তার শিরশ্ছেদের হুকুম হয়েছে এবং আজ রাত্রিতেই কার্যকর হবে।
সন্ধ্যার মুখরিত শহরের পরিবেশ। টি-স্ট্রীটের ব্যস্ত রাস্তার পাশের ফুটপাতে ঈষৎ-ব্যস্ত যে কয়েকজন কে দেখা যাচ্ছে, তাদের মধ্য একজনই বেশ চোখে পড়ার দাবিতে পরে। লোকটির বয়স পঞ্চাশ এর কাছাকাছি হবে। তবে চেহারা দেখে সহজে তার বয়স বোঝার উপায় নেই। এই বয়সেও সে পূর্ণ যুবকের সাবললিতা ধরে রাখে। রোদে পোড়া তামাটে চেহারা। মাথার চুল গুলোও অতটা পরিপাটি নয়। তবে সবচেয়ে বড় বিশিষ্ট, যা দেখে লোকটিকে আলাদা ভাবে চেনা যায়- বিশাল একজোড়া গোঁফ, যে গোঁফের নিচে নিষ্ঠুর হাসি।
অবশ্য চেহারার মাঝে নিষ্ঠুরতার ছাপ থাকলেও পরিচিত সবাই তাকে বেশ ভালো এবং ভদ্রলোক হিসাবেই জানে। ব্যক্তিগত ভাবেও তিনি তাই। শহর থেকে সামান্য দূরে তার বাড়ি। ছোট ছিমছাম সুন্দর বাড়ি। অতীতের সূক্ষ্ম কারুকার্য নিয়ে এই সময়েও সগর্বে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া অপূর্ব এই বাড়িটির মালিক ভদ্রলোক।
বিলাসিতার মাঝে বসা-বস না হলেও সে অসচ্ছল নয়। দিনগুলো তাই তার বেশ ভালভাবেই কেটে যাচ্ছে। শহরে ছোট্ট এক মুদির দোকান আছে তার। দোকানটাও উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। দোকানের আয় দিয়েই তার পরিবার ভালো ভাবে চলে যায়।
আপাত এটুকুতেই সন্তুষ্ট থাকতে পাড়ে সে। কিন্তু বংশের ধারাবাহিকতায় এবং ধারাবাহিকতার ঐতিহ্য(তার দৃষ্টিতে) রক্ষার্থে বাবা-দাদা কিংবা পর-দাদার দ্বিতীয় পেশাকে সে এখন আগলে আছে। তার এই পেশার কথা ঘুণাক্ষররেও কেউ জানে না। যে স্ত্রীর সাথে দুই যুগেরও বেশী অতিবাহিত করেছে ,সে স্ত্রীও জানে না এ কথা। অবশ্য তার ছেলে জানে। সে নিজেও চায় ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা হোক। যেদিন সে এ পেশা থেকে অবসর নিবে, সেদিন থেকে পেশা টা হবে ছেলের। ছেলেকেও সে ভাবে প্রস্তুত করেছে সে।
প্রথমে ছেলেও বিরূপ হয়েছিল। সে নিজেও যেমনটি হয়েছিল ঠিক তার বাবার বেলায়। তাই সে জানে ছেলের এ বিরূপতা ক্ষণিকের জন্য। বংশের নীল রক্ত তার ছেলের শরীরেও যে বইছে।
তবে জল্লাদ ঘাতক ইত্যাদি শব্দ ব্যাবহারে তার আপত্তি আছে। সে মনে প্রাণে বিশ্বাস করে- সে আইনের সেবক। আইন তাকে যে কাজে নিযুক্ত করেছে টা করতে সে বাধ্য।
জেব্রা ক্রস পার হয়ে শহরের শেষ মাথার জনশূন্য স্থানে চলে এলো সে। ঈষৎ আলোকিত চাপা গলি পেড়িয়ে প্রবেশ করলো ‘বার’- এ ।
ডীম লাইটের মৃদু আলোয় রুমের এক কোনায় গিয়ে বসলো সে। লোকজনের আনাগোনা এই সময়ে একটু কম। তবে রাত বাড়ার সাথে সাথে বাড়বে তাদের চিৎকার-কোলাহল। সিগারেটের ধোঁয়ায় ভিতরের বদ্ধ বাতাস ভারী উৎ’কট হয়ে আছে।
ইঙ্গিত পেয়ে ওয়েটার সদ্য নতুন এক বোতল হুইস্কি, বরফের কুচি সহ একটি গ্লাস নামিয়ে রাখল টেবিলের উপর।
‘আজ আরও একটি শিরশ্ছেদ করতে হবে’- কাঁপা কাঁপা হাতে ধরা স্বচ্ছ কাঁচের ভিতরের অর্ধেক হয়ে যাওয়া পানীয়র দিকে চেয়ে ভাবছিল সে। মনে মনে সংখ্যাটাও আওরাতে লাগলো... আটাশ... ত্রিশ... বত্রিশ... ।
প্রতিটি শিরশ্ছেদের পূর্বে এখানে আসে সে, পান করে গলা পর্যন্ত- যেন নিজেকে প্রস্তুত করার প্রয়াস। তবে কেউ মাতাল বললে ঘোর আপত্তি আছে। অ্যালকোহল তার জন্য অসহনীয় নয়। তবে আজকের মাত্রাটা মনে হয় একটু বেশী।
ঈষৎ এলোমেলো পদক্ষেপে রাস্তায় নামলো সে। ইঙ্গিত পেয়ে পিচ ঢালা রাস্তায় টায়ারের কর্কশ শব্দ তুলে থেমে গেল ট্যাক্সি। গন্তব্য খুব একটা দূরে নয়।
বিশাল এক হল-রুম, তার ছাঁদ যেন ছুঁই ছুঁই করছে আকাশ পর্যন্ত। লোনা ধরা দেয়ালের বদ্ধ পরিবেশে ভ্যাপসা গন্ধ। হল-রুমের এ প্রান্তে কতগুলো পুরনো চেয়ার, বড় একটি টেবিল এবং সামনেই সেগুন কাঠের শতাব্দী প্রাচীন বেদী। বেদীর গঠনাকৃতি ইংরেজি ইউ অক্ষরের মত এবং তার বর্ণ কালচে। জমাট রক্ত শুকিয়ে শুকিয়ে এই বর্ণ ধারণ করেছে। বেদীর পাশের দেয়ালেও অসংখ্য কালচে দাগ। কতশত মানুষের লাল রক্তে রঞ্জিত হয়েছে এ বেদী। কত শত প্রাণের নির্মম সাক্ষী- চার দেয়ালে আবদ্ধ এই মৃত্যুর মঞ্চ।
পিনপতন নীরবতার মাঝে বসে আছেন রায় কার্যকারী বিচারকগণ। বেদীর পাশে ক্ষুরধার হত্যাযজ্ঞ নিয়ে দাড়িয়ে আছে ঘাতক । তার মাঝে কোন ভাবাবেগ নেই। এ কাজে সে দক্ষ। ঘাতক খুব ভালভাবেই জানে, তাকে কিভাবে কাজ সম্পন্ন করতে হয়।
পিছনে দুহাত বাঁধা অবস্থায় আসামী কে নিয়ে আসা হল। পঁচিশ-ত্রিশ বছরের টগবগে যুবক। ঘাতক জানে না কি যুবকের অপরাধ। তার জানারও প্রয়োজন নেই।
কালো কাপড়ে মুখমণ্ডল ঢাকা আসামী স্বাভাবিক ভাবে হাঁটু-মুড়ে বসে লম্বভাবে দেহ পেতে দিল বেদীর উপর। ঘাতক অবাক হল আসামীর এ স্বাভাবিকতা দেখে। অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে তার এই মৃত্যু-মঞ্চে। কেউ কেউ চিৎকার করে কেঁদে উঠেছে। কেউবা অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছে। কেউ কেউ শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মিনতি করে গেছে প্রাণ ভিক্ষার। কিন্তু ঘাতক ভাবলেলিশহীন ভাবে পালন করে গেছে তার কর্তব্য।
হত্যাযজ্ঞ মাথার উপর তুলে ঘাতক দৃষ্টিনিক্ষেপ করলো রুমাল হাতে রায় কার্যকারী বিচারকের দিকে। এক মুহূর্ত পরে বিচারক রুমাল হাত থেকে ছেড়ে দিলেন। হত্যাযজ্ঞ উঠে এলো ঘাতকে মাথার উপর।
শেষ মুহূর্তে বন্দীর মুখাবয়বের উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ঘাতক। ঠিক একই সময়ে বন্দীও দৃষ্টি তুলল তার হত্যাকারীর দিকে।
কয়েক সেকেন্ড ঘাতক তাকিয়ে রইল বন্দীর চোখে চোখ রেখে। একটা যুগ যেন অতিবাহিত হল ঘাতকের কাছে। সে চোখের তীব্র দংশন যেন অসাড় করে ফেলল ঘাতককে। ঘাতক দেখল সৃষ্টির আদি থেকে অনাদিকাল সে দৃষ্টির মধ্য। প্রচণ্ড একটা নাড়া দিয়ে উঠল তার সমস্ত দেহ-মনে।
হত্যাযজ্ঞ নেমে এলো বেদীর উপরে।
রাস্তাটা নির্জন। নির্জনতার মাঝে একলা পেয়ে নেশাটাও বেশ জমিয়ে বসেছে ঘাতকের। পদক্ষেপগুলোও তাই তার এলোমেলো। একটা রাস্তা ক্রমশ দুটি তিনটি চারটি হয়ে যাচ্ছে। অনেকটা কষ্টে এক চোখ বন্ধ করে চারটি রাস্তাকে ফের একটিতে পরিণত করলো সে। নিজের সাফল্যে বেশ খুশি।
তবে এই মুহূর্তে তার মনের আঙিনা জুড়ে রয়েছে সেই একটি দৃশ্য- বন্দীর সেই অদ্ভুত মায়াবী দৃষ্টি, যে দৃষ্টির গভীরে লুকিয়ে আছে ধ্বংসের পৈচাশিক উল্লাস- যে দৃষ্টি তছনছ করে দিতে চায় সৃষ্টির আদি থেকে অনাদিকাল।
দমকা বাতাসে রাস্তায় ধুলো-ঝড় উঠল এবং তাতে বহমান পদার্থ-কুঞ্জ তীরের মত বিদ্ধ হচ্ছে ঘাতকের শরীরে। ঢং ঢং শব্দ তুলে একটি খালি অ্যালমুনিয়াম ক্যানের মোচড়ানো পিণ্ড চলে গেল তার পাশ দিয়ে। হঠাৎ তার মনে হল, দূরে কেউ দাড়িয়ে আছে। স্ট্রীট-লাম্পের মৃদু আলোয় তাকে আলাদা ভাবে চেনার উপায় নেই। শিহরণের ঢেউ বইয়ে গেল ঘাতকের দেহে যখন দেখল ছায়াটি একটি নারী। পৈশাচিকতা গ্রাস করে নিলো তার সমস্ত সত্তাকে। চলার গতি বাড়িয়ে দিল সে। একটা সময় পড়ে ঘাতকের বজ্র অটুটে বাধা পড়ল রমণী দেহ। সময় যেন স্থির। কেহ জানেনা, এমনকি ঘাতকও জানে না ক ঘটছে কিংবা কি ঘটতে চলছে। হঠাৎ দৃষ্টি আটকে গেল তার, সে দেখতে পেলো সেই দৃষ্টি, যে দৃষ্টি সে বন্দীর চোখে হত্যাকাণ্ডের পূর্বে। একটা মুহূর্ত মাত্র, তারপর ঘাতকের দশটি আঙুল চেপে বসলো নারী কণ্ঠনালীর নরম মাংসের উপর।
আসামি(ঘাতক) কে নিয়ে আসা হল হত্যা-মঞ্চে। পিছনে হাত বাঁধা অবস্থায় হাঁটু-মুড়ে তাকে বসানো হল বেদীর নির্ধারিত জায়গায়। তার দৃষ্টি আটকে গেল সেই স্থানে, যে স্থানে দাড়িয়ে সে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে বন্দীর উপর। সেই স্থান থেকে সে কল্পনা করেছে বন্দীর অনুভূতি। সে কল্পনা করেছে... যখন দেহ থেকে মস্তক আলাদা হয়ে যায়... ।
সেই স্থান থেকে সে দেখেছে ফিনকি দিয়ে ছুটে পরা রক্তের লাল স্রোত। সে দেখেছে বিচ্ছিন্ন দেহ কিংবা ধড়ের নিষ্ফল অক্ক্রোশ।
হায়, নিয়তির কি নিষ্ঠুর পরিহাস ।
ঘাতক এসে দাঁড়াল বেদীর পাশে। চোখ তার ঈষৎ লাল। দেহটিও কাঁপছে অদৃশ্য কম্পনের ফলে। ভীত নয় সে- এ গাড় অ্যালকোহলের প্রভাব। নার্ভ কে শক্ত করার জন্য তাকে আকণ্ঠ পান করতে হয়েছে।
বংশের ধারাবাহিকতায় উত্তরাধিকার সূত্রে সে ঘাতক। এটিই তার প্রথম যাত্রা। কিন্তু তা নিয়ে মোটেই বিচলিত নয়।
হত্যাযজ্ঞ তুলল সে মাথার উপর।
মাকড়সার জালের মত চুল-দাড়ি-গোঁফের আড়াল থেকে একজোড়া চক্ষু তুলে বন্দী(ঘাতক) দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো তার হত্যাকারী দেখার অন্মেষায় । কেঁপে কেঁপে উঠল তার দৃষ্টি।
শেষ সময়ে ঘাতক দেখল বন্দীকে। তীব্র একটা দৃষ্টি। যে দৃষ্টির অভ্যন্তরে লুকিয়ে আছে বিভীষিকার উল্লাস। যে দৃষ্টি চলে গেছে সময়ের অতল প্রবাহে, যে দৃষ্টি গ্রাস করে নিতে চায় বিশ্বচরাচর।
কেঁপে উঠল ঘাতকের সমস্ত সত্ত্বা।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই অক্টোবর, ২০১৩ রাত ৯:৩০