আপনি (নারী) এই অর্থে মানুষ নন যে মানুষ হিসাবে আপনার অর্জন অন্যের (বিশেষ করে পুরুষের) কর্মের ফল । বরং আপনাকে দায় গ্রহন করতে হবে কেবলি আপনার নিজের কর্মের জন্য । এখানে নারীর অবস্থা নিয়ে যে ব্যাখ্যা দেওয়ার চেস্থা করা হবে তার প্রতি সমাজতন্ত্রী ও খ্রিস্টবাদের আপত্তি থাকবে প্রবল । নারীকে মনে করতে হবে তার একটা বিশেষ ধরনের অস্তিত্ব রয়েছে যেভাবে মনে করে পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব তাদের কতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে (তারা মনে করে যে অন্যান্য সকল কিছুর থেকে তাদের আলাদা ভ্যালু আছে ) । আপনার (নারী) মনে করার কারণ থাকবে এটা যে, আপনি যদি মনে করেন আপনার একটা বিশেষ অস্তিত্ব রয়েছে তাহলে কিছুমাত্রায় প্রচলিত ক্ষমতার একীভূতকরণ ব্যাবস্থায় ফাটল ধরবে । আর একারনে কাফকার চরিত্ররা যেমন হতাশা এবং এক উদ্ভট অবস্তার সাথে লড়াই করে তেমনি আপনাকে নিজের অবস্থার সাথে নিজেকে লড়াই করতে হবে । আপনি আজকের একজন, আজকের একজন মানুষ, এই মুহূর্তের এক ব্যক্তিসত্তা কিন্তু নারী হিসাবে আপনাকে গড়ে তুলা হয়েছে ঐতিহাসিকভাবে লিঙ্গ নির্মাণ সাংস্কৃতিক প্রপঞ্চের মাধ্যমে । যা আবার আপনার বাইরের অবস্থা । তাই এই লড়াই যেমন সত্তাতাত্তিক তেমনি আবার সাংস্কৃতিক । শুধুমাত্র দৃশ্যমান বাস্তবতাই আপনার (নারী) জানার বিষয় ( what appears is what we know) । কারণ আপনার সতীত্ব, আপনার মাতৃত্ব, আপনার সিঁদুর, আপনার মন্ত্র, আপনার সৌন্দয, আপনার সংস্কৃতি, আপনার ইতিহাস আপনার সামনে এ্যাকুরিয়ামের মাছের চোখের দেখা বাস্তবতা উপস্থাপন করে । ঐ বাস্থবতা বিচার করার জন্য আপনাকে যে ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে তা ঐতিহাসিকভাবে নিষ্ক্রিয় করে রাখা । এখন আপনাকেই (নারী) করতে হবে যা করার তা । দার্শনিক হেগেলের মতো ১৮ শতকের বুদ্ধিবাদী দার্শনিকদের বিরুদ্ধে আজ নারীকে দাড়াতে হবে । কারণ আধুনিক সময়ের ক্রিটিক্যাল জেন্ডার বিষয়ক তাত্ত্বিক ভিত্তি করে গেছে পুরুষত্রন্ত্রের জন্য তারা । নারীকে আজকে ভাবতে হবে, সমস্ত মহাবয়ানগুলো তাকে ক্রমাগত শোষণ করছে । কারণ ঐ থিওরিগুলোর মাধ্যমে আপনার সমস্ত ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে । নতুন পরিভাষায় নতুন ধরনে ভাবতে হবে । ঐ সমস্ত দর্শনের মতো বিজ্ঞানও আপনাকে নিয়ে চরম সাধারণীকরণের সূত্র তৈরি করতে ব্যস্ত । আর তার ভাষা ও ভঙ্গিও পুরুষের । আর তা দখলও রয়েছে পুরুষের । তাই নারীকে বিজ্ঞানের খুপরি থেকে বেরিয়ে এসে নতুন করে বিজ্ঞানের ভাষা, নতুন করে বিজ্ঞানের ধরণ তৈরি করতে হবে । আজকের বিজ্ঞান হিসাবে যা চালান হয় তা হল পুরুষের দৃষ্টি । ঐ দৃষ্টিতে আপনাকে মাধ্যম করে প্রোডাক্ট চালান হয় । কারণ পুরুষতান্ত্রিক সমাজ “নারী মাধ্যমের মধ্য দিয়ে ” প্রোডাক্ট ভোগ করতে পছন্দ করে । তাই প্রচলিত বিজ্ঞানের ভাষিক দিক থেকে আপনার দৃষ্টি সরিয়ে এনে মনযোগী হতে হবে আপনার নিজের ভাষার প্রতি । ফলে আপনাকে বুদ্ধির (reason) খুপরি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে । আজ নারীকে নিজের বিশেষ দায়-দায়িত্ব সামনে আনতে হবে । আর এটা আনলে আপনার স্বাধীনতার বিষয়টি চলে আসবে । আপনাকে আপনার ভাষায় ভাবতে হবে, এই জগতের সম্পর্কের বাইরের “সত্তা” বলে আলাদা কিছু নেই আপনার মাঝে, যা এতদিন আছে বলে ভাবা হয়ছে । এই ভাবনার ফলে নারীর মাঝে একটা “Intentionality” তৈরি হবে যা আপনাকে বহিরমুখিতার দিকে নিয়ে যাবে । আজ থেকে নারীকে নিয়ে সকল “পূর্বানুমান, পূর্বসিদ্ধ” ধারনাগুলকে বাদ দিতে হবে । তা না হলে নারী কে মানুষ হিসাবে দেখা সম্ভব নয় । আর একটা ব্যাপার মনে রাখার মতো, ক্লাসিক্যাল থিওরিগুলো নারীকে মনে করে জ্ঞানের কর্তা ও সাইকো- ফিজিওলজিক্যাল সত্তা । এগুলোও বাদ দিতে হবে । ইতিহাস, ধর্ম, ও প্রচলিত থিওরি পাঠ করলে দেখা যায় নারী কে মনে করা হয়েছে জগতের স্থির সত্তা হিসাবে । তাই নারীকে মনে করতে হবে কোন আইডেন্টিটির কোন প্রাকসিদ্ধ অর্থ নেই । তাই তার ঐ আইডেন্টিটিরও কোন অর্থ হয় না । তাকে সর্বদা অথেনটিক হয়ে ওঠার চেস্থা করতে হবে । তবে তা আত্নবিসৃত হয়ে অন্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে পারে । যা এখনও পর্যন্ত নারী তার নিজের ক্ষেত্রে করে । এটা একধরনের “ নিজের হয়ে ওঠার” বাধা । নারী অন্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে চায় হতাশা, উদ্বেগ ইত্যাদি থেকে মুক্তির জন্য । কিন্তু এই মুক্তি তার এভাবে কোনদিন সম্ভব নয় । বরং নারীর এই মুক্তি মিলতে পারে আথেনটিক হয়ে উঠার দ্বারা । নারীকে বুঝতে হবে, (অন্য মানুষের মতো) হতাশা, উদ্বেগ ভীতি এগুলো হল তার অস্তিত্বের সহজাত স্মারক- এগুলোর মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায় মানুষের নিজেস্ব অস্তিত্ব । নিজের অস্তিত্ব উপলব্ধির জন্য মানুষকে (নারীকে) যা দরকার তা হল সব লক্ষ্য, আদরশচিন্তা, বাদ দিয়ে জীবনের ভঙ্গুরতা, মৃত্যু, আনিত্যতা, এইসব সত্যের মুখোমুখি হওয়া । পুরুষের কাছে তার চাওয়া, পুরুষের দ্বারা লক্ষ্য, পুরুষের দ্বরা অর্পিত দ্বায়-দায়িত্ব এসব নারীর অস্তিত্বের মৌলিক সত্যকে ঢেকে রাখে । নারীকে বুঝতে হবে পুরুষের দেওয়া নারীর জীবনের যে যৌক্তিক ব্যাখ্যা তা অচল । আবেগ ও ইচ্ছার যান্ত্রিক ও বস্তুগত ব্যাখাও অচল । প্রচলিত সমস্ত সাহিত্য, ভাষার কাঠামো, বিজ্ঞান, ধর্ম ও ইতিহাস কে দেখতে হবে তাকে “আযৌক্তিক ক্রিয়া” হিসাবে । প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নির্মিত আত্মপরিচয়ে নারীর “মানুষসত্তাকে” পাওয়া যায় না । তাই বাদ দিতে হবে সমাজের সাথে খাপ খাইয়ে চলাকে নারীর । প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর নারীকে বন্ধি করার প্রচলিত ন্যায়-নীতি, শৃঙ্খলা বাদ দিয়ে নতুন পথে হাঁটতে থাকে পুরুষতন্ত্র । তারা নারীরকে ভিন্নভাবে শোষণ করার জন্য নারীর অস্তিত্বে যোগ করে আবেগ, অনুভব, হতাশা, স্বধিনতা আর দায়- দায়িত্ব । নারীকে শোষণ করার জাল তখন হয়ে পড়ে আরও সূক্ষ্ম, জটিল ।
তাই নারীকে আজ অংশগ্রহণ করতে হবে স্বাধিনতা, পরিস্থিতি, আত্মপ্রতারণা ও প্রামানিকতার নানামুখি আন্তক্রিয়ায় । অন্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ হয়ে নারীকে আজ বুঝতে হবে নিজের সত্তাকে । পুজিবাদ, উপনিবেশবাদ, জাতিত্ব, বর্নবাদ, লিঙ্গ ধারনা নারীকে পদ্ধতিগতভাবে নিয়ন্ত্রন করে । এটা তাকে বুঝতে হবে । তাকে মনে করতে হবে তার পরিচয় তার নিজের দ্বারা স্বাধিনভাবে নির্বাচিত কর্মের ফল । আর এখানে অনেকেই নারীকে বাধা দিবে এই বলে যে, নারীর এই ভাবনা হল সমাজ বিরুদ্ধ ভাবনা । নারীর পরিচয় কেউ নির্মান করবে না । নারীকেই নির্মাণ করতে হবে তার পরিচয় । এই নারী হবে ব্যাক্তিনারী । তার সমষ্টিগত কোন পরিচয় থাকবে না । তারপর সে যা করবে সেই অনুযায়ী তার পরিচয় তৈরি হবে । আর একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল নারীর নিজের জন্যই প্রচলিত ধর্ম ও ঈশ্বরের অস্তিত্বে অবিশ্বাস করতে হবে । কারণ ...(ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা এখানে আসবে) । ঈশ্বরের অস্তিত্ব না থাকার সাথে নারীর নিজের সত্তার থাকার একটা সম্পর্ক আছে । নারীর আত্নমর্যাদার জায়গা হল তার নিজের পরিচয় । যেহেতু নারীর কোন ঈশ্বর থাকবে না তাই নারীর নিয়তি- নিয়ন্ত্রিত কোন গন্তব্য তাকবে না তাই নারী হবে স্বাধিন । স্বাধিন হতে সে বাধ্য । কিন্তু ব্যাক্তি নারী স্বাধিনতা দাবি করলেও শৃঙ্খলা খুঁজে বেরায় । স্বতঃস্ফূর্ত সিধান্ত গ্রহনের ভেতর দিয়ে স্বাধিনতার প্রকাশ । কিন্তু এই স্বাধিনতার কারনে নারীকে নিতে হবে নিজের জীবন গড়ার দায়িত্ব নিজেকে । এই সমাজের প্রতিকুল অবস্তা দ্বারা স্বাধিনতা নিয়ন্ত্রিত হবে । তারপরও নারীকে উপলব্ধি করতে হবে সে স্বাধিন । কারণ “আত্নপরিচয়হীনতায় ভুগলে মানুষ যার শরণাপন্ন হয়, তা হল ফ্যাশন ”_ কয়েনন্টিন ক্রিম্প ।
ইতিহাসে নারীকে যেভাবে রাখা হয়েছে তা হল অচেতন, মুর্ত, আত্নতিক্রমনের ক্ষমতাহীন । অপর দিকে পুরুষ হল আত্নতিক্রমনের বৈশিষ্ট্যময় ও আত্নসচেতন । মনে করা হয় যে নারী সত্তা তার নিজের মাঝে লীন থাকে (পাথর, পশু পাখির মতো) । তাহলে আজ নারী তার নিজেকে কিভাবে নির্মাণ করবে । যেহেতু আগেই বলেছি, মানুষের পরিচয়ের কোন পূর্ব শর্ত নেই তাই মানুষ হিসাবে নারীর নিজেকে গড়ে তুলতে হবে শূন্যতার উপর । নারীর স্বাধিনতা কিভাবে দশাগ্রস্তার সাথে ক্রিয়া করে তাই দিয়ে বুঝতে হবে তার পরিচয়ের প্রামাণ্যতা । অন্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রন হলে তার পরিচয় হয়ে পড়বে অপ্রামাণ্য । এখানে নারীর শরীর কাঠামো নারীর স্বাধিনতাকে বাধাগ্রস্ত করবে । এরপরও সে তার স্বাধিনতাকে উপলব্ধি করবে । কিন্তু এই স্বাধিনতার কারনে বাঙ্গালী নারীর মাঝে তৈরি হয় একধরনের দহন । যখন কোন কাজ সে নিজে পছন্দ করবে তখন তার ঝুকিও সে নিজেই নিবে । নারীর কি করা উচিত তা নির্দেস করার জন্য যেহেতু কোন ঈশ্বর, কোন পুরুষ থাকবে না তাই তাকে একধরনে দহনের মাঝে থাকতে হবে । তবে এই দহনই তার পরিচয় তৈরি করবে । আর নারী কে এও মনে রাখতে হবে যে, সকল নৈতিকতার মানদণ্ড পুরুষের তৈরি । আর একটা ব্যাপার হল “প্রেম” । পুরুষতান্ত্রিক সমাজে প্রেম হল এমন এক যুদ্ধ যেখানে নিজেকে অধিকৃত হতে না দিয়ে অপরকে অধিকার করার এক বাসনা । আর ঐ সমাজে নারী কেবল অপরের আকাঙ্ক্ষার বস্তু হয়ে উঠতে চায় । আর একারণে নারী পরাধিনতাকে নিজের জন্য স্বভাবিক বলে মনে করে । আর পুরুষ ভোগ করে সীমাহীন স্বাধিনতা । এই জটিল পরিস্থিতি জন্ম দেয় “Masochism” । অপরের দ্বারা এই অবস্থায় নারী পীড়িত হতে চায় । প্রেমের এই “Masochism” নারীর ক্ষেত্রে যখন তৈরি হয় তখন পুরুষ হয়ে ওঠে “Sadist” । এক্ষেত্রে নারী পুরুষের নিকট মাংসপিণ্ড অধিক কিছু হয়ে প্রতিভাত হতে পারে না । আর একারণে নিজের সত্তাকে তার নির্মান করার বিষয়টি থেকে যায় “প্রচলিত নারীবাদী শিক্ষিত পুরুষতান্ত্রিক সমাজে” অনেক দূরের কিছু । তাহলে আজ নারী তার নিজেকে কিভাবে নির্মাণ করবে ।