যুগে যুগে মুজাদ্দেদ , ইমাম এবং ইসলামী চিন্তাবিদদের অনেকই তদানীন্তন মুসলিম শাসকদের হাতে নিপীড়নের সন্মুখীন হয়েছেন। অতীতে যাঁরাই তদানীন্তন শাসকগোষ্ঠীর যুলম এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়েছেন তাঁদের সকলের উপরই নেমে এসেছিল নির্যাতনের ষ্টীমরোলার। ইতিহাস সাক্ষী , অতীতে যারা যালিমের ভূমিকায় ছিল আজকেও তাদেরকে মানুষ স্মরণ করে ঘৃণার সাথে। আর যারা মাযলুম ছিলেন তাঁরা শতাব্দীকাল থেকেই সন্মান ও মর্যাদার সাথেই মুসলিম উম্মাহর মন ও মননে রয়েছেন। বর্তমানেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেই সকল মুসলিম শাসক নিজেদের হীনস্বার্থে বা অন্য কারো স্বার্থ পূরণে ক্ষমতার দর্পে সত্যপন্থী মানুষদর উপর নির্যাতন করছেন ইতিহাস তাঁদেরকেও ক্ষমা করবেনা। ইতিহাস তাঁদেরকেও যালিম হিসাবে ঘৃণা করবে আর মাযলুমের জন্য আজকে যেমনি কোটি কোটি মানুষ চোখের পানি ফেলে আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করছে তেমনিভাবে আগতকালেও তাঁরা কোটি মানুষের অনুপ্রেরণার উতস হিসাবে থাকবেন।
অতীতে আদর্শিক বিরোধের কারণে অনেকই নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ক্ষমতার লোভ ও বস্তুগত স্বার্থ হাসিলের জন্য শাসকগোষ্ঠী যুলম নির্যাতনের মাধ্যমে বিপরীত মত পোষনকারীদের কন্ঠস্তব্ধ করতে চেয়েছে। ইমাম আবু হানিফাকে তদানীন্তন শাসক নিজের ক্ষমতার স্বার্থে বিচারপতির পদ-পদবী দিয়ে ব্যবহার করতে চেয়েছেন। তিনি তাতে সন্মত না হওয়ায় তাঁকে কারা নির্যাতন ভোগ করতে হয়। ইমাম মালেক , ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল তদানীন্তন শাসকগোষ্ঠীর মর্জিমত ফতোয়া দিতে সন্মত না হওয়ায় তাঁদের উপর নেমে আসে যুলম ও নিপীড়ন। ইমাম ইবনে তাইমিয়া শুধু তদানীন্তন শাসকগোষ্ঠীর কোপানলে পড়েননি বরং সে সময়কার কিছু আলেমও তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যাচারে নেমেছিল। মুজাদ্দেদে আলফেসানী বাদশাহ আকবরের কোপানলে পড়েন দীনে এলাহীর বিরুদ্ধাচারণ করার জন্য। সাইয়েদ কুতুবকে ফাঁসি দেয়া হয় সন্মুর্ণভাবে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন অজুহাতে। একইভাবে মিথ্যা অভিযোগে মাওলানা মওদুদীকে কারাভোগ করতে হয়।
বাংলাদেশে সত্যপন্থী মানুষদের উপর নির্যাতনের বিভিষীকাময় কিছু ঘটনা জানার পর অতীতে যেসব মর্দে মুজাহিদ শত নির্যাতনের পরও সত্যের পথে অটল ও অবিচল থেকে জীবন কুরবানী করেছেন তাঁদের জীবনী পড়ে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করছি অতীতের যালিমদের সাথে বর্তমান যামানার যালিমদের যুলমের কি ধরনের মিল রয়েছে? আর অতীতে কিভাবে ইসলামী চিন্তাবিদগণ নিপীড়নের মধ্যেও সত্যের উপর অটল ও অবিচল ছিলেন। অতীতের যুলমের কিছু বিবরণ পড়ার পর আমার কাছে মনে হল , যালিম সব যমানাতে একই রুপে আবির্ভুত হয়। যালিমরা পৃথিবীর বিভিণ্ন দেশের অধিবাসী হতে পারে কিংবা তাদের নামের বা ভাষার মাঝে পার্থøক্য থাকতে পারে কিন্তু তাদের যুলমের কারণ ও ধরন অনেকাংশে অভিন্ন। সময়ের আবর্তনে নিপীড়নের নিত্য নতুন কৌশল ব্যবহার করলেও সকল যালিমই ক্ষমতা দীর্ঘদিন ভোগ করার জন্যই আপোষহীন সত্যপন্থী মানুষকে নির্যাতন করে। দুর্বলচেতা কিছু মানুষ নির্যাতনের ভয়ে সত্যপথ ছেড়ে দিতে দ্বিধাবোধ না করলেও যুগে যুগে সত্যপ্রতিষ্ঠার পথে যাঁরা অনুপ্রেরণার উতস হয়ে আছেন তাঁরা জীবন দিয়েছেন কিন্তু কখনও আত্মরক্ষার জন্য মিথ্যার সাথে আপোষ করেননি। রাত ও দিন যেমনিভাবে একসাথে আসেনা। তেমনিভাবে সত্য ও মিথ্যা একসাথে চলতে পারেনা। সাময়িকভাবে কখনও যালিমদের জয়জয়কার অবস্থা দেখাগেলেও মিথ্যা পরাতভূত হবেই এবং যালিমদের যুলমের শাস্তি একদিন পেতেই হবে।
আমি এখন অতীতের কয়েকজন ইমাম ও ইসলামী চিন্তাবিদের কারাভোগ ও নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরছি।
ইমাম আবু হানিফার কারাবরণঃ ইমাম আবু হানিফা চার প্রসিদ্ধ ইমামের মাঝে বড় ইমাম হিসাবে পরিচিত। পাক-ভারত উপমহাদেশে তাঁর মাযহাবের অনুসারীর সংখ্যাই বেশী। খলীফা মানসুরের সময় ইমাম আবু হানিফাকে প্রধান বিচারপতির পদ গ্রহনের জন্য আহবান জানানো হয়। তিনি উক্ত প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে খলীফাকে সম্বোধন করে বলেন, ’’ আল্লাহর শপথ , কোন ব্যাপারে আমার ফয়সালা যদি আপনার বিরুদ্ধে যায় এবং আপনি আমাকে হুকুম দেন যে হয়ত সিদ্বান্ত পাল্টাও না হলে তোমাকে ফোরাত নদীদে ডুবিয়ে মারা হবে। তখন আমি ডুবে মরতে প্রস্তুত থাকব তবু নিজের সিদ্বান্ত পাল্টাতে পারবনা। তা ছাড়া আপনার দরবারে এমন অনেক লোক রয়েছে যাদের মনতুষ্টি করার মত কাজীর প্রয়োজন।’’
ইমাম আবু হানিফা খলীফার প্রস্তাব প্রত্যখ্যান করার পর তাকে ত্রিশটি বেত্রাঘাত করা হয় । যারফলে তাঁর সারা শরীর রক্কাক্ত হয়ে পড়ে। তখন খলীফা মানসুরের চাচা আব্দুস সামাদ ইবন আলী তাকে এজন্য খুবই তিরিষ্ড়্গার করে বলেন , ’’ ইনি শুধু ইরাকের ফকীহ নন। সমগ্র প্রাচ্যবাসীর ফকীহ।’’ এতে মনসুর লজ্জিত হয়ে প্রত্যেক চাবুঘাতের বদলে এক হাজার দিরহাম ইমাম আবু হানিফার কাছে পাঠান। কিন্তু ইমাম উক্ত দিরহাম গ্রহনে অস্বীকৃতি জানান। তখন তাকে বলা হয় তিনি এ অর্থ গ্রহন করে নিজের জন্য না রাখলেও দুঃখী-গরীবদের মাঝে বিলিয়ে দেন। এর জবাবে ইমাম বলেণ ’’ তার কাছে কি কোন হালাল অর্থও রয়েছে’’?। মানসুর এরপর আরও প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে উঠে। ইমামকে আরও চাবুকাঘাত করা হয়। কারারুদ্ধ করে পানাহারে নানাভাবে কষ্ট দেয়া হয়। তারপর একটা বাড়ীতে নজরবন্দী করে রাখা হয়। সেখানেই ইমাম আবু হানিফার মৃত্যূ হয়। কারো কারো মতে তাঁকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়। নির্মম নির্যাতনের শিকার ইমাম আবু হানিফা মৃত্যুর আগে অসিয়ত করে যান যে খলীফা মানুসর জনগনের অর্থ অন্যায়ভাবে দখল করে বাগদাদের যেই এলাকায় শহর নির্মান করেছে সে এলাকায় যেন এন্তেকালের পর তাঁকে দাফন করা না হয়।
মূলত খলীফা মানসুর তার ক্ষমতার স্বার্থেই ইমাম আবু হানিফাকে বিচারকের পদে নিয়োগ দিতে চেয়েছিলেন। তাই ইমাম তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। ইমাম আবু হানিফা এই বিষয়টি স্পষ্ট করেই খলীফা মানকুরকে জানিয়ে দিয়ে বলেন , ’’ আপনি আমাদেরকে আল্লাহর উদ্দেশ্যে ডেকে আনেননি। বরং আপনি চান যে আপনার ভয়ে যেন আমরা আপনার মর্জি মাফিক কথা বলি’’। বর্তমান যমানায় ইমাম আবু হানিফা সর্বজন সমাদৃত। আজকে যে সকল মুসলিম শাসকগণ আজকের যমানার ইমামও ইসলামী চিন্তাবিদদের উপর নর্যাতন করছেন কিংবা কারান্তরীণ করছেন তাদের অনেকই ইমাম আবু হানিফার মাযহাব অনুসারী বলে দাবী করেন। কিন্তু ইতিহাস এই সত্যেরই সাক্ষী যে, আজ সারা জাহানে ইমাম আবু হানিফার মর্যাদা এবং তদানীন্তন জালিম শাসকদের মর্যাদায় আকাশ পাতাল পার্থøক্য রয়েছে।
ইমাম মালেকর উপর নির্যাতনঃ শুধু ইমাম আবু হানিফা নয় ইমাম মালেকও আব্বাসীয় জালিম শাসকদের জুলমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মুখর ছিলেন। খলীফা মানসুরের চাচাতো ভাই মদীনার গভর্ণর জাফরের নির্দেশে ইমাম মালেকের উপর অবর্ণণীয় নির্যাতন করা হয়। ইমামের দেহের কাপড় খুলে নির্মমতার সাথে চাবুকাঘাত করা হয়। এরফলে সারা শরীর রক্তে রঞ্জিত হয়। কিন্তু এইভাবে নির্যাতন করেও তৃপ্ত হতে পারেননি মদীনার জালেম গভর্নর। ইমাম মালেককে ক্ষত বিক্ষত দেহ নিয়ে উটের পিঠে বসিয়ে শহরের অলি-গলিতে প্রদক্ষিন করা হয়। তারপর ইমাম রক্তাক্ত অবস্থায় মসজিদে নববীতে প্রবেশ করে রক্ত পরিষ্ড়্গার করে দুরাকাত নামায আদায় করেন। ইমাম গভর্ণরের কথামত ফতোয় দিতে অস্বীকৃতি জানানোর কারণেই তাঁর উপর এই ধরনের নির্যাতন করা হয়।
ইমাম আহমদ ইবন হাম্বলের গৃহবন্দীঃ ২১৮ হিজরীতে খলীফা মামুনুর রশীদ মুতাযিলা সম্প্রদায়ের খালকে কুরআন আক্বীদার প্রতি জোরপূর্বক জনগনের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেন। বাগদাদের তদানীন্তন গভর্নর ইসহাক ইবনে ইবরাহীম সকল আলেমতে একত্রিত করেন এবং শাস্তির হুমকি প্রদান করে খলীফার নির্দেশ মানার অনুরোধ করেন। মাত্র চারজন ছাড়া আর সব আলেমই নির্যাতনের ভয়ে খলীফার অনুরোধ রক্ষা করেন। এই চারজনের মধ্যে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল ছিলেন শীর্ষস্থানীয়। গভর্নরের নির্দেশে এদের উপর কঠিন শাস্তি দেয়া হয়। এরফলে দুইজন মুতাযিলা আক্বীদায় বিশ্বাস স্থাপনের ঘোষনা দেন। আর একজন নির্যাতনের মুখে শহীদ হন। এরপর ইমাম আহমদকে হাতকড়া ও পায়ে বেড়ি দিয়ে খলীফা মামুনের দরবারে নিয়ে যাওয়ার জন্য রওয়ানা দেয়া হয়। পথিমধ্যে সংবাদ আসে মামুনের মৃত্যু বরণ করেন। কিন্তু মামুনের মৃত্যু হলেও ইমামের প্রতি নির্যাতন কমেনি। বরং মুতাসিমের সময় নির্যাতন আরও বাড়িয়ে দেয়া হয়। ইমাম সাহেবকে চারটি ভারি বেড়ী পরিয়ে রমযান মাসে দুপুর বেলায় রোদে বসিয়ে চাবুকাঘাত করা হয়। ক্রমাগত চাবুকাঘাতে অসহ্য হয়ে ইমাম সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়লে তলোয়ারের তীক্ষ্ন ফলা দিয়ে খঁুচিয়ে তাঁর সংঞ্জা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হতো। খলীফা মুতাসিমের মৃত্যুর পর খলীফা ওয়াসিকের সময়ও ইমাম আহমদকে গৃহবন্দী করে রাখা হয় এবং তাঁকে নামাযের জন্যও বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হতোনা।
ইমাম ইবনে তাইমিয়ার কারাভোগঃ ইবনে তাইমিয়া আল্লাহ্ প্রদত্ত অনেক গুণে গুণান্বিত ছিলেন। তাঁর গূণাবলীর মধ্যে রয়েছেঃ ১· অসাধরণ স্মৃতিশক্তিঃ তিনি কোন কিছু একবার শুনলেই মুখস্থ হয়ে যেতো। ২· অধ্যবসায়ঃ তিনি ছোট বেলা থেকে অন্যান্য ছেলেদের মতো খেলাধূলায় সময় ব্যয় করতেননা। ৩· স্বাধীন চিন্তাঃ তিনি স্বাধীনভাবে চিন্তা করতেন। মূলত এ চিন্তাশক্তিই তাঁকে এত সন্মান ও মর্যাদা দিয়েছে। ৪· বাগ্মীতা ও লেখনী শক্তিঃ ইবনে তাইমিয়া বিশুদ্ধ বাগ্মী এবং অনন্য লেখক ছিলেন। তিনি যা চিন্তা করতেন তা দ্রুত মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারতেন।
ইমাম ইবনে তাইমিয়া এমন ধরনের মানুষ যিনি সামাজিক ও রাজনৈতিক দুরবস্থার মধ্যে বড় হয়ে উক্ত অবস্থার পরিবর্তন সাধনের জন্য চেষ্টা করেন। যারা সংস্ড়্গারক তাদের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য এটাই যে তাঁরা কোন সমাজে বসবাস করে উক্ত সমাজের স্রোত পরিবর্তনের চেষ্টা করেন। ইবনে তাইমিয়ার সময় মুসলমানেরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিভিন্ন রাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল। রাষ্ট্রপ্রধানরা ইসলামী খেলাফতের প্রতিনিধিত্ব করার পরিবর্তে নিজেদের সাম্রাজ্য প্রসারেই ব্যস্ত ছিল। তাতার ও খ্রীস্টানদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী মুসলিম ঐক্য ছিলনা। ১০৯৫ খ্রীস্টাব্দ থেকে ১২৭০ খ্রী পর্যন্ত এ যুদ্ধ চলতে থাকে। সালাহ উদ্দিন আইউবীর হাতে তাদের পতন হওয়ার আগ পর্যন্ত তাতাররা মুসলিম বিশ্বে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। এ সময় তাতাররা মুসলমানদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করে। তাদের অপরাধ শুধু এটিই ছিল যে, তারা এক আল্লাহ্্র উপর ঈমান এনেছে এবং হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াসাল্লামকে নবী ও রাসূল হিসাবে স্বীকার করেছে এবং ইসলামকে পূর্ণাংগ দ্বীন বা জীবন ব্যবস্থা হিসাবে মেনে নিয়েছে। তাতাররা অনেক মসজিদ ও মিম্বর ধ্বংস করে। কুরআনের সহীফাতে আগুণ ধরিয়ে দেয়। তারা বুখারা ও সমরকন্দে খুনের নহর প্রবাহিত করে। অনেক আলিম ও ইসলামী চিন্তাবিদকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এভাবে তারা একের পর এক মুসলিম দেশ দখল ও ধ্বংস করে । ৬৫৬ হিজরীতে ইসলামী খিলাফতের রাজধানী বাগদাদ আক্রমন করে খলীফা মু‘তাসিম আব্দুল্লাহ্ বিন মানসূরকে তার পরিবার পরিজনসহ হত্যা করে এবং বিভিন্ন গ্রন্থাগার জ্বালিয়ে দেয়। তাতাররা বাগদাদ দখল করার পর দামিশ্কের দিকে অগ্রসর হয়। সেখানে তারা আমীর ’ ইবল নিয়ান’ এর সাথে সন্ধিচুক্তিতে আবদ্ধ হয়। এরফলে খ্রিস্টানদের শক্তি বৃদ্ধি পায়। সে সময় ইমাম ইবনে তাইমিয়া তাঁর লেখনী ও বক্তব্যের মাধ্যমে তাতারদের যুলুমের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালান। ইবনে তাইমিয়া প্রত্যক্ষ যুদ্ধেও অংশ গ্রহণ করেন। তিনি ৭০২ হিজরীতে শাক্বহাব নামক স্থানে অনুষ্ঠিত যুদ্ধে শরীক হন। এতে মুসলমানেরা বিজয় লাভ করে। কিন্তু উক্ত এলাকায় পাহাড়ী অঞ্চলে ‘আল-হাশাশীন’ নামক একটি গোষ্ঠী থাকতো। তারা তাতারদের সংগে যোগ দিয়ে নারী ও শিশুদেরকে আটক করতো এবং সম্পদ লুন্ঠন করতো। ইবনে তাইমিয়া তাদের সাথে ৭০৪ হিজরীতে যুদ্ধ করে তাদেরকে বশ্যতা স্বীকার ও ইসলামী অনুশাসন মেনে চলতে বাধ্য করেন।
ইবনে তাইমিয়া যেসময় জন্মগ্রহণ করেন সেসময় তাতারদের আক্রমণে মুসলমানরা বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। মুসলিম দেশগুলোতেও ইসলামী অনুশাসন কার্যকর ছিলনা। সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা শোচনীয় ছিল। তারা কৃষিকর্ম এবং শিল্প কারখানায় কাজ করতো। পঁুজিপতি ব্যবসায়ীরা মাল গুদামজাত করে মুল্য বৃদ্ধি হলে বিক্রী করতো। এরফলে গরীব মানুষদেরকে প্রকৃত মূল্যের কয়েকগুণ বেশি দিয়ে কিনতে হতো। ইবনে তাইমিয়া সামাজিক অবিচারের বিরুদ্ধে কথা বলা ও লেখা শুরু করেন।
যুলমের বিরুদ্ধে ইবনে তাইমিয়ার প্রতিবাদী ছিলেন। তাই তাঁকে একাধিকবার নজরবন্দী ও কারা নির্যাতন ভোগ করতে হয়। ৭১৭ হিজরীতে তালাক সংক্রান্ত একটি ফতোয়া দেয়ার পর তদানীন্তন উলামায়ে কেরাম উক্ত ফতোয়ার বিরোধিতা করেন । ৭১৮ হিজরীতে সরকারের পক্ষ থেকে তাঁর উপর ফতোয়া প্রদানে নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়। কিন্তু তিনি ফতোয়া দেয়া বন্ধ করেননি। ৭২০ হিজরীতে এই কারণে তাঁকে পনের মাস আঠার দিন কারারুদ্ধ করে রাখা হয়। ৭২১ হিজরীতে কারাগার থেকে মুক্তি পান। মুক্তি পাওয়ার পর তিনি জ্ঞান গবেষণায় মনোনিবেশ করেন। চক্রান্তকারীরা সব সময় তাঁর বিরুদ্ধে লেগে থাকতো। ৭২৬ হিজরীতে কবর যিয়ারত সংক্রান্ত একটি ফতোয়াকে কেন্দ্র করে তারা সরকারের কাছে ইবনে তাইমিয়ার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ দায়ের করে যে, তিনি নেক বান্দাহ ও রওযা যিয়ারতের বিরোধী। এই অভিযোগে তাঁকে ৭২৬ হিজরীর ১৬ শা‘বান আবার আটক করা হয়। এই পর্যায়ে নির্যাতন শুধু তাঁর উপর সীমাবদ্ধ ছিল না, তাঁর ছাত্র এবং ভক্তদের উপরও নির্যাতন চালানো হয়। ইবনে কাসীর বলেন, ইবনে তাইমিয়া বন্দী থাকাবস্থায় তাঁর কাছে এই প্রস্তাব দেয়া হয় যে, তিনি যদি তাঁর কিছু আক্বীদা থেকে ফিরে আসেন তাহলে তাঁকে মুক্তি দেয়া হবে। এ সস্পর্কে হানাফী, শাফেয়ী ও মালেকী মাযহাবের তিন বিচারপতি তাঁর সাথে দীর্ঘসময় আলোচনা করেন। কিন্তু তিনি তাঁর আক্বীদা থেকে ফিরে আসতে অস্বীকৃতি জানান।
সাইয়েদ কুতুবের কারাবরণ ও শাহাদাতঃ ১৯৪৫ সালে জামাল আব্দুন নাসের ও ইংরেজদের মধ্যে চুক্তি হয়। ইখওয়ান ‘ইঙ্গ মিশর’ চুক্তির বিরোধিতা করে। ফলে ইখওয়ান কর্মীদের উপর চালানো হয় দমন, পীড়ন ও নির্যাতন। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পঞ্চাশ হাজার নেতা-কর্মীকে কারাবন্দী করা হয়। এর মধ্যে ছয়জন কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। তাঁদের মধ্যে সাইয়েদ কুতুবও ছিলেন। সে সময় তিনি ছিলেন জ্বরে আক্রান্ত। তিনি অসুস্থতায় বিছানায় কাতরাচ্ছিলেন। একজন সামরিক অফিসার ঘরে ঢুকলেন। তার সাথে ছিল অনেক সশস্ত্র সিপাহী। তারা রোগশয্যায় শায়িত সাইয়েদ কুতুবের হাতে ঐধহফ ঈঁঢ় পরিয়ে তাঁকে কারাগারের দিকে নিয়ে চললেন। তাঁকে কোন গাড়িতে না চড়িয়ে পায়ে হেঁটে যেতে বাধ্য করা হল। অত্যধিক অসুস্থতার কারণে রাস্তায় চলার পথে তিনি বারবার অজ্ঞান হয়ে পড়েন। হুঁশ ফিরে এলে মুখে উচ্চারিত হতো ইখওয়ানের প্রিয় স্লোগান ‘আল্লাহু আকবর ওয়া লিল্লাহিল হামদ।’ কারাগারের ভিতর প্রবেশের সাথে সাথে হিংস্র হায়েনার দল তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। দু’ঘণ্টা যাবৎ জেলের অন্ধকার কক্ষে অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়। তাঁর উপর এক ভয়ংকর কুকুর লেলিয়ে দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুরটি সাইয়েদ কুতুবের পায়ে কামড় দিয়ে টেনে হেঁচড়ে এদিক সেদিক নিয়ে যায়। এরপর তাঁকে একটি নির্জন কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। সাইয়েদ কুতুব নির্যাতনে ক্ষত-বিক্ষত। তার শরীর থেকে রক্ত ঝরছে। এমন অবস্থার পরও তাকে রিমান্ডে নিয়ে একের পর এক বিভিন্ন প্রশ্ন করা হয়। দীর্ঘ সাত ঘণ্টা যাবৎ প্রশ্ন পর্বের মাধ্যমে মানসিক নির্যাতন করা হয়। এই ধরনের নির্যাতনের ফলে সাইয়েদ কুতুব শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়লেও মানসিকভাবে ছিলেন খুবই সবল। ঈমানী বলে তিনি ছিলেন বলীয়ান। কখনো নির্যাতনের সীমা বৃদ্ধি পেলে তিনি মুখে উচ্চারণ করতেন ‘আল্লাহু আকবর ওয়া লিল্লাহিল হামদ।’ রাতে তাকে একটি অন্ধকার প্রকোষ্ঠে রাখা হতো। সকাল বেলা খালি পায়ে প্যারেড করতে বাধ্য করা হতো। এভাবে অমানুষিক নির্যাতনে তার বুকের ব্যথা, ঘাড়ের ব্যথাসহ সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ব্যথা-বেদনার সৃষ্টি হয়। তিনি নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হন। যার ফলে ১৯৫৫ সালের ২ মে তাকে সামরিক হাসপাতালে পাঠানো হয়। সাইয়েদ কুতুবের শিষ্য ইউসুফ আল আযম লিখেছেন- “সাইয়েদ কুতুবের ওপর বর্ণনাতীত নির্যাতন চালানো হয়। আগুন দ্বারা সারা শরীর ঝলসে দেওয়া হয়। পুলিশের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুর লেলিয়ে দিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থান রক্তাক্ত করা হয়। মাথার ওপর কখনো উত্তপ্ত গরম পানি ঢালা হতো। পরক্ষণে আবার খুবই শীতল পানি ঢেলে শরীর বরফের ন্যায় ঠান্ডা করা হতো। পুলিশ লাথি, ঘুষি মেরে একদিক থেকে অন্যদিকে নিয়ে যেত।
এমনও হয়েছে যে একাধারে ৪ দিন একই চেয়ারে বসিয়ে রাখা হয়েছে; কোন খানাপিনা দেয়া হয়নি। তাঁর সামনে অন্যরা পানি পান করতো অথচ তাঁকে এক গ্লাস পানি দেওয়া হতো না। সাইয়েদ কুতুবের ওপর এইভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন সত্ত্বেও তিনি সময় পেলেই জেলে দাওয়াতী কাজ করতেন। ইখওয়ানুল মুসলিমীন নিয়ে ভাবতেন ও বিভিন্ন পরিকল্পনা করতেন। তিনি ঈমানী চেতনায় এত বেশি উদ্দীপ্ত ছিলেন যে, কোন সময়ই অন্যায়ের সাথে আপোষ করতে চাননি। কারাগারে যাওয়ার ১ বছর পরই সরকারের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয় যে, ’’যদি আপনি ক্ষমা চেয়ে কয়েকটি লাইন লিখে দেন, যা বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশ করা হবে, তাহলে আপনাকে মুক্তি দেওয়া হবে। আপনি জেলের কষ্টকর জীবন থেকে মুক্তি পেয়ে ঘরে আরামে থাকতে পারবেন’’। উক্ত প্রস্তাব শুনে সাইয়েদ জবাব দিলেন- “আমার অবাক লাগে যে, এ সকল লোকেরা মযলূমকে বলছে যালিমের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চাইতে। আল্লাহ্র শপথ! যদি কয়েকটি শব্দ উচ্চারণের ফলে আমাকে ফাঁসির মঞ্চ থেকে নাজাত দেয় তবু আমি তা বলতে প্রস্তুত নই। আমি আমার রবের দরবারে এমনভাবে হাজির হতে চাই যে, আমি তাঁর উপর সন্তুষ্ট আর তিনি আমার উপর সন্তুষ্ট।”জেলখানায় যখনই তাকে ক্ষমা চাইতে বলা হত, তিনি বলতেন- “যদি আমাকে কারাবন্দী করা সঠিক হয়, তাহলে সঠিক সিদ্ধান্তের উপর আমার সন্তুষ্ট থাকা উচিত। আর যদি অন্যায়ভাবে আমাকে কারাগারে আটক রাখা হয়, তাহলে আমি যালিমের কাছে করুণা ভিক্ষা চাইতে রাজি নই।”এরপর সরকারের পক্ষ থেকে টোপ দেয়া হয়, তিনি যদি সম্মত হন তাহলে তাকে শিক্ষা মন্ত্রণায়ের দায়িত্ব দেয়া হবে। সাইয়েদ এ প্রস্তাব শুনে প্রতিক্রিয়ায় বলেন- “আমি দুঃখিত। মন্ত্রীত্ব গ্রহণ আমার পক্ষে সে সময় পর্যন্ত সম্্ভব নয়, যতক্ষণ না মিসরের পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে ইসলামী ছাঁচে ঢেলে সাজাবার এখতিয়ার দেয়া না হবে।
সাইয়েদ কুতুবকে ‘তাররা’ কারাগারে রাখা হয়েছিল। সেখানে ইখওয়ানের আরও ১৮৩ জন কর্মী ছিল। তাদের সাথে পরিবার পরিজনকেও দেখা করতে দেয়া হত না। একবার ‘আব্দুল্লাহ্ মাহের’ ও ‘আব্দুল গাফফার’ নামক দু’জন ইখওয়ান কর্মীকে তাদের আত্মীয়-স্বজন দেখতে আসেন। কিন্তু তাদের সাথে আত্মীয়দের সাক্ষাতের সুযোগ দেয়া হয়নি, বরং তাদের দেখতে আসার শাস্তিস্বরূপ কারাগারে আটক রাখা হয়। কারাবন্দী ইখওয়ান কর্মীরা উক্ত অমানবিক ঘটনার প্রতিকার চেয়ে কারা তত্ত্বাবধায়কের নিকট আবেদন জানান। কিন্তু ফল হল উল্টো। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে কারাগারে অস্ত্রে সুসজ্জিত সৈন্যরা প্রবেশ করে। সৈন্যরা অগ্নিগোলা বর্ষণ করতে থাকে। ঘটনাস্থলেই ২১ জন ইখওয়ান কর্মী শাহাদাত বরণ করেন, ২৩ জন মারাত্মক আহত হন। রক্তে রঞ্জিত হয় তাররা কারাগার। এ ঘটনার পর মন্ত্রী পরিষদের সচিব সালাহ দাসুফী তদন্তে আসেন। তদন্তে কি হয় এ ভয়ে সকলেই তটস্থ হয়ে পড়ে। না, যাদের গুলিতে রক্তের স্রোত বইছে তাদের কিছুই হয়নি। ইখওয়ান কর্মীদের উপর কড়া নজর রাখার নির্দেশ দিয়ে চলে গেলেন যালিম সরকারের সচিব মহোদয়।
আল্লাহ্ সাইয়েদ কুতুবকে এক বিরাট যাদুকরী সম্মোহনী শক্তি দিয়েছিলেন। কারাগারের সকলেই তাঁকে শ্রদ্ধা করতো, সম্মান করতো। তাঁর কাছে সকল কথা খুলে বলতো। কারাগারের বিভিন্ন বিষয় তিনি মীমাংসা করতেন। হাজতী, কয়েদীদের পরস্পরে ঝগড়া হলে তিনি বিচার করতেন। তাই তাঁকে উপাধি দেয়া হয় ‘কাজী উস সিজন’ -কারাগারে বিচারপতি। যখন কোন কয়েদীকে অন্য স্থানে স্থানান্তর করা হত তিনি তাকে বিদায় দিতেন। তাঁকে খাবারের কোন কিছু দেয়া হলে তা অন্যদের মাঝে বিতরণ করতেন। জেল সুপার, জেল ডাক্তার সবাই তাকে ভালবাসতো। তিনি কারাবন্দীদের খোঁজ-খবর রাখতেন। এমনকি কারাগারে যেসব প্রাণী থাকতো, তিনি তাদেরও যত্ন নিতেন, খাবার দিতেন। তিনি তাঁর আচরণে সবার মন জয় করেন। একবার তিনি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন ছিলেন। কারাসঙ্গী অন্যরা তাঁর খিদমত করতেন। তিনি হাসপাতাল আঙ্গিনায় অন্যদের সাথে খোশ-গল্প করতেন। তিনি ছিলেন খুবই ধৈর্যশীল। ইখওয়ান নেতৃবৃন্দ পরামর্শের জন্য কারাগারে গেলে স্বাভাবিকভাবেই পরামর্শ দিতেন। কখনও কখনও ছোট বোন হামিদা কুতুবের মাধ্যমে পরামর্শ পাঠাতেন। সাইয়েদের কারাজীবনে মানসিকতার কোন পরিবর্তন ঘটেনি। একবার আদালতের কাঠগড়ায় তিনি দাঁড়ানো। তাঁর ভাই-বোনেরা তাঁকে দেখতে এসেছেন। সবাইকে দেখে তিনি মুচকি হাসলেন। আল্লাহ্র কাছে দোয়া করলেন এবং ধৈর্যের উপদেশ দিলেন।
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জুলাই, ২০১০ দুপুর ২:১২