এই লেখাটি টিটুর জন্যে। ওর সাথে আমার দেখা হয়ে ছিলো ১৫ বছর আগে, মিউনিখে। সরকার আমাকে মিউনিখ পাঠিয়েছিলো সিমেন্স ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজিতে টেলিফোন এক্সচেঞ্জের উপর জ্ঞান অর্জনের জন্যে। হোটেল থেকে ক্লাশে যাবার জন্যে হাতে ট্রেনের ফ্রি পাশ ধরিয়ে দিয়েছে সিমেন্স ইন্সটিটিঊট । সেই পাশে মিউনিখের যেকোন সরকারি বাহনে যতবার ইচ্ছে ওঠা যায়।
৮টা ৫টা ক্লাশের চাপে সূর্যের মুখ দেখা হয়না। নভেম্বরে মিউনিখে দিন একেবারে খোলসের মধ্যে ঢুকে যায়। ক্লাশ শেষ হতে হতে বাতি জ্বলে ওঠে রাস্তায়। ক্লাশে এক্সচেঞ্জের হা করা প্যানেল আর কম্পিউটারে কতক্ষণ ডুবে থাকা যায়! ক্লাশের ফাঁকে বিনি পয়সার কফি খেতে খেতে একদিন মনে হলো শিক্ষা চুলোয় যাক। আমি মিউনিখের শেষ দেখে ছাড়বো। সেদিন থেকে আমি মনে প্রাণে পর্যটক হয়ে গেলাম। এক ঘন্টার লাঞ্চ ব্রেকে ইউবানে (পাতাল রেল) চেপে বসি। সামনে যে স্টেশন পড়ে নেমে পড়ি। বিকেলে ক্লাশ শেষেও একই রুটিন। টিটুর সাথে পরিচয় তখনই হল তখনই, একেবারে আকষ্মিক ভাবে।
সেদিন হোটেলে ফেরার একটু তাড়া ছিলো । ওবারসেন্ডলিং থেকে ইউবানে চেপেছি সেন্ডলিংগাটোরে ট্রেন বদলে ইউটু ধরে সিল্ভারহরন স্ট্রাসেতে নামার কথা। হঠাৎ ট্রেনের শব্দ ছাপিয়ে কানে এলো বাংলা গালির আওয়াজ। স্পষ্ট নয়, একেক বার মনে হচ্ছে পুরোটাই কল্পনা, অথবা কানের ভুল। হিজ মাস্টার্স ভয়েসের লোগোর সারমেয় ছানার মত কান খাঁড়া করে দিলাম। এক সময় মনে হল দু’জন লোকের মধ্যে কথা কাটাকাটি হচ্ছে, বাংলায়। খটমটে জার্মান ভাষায় গান শোনার চেয়ে বাংলায় ঝগড়া শোনাও অনেক ভালো। শব্দের উৎস খুঁজতে খুঁজতে সেন্ডলিংগাটো্র ছাড়িয়ে গেল ট্রেন। নামা হলোনা। কিন্তু শব্দটি স্পষ্টতর হল। সেন্ডলিংগাটোরে অনেক যাত্রী নেমে যাওয়ায় ট্রেনটি অনেকটাই ফাঁকা। তখন দেখলাম একটু দূরে দু’জন বাঙালির মধ্যে বাদানুবাদ চলছে। আমি নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে তাঁদের সামনের খালি সিটে বসে ঝগড়া শুনতে লাগলাম। আমার দিকে চোখ পড়তেই ঝগড়া থেমে গেল। সেই অবসরে জিজ্ঞাসা করলাম “ঢাকা থেকে?” উত্তর পেতে কিছুটা সময় লাগলো। একটু পর দু’জনে প্রায় একই সাথে বলে উঠলন, “না বাংলাদেশ থেকে”। বললাম “একই তো কথা!”
- মিউনিখে নতুন?
- হ্যা, এই কয়েকদিন হলো এসেছি।
- সেই জন্যেই ঢাকা আর বাংলাদেশ এক মনে হছে।
আমার ভ্রু কুঁচকানিতে প্রসঙ্গটি বদলে গেল।দু’জনের মধ্যে যাকে অপেক্ষাকৃত বয়স্ক মনে হচ্ছিল তিনি হাত বড়িয়ে দিলেন
- আমি আজিম
- সাইদুল ইসলাম।
- মিউনিখে থাকেন? আগে দেখা হয়নি।
- থাকি না। কয়েকদিন হল এসেছি।
তরুণ ছেলেটি কোন ভণিতা ছাড়াই বললো, আমরা সামনের স্টেশনে নামবো, ইচ্ছে হলে আসতে পারেন।আগপিছ না ভেবে নেমে পড়লাম তাদের সাথে। তরূণটির নাম টিটু, চাঁদপুরের শাহারাস্তি থেকে মিউনিখ এসেছে ভূয়া পাশপোর্টে। এদেশে আছে রোহিঙ্গা পরিচয়ে। আমাকে নিয়ে একটা টার্কিশ ফাস্ট ফুডের দোকানে ঢুকতে ঢুকতে টিটু নিজের সম্পর্কে জানাচ্ছিলো। কথা শুনে বুঝলাম ও আমারই এক সহকর্মীর ছোট ভাই ।আজিম ভাই একটু পিছিয়ে পড়েছিলেন।কাছে এসে টিটুকে জার্মান ভাষায় কিছু বললেন। উত্তরে টিটু বলল, উনি আমার ভাই এর বন্ধু। আপনি বাংলাতেই বলেন।
এই দু’জন মানুষের মাঝে অন্যকে আপন করে নেবার বিশেষ ক্ষমতা আছে। অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা বন্ধু হয়ে গেলাম। জানা গেলো মিউনিখের বাঙালি সমাজে ঝামেলা চলেছে। একপক্ষে মুন্সীগঞ্জের মানুষ অন্য পক্ষে ফেনী, চাঁদপুর,কুমিল্লা ইত্যাদি। ট্রেনের মধ্যেও দু’জনের মধ্যে এসব নিয়েই কথা বার্তা হচ্ছিল। আবেগ ছুঁয়ে গিয়েছিলো দু’জনকেই। গলার আওয়াজ বাড়ার কারণও সেটাই। আমি বললাম ভাগ্যিস আপনারা জোরে কথা বলছিলেন না হলে তো দেখাই হতো না। ফিরতি ট্রেনে ওঠার সময় টিটু এক নিঃশ্বাসে বলে গেলো, ‘আপনি সেন্ডলিঙ্গাটোর থেকেই ইউ থ্রিতে উঠবেন, আর শনিবারের কথা কিন্তু ভুইলেন না। আপনার বন্ধুদেরও নিয়ে আসবেন। জাস্ট ডাল ভাত। না কোন কারণ নেই, আপনি আমার ভাইএর বন্ধু, তাই আবার আমার শহরে’। বললাম, শনিবারের কথা কখন বললে? আমি তো তোমাদের বাসা ই চিনি না। ট্রেনের দরজা বন্ধ হবার তখন তেমন দেরি নেই। আজিম ভাই বললেন, ও বলি নাই? আপনার হোটেলের ঠিকানা আছে না। মাঝখানে একদিন যেয়ে বলে আসবো।
আজিম ভাই আর আসেন নি। টিটু গিয়েই আমাদের দাওয়াত দিয়ে এসেছিলো।শুধু তাই নয়, “নিজের অনেকদিন ঘোরা হয়না” জাতীয় অজুহাত তুলে আমাদের কে মিউনিখের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরিয়েও এনেছিলো। এই যাত্রায় টিটুদের অনেক কথা জানা হয়ে গিয়েছিলো আমাদের। যেমন টিটুর নাগরিকত্ব জটিলতা। বৈধ অভিবাসনের আশায় আজিম ভাইএর বেলজিয়ান প্রেম। তার বেলজিয়ান বউএর বাঙালি হবার প্রচেষ্টা ইত্যাদি ইত্যাদি। এদের প্রায় সবাই একাধিক কাজ করে জার্মানিতে টিকে থাকে, দেশে টাকা পাঠায়। আর নিরবে নিভৃতে কাঁদে। টিটু সকাল ৬ টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত কাজ করে একটা ক্লিনিকে, আর বিকেলে চারটা থেকে কাজ করে একটি জিমনেশিয়ামে তার কাছে জানা গেল আজিম ভাই এর গল্পও অনেকটা সে রকমই। তবে আজিম ভাই এর কষ্টের দিন শেষ হতে চলেছে। তিনি বৈবাহিক সূত্রে বেলজিয়ামের নাগরিকত্ব পেতে যাচ্ছেন। কাগজপত্র হাতে এলেই ছেড়ে যাবেন মিউনিখ।
টিটুর জন্যে আমাদের মিউনিখের দিন গুলি আর নিরানন্দ রইলো না। শনিবারের দাওয়াত তো ছিলোই। আরও অনেক কথা।
মিঊনিখ থেকে চলে আসার দিন টিটুর সাথে শেষ দেখা। । ছলছলে চোখে আমাদের বিদায় দিতে এসেছিলো। ও যখন ফিরতি ট্রেনে লাফিয়ে উঠছে তখন ট্রেনের দরজা বন্ধ হওয়া শুরু হয়েছে। আমাকে একটা কলম দেবার জন্যে এর মধ্যেও হাত বাড়িয়ে দরজায় চাপা খেয়ে ব্যথায় কুচকে গেল ওর মুখ। টিটুর জন্যে সেটা ভালোই হয়েছিলো। আমাদের জন্যে চলে আসা চোখের পানি টা ট্রেনের দরজার কাঁধে চাপাতে পেরেছিলো। ১৫ বছর পর হঠাৎ ফেবুতে টিটুর দেখা পেয়ে ওর সবকথা মনে পড়ে গেল। টিটুর বন্ধু তালিকায় আমি নেই । ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছি।
যে ব্যস্ততায় ওদের দিন যায়, চোখে পড়বে বলে মনে হয় না।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জুলাই, ২০১৫ ভোর ৪:৩০