ইভটিজিং নিয়ে তোলপাড় অনেক আগেই শুরু হয়ে গিয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কয়জনের এ সম্পর্কে স্বচ্ছ সাধারণ ধারণাটুকু হয়েছে? আর ইভটিজার্সরাই বা কতটুকু সচেতন হয়েছেন? এর পেছনে কাদের ভূমিকা রয়েছে? এটি কতখানি শাস্তিযোগ্য অপরাধ? এরকম অনেক ঘোলাটে বিষয়ের ধারণা দিতেই আজ এই পুরনো বিষয় ইভটিজিং নিয়ে লেখা।
ইভটিজিং কীঃ ইভটিজিং শব্দটি শুধু বাংলাদেশ নয়, পাকিস্তান ও ভারতেও এর ব্যবহার রয়েছে। ইভটিজিং বলতে কোন মানুষকে বিশেষ করে কোন নারী বা কিশোরীকে তার স্বাভাবিক চলাফেরা বা কাজ কর্ম করা অবস্থায় অশালীন মন্তব্য করা, ভয় দেখানো, তার নাম ধরে ডাকা এবং চিৎকার করা, বিকৃত নামে ডাকা, কোন কিছু ছুঁড়ে দেয়া, ব্যক্তিত্বে লাগে এমন মন্তব্য করা, ধীক্কার দেয়া, তার যোগ্যতা নিয়ে টিটকারী দেয়া, তাকে নিয়ে অহেতুক হাস্যরসের উদ্রেক করা, রাস্তায় হাটতে হাটতে ধাক্কা দেয়া, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করা, ইঙ্গিতপূর্ণ ইশারা দেয়া, সিগারেটের ধোয়া গায়ে ছাড়া, উদ্দেশ্যমূলকভাবে পিছু নেয়া, অশ্লীলভাবে প্রেম নিবেদন করা। উদ্দেশ্যমূলকভাবে গান, ছড়া বা কবিতা আবৃত্তি করা, চিঠি লেখা, পথরোধ করে
দাঁড়ানো, প্রেমে সাড়া না দিলে হুমকি প্রদান ইত্যাদিও ইভটিজিং-এর মধ্যে পড়ে। বর্তমানে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার যুগে মোবাইল ফোন এবং ই-মেইলের মাধ্যমেও ইভটিজিং হয়ে থাকে।
প্রকৃতপক্ষে ছেলে এবং মেয়ে উভয়ই এই অপরাধমূলক কাজের জন্য দায়ী। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে, ছেলেরাই এধরণের কাজ বেশি করে থাকে। মেয়েরাও এর জন্য কম দায়ী নয়। তাদের উসশৃঙ্খল পোশাক ছেলেদের আকৃষ্ট করতে অনেকাংশে দায়ী। নারী-পুরুষ এর মধ্যে আকর্ষণ বিধাতার সৃষ্ট, সুতরাং এটা কখনই এড়ানো সম্ভব নয়। কিন্তু তার মানে এই নয় যে নারী অশালীন পোশাক পড়ে পুরুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। যদি পোশাক পড়ে শরীরের মাপ বুঝাই যায় তাহলে ছেলেরা ৩৬-২৪-৩৬ বলে উচ্চস্বরে টিসিং করলে সেটার মধ্যে আমি দোষ খুঁজে পাই না। ছেলে-মেয়ের তর্কের শেষ নেই যে কাদের জন্য ইভটিজিং হয়। অনেক ছেলেরা দাবি করে, মেয়েরা শালীন ও ধর্মের নিয়মকানুন মেনে চললে ইভটিজিং হত না। তাহলে আমার তাদের কাছে আমার প্রশ্ন, ধর্ম কি শুধুই মেয়েদের জন্য? পর্দার আড়ালে থাকলেই যদি ইভটিজিং-এর মত অপরাধের ঝামেলা চুকে যায়, তাহলে ওয়েস্টটার্ন দেশ গুলোতে কেন সর্বাধিক মহিলা ধর্ষণের শিকার হয়? ধর্মের দোহাই-ই যদি সব, তাহলে এমন কি কোন ধর্ম আছে যেখানে পুরুষদের নারীসমাজের দিকে কুনজরে তাকানোর জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে?
৪ নং ছবিতে লক্ষ্য করুনঃ একজন ঈমানদার ব্যক্তি যখন ধর্মের অনুকূলে তার সহধর্মিণীকে বাইরে বের করছেন, তখনও লোকজনের দৃষ্টি থেকে তিনি তাকে মুক্ত করতে পারছেন না। সুতরাং ধর্ম সঠিক সমাধান নয়, মূল্যবোধের অবক্ষয়ই সবচেয়ে বড় কারণ। একজন চোরের মসজিদ থেকে কিছু চুরি করতেও হাত কাঁপে না, আবার একজন ভদ্রলোকের পকেট থেকে ১০০ টাকা লোকজনের ভিড়ে পড়ে গেলে তিনি সেটি তুলতেও লজ্জা পান। মূল্যবোধ এখানে চোর ও ভদ্রলোকের মধ্যে দেয়াল করে দিয়েছে, ধর্ম নয়। নারীকে পণ্য ও ভোগের বস্তু মনে করা, প্রকৃত শিক্ষার অভাব, সামাজিক অবক্ষয় ও বৈষম্য,বেকারত্ব ও হতাশা, সুস্থ সংস্কৃতির অভাব, মাদকের অবাধ ব্যবহার,
আইনের বাস্তবায়ন না হওয়া, আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের প্রকৃত প্রশিক্ষণের অভাব, নারীর প্রতি সমাজের (পুরুষদের) নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি প্রকৃতভাবে দায়ী।
ইভটিজিং একটি মারাত্মক অপরাধ। আর অপরাধ যেখানে আছে, শাস্তির ব্যবস্থাও রয়েছে। ইভটিজিং নিয়ে সরাসরি পৃথক আইন না থাকলেও বিভিন্ন আইনে এ সর্ম্পকে বেশ কিছু ধারা বা অনুচ্ছেদ রয়েছে।
বাংলাদেশের দন্ডবিধি আইনের ৫০৯ এবং ২৯৪ আইন অনুযায়ী ইভটিজিং বা উত্যক্ততা বা অশালীন অঙ্গভঙ্গি করা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যার জন্য একজন অপরাধীর জেল-জরিমানা হতে পারে। এছাড়া ডিএমপি এ্যাক্টের ৭৫, ৭৬ ধারা অনুযায়ীও এটি একটি অপরাধ এবং এর জন্য শাস্তির বিধান রয়েছে।
আমাদের করনীয়ঃ
১) রাস্তা ঘাটে চলাচলকারী যে কোন নাগরিক টিজিং বন্ধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন।
২) পারিবারিকভাবে শিশুকাল থেকে নারী-পুরুষ সম্পর্ক পরিষ্কারভাবে ছেলেমেয়েদের সামনে উপস্থাপন করতে হবে।
৩) নারী সদস্যদের প্রতি পুরুষ সদস্যদের শ্রদ্ধা প্রদর্শন, মর্যাদা দান, কটু ও অশ্লীল কথা না বলা, গালি-গালাজ না করা উচিত।
৪) টিজ করা একটি নিম্নমানের খারাপ কাজ এমনকি আইনের চোখে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ বিষয়ে সন্তানদের বিশেষ করে
ছেলে সদস্যদের অবগত করানো এবং মূল্যবোধ ও নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ১০:২৯