বার্থ মরিস'র জীবন নিয়ে যখন পড়ছিলাম, আমার মনে হচ্ছিল যেন কোনও ক্লাসিক উপন্যাস থেকে উঠে আসা এক সাহসী তরুণী নায়িকার গল্প পড়ছি ! প্রতিভা এবং অবহেলা, জেদ আর মমতা, সবশেষে বিশ্বজয় আর বিস্মৃতি - সব মিলে এক তরুণী'র ইতিহাসের অংশ হয়ে যাওয়ার গল্প। যে ইতিহাস গড়ছিল ফ্রান্সের একদল ক্ষ্যাপাটে ছেলে-মেয়ের দল। 'ইম্প্রেশনিস্ট'দের কথা বলছি। প্রথাগত সব নিয়ম-কানুন ভেঙে তারা পৃথিবী'র চিত্রশিল্পের ধরণকে পাল্টে দিচ্ছিল চিরদিনের মত। ইম্প্রেশনিস্টদের নিয়ে লেখা এই সিরিজ-রচনায় আমাদের আজকের শিল্পী বার্থ মরিস' (Berthe Morisot)।['মরিস' উচ্চারণে 'স'-এর নিচে হসন্ত পড়বেন না, উচ্চারণটা হবে 'Moriso'র মত] এক সাহসী তরুণীর চোখে প্রাণবন্ত জীবনের কিছু ছবি দেখতে যাব আজ। ইম্প্রেশনিস্ট'দের আলো-ঝলমলে জগতে আপনাকে স্বাগতম !
বার্থ মরিস', গর্জিয়াস এবং ফ্যাশনেবল
বার্থ মরিস'র জন্ম ১৮৪১-এ, ফ্রান্সের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। সম্ভ্রান্ত পিতা-মাতা তাদের মেয়েকে নাচ-গান-আর্ট ইত্যাদি শেখাবেন - এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু একই সাথে আবার এটাও স্বাভাবিক যে, তারা নিশ্চয়ই আশা করবেন না তাদের মেয়ে একদিন নর্তকী বা পেইন্টার হয়ে জায়গায় জায়গায় চর্চা করে বেড়াবে। যাই হোক, মরিস' পরিবারের দুই মেয়ে - বার্থ আর এডমা'ও কিশোরী বয়সে অন্যান্যদের মতই ড্রয়িং ক্লাস করতে গেল। কিন্তু এই দু'বোনের ক্রমাগত দক্ষতা দেখে রীতিমত উদ্বিগ্ন হয়ে শেষমেষ তাদের ড্রয়িং-টিচার গিয়ে সতর্ক করলেন তাদের মা'কে, "আপনার মেয়েদের যে অবস্থা দেখছি, ভবিষ্যতে এদের পেইন্টার না হবার তো কোনও সম্ভাবনাই দেখা যায় না ! বুঝতে পারছেন এর মানে কী? এমন বুর্জোয়া ক্লাসের মেয়েদের জন্য এতো রীতিমত বৈপ্লবিক একটা কান্ড হবে!"
সৌভাগ্যের বিষয়, মাদাম মরিস' এসব নিয়ে খুব একটা টেনশন করতেন না। তিনি উল্টো মেয়েকে ডেকে বলেন, "লোকে যদি পছন্দ করে তাহলে মাঝে মধ্যে পেইন্টিং করাটা এমন কোন সমস্যা না, তার ওপর একটা-দুটা বেচা-বিক্রি যদি হয় তো মন্দ কী !" বাস্তবিক এই ফ্যামিলি সাপোর্ট তার শিল্পীজীবনে অনেক বড় একটা ব্যাপার ছিল। ছবি আঁকার সরঞ্জাম যোগাড় করার জন্য অন্য অনেক ইম্প্রেশনিস্টদের মত তাকে ছবি-বিক্রির টাকার উপর নির্ভর করতে হত না। এমনকী, তার মৃত্যুর পর দেখা গিয়েছিল তার অধিকাংশ ছবিই অবিক্রিত অবস্থায় তার স্টুডিওতেই রয়ে গিয়েছিল - ছবি বেচতে পারাটা তার জন্যে অত গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয় ছিল না। সে যাই হোক, দুই বোনের আঁকাআঁকি তাই চলতে থাকে। বিশ বছর বয়সে বার্থের সাথে বন্ধুত্ব হয় আর্টিস্ট Camille Corot-এর সাথে। করোট বয়সে ছিলেন সিনিয়র - এই দুই বোনকে তিনি ছবি আঁকার ব্যাপারে প্রচুর সহায়তা করেন, আর অনেক শিল্পীদের সাথেও তাদের পরিচিত করিয়ে দেন। মাত্র তেইশ বছর বয়সেই বার্থের দু'টা ল্যান্ডস্কেপ পেইন্টিং প্যারিসের সর্বোচ্চ স্যালন এক্সিবিশনের জন্যেও মনোনীত হয়ে যায়, আর সমালোচকদেরও প্রশংসা কুড়ায় !
এটুক পর্যন্ত সবটা স্বাভাবিক সুখের গল্প... কিন্তু ইম্প্রেশনিস্টদের গল্প তো এতটা সরলরৈখিক হওয়ার কথা না ! এবার তাহলে ঘটনা বলতে শুরু করি। বার্থ চাইলে তার আগের ক্যারিয়ার চালিয়ে যেতে পারতেন, হতে পারতেন সেই সময়ের একাডেমিক্যালি সফল পেইন্টার, কিন্তু তাহলে তো তার অমর হওয়া হত না - এই ২০১৩ সালে আমরা অনলাইনে তার জীবনী পড়তে বসতাম না! তিনি হারিয়ে যেতেন আরও অনেক 'একাডেমিক্যালি সফল' পেইন্টারের মাঝে ! ইতিহাস গড়ার জন্যেই হয়ত, তার সাথে সাক্ষাৎ হল এদুয়ার্দ মানে'র। মানে'র সাথে তার বন্ধুত্ব গাঢ় হতে থাকে। এর মাঝে মানে'র সাথে চলা একদল ক্ষ্যাপাটে শিল্পী'র সাথেও তার পরিচয় হতে থাকে; নামগুলো আপনাদের কারও কারও চেনা মনে হতে পারে - ক্লদ মনে', রেনোয়া', ফ্রেড বাযিল, কামিল পিসারো আর আরও কয়েকজন। এদের পেইন্টিংসের বিভিন্নতার প্রতি মরিস' আকৃষ্ট হয়ে পড়েন, আর অনুপ্রাণিত হয়ে আস্তে আস্তে গড়ে তুলতে থাকেন সম্পূর্ণ নিজস্ব এক স্টাইল ! কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হল, এদুয়ার্দ মানে' তার শিল্পীসত্তাকে কখনই তেমন বড় করে দেখেন নি ! মানে'র কাছে তিনি ছিলেন একজন বন্ধু আর ভাল একটা মডেলমাত্র ! [আপনারা আবার মানে' আর মনে'কে এক মানুষ ভাবতে যাবেন না !]
মানে'র অনেক ছবিতে মরিস'কে মডেল হিসেবে দেখা যায়, কিন্তু মানে'র দিক থেকে ব্যবহারটা তার জন্য ছিল বিশাল কষ্টের কারণ। এই বিষয়ে পরে তার নোটবুকে লেখা কয়েকটা লাইন পাওয়া যায়, 'I do not think any man would ever treat a woman as his equal, and it is all I ask because I know my worth.' অবহেলা'র প্রতি ক্ষোভটা তীব্র, তবু এর মাঝেও তার দৃঢ়তা'টা কত স্পষ্ট !
বার্থ মরিস'র পোর্ট্রেট - এদুয়ার্দ মানে'র আঁকা। এই পোর্ট্রেট নিয়ে পরবর্তীতে 'ডেইলি টেলিগ্রাফ'-এর আর্টিকেলে বলেছিল -'shows a young woman of shocking determination'। ছবির মেয়েটা কেমন সরাসরি পেইন্টারের দিকে তাকিয়ে আছে; যেন বোঝাতে চাইছে - তাকে ইগনোর করার কোনও উপায় নেই !
সবচেয়ে অন্তরঙ্গ বন্ধু মানে'র কাছে থেকে এই অবহেলা পাওয়ার পরও মরিস' দমে না গিয়ে বরং নতুন জেদে সৃষ্টি করে চললেন এক ভিন্ন ছবি'র জগৎ। পুরানো ট্রাডিশনাল স্টাইল ছেড়ে তিনি তখন ইম্প্রেশনিস্টদের কাতারে যোগ দিয়েছেন, আর ইম্প্রেশনিস্টদের মাঝেও তার ব্রাশ-স্ট্রোকগুলো যেন আরও অভিনব, আরও দৃঢ় এবং জোরালো !
সাদা রং'টার উপর মরিস' দেখালেন অপূর্ব নৈপুন্য ! যেকোনও রংকে উজ্জল করতে সাদা ব্যবহার হয়, কিন্তু সাদা'কে উজ্জ্বল করাটা অতটা সহজ না, যতটা সহজ-স্বাভাবিকতায় মরিস' করে যাচ্ছিলেন ! পোস্টের অধিকাংশ ছবিতেই দেখবেন পোশাকে সাদার দুর্দান্ত কম্পোজিশন।
এর আগে তার বোন এডমা বিয়ে করে ফেলার পর তার প্রতিক্রিয়া ছিল মিশ্র - 'I both envy and lament your fate.' বোনের সুখে আনন্দিত হলেও তার দুঃখ হচ্ছিল বোনের শিল্পীজীবনটা শেষ হয়ে যাচ্ছে বলে। কিন্তু বোনকে তিনি ধরে রাখছিলেন তার অসাধারণ সেন্সের কিছু পেইন্টিংসের মাধ্যমে~
সন্তানসহ এডমা। এক্সপ্রেশনের জন্য বিখ্যাত একটা ছবি।
আর এমন স্টাইলের পেইন্টিং-এর ফলে তিনি ক্রমাগত প্রতিষ্ঠিত শিল্পীসমাজের সমর্থন হারাচ্ছিলেন। শিল্পীরা এসব পেইন্টিং মোটেই পছন্দ করত না - দেখে মনে হত কেমন অসম্পূর্ণ ! নিখুঁত ফিনিশিং নেই, এলোপাথারি ব্রাশস্ট্রোক ! এ কেমন ধারা? আমার মনে হয়, সিরিজের এই পর্যায়ে এসে 'ইম্প্রেশনিজম' ভাবধারা'র কিছু বিষয় এখন শেয়ার করা দরকার। 'ইম্প্রেশনিজম' - কথাটার বরাবর শব্দার্থ বলাটা একটু ঝামেলার, তার চেয়ে দু'লাইনে ব্যাখ্যা করে বলি। আপনি কোনও একটা দৃশ্য দেখার পর যদি সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে ফেলেন, বা চোখ সরিয়ে নেন - আপনার চোখে ওই দৃশ্যটা হয়তো নিখুঁতভাবে থাকবে না, কিন্তু তার একটা প্রতিচ্ছবি রয়ে যাবে, একটা 'ইম্প্রেশন' থেকে যাবে ! এই ইম্প্রেশনটাই এই আন্দোলনের শিল্পী'রা এঁকে যাচ্ছিলেন, যে কারণে তাদের কোনও ছবি'র লোকগুলো পোজ দিয়ে বসে নেই, তাদের সবক'টা ছবি বিস্ময়করভাবে চলমান, তাদের ব্রাশের আঁচরে গতিশীল আলোর প্রতিফলন - পেইন্টিংসের ভেতরের মানুষগুলো কেউ 'ছবির মত' সুস্থির না ! তারা বাস্তবের মত চঞ্চল !
আর এই চির গতিশীল বাস্তব চারপাশটাকে তারা পুরোপুরি তুলে ধরতে চাইছিলেন ক্যানভাসে। ক্লদ মনে' বিস্ময়কর নিপুনতায় আঁকছিলেন প্রাকৃতিক পরিবেশ; নাগরিক মুড আর এক্সপ্রেশন নিয়ে রেনোয়া'র কাজগুলো তো চিত্রশিল্পের ইতিহাসেই অসাধারণ পর্যায়ের, দেগা ধরে রাখছিলেন চলমান ফিগার মুভমেন্ট, কর্মচঞ্চলতা আর ল্যান্ডস্কেপে পিসারো আর সিসলী, দৃষ্টিভঙ্গিতে কাইবট, রঙের গভীরতায় সেজান - সবাই মিলে যেন তাদের সময়টাকে আটকে রাখছিলেন ! কিন্তু জীবনের একটা বড় অংশ তো তবু বাকি থেকে গেল ! শিল্পীরা সব বাক্স-পেটরা বগলদাবা করে - ট্রেনে চেপে নৌকায় চড়ে চলে গেলেন জীবনের ছবি আঁকতে; অথচ সামাজিক মানুষের এক মহাগুরুত্বপূর্ণ পরিবেশ - ঘর এবং সংসার - আঁকার জন্যে কেউ ছিলেন না ! এই দুশ্চিন্তা থেকে রেহাই দিয়ে গেলেন মরিস' ! আমার ভাবতে অবাক লাগে, প্রত্যেকটা ভিন্ন ভিন্ন বিষয় নিয়ে পেইন্টিংস করার মত সতন্ত্র ট্যালেন্ট নিয়ে জন্মানো এই মানুষগুলো ঠিক একই সময়ে একই জায়গায় হয়েছিলেন কী করে? হয়তো ইতিহাস তৈরি হবার সার্থেই; যাই হোক - অন্যান্যদের মত পথে-ঘাটে ছুটে চলে যাওয়াটা সম্ভ্রান্ত ব্যাচেলর তরুণী মরিস'র জন্যে ছিল বাড়াবাড়ি পর্যায়ের। তারচেয়ে বরং তিনি নিপুনভাবে ক্যানভাসে জীবন দিতে লাগলেন গৃহস্থালী'র প্রতিটা মুহুর্তকে !
সকালে ঘুম-ভাঙা থেকে শুরু
একান্তে নিজেকে তৈরি করে নেয়া
টবের গাছগুলোর খেয়াল রাখাও জরুরী
তারপর বাগান থেকে চেরী নিয়ে আসা
ঘর গোছানো
এই ছবি'র নাম 'দি বাথ'। গোসলের আগে চুল-বেঁধে প্রস্তুতি
কাপড় শুকাতে দেয়া
দুপুরে একটু অবসর, বাগানে রিল্যাক্স মুডে
সময় থাকলে একটু সেলাই
বিকেলে একটু বেড়িয়ে আসা
আর বিশ্রাম...
মরিস'র ছবিতে মেয়েদের ট্যালেন্টকে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন বারবার। মেয়েদের প্রতি পুরুষদের অবহেলা'র আচরণ তার মনে স্থায়ী দাগ কেটে রেখেছিল, হয়তো বা তাই...
প্রতিটা ছবিতে কী সাহসী ব্রাশের কাজ, উদ্দাম আর উচ্ছল !
পরবর্তীতে মরিস' বিয়ে করেন শিল্পী এদুয়ার্দ মানে'র ছোট ভাই ইউজিন মানে'কে। ইউজিনের কাছ থেকে তাকে আর অবহেলা'র শিকার হতে হয়নি, বরং ইউজিন তার নিজের শিল্পী-ক্যারিয়ার একরকম ছেড়ে দিয়েই মরিস'কে সমর্থন দিয়ে গেছেন সবসময়। ইউজিন আর তাদের মেয়ে জুলি ছিল মরিস'র প্রেরণার উৎস। তার ছবিতেও পরিবার এসেছে সবসময়।
ঘরের ভেতর ইউজিন বসা। বাইরে মা-মেয়ে।
মা-মেয়ে।
একাডেমিক সমর্থন ছেড়ে আসলেও ইম্প্রেশনিস্টদের মাঝে এসেও মরিস' জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন ! ব্যাপারটা এখন অবিশ্বাস্য শোনাতে পারে, তার জীবদ্দশায় তিনি ক্লদ মনে', রেনোয়া', পিসারো'দের চেয়েও জনপ্রিয় আর সফল ছিলেন ! কিন্তু এমন ড্রামাটিক উত্থান-পতন যার জীবনে, তার শেষটাও কি ড্রামাটিক না হলে চলে? হঠাৎ এক গ্রীষ্মে আদরের মেয়েটা অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি সবকিছু ছেড়ে-ছুড়ে মেয়ের সঙ্গী হলেন, আর একসময় নিজেই ইনফেক্শনে আক্রান্ত হয়ে পড়লেন ! সেই অসুখ থেকে তার আর ওঠা হয়নি। সময়টা ১৮৯৫। এর পরবর্তী সময়ে মনে', রেনোয়া', পিসারো'রা এঁকে যেতে থাকেন একের পর এক মাস্টারপিস; সেজান, দেগা, সিসলী - তাদের পেইন্টিংসে চোখ ধাঁধিয়ে দিতে থাকেন দর্শকদের - আর একসময়ের তুখোড় প্রতিভাবান বার্থ মরিস' হারিয়ে যেতে থাকেন বিস্মৃতির চোরাবালিতে।
তবু একসময় ঝড়ের শেষ হয়, মানুষ বড় বটগাছটা ছেড়ে আস্তে আস্তে আশেপাশে তাকাতে শুরু করে। আর তেমনি প্রায় এক শতাব্দী পরে বেরিয়ে আসে ভুলে যেতে বসা এক অসাধারণ শিল্পীর কাজগুলো - মানুষ নতুন করে আবিস্কার করে একজন বার্থ মরিস'কে ~
যিনি ছিলেন এক সত্যিকারের বিপ্লবী মানসিকতার মানুষ,
যিনি শিল্পের খাতিরে সেচ্ছায় ছেড়ে এসেছিলেন একাডেমিক সফলতা,
যিনি শত বিরূপ পরিবেশ আর অবহেলা সত্ত্বেও আত্মবিশ্বাসে ছিলেন দৃঢ় আর অটল,
যিনি ইম্প্রেশনিজম আন্দোলনকে সমৃদ্ধ করেছিলেন তার নিজস্ব ক্ষেত্রের নিপুনতায়,
আর যিনি সম্পূর্ণ নিজস্ব স্টাইলে গড়ে গিয়েছিলেন - রং-ঝলমলে এক আলো'র পৃথিবী !