এবারও যথারীতি সবার পরে নামতে হল। বিমানের বাইরে পা রাখতেই ছুঁয়ে গেল টরন্টোর শীত। আগের যাত্রীরা কে কোন দিকে গিয়েছে জানিনা।টরন্টো আমাদের গন্তব্য নয়। আমরা যাবো উইনিপেগ। টিকেট বের করে দেখলাম সেটা ছাড়বে রাত বারোটায়। ঘড়ির কাঁটা ৭ ছুঁই ছুঁই। তার মানে হাতে প্রায় পাঁচ ঘন্টা সময়।লটবহর এমনিতেই আমাদের দ্রুত হাঁটতে দিচ্ছিল না আমরা হেলতে দুলতে সামনে এগোতে থাকলাম।
টরন্টোর পিয়ারসন বিমান বন্দর তুরস্কের আতাতুর্ক থেকে আয়তনে বড় কিনা জানিনা। ব্যস্ততার দিক থেকে অনেক পিঁছিয়ে বিশ্বের ৩৭তম ব্যস্ততম এই বিমান বন্দর।১৯৩৭ ওন্টারিও প্রদেশের রাজধানী টরন্টোতে এই বিমানবন্দর প্রতিষ্ঠা করা হয়। কানাডার নোবেল বিজয়ী প্রধানমন্ত্রী লিস্টার বি পিয়ারসনকে সম্মান দেখাতে ১৯৮৪ সালে বিমান বন্দরের নতুন নাম করণ করা হয় পিয়ারসন ইন্টারন্যশনাল এয়ারপর্ট নামে। এই বিমান বন্দরের তিনটি টার্মিনাল থেকে প্রতিদিন বিমান ছেড়ে যায় ১১০টি গন্তব্যে।
এয়ারপোর্টের করিডোরে তেমন ভিড় নেই। প্রায় পনর বিশ মিনিট হাঁটার পর একটি ইনফরমেশন ডেক্স পেয়ে বললাম আমরা ইমিগ্র্যান্ট ভিসায় এসেছি। তারপর জিগ্যেস করলাম আমাদের কী করতে হবে কোথায় রি্পোর্ট করতে হবে ইত্যাদি। ফ্লাইট প্রায় পাঁচ ঘন্টা পরে। এই বিশাল ব্রড কোশ্চেনের উত্তর এলো শর্ট কোশ্চেনের উত্তরের মত, সামনে দিয়ে নিচে নেমে ইমিগ্রেশনে যাও, তারাই সব বলে দেবে।
এস্কেলেটর দিয়ে নিচে নেমে বায়ের দিকে দেখলাম দুটি প্রশস্ত দরজা। তাঁর সামনে টেপ দিয়ে এনক্লোজারের মত করা। এনক্লোজারের ডান দিকে দু’জন ইমিগ্রেশনের নারী পুরুষ দাঁড়িয়ে ছিলেন, তাদের দেখে আবার জিগ্যেস করার জন্যে ওদিকে পা বাড়িয়েছি, তাঁরা মনে হল আমাদের দেখে বিব্রত হয়ে গেলেন বললেন, যা বলার টেপের ভিতর থেকে বল।মনে হল, ওদের বলে লাভ নেই।(পরে শুনেছি ইমিগ্রেশনের আগে একটি নির্দিষ্ট লাইন পর্যন্ত যাত্রীরা যেতে পারেন। আমাদের সেই লক্ষণ রেখার ওপারে ছিলেন অফিসিয়ালরা।) দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে অবাক হয়ে গেলাম। আমরা দেরিতে নামার কারণে বাইরে ভিড়টা দেখতে পারিনি। ভিতরে অন্ততঃ তিরিশ পয়ত্রিশটি আঁকাবাঁকা লাইন। ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের কাউন্টার অনেক দূরে। অনেক রাস্তা পেরুনোর পর একেক জায়গায় তিন চারটে করে কম্পিউটার সেখানে যাত্রীই কিসব টেপাটেপি করছেন।দীপা বলল, এগুলো মনে হয় ডিক্লারেশন ফর্ম, প্লেনে দিয়েছিলো না?
মনে পড়লো প্লেনে আমাদের একটি ফর্ম ভরতে দেয়া হয়ে ছিলো, কী পরিমান টাকা পয়সা বা অন্যন্য মূল্যবান জিনিষপত্র নিয়ে যাচ্ছি তার বিবরণ দিতে। কানাডার নাগরিকদের প্রতিবার বিদেশ ভ্রমণ শেষে এই হিসাবটা দিতে হয়।আমাদেরও দিয়েছিল ওরকম একটি ফর্ম নিজের বিবেচনামত ফিলাপও করেছিলাম। তবে সে হিসেব নিকাশের জায়গা আমাদের এনক্লোজারে পড়েনি।
এক হাতে একটি ট্রান্সপারেন্ট ফাইলে পাসপোর্ট আর ল্যান্ডিং পেপার, ডিক্লারেশন ফর্ম, কাঁধে ল্যাপটপের ব্যাগ, আর অন্য হাতে কেবিন কেইস আর ছোট্ট একটা ব্যাগ নিয়ে লাইনে এগোতে থাকলাম। ইমিগ্র্যান্টদের জন্যে একই লাইন কীনা সেই সন্দেহ আর দূর হলনা। শেষ পর্যন্ত ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা বরাবর পৌছানোর পর বললাম, আমরা ইমিগ্র্যান্ট ভিসা নিয়ে এসেছি, আমাদের করণীয় কি বুঝতে পারছিনা। ভদ্রলোক হাসি মুখে বললেন, তোমাদের যা যা করার দরকার তোমরা ঠিক মতই করেছ। তোমাদের প্রথম কাজ হচ্ছে আমার কাছে পৌছানো, সেটিই যখন হয়েছে আর অসুবিধা নেই। তুমি শুধু ল্যান্ডিং পেপার গুলো দেখাও। সাথে যোগ করলো আর তোমাদের কোন ডিক্লারেশন ফর্ম আছে কী?
আমি বললাম ফর্ম একটা দিয়েছিলো, সেটাকে ডিক্লারেশন ফর্ম বলে কীনা আমি জানিনা। তুমি দেখতে পারো।
ফর্মটা দেখে সে বলল, এক্সিলেন্ট, আমি এটাই চাচ্ছিলাম।
বললাম,আমি তো শুনেছি এদেশে আসার সময় কী কী নিয়ে এসেছি তার একটা তালিকা জমা দিতে হয়। সে বলল, তুমি ঠিকই শুনেছো। সেটা কোথায় করতে হয় তোমাকে আমি দেখিয়ে দেবো।
ল্যান্ডিং পেপার চেক করে পাসপোর্টে সিল মেরে মিষ্টি হাসি দিয়ে সে বলল, ওয়েলকাম টু ক্যানাডা, তারপর দেখিয়ে দিলো আরেকটি ঘরের পথ।
ইমিগ্রেশন অফিসার যখন পরবর্তী গন্তব্য দেখিয়ে দিয়েছিলো, তখন মনে হয়েছিলো সামনে গেলেই হবে। সামনে এগিয়ে ফটিকের 'ওই হোথা' মনে পড়ে গেলো। বা এবং ডান দু’দিকেই পথ আছে, রবার্ট ফ্রস্ট পছন্দ করতেন দ্য রোড লেস ট্রাভেল্ড বাই। আমি তার অধম ভক্ত, নিজেকে ভালোর দলে বিভক্ত করার মত মনের জোর নেই। যেদিকে বেশি লোক সেদিকে অর্থাৎ ডান দিকের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলাম।
এখানে ইংরেজি L আকৃতির একটি রুমের বাম দিকে দশ বারোটি কাউন্টার, ডান দিকের বাড়ানো জায়গায় তিন/চার সেট বেঞ্চ আর মাঝ খানে লাইনে দাঁড়ানো বেশ কয়েকজন অভিবাসন প্রত্যাশী। লাইনের মাথায় মাঝ বয়সী একজন এশীয় মহিলা, লাইন এবং কাউন্টারের মাঝে সমন্বয় করছেন। সোজা কথা কাউন্টারের লোকদের কাজ ফুরালে লাইনের লোককে কাউন্টারে পাঠাচ্ছেন। প্রথম দর্শনে তাঁকে বন্ধু বতসল মনে হচ্ছিলো না। গম্ভীর মুখে তিনি লাইনের লোক জনের সাথে কথা বলছিলেন।
একটু পরে আমাদের ডাক পড়লো কাউন্টারে। সেখানে সম্ভবত একজন স্প্যানিস ভদ্রলোক আমাদের অভ্যর্থণা জানালেন। এবার আর ডিক্লারেশন ফর্মের কথা উঠলো না। তিনি ল্যন্ডিং পেপারস এবং পাসপোর্ট নিয়ে বললেন, কিছু লেখালেখির কাজ আছে, আমি শেষ করি ততক্ষণে তোমরা ওয়েটিং এরিয়ায় অপেক্ষা কর। মিনিট দশেক পর ডাক পড়লো।
কাউন্টারে গিয়ে বললাম, প্রিন্সপ্যাল আপ্লিক্যান্ট তো আমার স্ত্রী, তুমি আমাকে ডাকাডাকি করছো কেন। হাসিমুখে তিনি বললেন, তুমি ফ্যামিলি হেড কীনা বলো! তাঁর আর জবাব দিলাম না। প্রত্যেকের ল্যান্ডিং পেপারে সই করার পর, একটি করে পাতা তিনি ফেরত দিলেন। এর সাথে সাথে আমরা কানাডার পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট (পি আর) হয়ে গেলাম।তিনি বললেন ৬ সপ্তা’র মধ্যে তোমাদের ঠিকানায় পি আর কার্ড পৌছে যাবে।
লাইনে খবরদারি করা মহিলাকে তখন আর তেমন গম্ভীর মনে হচ্ছিলো না। তিনি বললেন পি আর কার্ডের ঝামেলা যেহেতু শেষ তোমরা পাশের রুমে গিয়ে সিকিউরিটি ইন্সিওরেন্সের কাজটা করিয়ে যেতে পারো। বললাম, আমরা তো এখানে থাকবোনা, কাজটা উইনিপেগে গিয়েই করবো, আমাদের লাগেজ কোথায় কালেক্ট করবো বলতো !
তিনি বললেন সিঁড়ি দিয়ে সোজা নিচে চলে যাও, লাগেজ ওখানেই পাবে। নিচে নেমে দেখলাম এক সাথে অনেক গুলি বেল্টে লাগেজ আসছে। আমাদেরটা কোন বেল্টে বুঝতে পারছিনা।কোন একটি মনিটরে এসব লেখা পাবো ভেবে সামনে এগোতে থাকলাম। প্রতিটা বেল্টের কাছের দেয়ালে লেখা কোথাকার ফ্লাইট। ছড়ানো ছিটানো মানুষ, আসলে এলাকাটির বিশালতার জন্যে কয়েকটি বিমানের হাজার, দেড় হাজার যাত্রীকেও ছড়ানো ছিটানো মনে হচ্ছে। মাঝে মাঝে ছোট্ট ট্রলির মত দুই চাকার বাহন নিয়ে ঘোরাঘুরি করছেন দুই একজন। তাদেরই একজন জিগ্যেস করলো, ‘ক্যারেজ লাগবে?’
একটু অবাক হলাম, ঢাকা ছাড়া অন্য কোথাও এরকম যেঁচে সাহায্যের প্রস্তাব নিয়ে আসতে দেখিনি। বললাম আমি জানিনা এখন পর্যন্ত লাগেজ পাইনি। সে জিগ্যাস করলো মোট কত গুলি?
- ১৩
- যাবে কোথায়?
- আমরা এয়ার কানাডায় যাবো, উইনিপেগ
- ওকে ২৬ ডলার লাগবে, তোমার লাগেজ পৌছে যাবে এয়ার কানাডায়, আর তুমি টাকা দেবে আমার কোম্পানিকে
বাঙালিরা প্রথম প্রথম বিদেশে টাকা খরচ করতে গিয়ে নামতা পড়া শুরু করেন।আমি খাঁটি বাঙালি ২৬ বাষট্টি ১৬১২ অনেক টাকা। বললাম টার্কিশ এয়ারলাইন্সের লাগেজ কোন বেল্টে বলতে পারো?
আমার বড় মেয়ে সারাহ লাগেজ টানাটানির মত বড় বড় কাজে সবসময় আমার স্বেচ্ছা সহযোগী। আমরা দ্রুত পায়ে হাঁটলাম বেল্টের দিকে। দেরিতে আসায় বেশি খোঁজাখুঁজি করতে হলোনা। আটটা স্যুটকেইস পাওয়া গেলো একই জায়গায়। দীপা বলল, মনে নেই ফয়সল ভাই বলছিলো কাগজের কার্টুন আলাদা জায়গায়?
সামনের একটা স্টোরের মত জায়গায় সেটাও পাওয়া গেলো। চারটা ট্রলিতে সব কিছু নিয়ে আমরা রওনা দিলাম কাস্টমস কাউন্টারে। ছোট্ট শ্রেয়াকেও ঠেলতে হচ্ছে বিশাল এক ট্রলি । খুব বেশি ভীড় ভাট্টা এখানে ছিলোনা। আমাদের আগে এক চাইনিজ, আর সম্ভবত এক ভারতীয় পরিবার। সমস্ত মাল পত্র ট্রলিতে ভরে কাস্টমস কর্মকর্তার সামনে দাঁড়িয়ে।
আমাদের ডাক পড়লো মিনিট পাঁচেক পর। তখন পর্যন্ত আমার জড়তা কাটেনি। পরবর্তী ফ্লাইট কোথা থেকে ছাড়বে জানিনা। স্থাবর যে সব নিয়ে গিয়েছি, কাস্টমসে তার লিস্ট দেওয়া হয়নি। বাংলাদেশ থেকে অভিজ্ঞরা বলে দিয়েছেন মূল্যবান যা কিছু নিচ্ছো সেগুলি তো লিস্ট করাবাই, সাথে যা নিতে পারোনি ভবিষ্যতে নিয়ে যাবা, তাও লিখিয়ে দিয়ে আসবা। না হলে পরে সে সব নিতে গেলে ট্যাক্স লাগবে। একজন বলেছেন গহনা গাটির ছবি তুলে আলাদা আলাদা কপি নিয়ে যেতে, কাস্টম অফিসার নাকি ওই ছবির পিছনে সিল মেরে দেবেন, পরে কোন সময় নিয়ে গেলে ট্যাক্স রেয়াত পাওয়া যাবে। দীপা তাঁর গহনার জগত ব্যাংকের লকারে আগেরদিন যখন নিয়ে গিয়েছিল, তখন মোবাইল ফোনে তাঁর কিছু ছবি তুলেছিলাম।প্রিন্ট আউট নেওয়া হয়নি।
কাস্টমস অফিসারকে বললাম, ওজনের সীমাবদ্ধতার জন্যে আমরা তো অনেক কিছুই নিয়ে আসতে পারিনি...
- আচ্ছা তোমরা কী সেগুলি আনতে চাও?
- হ্যা
- ঠিকাসে, কী কী আনতে চাও বলো তার দামের হিসাব করতে হবে।
খুবই সোজা সাপ্টা কথাবার্তা। বললাম, খাট পালঙ থেকে শুরু করে, পোষাক আশাক, ডেকোরেশন পিস গয়না গাটি সব কিছুই রেখে এসেছি। তুমি চাইলে গহনার ছবি দেখাতে পারি।
ছবি দেখার পর সে বলল, তিনটি ক্যাটাগরিতে সবকিছু ভাগ করে ফেলো জুয়েলারি, ফার্ণিচার আর ক্লোদিং। ডেকোরেশন পিসটিস জুয়েলারির মধ্যে ফেলে দাও।আর ডলারে এগুলির দাম কত হতে পারে বলে দাও।
এর পর আমাদের কথা মত দাম লিখে ফর্মে সাইন করে এবং করিয়ে একটি কপি দিয়ে বলল, যত্ন করে রেখ, পরে কাজে লাগবে।
তাঁর কাছ থেকে এয়ার কানাডার হদিস নিয়ে পা বাড়ালাম সামনে।
একই করিডোর ধরে কিছুদূর যাবার পর এক সুন্দরী মহিলা আমাদের বোর্ডিং পাশ চেক করে বললেন, লাগেজ একদম কোনার কাউন্টারে বেল্টে চড়িয়ে দাও।
বেল্টের কাছে এক সাদা যুবক আর এক ভারতীয় প্রৌঢ় কাজ করছিলো। তারা দু’জনেই মাল ওঠাতে সাহায্য করলো।
বাক্সপেটরা সবই উঠে গেলো, কার্টনটির বেলায় ভারতীয় লোকটি বলল, তিনতলায় ওভার সাইজ কাউন্টারে নিয়ে এটাকে বুক কর।
একটু দূরে লিফট।আবার ট্রলিতে করে কার্টন নিয়ে লিফটে উঠলাম।তিন তলায় গিয়ে বুঝলাম ক্ষতি কিছু হয়নি। তিন তলাতে এয়ার কানাডার অনেক গুলি কাউন্টার এখানে চেকইনের পর বিভিন্ন গেট দিয়ে বিমানে ওঠে যাত্রীরা।
আমাদের চেকইনের সময়, দেখিয়ে দেওয়া হল, ওভার সাইজ কাউন্টার। আর বলা হলো প্লেনে উঠতে হবে D 24 থেকে।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই এপ্রিল, ২০১৬ রাত ৯:০১