শিউলি আমাদের অতি পরিচিত ফুল। অনেক লেখলেখি হয়েছে এই ফুল নিয়ে। আমি আর নতুন অরে কিছু লিখতে পারবোনা জানি। তারপরও সকালে হাঁটতে বেরিয়ে পিচের রাস্তার উপর শিউলি ঝরে থাকতে দেখে সুনীলের কবিতার লাইনটা মনে পড়ে গেলোঃ
শিউলি ফুলের রাশি শিশিরের আঘাতও সয়না।
এই লাইনটা এমন ভাবে মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকলো যে শিউলি পূরান লিখতে না বসে পারলাম না। শিউলিকে নিয়ে দু’টি প্রেমের গল্প চালু আছে। তার একটি ক্রোধের আর একটি অভিমানের। আমার মনে হয় শিউলির সাথে অভিমানটা বেশ মানিয়ে যায়। সেই গল্পটাই বলি।
মর্ত্যের এক নরম মনের রাজ কন্যা, পারিজাত তার নাম, হঠাত করেই প্রেমে পড়ে গেলো পরাক্রমশালী সূর্যের। একশ’একাশিটা চাঁদ যাকে নিত্য ঘিরে নৃত্য করে, সেই সূর্যের কী সময় আছে পারিজাতের দিকে তাকাবার! সূর্যের অবহেলায়, অভিমানে আত্মহত্যা করলো রাজকণ্যা। তার দেহভস্ম হতে জন্ম নিলো একটি গাছ। চাঁদের আলোয় সবাই দেখলো সুন্দর সাদা ফুলে ছেয়ে গেছে সেই গাছ। সেই ফুলের সৌরভ ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিক। সূর্য তখন অন্য রাজ্যে। এই ফুলের খবর তার কাছেও পৌছল। তবে তিনি ফিরে এসে দেখলেন পায়ের কাছে ঘাসের মত্যে ফুল বিছিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মৌন এক বৃক্ষ। ঘাসের মধ্য পড়ে থাকলেও ফুল গুলিকে লাগছে মোমের আলোর মত স্নিগ্ধ আর পবিত্র।
গল্প তো গল্পই। তবে এই গল্পের সাথে মিল আছে শিউলির স্বভাবের। শরতের রাতে শিউলি ফুটে ঝরে যায় ভোর বেলাতেই। শিউলি আমাদের নিজস্ব ফুল। রবীন্দ্রনাথ বলতেন শেফালি । বৈজ্ঞানিক নাম নিকান্থেস আরবরত্রিস্তিস। মূলতঃ শিউলির স্বভাবের কথা ভেবেই
বিজ্ঞানীরা এই নাম রেখেছেন। ল্যাটিন ভাষায় নিকান্থেস মানে সন্ধায় ফোটা আর আরবরত্রিস্তিস বিষন্ন গাছ। ভারত বর্ষেই এদের আঁদিবাস। দক্ষিণ থেকে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় এটি ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়েছে । শরতের শুরু থেকে হেমন্ত অব্দি শিউলি ফোটার দিন সময়।
শিউলির জন্যে খুব বেশি জায়গা লাগেনা। বাগানের কোনে, গেটের ধারে শিউলি গাছ দাঁড়িয়ে থাকে নিরবে নিভৃতে। এরা তিন থেকে ছয় মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। মাথার দিকে একটু ঝাকড়া হয়ে নিচে ঝুঁকে পড়ে। গোড়ায় পানি জমে গেলে শিউলি গাছকে বাঁচানো মুস্কিল। ফুল আসার আগে খুব একটা নজরে পড়েনা। ফুল এলে ঘাস, মাটি এমনকি বাতাসও তা টের পায়। পারফিউম শিল্পের মালিকদের কাছে আগেই নাইট জেসমিনের (শিউলির ইংরেজি নাম) কদর ছিলো। আজকাল ওষূধ শিল্পেও শিউলির নাম ছড়াচ্ছে।
মুলতঃ পাঁচ (সাত পাপড়িও হয়) পাপড়ির শিউলি্র সাদা মোমের মত রং। অনেকাটা চরকার মত পাপড়ির বিন্যাস। কমলা রঙের বৃন্ত ফুল গুলিকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে। দিনের বেলা ফুলে ছাওয়া গাছ দেখা প্রায় অসম্ভব, তবে কুয়াশার দিনে বেশ কিছু ফুল দেখা যেতে পারে, আজ সকালে যেমন আমি দেখেছি।
শিউলির পাতা খানিকটা বট পাতার মত, তবে অগ্রভাগ অত সরু নয়। বরং বলা যায় পান পাতার সাথেও বেশ মিল আছে। ফল গুলি গোলাকার, চ্যপ্টা অনেকটা খাবার ট্যাবলেটের মত।
শিউলির উপযোগিতা আর উপকারিতার শেষ নেই। ফুল থেকে মূল পর্যন্ত সবই মানব কল্যাণে বিলিয়ে দেবার জন্যেই জন্ম এই বিষাদ বৃক্ষের।
শিউলির পাতার রস পিত্ত, কফ, ব্যাথা, ও পুরনো জ্বরের জন্যে উপকারি। টাটকা রসে্র সাথে মধু মিশিয়ে খেলে কৃমি দূর হয়। পাপড়ি বেটে আদার রস মিশিয়ে খেলেও জ্বর কমে। বীজের গুড়ো মাথায় দিলে খুশকি কমে। কিভাবে ব্যবহার করতে হবে বলতে পারবোনা। সে সব জানে কবিরাজ আর অন্তর্জাল।
এছাড়া নানান রকম এন্টি ভাইরাল ও এন্টি ফাঙ্গাল ওষুধ তৈরিতে ইই ফুল ব্যবহার করা হয়। এসেন্স ও রং তৈরির কাজে অনেক আগে থেকেই এই ফুল ব্যবহার করতে হয়।
এসব গুনের হিসাব গুনতে গুনতে সূর্যের জন্যে আমার দুঃখই হচ্ছিল। বউএর খোঁজেই মনে হয় বেচারাকে সারা বছর পূর্ব পশ্চিম করতে হয়।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই নভেম্বর, ২০১৫ ভোর ৫:৫২