“বাবা”
লেখাঃ শাকিল মাহমুদ সুমন
.
“সুমন সাহেব আপনি ঠিক আপনার বাবার মতই।দেখতে শুনতে,কাজে কর্মে,কথাবার্তায়। জানেন আপনার বাবা অনেক ভালো একজন লোক ছিলেন। অফিসের সকল শ্রেণির কর্মকর্তাদের সাথে অনেক সুন্দর ব্যবহার করতেন। উত্তম মনের অধিকারী ছিলেন লোকটি। কিন্তু ভাগ্যের কি পরিহাস ভালো মানুষগুলোকে আল্লাহ্ খুব তাড়াতাড়ি ছিনিয়ে নেন সকলের কাছ থেকে। জানেন সুমন সাহেব, আপনার বাবা যখন অফিসে আসতো তখন সকলের মুখ হাস্যজ্বল থাকতো, অফিসের কোনো কর্মকর্তার যদি মন খারাপ থাকতো ঠিক কিভাবে যেন তিনি বুঝে যেতেন মন খারাপের বিষয়টি। তারপর উনি তাকে নিজের রুমে ডেকে এনে একান্তভাবে সমস্যাগুলো জানতে চাইতেন এবং তা সমাধান করে দিতেন। সত্যিই লোকটি বড্ড ভালো ছিলেন”।
ইনি রহিম চাচা, আমার কাছে বসে বাবার গল্প শোনাচ্ছেন। আমাদের অফিসের ম্যানেজার তিনি। আমাদের প্রতিষ্ঠানের জন্মলগ্ন থেকেই উনি এখানে আছেন। মাঝে মাঝে অবসরে উনি আমার কাছে আসেন এবং এই প্রতিষ্ঠানের,বাবার এবং বাকি সকলের গল্প শোনান। বাবা মারা যাওয়ার পর অনেকদিন এই প্রতিষ্ঠান দেখাশোনা করেন রহিম চাচা। বাবার খুব পছন্দের এবং বিশ্বাসযোগ্য একজন মানুষ ছিলেন তিনি। আমার স্পষ্ট মনে আছে চাচার গল্প বাবা বাসায় গিয়েও আমাদের কাছে বলতেন।
আমি ঠিক তখন এগারো বছরের একজন কচি শিশু। তখন থেকে আমার খুব ইচ্ছা বাবার অফিসে আসব, বাবার সাথে বসবো, বাবা বিজনেস পার্টনারদের সাথে কিভাবে কথা বলে তা দেখবো, মায়ের হাতে বানানো লাঞ্চ বাবা ও আমি একসাথে খাবো, ১টার দিকে আজান হলে বাবার সাথে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়বো।
ইশ! ইচ্ছে করছে আবারও ফিরে পেতে সময়গুলো। আমার স্কুল যেদিন বন্ধ থাকতো সেদিন বাবাকে রিকুয়েস্ট করতাম আজ যেন বাবা আমায় অফিসে নিয়ে যায় নয়তো বাহানা ধরতাম-না নিলে আজ সারাদিন আমি কিছুই খাবোনা। বাবা মাঝেমাঝে আমায় নিতে দ্বিধাবোধ করতেন কারণ তিনি বলতেন-
‘বাবা ঢাকা হচ্ছে গাড়ির শহর, এখানে প্রায়শই দূর্ঘটনা ঘটে, তুমি ছোট মানুষ কিছু হলে অনেক ব্যাথা পাবে তাই তোমাকে যেতে হবে না। যেদিন রাস্তা ফাকা থাকবে সেদিন তোমায় আমি নিয়ে যাবো’।
আমার বয়স যখন বিশ তখনও বাবার কাছে আমি এই বাহানাগুলো করতাম। আর বাবাও হয়তো মনে করতেন তার সেই এগারো বছরের ছোট্টো সুমন তাকে রিকুয়েস্ট করছে অফিসে নিয়ে যেতে। বাবার শাহাদাৎ আঙুলের ডগায় ধরে হাটতাম একসাথে। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান আমি। বাবা অনেক স্বপ্ন দেখতেন আমায় নিয়ে একদিন আমি অফিসের দায়িত্ব কাঁধে নিবো,বাবার মতো সৎ হবো। আজ আমি অফিসের দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছি, বাবা যে পথ আমাকে দেখিয়েছেন আমি ঠিক সেই পথেই এগোচ্ছি।
আমার খুব মনে পড়ে বাবা যখন অসুস্থ অবস্থায় বিছানায় পড়েছিলেন তখন আমাকে ডেকে নিয়ে তিনি তার পাশে বসাতেন, মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন। আমায় বলতেন কখনও যেন মিথ্যা কথা না বলি,কারো সাথে খারাপ আচরণ যেন না করি, সর্বদা সৎ পথে যেন থাকি। বাবা প্রায়শই আমায় নেলসন মেন্ডেলার সেই বিখ্যাত প্রবাদটি বলতেন-
“সম্মান তাদের প্রাপ্য
যারা কখনো সত্যকে
পরিত্যাগ করে না,
এমনকি পরিস্থিতি যখন
অন্ধকারচ্ছন্ন এবং বেদনাদায়ক”।
বাবা যখন কথাগুলো বলতেন তখন কেন জানি অজানা এক ব্যাথায় চোখ থেকে ঝরঝর করে পানি বেরিয়ে আসত। বাবা তখন আমায় বুকে জড়িয়ে নিয়ে সান্ত্বনা দিতেন।
সকাল বেলা ভার্সিটি যেতাম বাবাকে ঔষধ খাইয়ে, দুপুরে মা খাওয়াত, রাতে আবার আমি খাইয়ে দিতাম। বাবার বয়স হয়ে গেছে ধীরে ধীরে আরও অসুস্থ হয়ে যাচ্ছেন। অফিস দেখাশোনার দায়িত্বে আছেন রহিম চাচা। দীর্ঘদিন অফিসের ভার চাচার কাঁধেই ছিল। হঠাৎ একদিন যখন আমি ভার্সিটিতে মা ফোন করে বাবার গুরুতর অসুস্থতার কথা জানান। মাকে বলে দিয়েছিলাম বাবাকে স্কয়ার হসপিটালে নিয়ে যেতে আমি সেখানে আসছি। কিন্তু ততক্ষণে আল্লাহ্ বাবাকে আর বাঁচিয়ে রাখেননি। বাবা চলে গেছেন ওপাড়ে, আমায় এতিম করে দিয়ে। মা কান্না মিশ্রিত কন্ঠে খবরটুকু আমায় দিলেন। বাবাকে আর হসপিটালে নেওয়া হয়নি, মাঝপথ থেকে গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে আসা হয় বাড়িতে।
সেই যে বাবা চলে গেলেন তারপর থেকে বঞ্চিত হয়ে যাই বাবার ভালবাসা,আদর,স্নেহ থেকে,অনুপ্রেরণা থেকে। কিন্তু বাবার আদর্শকে আমি আমার ভিতর লালন করি। নিলাম অফিসের ভার, শুরু হলো এক নতুন জীবন। আজ ডিসেম্বরের ৮তারিখ, এই দিনটিতেই বাবা চলে যান পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে। জানি আজ অফিস শেষে যখন মায়ের কাছে যাব তখনই দেখব মা বাবার চশমা,পাঞ্জাবি,স্যুট সামনে নিয়ে কাঁদছেন। এটাই হয়ে আসছে বিগত আটটি বছর। আর এই রাতে আমার ঘুম হয়নি কখনও, মাঝরাতে বাড়ির চিলেকোঠার পাশে বসে আকাশপানে তাকিয়ে কাঁদি বাবার জন্য। সেই গোপন কান্না আল্লাহ্ এবং বাবা ছাড়া কেউ জানেন না। বাবা তোমাকে খুব দরকার খুব খুব।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ রাত ৮:৫১