাকে। নিত্যান্ত বিপদে পড়লেও কারো কাছে হাত পাতার পক্ষপাতি আমি নয়।
ঢাকায় পড়াশোনার খরচ চালাতে পারবে না দেখে আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল আমার মামা বাড়ি। ঢাকার ভালো স্কুল ছাড়ার কষ্ট না। যে কষ্টটা আমাকে সবচেয়ে বেশি যন্ত্রনা দিত সেটা হল আমার মাকে ছেড়ে থাকা। নানা নানি আর মামা খালারা যতই আদর করুক না কেন দিনশেষে মনের কোণে মায়ের জন্য একটা আকুতি থেকে যেত । সবার সামনে কাদতে পারতাম না দেখে বাগানে গিয়ে বা ঘরের বাইরের ডালিম তলায় গিয়ে ফুফিয়ে কাদতাম। বাবা মাকে গালি দিতাম। কতই বা বড় আমি। ক্লাশ টু'তে পড়ি।
ছেড়া স্পঞ্জের স্যান্ডেল পড়ে স্কুলে যেতাম। ক্লাশ সিক্স থেকে নাইন পর্যন্ত। বর্ষার কয়েকমাসে পুরো খালি পায়ে। টাকার অভাবে চুল কাটাতে পারতাম না মাসের পর মাস। মাস শেষে স্যারের প্রাইভেট এর টাকা দিতে পারতাম না দেখে ব্যচের সবার সামনে অপমান গিলতে হত। টাকা চেয়ে ঢাকায় থাকা বাবা মাকে চিঠি লিখতাম। মোবাইল বা টেলিফোনের বালায় ছিল না। কারেন্টই ছিলনা । উত্তর পেতাম না। হয়তো ঢাকা থেকে কেউ গ্রামে গেলে পেতাম তাদের পাঠানো টাকা।
এখন বুঝি ছোটবেলার অসহায়ত্ব আমাকে এখনো তাড়িয়ে বেড়ায়। এই জন্য আমার চারপাশে এত লোক থাকা সত্ত্বেও নিজেকে খুবই নিঃসঙ্গ মনে হয়।
তবে টাকা কামাইয়ের জন্য আমি কখনো পড়ালেখা করিনি। আমি করেছি আগ্রহের কারনে। নিঃসঙ্গতা ঘোচাতে তখন আমার জন্য বইয়ের বিকল্প কিছু ছিল না। এভাবে পড়াশোনা করে এইটে বৃত্তি পাই। এসএসসিতে জিপিএ-৫।
কিন্তু সেই পুরোনো অভাবের গল্প আর বাবা মার অসচেতনতা আর অদূরদর্শিতার কারণে তাল ঠিক রাখতে পারিনি। এইচএসসিতে বাজে ফলাফল এর পর জীবনের অনেক সম্ভাবনারই অবসান ঘটে।
তবু স্বপ্ন দেখতাম, সুদিন একবার আসবে। আসবেই.........................
কারো কাছে হাত পাতবোনা বা কারো উপর আর বোঝা হয়ে থাকবোনা বলে কাজ করি। নিজে চলি, সংসার চালায় আর ঋণ শোধ করি। একাই প্রায় দুইটা সংসার চালাই। নিজের মত করে টাকা খরচ করি।
আপনজনদের ছেড়ে দূরে থাকার কষ্টটা আমার অতটা অনুভূত হয়না। গত ছয় বছরে আটবার থাকার জায়গা বদল করেছি। নোংরা ফ্লোর থেকে শুরু করে এসি রুমেও ঘুমিয়েছি। খারাপ থাকার কষ্টটাকে সুখের প্রলেপ দিয়ে ঢেকে মেকি হাসি হেসেছি। আমি বুঝে গেছি এরই নাম জীবন। ঝর্ণায় গড়িয়ে পড়া জলের মাঝে নূড়ির ন্যয় সুখগুলো জলরুপ দুঃখের কাছে খুবই সামান্য। ওই সামান্যতেই আমার সন্তুষ্টি।