১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে শ্রমের ন্যায্য দাবি প্রতিষ্ঠা করার আন্দোলনে আত্মাহুতি দান করেছিলেন শ্রমিকরা। তাদের রক্তাক্ত স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ১৮৯০ সাল থেকে এই দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। দুনিয়ার প্রতিটি দেশে মে মাসের ১ তারিখ নানা আয়োজনে পালন করা হচ্ছে শ্রমিক দিবস। বাংলাদেশও এই দিবসটি নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পালিত হয়ে আসছে। সরকারি-বেসরকারি নির্বিশেষে সকল পর্যায়ে মে দিবস এখন গুরুত্বসহকারে পালিত হচ্ছে। মে দিবস এলেই আমাদের সামনে ভেসে ওঠে ঘর্মাক্ত মেহনতি মানুষের প্রতিচ্ছবি। আর এই মেহনতি মানুষের অধিকারের প্রশ্নটিও সাথে সাথে উঠে আসে এই ঐতিহাসিক দিনে। তবে এই দিবসের তাৎপর্য অনেক। এর পেছনে রয়েছে একটি রক্তস্নাত ইতিহাস।
আজ থেকে ১২৯ বছর আগের কথা। “সূর্যোদয় থেকে সুর্যাস্ত”- এই ছিল তখনকার দিনের কাজের ঘন্টা।মালিকেরা নগণ্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে দরিদ্র মানুষের শ্রম কিনে নিতেন।মালিকেরা উপযুক্ত মজুরি তো দিতেনই না, বরং তারা শ্রমিকের সুবিধা-অসুবিধা, মানবিক অধিকার ও দুঃখ-কষ্ট পর্যন্ত বুঝতে চাইতেন না। মালিকেরা তাদের অধীনস্থ শ্রমিককে দাসদাসীর মতো মনে করতেন। আর তাদের সাথে পশুর মতো ব্যবহার করতেন। সুযোগ পেলেই মালিকেরা শ্রমিকের ওপর চালাতেন নানা শারীরিক ও মানসিক নিপীড়ন। বলতে গেলে শ্রমিকের ন্যূনতম অধিকারও তখন রক্ষিত হতো না। মালিকেরা প্রায়শই কাজ ছাড়া শ্রমিকের কোনো কথা শুনতেন না। শ্রমিকের গায়ের ঘাম ও সীমাহীন শ্রমের বিনিময়ে মালিকের সম্পদের পাহাড় গড়ে উঠত। অথচ তার ছিটেফোঁটাও শ্রমিকের ভাগ্যে জুটত না। পরিবার-পরিজন নিয়ে শ্রমিকের কাটত দুর্বিষহ জীবন। তখন শ্রমিকের জন্য কাজের নির্দিষ্ট সময় যেমন ছিল না, তেমনি ছিল না মজুরির কোন নিয়ম-কানুন। ফলে শ্রমিকের শ্রমকে যথেচ্ছ ব্যবহার করে মালিক অর্জন করতেন সীমাহীন সম্পদ।
আঠারো শতকের ঘোড়ার দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিকরা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান। চৌদ্দ, ষোল এমনকি আঠারো ঘন্টার কাজের দিনও তখন চালু ছিল। ১৮০৬ সালে ফিলাডেলফিয়ার ধর্মঘটরত জুতা-শ্রমিকদের নেতাদের বিরুদ্ধে যখন ষড়যন্ত্রের অভিযোগে মামলা চলছিল, তখন প্রকাশ পায় যে, শ্রমিকদের উনিশ থেকে কুড়ি ঘন্টা পর্যন্তও খাটানো হচ্ছিল।
মে দিবসের ধর্মঘটের প্রস্তুতি-
১৮২০ থেকে ১৮৪০ সাল পর্যন্ত কাজের ঘন্টা কমাবার দাবিতে ধর্মঘটের পর ধর্মঘট হয়। দৈনিক দশ ঘন্টা কাজের নিয়ম চালু করবার সুনির্দিষ্ট দাবিও অনেক শিল্পকেন্দ্রে তোলা হয়। দুনিয়ার প্রথম ট্রেড ইউনিয়ন বলে খ্যাত ফিলাডেলফিয়ার মেকানিকদের ইউনিয়নের জন্ম হয় ১৮২৭ সালে, গৃহনির্মাণশিল্পে নিযুক্ত শ্রমিকদের এক ধর্মঘটের মারফত, তাও এই দশ ঘন্টা কাজের দাবিতেই। ১৮৩৪ সাল নিউইয়র্কে রুটি কারখানার শ্রমিকদের ধর্মঘট চলতে থাকাকালে ‘ওয়ার্কিং মেনস অ্যাডভোকেট (মেহনতী মানুষের মুখপত্র) নামক পত্রিকা খবর দেয়, “মিশর দেশে যে ক্রীতদাস প্রথা প্রচলিত আছে তার চাইতেও দুঃসহ অবস্থার মধ্যে রুটি কারখানার কারিগররা বছরের পর বছর কাটিয়ে থাকেন। চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে গড়ে আঠারো থেকে কুড়ি ঘন্টাই তাঁদের খাটতে হয়!”
এসব অঞ্চলে দশ ঘন্টা কাজের দিনের আওয়াজ দ্রুতবেগে একটা আন্দোলনের আকার ধারণ করল। ১৮৩৭ সালের সঙ্কটে এই আন্দোলন ব্যাহত হয়: কিন্তু তা সত্ত্বেও এরই ফলে রাষ্ট্রপতি ভ্যান ব্যুরেনের আমলে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারী কাজে নিযুক্ত শ্রমিকদের জন্য দশ ঘন্টা, কাজের দিন বেঁধে দিতে বাধ্য হয়। যাইহোক, এই আইন সমস্ত ক্ষেত্রে সম্প্রসারিত করবার সংগ্রাম পরবর্তী যুগে একটানা গতিতে চলতে থাকে। কয়েকটা শিল্পে এই দাবি স্বীকৃত হবার সঙ্গে সঙ্গেই শ্রমিকরা দৈনিক আট-ঘন্টা কাজের নিয়ম চালু করবার দাবি তোলেন। ১৮৫০ সাল থেকে পরবর্তী বছরগুলোতে শ্রমিক ইউনিয়ন গড়বার ব্যাপারে প্রবল কর্মোদ্দীপনা দেখা দেয়, তারফলে এই দাবিও ক্রমশ জোরদার হতে থাকে। ১৮৫৭ সালের সঙ্কটের ফলে এই সংগ্রাম বাধাপ্রাপ্ত হয়। তবে সঙ্কট শুরু হবার আগেই কয়েকটি সুসংগঠিত শিল্পে এই দাবি আদায় করা সম্ভব হয়েছিল। কাজের ঘন্টা কমানোর এই আন্দোলন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই হয়েছিল, তা নয়, উদীয়মান পুঁজিবাদী ব্যবস্থা যেখানেই শ্রমিকেরা শোষিত হচ্ছিল, সেখানেই এই আন্দোলন জন্ম নিয়েছিল। তাই দেখা যায় যে, অষ্ট্রেলিয়ার মতো সুদূর দেশের গৃহ-নির্মাণ শ্রমিকরাও আওয়াজ তুলছিলেন “আট-ঘন্টা কাজ, আট-ঘন্টা আমোদ-প্রমোদ, আট-ঘন্টা বিশ্রাম”, এবং এই দাবি আদায় করতেও সক্ষম হয়েছিল।
শিকাগো ধর্মঘট এবং হে মার্কেটের ঘটনা-
সেকালে বামপন্থী সংগ্রামী শ্রমিক আন্দোলনের কেন্দ্র ছিল শিকাগো। স্বভাবত এই শিকাগোতেই ১লা মে’র ধর্মঘট খুব সংগ্রামী চেহারা ধারণ করে। শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত এমন অনেকগুলো রাজনৈতিক সমস্যা সম্পর্কে যথেষ্ট পরিষ্কার ধারণা না থাকলেও সে সময়কার আন্দোলন বাস্তবিক পক্ষে সংগ্রামী আন্দোলনই ছিল। শ্রমিকদের সংগ্রামের ময়দানে সামিল করতে জীবন ও জীবিকার অবস্থার আশু উন্নয়নের জন্য লড়াইয়ের মারফত তাদের সংগ্রামী চেতনা গড়ে তুলতে সে সময়কার আন্দোলন সর্বদাই প্রস্তুত ছিল। সংগ্রামী শ্রমিক সংস্থাগুলোর সহযোগিতার ফলে শিকাগোর ধর্মঘট বিরাট আকার ধারণ করল। ধর্মঘট শুরু হবার অনেক আগেই ধর্মঘটের প্রস্তুতি চালাবার জন্য সেখানে একটি আট-ঘন্টা-শ্রম-সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই অট-ঘন্টা-শ্রম-সমিতি ছিল একটি ঐক্যবদ্ধ মোর্চার প্রতীক। এই সমিতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল ‘ফেডারেশন’, ‘নাইটস অব লেবর’ এবং আমেরিকার শ্রমিকশ্রেণীর প্রথম সংগঠিত সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল ‘সোস্যালিস্ট লেবর পাটি’র অন্তর্ভুক্ত ইউনিয়গুলো। সমস্ত বামপন্থী শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সংস্থা ‘সেন্ট্রাল লেবর ইউনিয়ন’। এই আট-ঘন্টা-শ্রম-সমিতিকে সমর্থন জানায়। ১লা মে’র ঠিক আগেকার রবিবারে ‘সেন্ট্রাল লেবর ইউনিয়ন’ একটি সমাবেশ সংগঠিত করে; ২৫০০০ শ্রমিক এই জমায়েত অংশগ্রহণ করেন।
আমেরিকার ফেডারেশন অব লেবার ১৮৮৪ সালের ৭ অক্টোবর প্রথমবারের মতো প্রতিদিন আট ঘণ্টা কাজের দাবি তুললেন। তবে এতে তেমন কাজ হলো না। মালিকপক্ষ শ্রমিকদের দাবি তো মানলই না, বরং তারা শক্ত অবস্থান নিলো। ফলে এক সময় শ্রমিকের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ বিস্ফোরণের আকার ধারণ করল। আর সেটা ঘটল আজকের তথাকথিত মানবাধিকার ও সভ্যতার অহঙ্কারী দেশ আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটে। কাজের সময় ৮ ঘণ্টা নির্ধারণ, মজুরির পরিমাণ বৃদ্ধি ও কাজের উন্নত পরিবেশ তৈরি করাসহ শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায়ে ১৮৮৬ সালের পয়লা মে হে মার্কেটের শিল্পশ্রমিকেরা ধর্মঘটের ডাক দিলেন। এ ধর্মঘটে যোগ দেন প্রায় ৩ লাখ শ্রমিক। তারা কলকারখানা বন্ধ রেখে নেমে এলেন রাজপথে।
শ্রমিকশ্রেণীর শত্রুরাও সে সময় নিস্ক্রিয় ছিল না। মালিক এবং শিকাগো সরকারের সম্মিলিত শক্তি সংগ্রামী নেতাদের ধ্বংস করে ফেলতে বদ্ধপরিকর হয়েছিল; তারা ভেবেছিল এর ফলে শিকাগোর সমগ্র শ্রমিক আন্দোলনকে মারাত্মক আঘাত হানা সম্ভব হবে, বৃহত্তর ক্ষমতার বলে তারা শিকাগোর শ্রমিক অভিযানের গতি রোধ করে। এই ১লা মে তারিখের ঘটনারই প্রত্যক্ষ পরিণতি হলো ৩রা ও ৪ঠা মে তারিখের ঘটনাগুলো- হে মার্কেটের ঘটনা বলে যা পরিচিত। ৩রা মে তারিখের ‘ম্যাক-কর্মিকরিপার কারখানা’র ধর্মঘটরত শ্রমিকদের এক সভায় পুলিস জানোয়ারের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে ছ’জন শ্রমিককে হত্যা এবং অনেককে আহত করে। পুলিসের এই পাশবিক আক্রমণের প্রতিবাদে ৪ঠা মে হে মার্কেট স্কোয়ারে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শান্তিপূর্ণভাবে চলছিল এবং সেদিনকার মতো স্থগিত হতে যাচ্ছিল, এমন সমায় সমবেত শ্রমিকদের উপর পুলিস আবার আক্রমণ করে, ভিড়ের মধ্যে একটি বোমা এসে পড়ে এবং তার আঘাতে একজন সার্জেন্ট নিহত হয়। সঙ্গে সঙ্গেই লড়াই শুরু হয়ে গেল: সে লড়াইয়ে মুত্যু হয় সাতজন পুলিসের আর চার জন শ্রমিকের।
এদিকে শ্রমিক ধর্মঘট সংঘটিত করার অপরাধে শ্রমিক নেতা আগস্টসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। শুধু তাই নয়, অভিযুক্তদের প্রহসনমূলক বিচারের মুখোমুখি করে সরকার। তারপর ১৮৮৭ সালে সাজানো মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। এর ফলস্বরূপ ১১ নভেম্বর উন্মুক্ত স্থানে আগস্ট স্পিজসহ ৬ জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। লুইস লিং নামের এক শ্রমিক ফাঁসির আগের দিন কারাগারের ভেতর আত্মহত্যা করেন। আরেকজনের ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। এত কিছুর পরও শ্রমিক আন্দোলন দাবিয়ে রাখা যায়নি। বরং সারা দুনিয়ায় শিকাগোর রক্তাক্ত ঘটনার উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে। আমেরিকায়ও এই আলোড়ন সৃষ্টিকারী শ্রমিক আন্দোলনের প্রভাব ধীরে ধীরে প্রসার লাভ করে। ফলে অনেক প্রতিষ্ঠান ও কলকারখানায় ৮ ঘণ্টা কাজের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
শিকাগোর রক্তঝরা শ্রমিক আন্দোলন ক্রমেই সফল হওয়ার পথে অগ্রসর হয়। মাত্র ৪ বছর পর ১৮৮৯ সালে আন্তর্জাতিক শ্রমিক কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। এই কংগ্রেসে শিকাগোর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন ও আন্তর্জাতিক সংহতি প্রকাশের জন্য এক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কংগ্রেসের সিদ্ধান্তবলে প্রতি বছর ১ মে ঐক্যবদ্ধভাবে পালনের ঘোষণা প্রদান করা হয়। এভাবেই শুরু হয় মে দিবস বা আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। ফলে ১৮৯০ সাল থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শ্রমিকেরা ১ মে দিবসটি পালন করে আসছেন।
মে দিবস সম্পর্কে লেনিন-
রাশিয়ার বিপ্লবী আন্দোলনে তার কর্মজীবনের গোড়ার দিকে রাশিয়ার শ্রমিকদের কাছে মে দিবসকে বিক্ষোভ ও সংগ্রামের দিবস হিসাবে তুলে ধরেন লেনিন। ১৮৯৬ সাল থেকে জেলে আটক থাকাকালে তিনি রাশিয়ার প্রথম মার্কসীয় রাজনৈতিক সংস্থাগুলোর অন্যতম ‘সেন্ট পিটার্সবার্গ ’ ‘ইউনিয়ন অব স্ট্রাগল ফর লিবারেশন অব দি ওয়ার্কিং ক্লাস’ (শ্রমিক শ্রেণীর মুক্তি সংগ্রামের জন্য সেন্ট পিটার্সবার্গের ইউনিয়ন) নামক সংগঠনের জন্য একটি মে দিবসের ইশতেহার রচনা করেন। সেই ইশতেহার গোপনে দেশের বাইরে চালান করা হয় এবং এর ২০০০ কপি ৪০টি কারখানার শ্রমিকদের মধ্যে বিলি করা হয়। ইশতেহারখানা খুবই সংক্ষিপ্ত ছিল এবং যাতে করে অত্যন্ত অনগ্রসর শ্রমিকও পড়ে বুঝতে পারেন সে জন্য লেনিনের অভ্যস্ত ভঙ্গিতে অর্থাৎ সহজ এবং সরাসরি কায়দায় লেখা ছিল। উক্ত ইশতেহার প্রকাশের কাজে সহায়তা করেছিলেন এমন একজন সমসাময়িক ব্যক্তি ঐ সম্পর্কে লিখেছিলেন, “এক মাস পরে যখন ১৮৯৬ সালের বিখ্যাত সুতাকলের ধর্মঘট ফেটে পড়ল, তখন শ্রমিকরা আমাদের বলেছিলেন যে ছোটো সাধাসিধে ইশতেহারখানাই প্রথম তাঁদের প্রেরণা যুগিয়েছিল।”
কলকারখানায় কীভাবে মালিকের স্বার্থে মজুরদের শোষণ করা হয় এবং কীভাবে অবস্থা উন্নয়নের দাবি তুললে সরকার তাদের নির্যাতন করে তা বলবার পরে, উক্ত ইশতেহারে লেনিন মে দিবসের তাৎপর্য বর্ণনা করেছেনঃ
ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, জার্মানি এবং অন্যান্য দেশ যেখানে শ্রমিকরা ইতিপূর্বেই শক্তিশালী সব ইউনিয়নে সংগঠিত হয়েছেন এবং নিজেদের জন্য অনেক অধিকার আদায় করেছেন- সেই সমস্ত দেশ উনিশে এপ্রিল তারিখটিকে (১লা মে) (পশ্চিম ইউরোপের ক্যালেন্ডার থেকে রাশিয়ার ক্যালেন্ডারের তারিখ ১৩ দিন পিছিয়ে ছিল) শ্রমিক শ্রেণীর সর্বজনীন কর্মবিরতির দিন হিসাবে ঠিক করেছে। কলকারখানার গুমোট পেছনে ফেলে নিশান উড়িয়ে সঙ্গীতের তালে তালে তাঁরা মার্চ করেন শহরের বড় বড় সড়কে; মালিকরা দেখতে পায়, তাঁদের ক্রমবর্ধমান শক্তি। শ্রমিকরা জমায়েত হন বিরাট গণসমাবেশে মালিকদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে বিগত বছরের জয়ের সালতামামি দিয়ে সেখানে বক্তৃতা হয়; সেইসব সমাবেশে শ্রমিকরা ভবিষ্যতের সংগ্রামের পরিকল্পনাও হাজির করেন। সেইদিন থেকে কাজ না করার জন্য মালিকরা শ্রমিকদের জরিমানা করতে সাহস পায় না। কারণ ধর্মঘটের ভয় আছে। এই দিনেই আবার শ্রমিকরা মালিকদের স্মরণ করিয়ে দেন তাঁদের প্রধান দাবি: ৮ ঘন্টা কাজ, ৮ ঘন্টা আমোদ-প্রমোদ, ৮ ঘন্টা বিশ্রাম, এই আওয়াজই আজ অন্যান্য দেশের শ্রমিকদের দাবি।”
মে দিবসের ছ’মাস আগে লেনিন মে দিবসের অনুষ্ঠানাদির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন; এই থেকেই বোঝা যায়, তিনি মে দিবসের অনুষ্ঠান প্রভৃতিকে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন। তাঁর কাছে মে দিবস ছিল, “রাশিয়ার মানুষের রাজনৈতিক মুক্তির জন্য অপরাজেয় সংগ্রাম” এবং “শ্রমিক শ্রেণীর শ্রেণীগত অগ্রগতি ও সমাজতন্ত্রের জন্য সরাসরি সংগ্রাম” এর কেন্দ্রবিন্দু।
মে দিবসের অনুষ্ঠানগুলো “কীভাবে বিরাট বিরাট রাজনৈতিক সমাবেশে পরিণত হতে পারে।” সেই প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে লেনিন প্রশ্ন করেন, ১৯০০ সালের খারকভের মে দিবস অনুষ্ঠান “কেন একটি অনন্যসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।” লেনিন নিজেই এর প্রশ্নের জবাবে বলেন, “ধর্মঘটে শ্রমিকদের ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ, পথে পথে বিরাট বিরাট জনসভা, লালঝান্ডা-উত্তোলন, ইশতেহারে ইশতেহারে আট-ঘন্টা কাজের দিন ও রাজনৈতিক মুক্তির দাবি উত্থাপন এবং এইসব দাবির বিপ্লবী চরিত্র” (এইসব কারণেই খারকভের মে দিবস একটি অনন্যাসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা)।
আট-ঘন্টা কাজের দাবির সঙ্গে অন্যান্য ছোটোখাটো এবং নিছক অর্থনৈতিক দাবিদাওয়া জুড়ে দেবার জন্য লেনিন খারকভের পার্টি নেতাদের ভর্ৎসনা করেছেন, কারণ তিনি চাননি যে, মে দিবসের রাজনৈতিক চরিত্র কোনও রকমে ঢাকা পড়ে যায়।
বাংলাদেশে মে দিবস-
নারায়ণগঞ্জে প্রথম মে দিবস পালিত হয় ১৯৩৮ সালে। তারপর পাকিস্তান আমলেও মে দিবস যথাযথ উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে পালিত হয়েছে। স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে বিপুল উদ্দীপনা নিয়ে মে দিবস পালিত হয়। এদিন বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন এ উপলক্ষে র্যালি, সমাবেশ, শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও পোশাকশিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের বিভিন্ন সংগঠন পৃথকভাবে কর্মসূচি পালন করে। মে দিবস উপলক্ষে সরকারি-বেসরকারি টেলিভিশনেও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। জাতীয় পত্রিকাগুলোও দিবসটির তাৎপর্য তুলে ধরে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে।শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য শ্রমিকদের আত্মত্যাগের দিনটিকে তখন থেকেই সারা বিশ্বে ‘মে দিবস’ হিসেবে পালন করা হচ্ছে। একই সঙ্গে এদিনে বিশ্বব্যাপী সরকারি ছুটি থাকে। বাংলাদেশেও সরকারি ছুটি।
বিঃ দ্রঃ
কর্মক্ষেত্রে ৮ ঘণ্টা শ্রমের হয়তো বা নিয়ম প্রতিষ্ঠা হয়েছে, তবে এখনও শ্রমিক নিপীড়ন থামেনি এবং শ্রমিকের প্রকৃত মর্যাদা ও শ্রমের মূল্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অহরহ শ্রমিক বিক্ষোভ থেকে আমরা সহজেই এটা অনুধাবন করতে পারি। দুনিয়ার কোথাও শ্রমিক-মালিক সুসম্পর্ক, শ্রমিকের প্রকৃত মজুরি এবং তাদের বাঁচার উন্নত পরিবেশ এখনও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
লেখক- মাহবুব এইচ শাহীন
view this link
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মে, ২০১৬ ভোর ৪:০৪