৬/৪ দ্বারকা নাথ স্ট্রিট, জোড়সাঁকো ঠাকুর বাড়ির অফিসিয়াল ঠিকানা
ঢাকা থেকে বন্ধুরা বলে দিয়েছিল, জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ি বললে যেকোনো ট্যাক্সিওয়ালা চোখ বুজে নিয়ে যাবে রবীন্দ্রনাথের বাড়ি। কলকাতায় এসে বুঝলাম এখানকার ট্যাক্সিওয়ালাদের এখন চোখ ফুটেছে। চোখ বুজে ঠাকুর বাড়ি যাবার দিন শেষ। প্রথম যে ট্যাক্সি ধরলাম তার চালক বলল, ‘দাদা, ঠাকুর বাড়িতো বুঝলাম, ঠিকানাটা বলুন’। দুই-তিন জন ক্যাবচালকের কাছে একই রকম জবাব পেয়ে, সোহাগ ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস-এর (জি হ্যাঁ, আমাদের সোহাগ পরিবহনের সাথে সম্পর্কিত) সোনাভাই’র শরণাপন্ন হলাম। তিনি বললেন, বলুন সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ যাবো, গিরিশ পার্কের দিকে। এবার পাওয়া গেল একজন বয়স্ক ট্যাক্সি চালক। প্রথমেই বললেন, ‘সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউতে ১০০ টাকা লাগবে’। বললাম, ‘মিটার খারাপ নাকি?’, বলল, ‘দাদা মিটার ঠিক আছে, মমতা খারাপ।’
মানে?
জিনিসপত্তরের যা দাম, মিটারে পোষাবে?
এর আগে গোটা চারেক ট্যাক্সি ছুটে গেছে, আর কথা না বাড়িয়ে উঠে বসলাম। ট্যাক্সি চলতে শুরু করার পর বললাম, ‘দাদা, রবীন্দ্রনাথের বাড়ি চেনেন?’ তিনি বললেন, ‘আপনি আসলে যাবেন কোতায়? এগবার বলেন সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ, এগবার গিরিশ পার্ক, এখুন আবার রবীন্দ্রনাথের বাড়ি’। বললাম, ‘দোষ আমার নয় দাদা, এতক্ষণ অন্তত চার জনকে বলেছি, কলকাতার লোক ঠাকুর বাড়ি না চিনলে রাগ হয় না! আমি আসলে ঠাকুর বাড়ি যাব’। তিনি একটু গম্ভীর হয়ে, ‘ছেলে ছোকরার কাছে রবীন্দ্রনাথের কথা জানতে চাইলে হবে!’
এক পাশ থেকে
এ-রাস্তা সে-রাস্তা ঘুরে আমরা যখন ৬/৪ দ্বারকানাথ স্ট্রিটে পৌঁছালাম তখন ট্যাক্সির মিটারে উঠেছে মোটে ৫৭ টাকা ৬০ পয়সা। প্রায় ৪০ টাকা বেশি গুনতে হলো কোনো কারণ ছাড়াই। এটাই ঠাকুর বাড়ির অফিসিয়াল ঠিকানা। অবশ্য এঠিকানা বললেও ট্যাক্সি ওয়ালাদের চেনার সম্ভাবনা কম। সবচেয়ে ভালো রবীন্দ্র সরণী হয়ে গিরিশ পার্ক মেট্রোর কথা বলা, রবীন্দ্র সরণীর আগের নাম চিতপুর রোড।
ঠাকুর বাড়িতে যাবার রাস্তা যেমনই হোক, বাড়িটা দেখার মতো। অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে দ্বারকানাথ ঠাকুর বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন বড় বাজারের শেঠদের জমিতে। ধীরে ধীরে এই পাড়াটি হয়ে ওঠে বাংলা সাহিত্যের বহু বিখ্যাত ঘটনার সাক্ষী। এ পাড়াতেই থাকতেন ‘হুতোম প্যাঁচার নকশার’ কালী প্রসন্ন সিংহ, ভারতবর্ষে জুলিয়াস সিজার নাটক প্রথম অভিনীত হয়েছিল যার বাসায় সেই পিয়ারি মোহন বোস, মাইকেল মধুসূদনের ‘কৃষ্ণকুমারী’ প্রথম মঞ্চস্থ হয়েছিল যাঁর উদ্যোগে সেই জ্ঞানেন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ আরও বেশ কয়েক জন বিখ্যাত মানুষ।
যেন রবি ঠাকুরের নাতি পুতি
১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্ম শতবার্ষিকীতে পশ্চিম বাংলার তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী বাড়িটি রবীন্দ্রভারতী সোসাইটির কাছ থেকে অধিগ্রহণ করেন। ১৯৬২ সালের ৮ মে পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু ৩৫,০০০ বর্গ মিটারের বাড়িটিতে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন রবীন্দ্রভারতী মিউজিয়াম। ঠাকুর বাড়িতে প্রতিভার অভাব ছিল না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাবা ছিলেন ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। তাঁর সম্পাদনায় তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা বের হতো এ-বাড়ি থেকেই। কবিগুরুর ভাইপো অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন বাঙালি চিত্রশিল্পীদের অগ্রজ। এঁরা সকলেই বাংলার নবজাগরণের (রেনেসাঁ) কীর্তিমান পুরুষ। মেয়েদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের বড় বোন সৌদামিনী দেবীর লেখার হাত ছিল অসাধারণ। এঁদের সকলের কীর্তির স্বাক্ষর বয়ে বেড়াচ্ছে ঠাকুর বাড়ি। প্রতি বছর এখানে ঘটা করে পালিত হয় বর্ষবরণ, পঁচিশে বৈশাখ আর বাইশে শ্রাবণ।
জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ি সপ্তার ৫দিন ১০টা থেকে ৫টা পর্যন্ত (সোম-শুক্র) দর্শকদের জন্যে উন্মুক্ত। শনিবারে খোলা থাকে ১টা পর্যন্ত। রবিবার বন্ধ। নিচতলায় টিকেট কেটে, সিঁড়ি ঘরের নিচের লকারে ক্যামেরা, মোবাইল, ব্যাগ এসব রেখে, জুতো খুলে তারপর যেতে হয় বাড়ির ওপর তলায়। রবীন্দ্রনাথের আঁতুড় ঘর থেকে শুরু করে যে ঘরে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন, সেটিও আছে সাজানো গোছানো। প্রতিটি ঘরেই টের পাওয়া যায় তাঁর উপস্থিতি। মোট ৪টি ভবনের ১৮টি গ্যালারি জুড়ে রবীন্দ্রভারতী মিউজিয়াম। মূল বাড়িটি আয়তাকার। দোতলায় উঠেই হাতের বাঁদিকে যে ঘরটি পড়ে সেটি ছিল রবীন্দ্রনাথের খাবার ঘর, তার সাথেই লাগোয়া মৃণালিনীর হেঁসেল। পাশে সঙ্গীতের ঘর, এর পর মহাপ্রয়াণের ঘর। ১৯৪১-এর ৩০ জুলাই মাসে এ ঘরেই কবিগুরু তাঁর শেষ কবিতা, ‘তোমার সৃষ্টির পথ’-এর ডিক্টেশন দিয়েছিলেন। এর মাত্র সাতদিন পর তিনি পাড়ি জমান না-ফেরার দেশে।
দুটি আর্ট গ্যালারিও রয়েছে এই ভবনে, একটি প্রাচ্য আর একটি পাশ্চাত্যের ধারার। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যামিনী রায়, নন্দলাল বসুসহ আরও অনেক নামকরা শিল্পীর আঁকা ছবি আছে এখানে। বাংলাদেশি কারো আঁকা ছবি থাকলে খুশি হতাম। নোবেল পুরস্কারের গ্যালারিটিও চমকপ্রদ। গীতাঞ্জলি ও নোবেল পুরস্কারের টুকরা-টাকরা গল্প ছাড়াও নাইটহুড বর্জনের কারণ বর্ণনা ইংরেজ সরকারকে লেখা পত্রের কপিটিও আছে এখানে।
সংগ্রহশালার সিঁড়ি
জাপান ও চীন সরকারের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত গ্যালারি দুটিও মনে রাখার মতো। মূল ভবনের পাশের ভবনটির নাম বিচিত্রা। ১৯৬০ সালের আগ পর্যন্ত এই ভবনটি ছিল বিশ্বভারতীর অংশ। বিচিত্রার দোতলায় ভিক্টোরিয়া হল, আর মৃণালিনী দেবীর ঘরটা ভালো লেগেছে, মৃণালিনী দেবীর কথা ভেবে। ভিক্টোরিয়া হলে শিলাইদহ কুঠিবাড়ির কিছু ছবি। রবীন্দ্রনাথ যে বোটে করে ঘুরে বেড়াতেন পদ্মায় সেই বোটের একটি চমত্কার প্রতিকৃতিও আছে এখানে, বাংলাদেশ সরকারের উপহার হিসেবে।
তিন তলায় মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ আর সারদা দেবীর ঘরসংসার। সারদা দেবী ছিলেন আমাদের যশোরের মেয়ে। ৮ বছর বয়সে তিনি ঠাকুরবাড়ি এসেছিলেন বউ হয়ে।
রকবাজি
আমার মনে হয় ঠাকুর বাড়ির দুজন দুঃখী মানুষের একজন সারদা আর অন্য জন মৃণালিনী। সারদা তো তবু নিজের নামটা নিয়ে বেঁচেছিলেন, মৃণালিনীর নামটিও বদলে দিয়েছিল ঠাকুর বাড়ি। খুলনার ফুলতলার বেনীমাধব রায় চৌধুরীর মেয়ে ভবতারিনী দেবী দশ বছর বয়সে যেদিন এ বাড়িতে বউ হয়ে এসেছিলেন তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স ছিল ২২। আটপৌরে ভবতারিনী নাম ঠাকুর বাড়িতে মানাবে কেন? রবীন্দ্রনাথের বড় দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথের পছন্দে তাঁর নতুন নাম হলো মৃণালিনী। এরপর যে ১৯ বছর তিনি বেঁচে ছিলেন, সেখানে তাঁর নিজস্ব ভূমিকার কথা খুব একটা জানা যায় না। সারদা দেবীর জীবন তাও মৃণালিনীর চেয়ে একটু ভালো ছিল, কর্তার দেখা খুব একটা না পেলেও সংসারের কর্তৃত্ব ছিল তাঁর। রবীন্দ্রভারতী মিউজিয়ামের লাইব্রেরিটিও সমৃদ্ধ নানান দুষ্প্রাপ্য বইয়ে। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জার্নাল এখানে নিয়মিত আসে। এখানে সানজিদা খাতুনের বই দেখে ভালো লাগল।
অন্দরমহল
ওপরে যেহেতু ছবি তোলা নিষেধ, ছবি তোলার জন্যে এলাম নিচতলার অন্দরমহলে। আয়তাকার উঠোনের একদিকে স্থায়ী মঞ্চ আর একদিকে পুজোর ঘর,পরবর্তী সময়ে এখানেই হতো ব্রাহ্মসমাজের সভা। মূল বাড়ির বাইরের দিকের একটি ভবনে আছে রবীন্দ্রনাথের ব্যবহূত একটি গাড়ি। গাড়িটির নম্বর WGF 91.
রবীন্দ্রনাথের গাড়ি
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই মিউজিয়ামের বিভিন্ন নিদর্শনের বর্ণনার জন্যে ব্যবহূত হয়ছে, ঠাকুর পরিবারেরই কারো না কারোর লেখা বা কবিতার অংশ।
পাঁচটায় বন্ধ হয়ে যায় ঠাকুর বাড়ির দরজা। বেরিয়ে আসতে মন চাইছিল না। রবীন্দ্রনাথের বাড়ির সবকিছুই মনে হয় কোনো না কোনোভাবে আমাদের চেনা জানা। এর কারণ খুঁজে পেলাম বেরিয়ে আসার সময় মূল প্রবেশদ্বারের পাশে লেখা পরিচয় কবিতার শেষ ক’টি লাইন দেখে :
সেতারেতে বাঁধিলাম তার, গাহিলাম আরবার, মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি তোমাদেরই লোক, আর কিছু নয়, এই হোক শেষ পরিচয়।
শেষ পরিচয়
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জুন, ২০১৫ ভোর ৫:২৭