হাতে, কাঁধে ব্যাগ, বোঁচকার বহর নিয়ে আমার ঘুরতে ভালো লাগেনা। তারপরও ভ্রমণে আমার এসব নিত্যসঙ্গী। চারজনে ১০টি ব্যাগ নিয়ে প্লেনে উঠেছিলাম। কেবিন কেইস ছাড়াও তার মধ্যে ল্যাপটপ, ফখরদ্দিনের বিরিয়ানি, হ্যাভারস্যাক, বই, ক্যামেরা ইত্যাদি ইত্যাদি। এতকিছু নিয়ে প্লেনে ওঠা যত কঠিন নামা তার চেয়ে সহজ নয়। প্লেন থামার সাথে সাথে অথবা তার একটু আগে থেকেই কিছু যাত্রী উপর থেকে মাল পত্র নামাতে শুরু করেন। ওঠা নামায় বরাবর অপটু আমি উপরের দিকে হাত বাড়াতে বাড়াতে, বিমানের আরাম প্রিয় যাত্রীটিও নামার জন্যে করিডোরে দাঁড়িয়ে গেলো। তাদের মাথার উপর দিয়ে মাল পত্র নামানো এলেমদার লোকের কাজ। কারো গায়ে মাথায় লেগে যাবার ভয়ে আমরা চারটি প্রাণী নিজেদের সিটের কাছে দাঁড়িয়ে অন্যদের নামা দেখতে থাকলাম। আমরা বের হতে হতে অন্য যাত্রীরা অনেক দূরে চলে গিয়েছে। আমরা TK 713তে ইস্তাম্বুল এসেছি। TK 17 ধরে যেতে হবে টরন্টো। মোটে এক ঘন্টা পঞ্চাশ মিনিট সময় মাঝ খানে। এয়ারপোর্ট যারা চেনেন তাদের জন্যে সমস্যা নয়। আমাদের চলতে হচ্ছে নিয়ন সাইন পড়তে পড়তে। TK 17 একই টার্মিনাল থেকে ছাড়বে আর সেটির বোর্ডিং পাশও ঢাকা থেকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে বলেই আমরা সময়ের লড়াইয়ে টিকে গেলাম।
সিক্যুরিটি চেকের সময় ঠং করে শব্দ করে উঠলো যন্ত্র। নিরাপত্তা প্রহরী খুব মনোযোগ দিয়ে চেক করতে থাকলেন আমার পোষাক আশাক। পকেট হাতড়ে কিছু না পেয়ে বললেন, ইত মে বি দ্য বেলত এন্দ দ্য চেইন অব ইয়োর স্যুজ। অগত্যা বেল্ট জুতো খুলে আবার ঢুকতে হল যন্ত্রের তলায়। এবার নিশ্চিত হয়ে হাসি মুখে বিদায় জানালেন তিনি। গেইট নম্বর ডি ৯ দিয়ে টিকে ১৭ এর বোর্ডিং শুরু হয়েছে। ইস্তাম্বুলে তাপমাত্রা দশের নিচে। কিন্তু সে সব কিছু আমাদের প্রভাবিত করছে না। ফ্লাইট ধরার জন্যে দ্রুত হাটার কারণে ঠান্ডা লাগছেনা।
বোর্ডিং পাশ দেখার সময় কানাডা ইমিগ্রেশনের ল্যান্ডিং পেপারস খুটিয়ে খুটিয়ে পরীক্ষা করলেন দায়িত্ব প্রাপ্তরা। অবশেষে ছাড়া পেয়ে বিমানে উঠলাম। এবার সিট বিমানের লেজের দিক ৪২ নম্বর সারিতে। ২টার সময় যখন বিমান ছাড়ছে বাংলাদেশে তখন সন্ধ্যা ছয়, সুর্য ডোবার সময়। ইস্তাম্বুলের আকাশে সূর্যের তখন পূর্ণ যৌবন।
আগের নয় ঘন্টায় কেবিন ক্রুদের মধ্যে একটু ভাসুর ভাদ্রবধু ভাব লক্ষ করেছিলাম। ইস্তাম্বুলে আসার পর তাদের যত্ন আত্তির মাত্রা বেড়ে গেলো। প্রথমে গরম পানিতে ভেজা সেন্টেড ন্যাপকিন এলো স্নিগ্ধতার পরশ বুলাতে। এর পর কাজু বাদাম কিশমিশের মিশেলে তৈরি কোন একটা খাবার (এই সব ভদ্রতার সম্ভবত কোন নাম আছে, কেউ জানালে খুশি হব), তারপর ফ্রেশ জুস। বুঝলাম অন্যান্য অনেক এয়ার লাইন্সের মত তুর্কিদের অতিথিরাও ইওরোপে পৌছাতে পৌছাতে নারায়ন হয়ে যান।
ইস্তাম্বুল থেকে টরন্টো প্রায় পৌনে ছয় হাজার মেইল আকাশ দূরত্বে। সাড়ে দশ ঘন্টার ধাক্কা। ইতালি, স্পেন আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে তারপর কানাডা।
এক ঘেয়েমি দূর করার জন্যে সময়টাকে তিন ভাগে ভাগ করলাম। দুইবার খাওয়া দাওয়ায় সর্বোচ্চ ৪০ মিনিট, দু’টি হিন্দি সিনেমা পাঁচ থেকে ছয় ঘন্টা। বাকী সময় ইন ফ্লাইট ম্যগাজিন পড়া, ঘুমানো ইত্যাদি।
এখানে আসার সময় ক্রিড দেখলেও আরও দু’টি পছন্দের ছবি দেখা হয়নি সময়ের অভাব এবং ঘুমিয়ে পড়ার স্বভাবের কারণে। এই যাত্রায় লিস্টে সেই মুভিগুলোর নাম দেখতে পেয়ে চনমনে হয়ে উঠলাম। বিমান আকাশে উড়তে না উড়তে শুরু হল অজয় দেবগনের দৃশ্যম।
মনে হল, দৃশ্যম ছবিটা বক্স অফিসে ঢেউ তুলেছে কাহিনী আর গতির কারণে। অজয় দেবগন আর তাবু ছাড়া কোন নাম করা শিল্পী নেই। এবং দু’জনেই অভিনয় করেছেন গ্ল্যমারহীন রোলে তার পরেও দুই সপ্তায় চুরাশি কোটি এমনি হয়নি।
টার্কিশ এয়ার লাইন্সে মোটা দাগের তিন ধরণের খাবার, ভেজিটেরিয়ান, নন ভেজিটেরিয়ান আর এশিয়াটিক মিল। ঘন্টা দেড়েক পর খাবার পাওয়া গেলো। মেইন ডিশে ভাত রুটি কিছু নেই। কয়েক টুকরো মাংস আর শাক পাতার সাথে সাথে আলু ভর্তা, সাইড ডিশে ছোট্ট এক টুকরো পাউরুটি, বাটার, চীজ, এছাড়া সালাদ, কাস্টার্ড, ফল মূল আরও কি কি যেন ছিলো।
এএবেলায়ও খাওয়া দাওয়ার পর জানালা নামিয়ে দিয়ে গেলো বিমান বালারা। তারপর যথারীতি ঘুম। আমার ঘড়িতে বাংলাদেশি সময় তখন সাড়ে সাতটা পেরিয়েছে। আকাশে তেজী সূর্য। আমরা উড়ছি পশ্চিমে।কাজেই সূর্য ডুবছে না। দিন হয়ে যাচ্ছে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর।
ইস্তাম্বুল পর্যন্ত এসেছিলাম দীপার পাশে বসে। TK 17 এ চারটি সিট পড়েছে সামনে পেছনে। সামনের সিটে আমি, পাশে দু’জন তামাটে ইংরেজ। পেছনে দুই কণ্যাকে নিয়ে দীপা। মেয়েদের খোঁজ নিতে গিয়ে দেখলাম দু’জনেই মহা বিরক্ত। অবারিত স্বাধীনতা(বিরতিহীন টেলিভিসন, মুভি, গেইমস)আর ভালো লাগছেনা, বাবা আর কতক্ষণ?
সে কথার সরাসরি উত্তর না দিয়ে বললাম, টিভি দেখতে ভালো লাগছেনা? উত্তর আশা করিনি।পাওয়াও গেলোনা। আমার বাম পাশের সামনের সিটে একজন ভারতীয় তরুণি বসেছেন দুই শিশু কণ্যাকে নিয়ে। ছোটটির বয়স একের বেশি নয়। প্যারাম্বুলেটরে শুয়ে ঘুমিয়ে কাটাচ্ছে সে। আর বড় জন মাঝে মধ্যে দৌড়া দৌড়ি করছে। এছাড়া প্লেনের এই লেজের দিকে অন্যরা হয় ঘুম অথবা টিভিতে মগ্ন। আমি শুরু করলাম আমার তিন নম্বর ছবি, পিকু।
বানিজ্যিক কারণে ভারতের সিনেমায় বাংলা ভাষার গুরুত্ব বাড়ছে। আগে ঋষিকেশ মুখার্জি ছাড়া বোম্বের কোন পরিচালকের মুভিতে বাংলা সংলাপ শোনা যেতনা। বাংলার দর্শকদের জন্যে এখন অনেক ছবিতেই বাংলা সংলাপের ছড়াছড়ি।পিকু ছবিটা খানিকটা সে ধরণের হলেও আমেজটা একেবারেই অন্যরকম। দিল্লী প্রবাসী বাঙালি বাবা আর মেয়ের গল্প পিকু। প্রধান শিল্পীদের মধ্যে যীশু আর মৌসুমী বাদে সবাই অবাঙালি। সংলাপ,অমিতাভ আর দীপিকার অভিনয়েরজন্যে ছবিটা সারা বিশ্বে প্রায় দেড়শ’ কোটি টাকার ব্যবসা করেছে।
পিকু শেষ করতে করতে আমরা আটলান্টিকে এসে পড়লাম। ঘড়িতে তখন বাংলাদেশের রাত দশটা আকাশে গণ গণে সূর্য। তাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ডুব দিলাম ঘুমের দেশে।
বাংলাদেশি রাত একটায় যখন ঘুম ভাংলো, পাশের তামাটে ইংরেজ বিনয়ের সাথে বের হবার পথ চাইলো। আমার মনে হল, সম্ভবত আরও কিছু সময় আগে থেকে তাঁর বেরুনোর ইচ্ছে হচ্ছিল, আমাকে ঘুমোতে দেখে ডাকেননি। বসে তাহকতে থাকতে পায়ে ঝিঁঝিঁ ধরে গিয়েছিলো। তাঁকে পথ ছেড়ে দিয়ে আমি হাঁটতে বের হলাম। জানালার বাইরে সূর্যের তেজ তখনও কমেনি। আমার ঘড়িতে সূর্যের বয়স ১৮ ঘন্টা হয়ে গিয়েছে। ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ সময় রাত দশটায় সূর্য ডুবতে দেখেছিলাম সোমালিয়ায়। আজকের দিন তার চেয়ে বড় হয়ে গেলো।
এর পর আবার সেই একই রুটিন। কানাডার ভূখন্ডে ঢোকার পর শেষ বারের খাবার দেওয়া হলো। টরন্টো পৌছাতে পৌছাতে বৃষ্টি শুরু হলো। টরন্টোতে তাপ মাত্রা ৪ ডিগ্রী, সময় সন্ধ্যা সাড়ে ছয়, সূর্য ডোবার আয়োজন শুরু হয়েছে তবে মেঘের কারণে তাকে শুধু মাঝে মধ্যে দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশে ভোর সাড়ে চারটা। আমার সাড়ে বাইশ ঘন্টার দীর্ঘতম দিন শেষ হতে যাচ্ছে। টরন্টোর পিয়ারসন বিমান বন্দরে দীর্ঘ ছায়া ফেলতে ফেলতে অবতরণ করছে TK 17.
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই এপ্রিল, ২০১৬ সকাল ৯:৫৭