বেশ পুলকিত হয়েছিলাম সিলেটের ছেলে ঢাকায় বৃটিশ হাইকমিশনার হয়ে আসায়। কিন্তু কেন যেন এসব আমাদের কপালে সয় না। আমাদের উদার ও নির্যাস ভালবাসার পাপড়িতে না বসে তারা নিজেরাই নিজেদেরকে ব্রাকেট বন্দী করে ফেলেন। ছোট বেলায় আম্মার নানীর মুখে শুনতাম, ‘সব ভাতের দোষ! যাদেরকে খাওয়ায়ে পড়িয়ে চোখ ফোটায়ে দেই, বছর না ঘুরতেই তারা অন্যের কীর্তন গায়!’ ইউরোপের সবচেয়ে ভোকাল আমাদের এমবেসিডড়কে গোল টেবিলের বাইরে কয়জন ভালবাসে তা বোধ করি এখন খুজতে হবে।
আমরা কেউ শ্বেত ভালুকের মুলক থেকে ঘুরে এসে চেনা লোকদের নিয়ে পুরোনো কথা নতুন করে আহামরি করে বলি, কেউবা শ্বেতী সেজে ঘরের মধ্যে ঢুকে ইদুরের মত ধানের বস্তার কোনা থেকে খেয়ে খেয়ে সাবাড় করে দেই। কারন প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিবৃত্তিক সৌকর্যহীন বিড়াল তো আর জেগে নেই! সে তো এখন অযোগ্য ও বিশ্বাসহীনতার অপবাদ নিয়ে লম্বা ঘুম আর পালানোর পথ নিয়েই ব্যস্ত! গত এক বছরের পলিটিক্যাল সিডরে বিপর্যদস্ত এক ক্লান্ত সৈনিক সে!
আমাদের মত গরীবদেশের সমস্যা হল বাইরের বড়লোক ও বড়মাথাওয়ালাদের ছবককে আমরা বড্ড পাত্তা দেই, আবার পল্টন ময়দানে গর্ব করে বলি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী আমরাই! অন্য কথায়, তাদেরকে বেশ সুযোগও করে দেই আমাদের নাড়ি নক্ষত্রের মধ্যে সুবিধামত সময়ে ঢুকে পড়ে তা কেটে ছেটে ফেলার। আবার নিজেরাও সবার জন্য সমান আচরণ না করে অপরিপক্কতার পরিচয় দেই প্রায়শ।
এই যেমন, রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানে বসে প্রেসিডেন্ট সাহেব সোজা পথে না গিয়ে চায়ের দাওয়াতের নতুন লজ্জাজনক কালচার স্থাপন করে যে খারাপ রেওয়াজটি চালু করেছিলেন, তার আজ শেষ দেখালেন জাতির বিবেকদের ক্ষমা করার মধ্য দিয়ে।ক্ষমা করা মহৎগুন, ক্ষমাতে বা ক্ষমা নেয়াতে দুটোতেই লজ্জা নেই। আবার, ক্ষমা না নিয়ে অন্যায়ভাবে আটকের প্রতিবাদে মানবাধিকার লংঘনের জন্য কেয়ারটেকার চীফের বিরুদ্ধে মামলা করাও তো জাতির বিবেকদের নাগরিক অধিকার। এভাবে মামলা-ধামলা চলতে থাকলে সাধারন মানুষের চ্যাপ্টা হওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকবে না বৈ কি (আর বাকীই বা আছে কি?)! তাছাড়া , জাতির বিবেকদের বিবেক যে দুইজনের হাতে বন্দী তাদের কি হবে? আধুনিক সভ্য সমাজে এমন সুব্যবস্থা চালু থাকলে এত আইনজীবি, বিচারকদের রাতদিন খেটে, রাষ্ট্রের এত টাকা খরচ করে মামলা চালানোর দরকারই বা কি? বৃটিশরা যদি বাংলাদেশের আইন ঢাকা ইউনিভার্সিটিরপ্রফেসর ও সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবিদের বাইরে রেখে শুধুমাত্র অশিক্ষিত, দিন-মজুর ও রিক্সাওয়ালাদের জন্যই করে থাকে সে আইন তো মনে হয় বদলানো দরকার!
সনাতনী সত্য কথাটা কি রপ্ত করা যায় না, অপরাধী যেই হোক তার সাজা ভোগ করতে হবে, আর নির্দোষী বা নিতান্তই সন্দেহের বশবর্তী হয়ে কাউকেই হয়রানী করা যাবে না বা তাদেরকে ছেড়ে দিয়ে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার সুযোগ করে দিতে হবে? জরুরী আইন মানা সবার জন্যই জরুরী করতে হবে, নইলে এর গুরুত্ব হারানো আগেই উঠিয়ে নিতে হবে। এভাবে একের পর এক দেশের গুরুত্বপূর্ণ সব ইনস্টিটিউশনগুলো কার স্বার্থে ভেঙে ফেলা বা বিতর্কিত করা হচ্ছে? যাহোক, ওসব রেখে আর বিরুক্তি না বাড়িয়ে চলুন মূল আলোচনায় আসি।
আমাদের আজকের আলোচনা অ্যামনেষ্টি ইন্টারন্যাশনালের অবিচার নিয়ে।
নর্দান আয়ারল্যান্ডের এক স্কুলে পড়াশুনা করতে টিন এজেই দেশ ছেড়েছিলেন বাংলাদেশের মেয়ে আইরিন খান । তারপর ইংল্যান্ড, আমেরিকায় পড়াশুনা শেষ করে ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিষ্টসে মানবাধিকার কর্মী হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন ১৯৭৮ সালে। অনেক ক্ষেত্রেই তিনি যে প্রথম হওয়ার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা জনাব শফিক রেহমান ৮ই জানুয়ারীতে লিখেছেন। গত বছরের নিরুত্তাপ রাজনীতি ও উত্তপ্ত পেট নিয়ে মাত্র ৩০টি বাক্যে তিনি দেশের মানুষের মনের সব কথাগুলো সুন্দর করে বুঝিয়ে দিয়েছেন। মিসেস খানের প্রাক্তণ দেশে এবারের সফর নিয়ে এই কলামে মেসবাহ উদ্দিন শাকিল খোলাখুলিভাবে চমৎকার একটি আর্টিকেল লিখে কা কা না করার অনুরোধও করেছেন। এই অসামান্য মেধাবী সিলেটি মেয়ের এবারের ভ্রমণটি সরকারীভাবে না হলেও তার বর্তমান সম্মানজনক পদে আসীন থাকায় মিডিয়াতে বেশ গুরুত্ব পেয়েছে। উল্লেখ্য, তিনি একটি রাজনৈতিক দলের অর্থনীতি বিষয়ক সম্পাদক ডঃ আতিউর রহমানের গড়া এনজিও ‘মানুষের জন্য’-র আমন্ত্রণে এসেছিলেন । যাহোক, আমরা সেদিকে নজর না দিয়ে এবার দেখি বাংলাদেশের প্রতি এই মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানটি সময়ে সময়ে কেমন ব্যবহার করে।
১৯৭১-র মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবাধিকারের ঝান্ডাবহনকারী অ্যামনেষ্টি ইন্টারন্যাশনালের বয়স ছিল দশ বছরেরও বেশী। পাক বাহিনীর বর্বরতায় প্রকাশ্য সমর্থনদানকারী আমেরিকা ও বৃটেনের পদলেহী হয়ে একটি বিবৃতিও দিতে তাদের গলা শুকিয়ে গিয়েছিল। দালাল আইনের দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য কি এ.আই মুজিব সরকারকে চাপ দেয়নি? পুরোনো দিনের কথা না হয় বাদ দিলাম, যদিও পত্রিকায় পড়ে মনে হয় তিনি এগুলো নিয়ে বেশী ব্যস্ত ছিলেন।
‘অ্যামনেষ্টি ইন্টারন্যাশনাল রিপোর্ট ২০০৭’, যেখানে ২০০৬ সালের ঘটনাসমূহ প্রতিফলিত হয়েছে, তাতেও বাংলাদেশের গোটা চিত্র তুলতে প্রকারান্তরে অবজ্ঞাই করা হয়েছে। রিপোর্টে ৩১ অক্টোবর রাজশাহীতে গণফোরামের সমাবেশে চারদলকে দায়ী করে হামলা, ১৫ নভেম্বর আওয়ামী লীগের কার্যালয়র সামনে ছোট ছোট সিরিজ বোমা বর্ষনে ৮ জন আহত, এমপি আসাদুজ্জামান নূর ও সাবের হোসেন চৌধুরীর উপর হামলার কথা উল্লেখ করে দায়ী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় না আনার কথা বলা হয়েছে। অথচ এই অল্প সময় (মাত্র ১৬ দিন)-র মধ্যে, আরেকটি মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’-র রিপোর্ট অনুযায়ী ৫০ জন (যাদের মধ্যে ৩৯ জনই ৪ দলীয় জোটের)-র মৃত্যু ও ২৫০ জনের আহত হওয়ার ঘটনা ঘটে এবং সর্বোপরি মানবেতিহাসে সবচেয়ে অসভ্য, হিংস্র ঘটনা ২৮ অক্টোবর (যা বিবিসি ও সিএনএন সহ সব আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম খুনীদের ছবিসহ লাইভ সম্প্রচার করেছ) সৃষ্টি করা হয়, একই বছরের রিপোর্টে আশ্চর্যজনকভাবে এসবের উপস্থিতি দারুনভাবে উপেক্ষীত হয়েছে।
এ বছর ২৮ জানুয়ারী একটি পত্রিকায় মিসেস খান তার খুব নিকটের পত্রিকায় ‘বাংলাদেশে অধঃপতনের চক্র’ নামক একটি আর্টিকেলে জরুরী অবস্থাকালীন বছর ২০০৭ সাল নিয়ে লিখেছেন ‘অবশ্যই শারিরীক নিরাপত্তা এবং মানবাধিকার লংঘনের পরিস্থিতি আগের তুলনায় নাটকীয়ভাবে উন্নত হয়েছে।‘ অথচ, ১ জানুয়ারী দেশের একটি মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’- উল্লেখ করেছে, ‘..... ২০০৭ সালের ১২ মাসে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে ১৮৪ জন নিহত হয়েছে। জেলহাজতে মারা গেছে ৮৭ জন। ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৪৫৯ জন, এর মধ্যে ২৪৬ জনই শিশু। অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে ১৬১টি। ইন্ডিয়ার সীমান্ত রক্ষীবাহিনী বিএসএফ ১২০ জন বাংলাদেশী নাগরিককে হত্যা করেছে। অপহরণ করেছে ৯৮ জনকে, ৩ জন বাংলাদেশী নারী বিএসএফ’র হাতে ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ১৯৮ জন বাংলাভাষী নাগরিককে পুশইন করা হয়েছে। ........... আমরা আরো লক্ষ করছি, বাংলাদেশ সীমান্তে ইন্ডিয়ান বাহিনী নির্বিচারে বাংলাদেশী নাগরিকদের হত্যা করলেও এ ব্যাপারে অ্যামনেস্টি বা সুশীল সমাজের দাবিদাররা নিশ্চুপ। অধিকার-এর দেয়া তথ্য অনুযায়ী ২০০৭ সালে ১২০ জন বাংলাদেশী নাগরিক বিএসএফ’র হাতে নিহত হয়েছে অর্থাৎ মাসে ১০ জন বাংলাদেশীকে হত্যা করা হয়েছে। প্রতি বছর এ হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা বেড়েই চলছে। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ৩৯১ জন বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে বিএসএফ। অর্থাৎ গত পাঁচ বছরে গড়ে ৭৮ জনকে হত্যা করা হলেও ২০০৭ সালে তা ১২০ জনে দাঁড়িয়েছে।‘ পুলিশ বলেছে সামগ্রিকভাবে অপরাধ আগের বছরের চেয়ে বিশ শতাংশ নাকি বেড়েছে।
উল্লেখ্য, চায়নার সাথে সীমান্তরেখা থাকলেও বিএসএফ-র গুলি ওদিকে কিন্তু ফোটে না, শুধু হতভাগা বাংলাদেশীদের ধরে ধরে গুলি করতেই তারা ব্যস্ত! অ্যামনেষ্টি ইন্টারন্যাশনাল এসব নিয়ে কথা বলেনা, ২৮ অক্টোবর টাইপের দিনগুলো নিয়ে দেশী মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামালরা পর্যন্ত কথা বলেন না (যদিও আর্মি চীফ সুযোগ পেলেই এর বীভিৎসতা নিয়ে কথা বলেন, কিন্তু খুনীদের ধরার ব্যাপারে রহস্যজনকভাবে একদম চুপ!)। কারন, এর মাঝে কেমন যেন অন্য রকম ফোবিয়া আছে, মৌলবাদীর তাড়ি মেশানো আছে। তাছাড়া দুই কুকুরের লড়াই বলে যারা আমাদের স্বাধীনতাকে অপমান করেছিল শুধু তাদের নিয়ে ব্যস্ত থাকার মধ্যে আলাদা মজাও হয়তোবা রয়েছে। আইরিন খান কথা বললেন পুলিশ হেফাজতে আদিবাসী একজন চলেশ রিছিলের মৃত্যু ও কার্টুনিষ্ট আরিফের মুক্তি নিয়ে, লিখলেন স্থানীয় পুলিশ ও র্যাব কর্তৃক একজন সাংবাদিকের নির্যাতনের কথা। এসব অবশ্যই নিন্দনীয়, সন্দেহ নাই।কিন্তু কেন যেন মিসেস খান নিজেকে ব্রাকেট বন্দী করে ফেলছেন, সুযোগ থাকা সত্ত্বেও পদের সম্মান রাখতে নিজের আগের একচোখা নীতিতে পরিবর্তন আনতে পারছেন না, অন্য কথায় মৌলবাদীর ভূত বা বিষাক্ত কালনাগিনীর থাবা হয়তোবা তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে সারাক্ষণ। অধঃপতনের চক্রে নিজেই পা দিয়েছেন। তিনি হয়তো পালটা প্রশ্ন ছুড়ে বলবেন এত অল্প সময়ে একসাথে অত মানুষের লাশ ও অধিকার নিয়ে কথা বলা যায়? তাছাড়া আশপাশের মানুষজন যারা কিনা দাওয়াত করে নিয়ে এল তাদের জন্যও বা বলি কিভাবে? আমরা তাকে অনুরোধ করব, ঠিক আছে সময় করে পরে বলবেন।সাথে এও অনুরোধ করবো, শুধু দূর থেকে না বলে ঢাকায় এসে যেভাবে সাংবাদিক সম্মেলন করে ঝেড়ে দিয়ে গেলেন, ঠিক সেভাবে না হলেও অন্তত মাঝারি সারির দু’একজন সাংবাদিক ডেকে ওয়াশিংটন বা লন্ডনে গিয়ে মানবাধিকারের সবচেয়ে বড় লংঘনকারীদেরকে দুই কথা শুনিয়ে আসেন। আমরা আপনাকে নিয়ে আরো গর্ব করব।
এবার একটু ধারনা নেয়ার চেষ্টা করে দেখি আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে জন্ম থেকেই অ্যামনেষ্টি ইন্টারন্যাশনালের আচরন কেমন।
ইংলিশ আইনজীবি পিটার বেনেনসন (Peter Benenson) ১৯৬১ সালের জুলাইতে লন্ডনে মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেষ্টি ইন্টারন্যাশনালের জন্ম দেন। বর্তমানের কাজের সাথে আকাশ পাতালের ফারাক থাকলেও প্রতিষ্ঠালগ্নে এটির উদ্দেশ্য ছিল মোটামুটি এরূপ, ‘আমরা হলাম পৃথিবীর চারদিককার সাধারন মানুষ যারা মানবতা ও মানুষের অধিকার রক্ষায় বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর। যেকোন ব্যক্তির প্রতি ন্যায়বিচার, সুষম আচরন, বাক-স্বাধীনতা ও সত্য যেখানে প্রত্যাখাত আমরা সেখানে তার অধিকার ফিরিয়ে দিতে তৎপর।‘ এর বর্তমান লোগোটি হল, মোমবাতির আলো বা শান্তির দ্যুতি ছড়াতে একটি কাটাতার বা অন্যায় অবিচার বাধা দিচ্ছে। পিটারকে প্রতিষ্ঠানটি গড়তে ১৯৬০ সালের ১৯শে নভেম্বরে তার ঐতিহাসিক লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ড ভ্রমণই ব্যাপকভাবে উৎসাহিত করে। পর্তুগীজ দুই ছাত্রের মাতাল হওয়াকে কেন্দ্র করে সাত বছরের সাজা দিয়েছিলেন তৎকালীন আদালত। সেই ঘটনাটিই তিনি পত্রিকাতে পড়ছিলেন ভ্রমণরত অবস্থায় এবং ভাবছিলেন সহায়-সম্বলহীন মানুষদের জন্য কিছু একটা করবার। সমাজের নিগৃহীত, উপেক্ষিত মানুষদের নিয়ে বিখ্যাত আর্টিকেল লিখলেন ‘দি ফরগোটেন প্রিজনার্স (The Forgotten Prisoners)’ এবং এর এক বছরের কম সময়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করলেন অ্যামনেষ্টি ইন্টারন্যাশনাল, সংক্ষেপে এ.আই। শুরুটাই ছিল বিতর্কের। উপরোক্ত ভ্রমণটি নিজের পকেটের টাকায় করেছিলেন বলে পিটার যে দাবীটা করেছিলেন তা নিয়ে তার কাছের লোকেরাই প্রশ্ন তুলেছেন। আর বর্তমানে তাদের নানা কর্মকান্ডে বিতর্ক ও দ্বৈত নীতির প্রতিবাদে এর প্রতি নিন্দা, শাখা-প্রশাখা গজিয়ে মারাত্মক আকার ধারন করে এ.আইয়ের ললাটে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির ২৭ বছরের মাথায় কালিমা একে দিয়েছে অথবা দিচ্ছে প্রতিদিন।
বলে রাখা ভাল, পাশ্চাত্যের অবিচারের কদাচিৎ প্রতিবাদ করলে এমনেষ্টিকে বলা হয় ‘এন্টি ওয়েষ্টার্ণ’ আর পৃথিবীর বেশীরভাগ মানুষই বিশ্বাস করে এটিকে ‘প্রো ওয়েষ্টার্ণ’ বলে। এই প্রতিষ্ঠানটির আচরনগত পার্থক্য খোলামেলাভাবে চোখে পড়ে যখন কোন এক পক্ষের নামের সাথে ‘মুসলিম’ শব্দটি সংযুক্ত থাকে। ইরাক, আফগানিস্তান দখল, কাশ্মিরী ও প্যালেষ্টাইনীদের ষাট বছরের স্বাধিকার আন্দোলন, চেচেন, বলকানদের মুক্তি আন্দোলন, সুদানের ডারফুর সমস্যা, মরোদের আন্দোলন ইত্যাদিতে এ.আইয়ের জনপ্রিয় শ্লোগান ‘হিউম্যান রাইট নাউ (Human Right Now)’ কেন যেন থেমে যায়।
এই দু’মুখো নীতির বিরুদ্ধে সম্ভবত সবচেয়ে শক্তিশালী আর্টিকেল লেখেন এবং কথা বলেন লন্ডনের ইকোনোমিষ্ট, আগ্রাসীবিরোধী, অ্যামনেষ্টির একসময়ের কট্টর সমর্থক, লেখক পল দ্যা রোইজ (Paul De Rooij)। অনলাইন ম্যাগাজিন কাউন্টার পানচ (আলেক্সান্ডার ককবার্ন ও জেফ্রি সেন্ট ক্লেয়ার সম্পাদিত)-এ একাধিক আর্টিকেল লিখে এ.আইয়ের রিপোর্টে ব্যবহৃত চতুর শব্দাবলীর চুলচেরা বিশ্লেষণের পাশাপাশি সাম্রাজ্যবাদী ধনিক শ্রেণী ও মজলুম মুসলিম জাতির প্রতি আচরনের তুলনামূলক চিত্র পরিস্কারভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন, ২০০২ সালের ২রা অক্টোবরে ইসরাইলী ট্যাংক প্যালেষ্টাইনের খান ইউনুস থেকে প্রত্যাহারের পর পরই রাস্তায় প্রচন্ড ভীড়ের মধ্যে বোমাবর্ষণ করে ইসরাইলী হেলিকপ্টার। এমনকি আইন কানুনের তোয়াক্কা না করে সাথে একটি মিসাইল ছুড়ে দেয় হসপিটালেও। মুহুর্তেই প্রাণ যায় ১৪ জনের, আহত হন ৮০ জন প্যালেষ্টাইনী। ‘মহা সাফল্য (গ্রেট সাকসেস্)’ বলে আখ্যায়িত করলেন শ্যারন। কেউ হয়তো সংগত কারনেই আশা করছিল এ. আই কিছু বলবে। কিন্তু এ.আইর সমস্যা হল এরকম সময়ে ইচ্ছাকৃতভাবে বেমালুম চেপে যাওয়া- ভূখন্ডের উপর ঘটে যাওয়া নিদারুন বড় বড় ঘটনাসমূহ না বুঝার ভান করা।
পল দ্যা রোইজ তার বিখ্যাত দুটি প্রবন্ধ (Amnesty International & Israel: Say it isn’t so এবং Amnesty International: A False Beacon?)-এ আরো লিখেছেন, এ.আইয়ের রিপোর্টিং-র ভাষা পক্ষপাত দোষে দুষ্ট। দ্বিতীয় ইন্তেফাদার শুরু থেকে এই প্রতিষ্ঠানটি খুব কমবারই ইসরাইলী সহিংসতার বেলায় ‘নিন্দা (Condemn)’ শব্দটি পর্যন্ত উচচারিত করেছে। অথচ প্যালেষ্টাইনীদের স্বাধীকার আন্দোলনের লড়াকুদের প্রতি এটির ব্যবহারে এ.আই কখনো কার্পন্য করেনি বা করছেও না। ভীতপ্রদ (horrific), বীভিৎস (shocking), ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা (deliberately killed) ইত্যাদি পরিভাষাসমূহ প্যালেষ্টাইনীদের জন্য স্থায়ীভাবে বরাদ্ধ করে রেখেছে অ্যামনেষ্টি ইন্টারন্যাশনাল। এমনকি তাদের দিকে তাক করে এক রিপোর্টে মাত্র এক প্যারায় তিনবার ‘যুদ্ধ অপরাধ’ শব্দ ব্যবহারের নজিরও স্থাপন করেছে এ.আই। পল প্রশ্ন করে লিখেছেন, যারা শিশু, মহিলা, বৃদ্ধ থেকে শুরু করে নীরিহ মানুষদের হত্যা, ধর্ষণ, অপহরন এমন কোন কুকর্ম নাই যা করেনা, সেই ইসরাইলীদের প্রতি আমাদের মানবাধিকার সংগঠনের আচরন এমন কেন? দখলদারদের প্রতি এ.আইয়ের অনুযোগের সাথে আহ্বানগুলো থাকে এমন, ইসরাইল নিয়ম কানুন মানছে না, তাদেরকে ভাল আচরন করতে হবে, মানবাধিকারের প্রতি তাদের সম্মান দেখানো উচিৎ (to breach legal provisions, to breach standards, to be disproportionate or elicit calls to respect human rights) ইত্যাদি। এসব দেখে মনে হয় বিশ্বব্যাপী এই.আইয়ের মোমবাতির শান্তির আলো ছড়াতে শুধু মুসলমানেরাই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।
এভাবে, কোন একটি জাতিকে টাগেট করে সেই জাতির ভেতর থেকেই দেশে দেশে মেকী অতি গনতন্ত্রী ও অনুগত কিছু পুতুল নিয়ে মানব বিধ্বংসী খেলায় মেতে উঠলে মোমবাতির আলোয় বিশ্বে কখনো শান্তির দ্যুতি ছড়াবে না। কিছু বিকৃত চিন্তার মানুষদের কর্মকান্ডের দায়ভার গোটা গুষ্ঠীর উপর চাপিয়ে দিলে নিজের সংঘঠনের উদ্দেশ্যের সাথেই প্রতারণা করা হবে। আর সার্বজনীনতার কথা বলে মূলত জনগনের মাঝে বিভাজন সৃষ্টি ও নিরপেক্ষতার ভান করে বিশ্বের সচেতন সম্প্রদায়কে বোকা বানানো কষ্মিনকালেও সম্ভব হবে না, বরং বিভেদ-বিভক্তি এতে করে বাড়তেই থাকবে।
যায়যায়দিনে পড়ুন ৫ই ফেব্রুয়ারী ২০০৮
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা এপ্রিল, ২০০৮ সন্ধ্যা ৬:৫১