somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধঃ জানুন নাৎসী রননীতি ও ব্লীৎসক্রীগের ইতিহাস-৩

০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১২ রাত ১২:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধঃ জানুন নাৎসী রননীতি ও ব্লীৎসক্রীগের ইতিহাস-১
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধঃ জানুন নাৎসী রননীতি ও ব্লীৎসক্রীগের ইতিহাস-২
নাৎসী রণনীতিঃক্রমবিকাশ-২
কিন্তু পূর্ব ইউরোপের এই বিস্তীর্ণ ক্ষেত্র জয় করা কি আদৌ সম্ভব?সম্ভব হলে কি ভাবে?
হ্যাঁ পূর্ব ইউরোপের এই বিস্তীর্ণ ক্ষেত্র জয় করা সত্যিই কঠিন।
এই বিস্তীর্ণ ক্ষেত্র জয় করা সম্ভব হবেনা, যদি ১৯১৪-১৮ এর যুদ্ধের মত জার্মানীকে দুই রণাঙ্গনে একই সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়।অতএব জার্মানীর প্রাথমিক ও আবশ্যিক মৌল নীতি হওয়া উচিৎ কখনোই ইউরোপে দুটি মহাদেশীয় শক্তির সহবস্থান মেনে না নেওয়া। শেষ পযর্ন্ত ইউরোপে একটি শক্তিই থাকবে এবং সেই শক্তি হবে জার্মানী।এটা জার্মান জাতির জন্মগত অধিকার।ইউরোপে অন্য কোন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার পথ প্রয়োজনবোধে অস্র প্রয়োগ করে থমিয়ে দিতে হবে।ইতিমধ্যে কোনজাতি যদি প্রতিষ্ঠা লাভ করে থাকে,তবে তাকে মানচিত্র থেকে মুছে দিতে হবে।

সুতরাং এই অর্থে জামার্নীর ভয়ন্কর শত্রু কে?

হিটলার নিজেই তার আত্মজীবনিতে(মাইনক্যাম্প)এর উত্তর দিয়েছেন এভাবে-
“ফ্রান্স আমাদের গলা টিপে ধরেছে।ইউরোপে এই অধিপত্য প্রতিষ্ঠার ফরাসী প্রয়াসকে ব্যর্থ করার জন্য আমাদের জীবন পণ করে লড়তে হবে”।

ফ্রান্স ও জার্মানীর মধ্যে এই চিরন্তন সংঘাতের অবসান হতে পারে একমাত্র আক্রমাণাত্বক আঘাতের দ্বারা, যার ফলে ফ্রান্স অবশ্যই ধ্বংস হয়ে যাবে।
এই সত্যটি যখন জার্মানী ভালভাবে বুজবে,তখন সে শুধুমাত্র নিস্ক্রিয় আত্বরক্ষা করে নিজের শক্তির অপচয় করবেনা,ফ্রান্সের সঙ্গে চরমবোঝাপড়ার জন্য তৈরী হবে; জার্মানীর মহত্তম ও চুড়ান্ত লক্ষে পৌঁছবার জন্য ফ্রান্সের বিরুদ্ধে চুড়ান্ত সংগ্রাম শুরু করবে।

আর এভাবেই ফরাসী সমস্যার অবসান ঘটানো সম্ভব হবে।অবশ্য একটি শর্ত মেনে নিলেই তা হতে পারে। পরবর্তীকালে এবং চিরকালের জন্য জার্মানীর সম্প্রসারণের সুযোগ হিসেবেই ফ্রান্সের বিনষ্টিকে বিচার করতে হবে।ফ্রান্সকে ধ্বংস করার জন্য প্রথম তাকে সম্পূর্ণ ভাবে বিচ্ছিন্ন করে দিতে হবে।

সে জন্য পূর্বইউরোপের সঙ্গে ফ্রান্সের মিত্রতার সম্পর্কের অবসান ঘটানো জরুরী।

জার্মানকে ইংল্যান্ড ও ইতালীর সঙ্গে মিত্রতার সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে,কারন তা না হলে জার্মানীর উন্মুক্ত পশ্চিম সীমান্ত রক্ষা করা সম্ভব হবেনা।

হিটলারের রণনীতির মোদ্দাকথা হলো- ফ্রান্স কে মুছে দিতে হবে।
কারন ইউরোপে ফ্রান্সের ইতিহাস সম্মত নীতি হলো জার্মানীকে দাবিয়ে রাখা।জার্মানীর পথের কাঁটা ফ্রান্স।অর্থাৎ হিটলারের রণনীতির মূল লক্ষ্য বৃহৎ রাষ্ট্র হিসেবে ফ্রান্সের পুরো ও স্থায়ী বিলুপ্তি।হিটলারের এই মূল লক্ষের কথা মনে রাখলে তিরিশের দশকে ইউরোপীয় রাজনীতিতে হিটলারের প্রত্যেকটি চালের অর্থ স্পষ্ট হয়ে উঠে।যেমনঃ

* স্পেনীয় গৃহযুদ্ধে হস্তক্ষেপ।
* ইতালীর সঙ্গে মিত্রতা।
* জার উপত্যকা পুনরায় দখল করার জন্য আন্দোলন।
* রাইনল্যান্ডে জার্মান অধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা।
* চেকোশ্লোভাকিয়ার ধর্ষন।
* জিগফ্রিন্ড রেখার নির্মান।
* সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে অনাক্রমন চুক্তি
* সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে পোল্যান্ডের ভাগ বাঁটোয়ারা।
এ সবই একটি বিশেষ অর্থে মন্ডিত হয়ে উঠে। এই পূর্ব ইউরোপে জার্মান আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক ও আবশ্যিক শর্ত বিধ্বস্ত ফ্রান্স।

কিন্তও এ প্রাথমিক শর্ত পুরন হওয়ার পরও একটি জার্মান আদলে গঠিত ইউরোপ প্রতিষ্ঠার পথে আরো বড় দুটি বাধা থেকে যায়।

প্রথমটি হচ্ছে ব্রিটিশ রয়াল এয়ারফোর্স এবং দ্বিতীয়টি রুশ রেডআর্মি

ব্রিটিশ রয়াল এয়ারফোর্স জার্মানীর পক্ষে থাকবে, অন্তত বিপক্ষে থাকবেনা,এ ধরনের আশা দীর্ঘদিন লালন করেছেন হিটলার।
আর রুশ রেডআর্মি সম্পর্কে অবজ্ঞা ছিল তাঁর।

হিটলার জানতেন,ব্রিটেনের সঙ্গে একটা সমঝোতায় পৌঁছতে না পারলে তাঁর কোন পরিকল্পনাই সফল করা যাবেনা।


কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়াম
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়াম(প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির সম্রাট ছিলেন কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়াম ) ব্রিটেনের বন্ধুত্ব অর্জন করতে সক্ষম না হওয়ায় তার তীব্র নিন্দা করে মেইন ক্যাম্পে লিখেছিলেনঃ
“ ইংরেজ জাতিকে অমাদের সবচেয়ে মূল্যবান মিত্র বলে দরে নিতে হবে। ইতালী ও ইংল্যান্ডের সঙ্গে মৈত্রীচুক্তির মাধ্যমে জর্মানীর পার্শ্ব ও পশ্চাৎ ভাগ সুরক্ষিত না হলে জার্মানীর পক্ষে কোনভাবেই ফ্রান্সকে করায়ত্ব করা অথবা পূর্ব ইউরোপ অধিকার করা সম্ভব হবেনা।একমাত্র এ দু’দেশের সঙ্গে মিত্রতার সম্পর্ক থাকলেই তবে প্রতিকূল রণনীতিক পরিস্হিতি জার্মানীর অনুকূলে যেতে পারে।এ নতুন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক একদিকে জার্মানীর পার্শ্বকে সুরক্ষিত করবে,অন্যদিকে জীবন ধারনের জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয় পন্য ও কাঁচামালের যোগান অব্যহত থাকবে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জার্মানীর দুই মিত্র অষ্ট্রিয়া-হাঙ্গেরী(জরাগ্রস্ত) এবং মমূর্ষ তুর্কীর কথা স্মরণ করলে জার্মানীর ইউরোপীয় মিত্র সম্পর্কে অনীহা থাকা অস্বাভিক কিছু নয়।কিন্তু এবারের মিত্র ব্রিটেন বিশ্বের সবচেয়ে বড় শক্তি আর ইতালী জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ, যৌবনাক্রান্ত একটি দেশ।

১৯১৪-এর আগে ইল্যান্ডের মিত্রতা আদায়ের জন্য কোন ত্যাগকেই ত্যাগ হিসেবে গন্য করা উচিৎ ছিল না।তৃতীয় রাইখও কোন ত্যাগকেই ত্যাগ হিসেবে মনে করবেনা, যদি ইংরেজদের সাথে সমঝোতাজার্মানীকে ইউরোপীয় মহাদেশে অপ্রতিহত প্রতিপত্তি এনে দেয়। এর জন্য জার্মানী উপনিবেশ ও সামুদ্রিক অধিপত্যের কামনা ভুলে যেতেও রাজী।বিশ্বের বাজারে ইংল্যান্ডের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ও লিপ্ত হবেনা সে।এমন কি নৌবহর নির্মানের প্রতিযোগিতায় নামবে না।ব্রিটিশ মৈত্রির ফলে জন্ম নিবে প্রতাপম্বিত এক জার্মান ভবিষ্যত।”


অবশ্য অন্য দৃষ্টিকোন থেকে বিচার করলেও ইঙ্গ-জার্মান মৈত্রি গভীর অর্থবহ বলে মনে হবে।
ব্রিটেনের সঙ্গে জার্মানীর সম্পর্ক অনেকাংশে তার প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি নির্দিষ্ট করে দেবে।

হিটলার লিখেছেনঃ
“ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ইংঙ্গ-স্যাক্সন দুনিয়াকে আড়াল করে রেখেছে।অন্য কোন রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্রিটেনের তুলনা করা চলেনা। সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত ঐক্য ব্রিটিশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে একসূত্রে গ্রথিত করেছে”

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর সীমাহীন শক্তি সম্পর্কেও সচেতন ছিলেন হিটলার।জাপানকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিপক্ষ হিসাবে খাড়া করে চেয়েছিলেন আন্তর্জাতিক ভারসাম্য রক্ষা করতে।

জাপান-জার্মান মৈত্রি চুক্তির পেছনে এই চেতনাই কাজ করেছে।

মেইনক্যাম্পের পাতা উল্টালেই বোঝা যায় যে, ব্রিটেনের সঙ্গে মিত্রতার গুরুত্ব সম্পর্কে হিটলারের সন্দেহ বিন্দুমাত্র ছিল না।কিন্তু এই মিত্রতার নীতি বাস্তবে রূপান্তরিত করতে পারেননি তিনি। বরং তিনি যে নীতি অনুসরন করেছেন তা ব্রিটেনের সঙ্গে অমোঘ অনিবার্যতায় যুদ্ধ নিয়ে এসেছে।

কিন্তু তা সত্ত্বেও বরাবরই হিটলারের আশা ছিল যে ব্রিটেন যুদ্ধে নামবেনা।সম্ভবত তিনি মনে করেছিলেন যে ব্রিটিশ চরিত্রের সেই অনমনীয় কাঠিন্য আর বজায় নেই।

এখন তা নমনীয় ও দুর্বল।

ব্রিটিশ চরিত্রের এই হিটলারী মূল্যয়নের কোন বাস্তব ভিত্তি ছিল না, এ কথা কিন্তু বলা চলেনা। বরং বলা চলে প্রচুর বাস্তব ভিত্তি ছিলো।


ষ্টানলী বল্ডুইন


নেভিল চেম্বারলেন

বল্ডুইন ও চেম্বারলেনের আমলের ব্রিটিশ আচরনের পরিপ্রেক্ষিতে এই অবমূল্যায়ন অনেক স্বভাবিক ছিলো।তৎসময়ে ব্রিটিশ আন্তর্জাতিক নীতি অনেক নমনীয় ছিল বিশেষ করে পরবর্তী সময়ে চেকোশ্লোভাকিয়ার ভাগ্য নির্ধারনে চেম্বারলেনের হিটলার তোষননীতি তো রিতিমত বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তুলেছিল। শুধুমাত্র যুদ্ধ এড়ানোর জন্য চেম্বারলেন হিটলারের সঙ্গে একজোট হয়েছিলেন।যা চেম্বালেনের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে একটি কলংকজনক অধ্যায় হিসেবে আজও বিবেচিত।

হিটলার ভেবেছিলেন ব্রিটেনের বন্ধুত্বের ফলে ব্রিটিশ বিমান শক্তি জার্মানীর নৌশক্তির অভাব মেটাবে।

কিন্তু ব্রিটিশ পররাষ্ট্রনীতির একটি অপরিবর্তনীয় সংকল্পের গভীর অর্থ বুঝতে পারেননি হিটলার।হয়ত তা বোঝা সম্ভবও ছিল না হিটলারের পক্ষে। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রনীতির ঐতিহ্যগত সংকল্প ছিলঃ

জার্মানী অথবা কোন একটি ইউরোপীয় রাষ্ট্রকে ইউরোপে একাধিপত্য কায়েম করতে না দেওয়া।

হিটলারের প্রাগ অধিকার করার পর এই ঐতিহ্যগত শক্তিসাম্যের নীতি চেম্বারলেনের পররাষ্ট্রনীতির মূল ভিত্তি হয়ে দাড়ায়।
চেম্বারলেন তখুনি হিটলার তোষননীতি বর্জন শুরু করেন।

হিটলার বুঝেন নি যে, কোন মহাদেশীয় রাষ্ট্র যত শক্তিশালী হবে,তার উচ্চাকাংখা ও সম্প্রসারন কামনা যত বাড়বে,সেই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ প্রতিরোধ ততই দৃঢ় হবে।

ব্রিটিশ জাতির শান্তিকামনা যতই প্রবল হোক না কেন,যুদ্ধের প্রতি তার যতই অনীহা থাক,শেষ পর্যন্ত সেই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সে যুদ্ধে নামতে বাধ্য হবেই।
ব্রিটিশ নীতির এই বিশেষ দিকটি বোঝেন নি কিংবা বুঝতে চাননি বলেই হিটলারের শেষ পযর্ন্ত আশা ছিল ব্রিটেন যুদ্ধে নামবে না।ব্রিটেন যুদ্ধে যোগ দেওয়া সত্ত্বেও হিটলার আশা করেছিলেন, পোল্যান্ডের সমস্যার সামরিক সমাধানের পর ব্রিটেনের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিলে সেই ঘাতক হাত বুঝি ব্রিটেন গ্রহন করবে।এমনকি ডানকার্কে ব্রিটিশ বাহিনীর অপসারনের সুযোগ হিটলারের যে নির্দেশের ফলে সম্ভব হয়েছিলো, তার মূলেও হয়তো ছিল এই সমজোতার কামনা।

আমরা জানি ডানকার্কের সৈন্য অপসারন ছিল দিত্বীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসে সবচেয়ে অলৌকিক ঘটনা।যা অপারেশন ডায়নামো নামে পরিচিত ছিল।

নিচের ছবিগুলোতে দেখা যাচ্ছে অপারেশন ডায়নামোর ব্রিটিশ সৈন্য অপসারন হচ্ছে ইংলিশ চ্যানেল দিয়ে।







অতএব নিয়তির অমোঘ নির্দেশে যে নীতি অনুসরন করার জন্য হিটলার কাইজারকে নিন্দা করেছিলেন,সেই পথে তাকেও যেতে হয়েছিল।ব্রিটেনের সঙ্গে মিত্রতা শেষ পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। ইতালীকে বন্ধু হিসেবে পেলেও ইতালীর সঙ্গে জোট বেধেঁ হিটলার বিন্দুমাত্র লাভবান হন নি।প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যেমন কাইজারকে মৃতপ্রায় অষ্ট্রিয়া-হাঙ্গেরী সাম্রাজ্যের শববহন করতে হয়েছিল,তেমনি হিটলারকে ইতালীর দায় বহন করতে হয়েছিল।আসলে মুসলিনীর লম্বা লম্বা কথাই ছিল,আর কিছুই ছিলনা।

তবু এ কথা স্বীকার করতে হয় যে,তিনি ফ্রান্সকে বিচ্ছিন্ন করে ধ্বংস করতে পেরেছিলেন এবং ব্রিটেনও প্রায় ধ্বংসের মুখোমুখি এসে দাড়িয়েছিল, যদি না হিটলার ডানকার্কে বিটিশ সৈন্য অপসারনের সুযোগ না দিতেন।

ফ্রান্সকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য প্রথম হিটলারী চাল ১৯৩৪ এর পোল-জার্মান চুক্তি। এই চুক্তির জন্য হিটলারকে কিছুই ছাড়তে হয়নি।ঠিক ঐ মুহূর্তে পোল্যান্ড জার্মানীর চেয়ে শক্তিশালী-এই বাস্তব পরিস্থিতিকে হিটলার আপাতত স্বীকার করে নিয়েছিলেন মাত্র।কিন্তু এতে মারাত্বক ক্ষতি হয়েছিল ফ্রান্সের।প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পূর্ব ইউরোপে জার্মান আগ্রাসন বিরোধী যে রাষ্ট্রজোট গড়েতুলেছিল ফ্রান্স, পোল-জার্মান চুক্তিতে সেই রাষ্ট্রজোটে ফাটল ধরে যায়। রাইনল্যান্ড পুনরাধিকার,অষ্ট্রিয়ার সংঙ্গে সংযুক্তি, চেকোশ্লোভাকিয়ায় বিচ্ছিন্নতাকামী হেনলাইনের সমর্থন মূলত ফরাসী নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে আমুল চিন্নভিন্ন করে দেয়।
মিউনিখ চুক্তির আগে হিটলার একবারে বেশী কিছু চাইতেন না।তার দাবী এমন ছিল না যা প্রতিপক্ষের মেনে নেয়া অসম্ভব হত এবং যার ফলে যুদ্ধ বেধে যেতে পারতারন তখনও যুদ্ধের ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত নন হিটলার। ছোট রাষ্ট্রগুলোকে এক এক করে মুছে দিতে থাকেন তিনি;ফ্রান্সের শক্তিও ধীরে ধীরে কমে যেতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ শুরু হবার আগেই অবসন্ন হয়ে পড়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অপরাজিত ফ্রান্স হিটলারের গ্রাস থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারেনি । ফ্রান্সকে নিপুন ভাবে বিচ্ছিন্ন করে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন হিটলার। জার্মান বহিনী ফ্রান্সে ঝটিকা ধরনের যুদ্ধ ঘটিয়ে ফরাসীবাহিনীকে পুরো ধ্বংস করতে চেয়েছিল। হিটলার চেয়েছিলেন একটি রাজনৈতিক ঝটিকা যা ইউরোপের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চের পাদপ্রদিপের আলো থেকে ফ্রান্স ও তার মিত্রদের চিরদিনের মত সরিয়ে দেবে।

কিন্তু ফ্রান্সকে সম্পূর্ন ধ্বংস করারর হিটলারী নীতি জার্মান বৈদেশিকনীতির ঐতিহ্যকে লঙ্ঘন করেছিল। এই বিশেষ ক্ষেত্রে হিটলারী নীতি ফ্রেডারিক অথবা বিসমার্কের পররাষ্ট্রনীতি থেকে ভিন্ন। ১৮৮৭ সালে বিসমার্ক লিখেছেনঃ
“একটি বৃহৎ রাষ্ট্র হিসেবে ফ্রান্সের অস্তিত্ত্ব অন্যান্য রাষ্ট্রের মত জার্মানীর কাছেও আবিশ্যিক।ফ্রান্স যদি আমাদের আক্রমন করে এবং যুদ্ধে যদি আমরা বিজয়ী হই,তবুও চার কোটি ইউরোপীয়ের দেশ ফ্রান্সকে ধ্বংস করে দেওয়ার কথা আমরা চিন্তাও করতে পারিনা।”
কিন্তু হিটলার ফ্রান্সের ধ্বংসই চেয়েছিলেন, চেয়েছিলেন প্রান্সকে জার্মান উপনিবেশে পরিণত করতে।
রাইখের সামরিক বাহিনী নাংসী সমরযন্ত্রের ধারালো প্রন্তের বেশী কিছু নয়। শতকরা একশত ভাগ একনায়কতন্ত্রের রণনীতিতে যুদ্ধ এবং সামরিক অভিযান কখনই শত্রুর বিরুদ্ধে প্রথম পদক্ষেপ নয়।বিনা যুদ্ধে জয়লাভের সব চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর শেষ উপায় হিসাবেই বেছে নিতে হয় যুদ্ধের পথ।
ক্ষমতা দখল করার পর থেকে মিউনিখের চুক্তি পর্যন্ত হিটলারের জীবনের প্রচন্ড সফলতম যুগ।হিটলার বিনা রক্তপাতে প্রত্যেকটি লড়াইয়ে জিতেছেন।
শুধু এ পর্যন্ত যদি হিটলারের রাজনৈতিক জীবন শেষ হত, তবে ইতিহাস হয়তো অন্য খাতে বইতো।হিটলারারকে জার্মানবাসী আজীবন শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসিয়ে রাখত।
মিউনিখের পর চেম্বারলেন পোল্যান্ডকে রক্ষার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পর এবার সৈনিকদের ওপর লড়াইয়ের ভার দিতে হয়।
স্নায়ু যুদ্ধে জেতার মূলমন্ত্র হলো, একটি জাতির জাতীয়তাবোধ কে একটি লক্ষ্যে স্থির করা। পুরো জাতিকে এমন এক মূল্যবোধের ধারনা দেওয়া যাতে সেই জাতির এ সুকঠিন ঐক্য অন্যান্য জাতিকে সবসময় ভীত রাখে। এ শর্তকে হিটলার চরম ভাবে উপলব্ধি করেন।
স্নায়ু যুদ্ধে জেতার শর্ত জার্মান জাতিকে গোটানো স্প্রিঙের মত একটি ঐক্যবদ্ব শক্তিতে পরিনত করা, যাতে এই ভয়ানক ঐক্য অন্যান্য রাষ্ট্রকে সারাক্ষন ভীত সন্ত্রস্ত রাখে।
জার্মান জাতিকে ঐক্যবদ্ব করার জন্য হিটলার একটি কঠিন পথ বেছে নেন। তা হচ্ছে ভিন্নমতাবলম্বীদের জনমের মত ধ্বংস করে দেওয়া। অর্থাৎ ইহুদী,চার্চ,বিশ্ববিদ্যালয়,ট্রেড ইউনিয়ন,,স্যোসাল ডেমোক্রেট এবং কমিউনিষ্ট সহ আন্তর্জাতিকতাবাদী শান্তিকামী দল ওগোষ্ঠিকে নির্মম ভাবে নির্যাতনের মাধ্যমে বিলুপ্ত করে দেওয়া। এর ফলে নাৎসীবাদে দীক্ষিত একটি অখন্ড জাতি গঠন। অন্য আরেকটি রাস্তা হলো,নাৎসী পার্টির কঠিন নিয়মানুবর্তিতার আবরনে সংবাদপত্র ও রেডিওর মাধ্যমে সুনিপুন প্রচার যোগ করে জার্মান জাতীয় অহংকারকে উদ্বুদ্ধ করা। রনোন্মদনা,ইহুদী বিরোধিতা,জাত্যাভিমান,রাষ্ট্রপুজা ও নাৎসী কর্মপন্থার অন্যান্য বিষয় জার্মান ইতিহাসের গভীরে প্রোথিত। অন্তত হিটলার তাই বিশ্বাস করতেন এবং এ বিশ্বাসকে জার্মান জাতির মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন।
হিটলার আবারো মাইনক্যাম্পের পাতায় লিখেছেনঃ
“বহ্যিক শক্তির অধিকারী হতে পারলেই জার্মানীর পুনরুথ্থান সম্ভব।
কিন্তু শক্তিমান হবার উপায় শুধূমাত্র অস্রশস্র নয়,যদিও বুর্জোয়া রাজনিতীবিদরা বরাবরই এই কথা বলেছেন।উপায় মাত্র একটাই, তা হচ্ছে ইচ্ছাশক্তির প্রচন্ডতা।ব্রক্ষ্মাস্রও অকেজো এবং অর্থহীন এর কাছে,যদি সেই আত্মিক শক্তি না থাকে,যা দৃঢ়সংকল্প নিয়ে সেই অস্র ব্যবহার করতে পারে সেচ্ছায়।
সুতরাং ক্ষমতা ফিরে পাবার মূল কথা কিভাবে আমরা অস্র তৈরি করব তা নয় বরং কিভাবে আমরা জন্ম দেবো সে আত্মিক শক্তির,যা একটি জাতিকে অস্র বহন করার যোগ্য করে তোলে”

জার্মান জাতির ভেতরে সুপ্ত বিজয়ী হওয়ার ইচ্ছাকে জাগ্রত করে হিটলার এই জাতিকে এক অকল্পনীয় পরিবর্তনের পথে নিয়ে যান।
১৯১৮ সনে জার্মানী পরাজিত হয়নি।বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছিল।উড্রো উইলসনের প্রতিশ্রূতিতে বিশ্বাস করে জার্মানী স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করে। সে আশা করেছিল একটি বিবেচক ও ন্যায্য শান্তি চুক্তি হবে।কিন্তু উড্রো উইলসন বিশ্বাস ভঙ্গ করেন। এ বিশ্বাস ভঙ্গের কোন তুলনা নেই ইতিহাসে।
এভাবে ক্রমাগত প্রচারনার মাধ্যমে ভার্সাই চুক্তির বিরুদ্ধে জার্মানীর জনসাধারনের মধ্যে প্রবল প্রতিশোধ স্পৃহা জাগিয়ে তোলেন। জার্মান যুবকদের প্রানে সঞ্চার করেন প্রবল জাতীয়তাবাদী আক্রোশ এবং হিটলারের প্রতি অকুন্ঠ আনুগত্য।জার্মান যুবকদের সামনে স্পার্টান জাতির লক্ষ্যকেতুলে ধরেছিলেন।হিটলার লিখেছেনঃ
“রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য হল সারা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে তাকে ক্রমশ নিরাপদ পৃথিবীব্যাপী কতৃত্বের পথে নিয়ে যাওয়া।”
যুদ্ধের জন্য হিটলারের অর্থনৈতিক প্রস্তুতির বিশদ বিবরন দিতে গেলে লেখা অনেক বড় হয়ে যাবে। তাই দরকারী কথা হল, জার্মান জেনারেল ষ্টাফর একটি ধারনাকে নাৎসীরা গ্রহন করেছিল। তাদের বিশ্বাস ছিল যে ১৯১৪-১৯১৮’র যুদ্ধ যথেষ্ট সার্বিক ছিলনা।তখন সার্বিক যুদ্ধের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ছিলনা।সার্বিক যুদ্ধের জন্য অবরোধের বিরুদ্ধে কাঁচামাল ও খনিজ দ্রব্যের ভান্ডার গড়ে তোলা দরকার। অর্থনৈতিক ও মানসিক দিক থেকে গোটা দেশকে এমনভাবে তৈরী রাখা দরকার,যাতে গোটা জাতি প্রয়োজনে স্বতঃস্ফুর্ত সমর্থন দেবে। গোয়েরিঙের নেতৃত্বে দুটি চার বছরের পরিকল্পনা জার্মান অর্থনীতিকে পুরোপুরি সামরিকীকরন করে ফেলে।


হেরমেন গোয়েরিং

ফলে ১৯৩৯ সালে জার্মান বাহিনী যখন যুদ্ধ শুরু করে,তখন অন্যান্য দেশের বাহিনীর চাইতে জার্মান বাহিনী অনেক সুসজ্জিত।ভান্ডারে আধুনিক সমরোপকরনের প্রাচর্য। সার্বিক একনায়কতন্ত্রের মধ্যে এই সার্বিক যুদ্ধ যেন এক দেহে লীন।

চলবে..............









সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১২ রাত ১২:১৪
২৬টি মন্তব্য ২৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মপোলব্ধি......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৫১

আত্মপোলব্ধি......

একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !

লিখেছেন হাসানুর, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩২



হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।

লিখেছেন তানভির জুমার, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩৩

আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?

লিখেছেন রাজীব, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৪২

ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।

আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×