ফ্রান্স, উনিশ শতকের শেষার্ধ। বলা নেই, কওয়া নেই - একদম হঠাৎ করেই যেন কোত্থেকে এক ঝাঁক তরুণ-তরুণী এসে প্রথাগত আর্ট একাডেমি'র বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করে বসল; শুরু হল এক বিস্ময়কর অ্যাডভেঞ্চারের গল্প। আর হাতে-গোণা ওই ক'টা ছেলে-মেয়ে এত বেশি প্রতিভাবান ছিল যে, একদিন তারা বিশ্বের চিত্রশিল্পের ইতিহাসই পাল্টে দিল চিরদিনের মত ! 'ইম্প্রেশনিস্ট'-দের কথা বলছি ! মনে', রেনোয়া', দেগা', পিসারো, সেজান... - প্রত্যেকে একত্রিত হচ্ছিলেন পুরো বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয়ার জন্য ! চিন্তাধারা'য় সবার মাঝে মিল ছিল, কিন্তু কাজের ধারায় প্রত্যেকে ছিলেন পুরোপুরি ইউনিক আর অসাধারণ পর্যায়ের ! এদের মাঝে একজন ছিলেন খুব অন্যরকম; প্রতিভার কমতি ছিল না, কিন্তু কেন জানি খুব বেশি অপরিচিত; ইম্প্রেশনিজমের এক অপরিহার্য চরিত্র, কিন্তু ইম্প্রেশনিস্টদের নাম নিতে গেলে তার কথা তেমন মনেই আসে না - তিনি ফ্রান্সের ধনকুবের শিল্পী গুস্তাভ কাইবট (Gustave Caillebotte)। শুধু ইম্প্রেশনিজমের সময়ের না, কাইবট'এর দেখার চোখ ছিল অন্য যেকোনও সময়ের শিল্পীদের থেকে একদমই আলাদা ! তার ছবি'র গল্পটা শোনার পর আপনি নিজেও হয়তো চেনা-পরিচিত পৃথিবীটাকে একদম নতুনভাবে আবিস্কার করতে পারেন ! অতএব, প্রস্তুত হয়ে বসুন - আজকে আমরা কাইবটের চোখে এক পৃথিবী দেখতে যাচ্ছি !
সেল্ফ পোর্ট্রেট, কাইবট'
ইম্প্রেশনিস্টদের নিয়ে কথা বলতে গেলে কাইবট'এর নামটা প্রথমদিকে আসে না, অনেকসময় মাঝামাঝিও আসে না। প্রতিভার তুলনায় তার পরিচিতি কেন যেন বাড়াবাড়ি রকমের অল্প। আমি নিজেও স্বীকার করছি, ইম্প্রেশনিস্ট'দের চেনার পরও অনেকদিন পর্যন্ত কাইবট'এর ছবিগুলোতে আমার তেমন আগ্রহ-মনোযোগ ছিল না। কিন্তু এই সিরিজ লেখার সময় আরেকটু বিস্তারিত স্টাডি করতে গিয়ে কাইবট'এর ছবির দৃষ্টিকোণ দেখে আমি রীতিমত অবাক এবং মুগ্ধ হচ্ছিলাম ! আর বুঝতে পারছিলাম - আর্ট ক্রিটিক Ernest Chesneau কেন তাকে বলেছিলেন "Lover of Strange Perspective"! বুঝতে পারছিলাম এই শিল্পীটা খুব আলাদা।
ইজেল-সহ সেল্ফ পোর্ট্রেট, কাইবট'
গুস্তাভ কাইবট। সূচনায় তাকে পরিচিত করিয়ে দিলাম 'ধনকুবের শিল্পী গুস্তাভ কাইবট' নামে, কারণ ব্যাপারটা ইম্প্রেশনিস্টদের মধ্যে ছিল বড় রকমের ব্যতিক্রম। মনে'র বাবা ছিল মুদি'র দোকানদার, রেনোয়া'র বাবা দর্জি, দেগা বা বাযিল মোটামুটি সচ্ছল পরিবার থেকে আসলেও একেবারে বিত্তশালী বলার মত ছিলেন না। সেদিক থেকে কাইবট'দের ছিল অঢেল সম্পত্তি ! তাই বলে বাপের টাকায় তিনি উচ্ছন্নে যান নি। উইকিপিডিয়া'র সূত্রে নিশ্চিত হলাম, কাইবট ডিগ্রিধারী ল'ইয়ার ছিলেন, আবার একই সাথে ইন্জিনিয়ার'ও ছিলেন, ফ্রাঙ্ক-প্রুশিয়া'র যুদ্ধে তিনি সৈনিক হিসেবেও যোগ দিয়েছিলেন - আর এসব করা হয়ে গেছে যখন তার বয়স সবে একুশ বছর ! যুদ্ধশেষে ফিরে এসে কাইবট'কে পেইন্টিং-এর নেশায় পেয়ে বসে, তাই এবার তিনি গেলেন আর্টিস্টদের পীঠস্থান École des Beaux-Arts (স্কুল অফ ফাইন আর্টস)-এ। তবে স্বভাবসুলভ কারণেই (অন্যান্য ইম্প্রেশনিস্টদের মতই) ওই একাডেমিক আর্টে তিনি বেশিদিন স্থায়ী হলেন না। তারচে বরং ইম্প্রেশনিস্ট'দের প্রাণবন্ত পেইন্টিংস তাকে আকৃষ্ট করল। কাইবট' একে তো এই ধাঁচের আর্টের প্রতি আগ্রহী, তার উপর টাকা-পয়সা'র চিন্তাভাবনা নেই - সবমিলিয়ে একটা ভাল সম্ভাবনা আঁচ করতে পেরে এদগার দেগা তাকে নিয়ে গেলেন ইম্প্রেশনিস্টদের গ্যাং-এ ! ফলাফল হল অভাবিত !
সেই সময়ের ফ্রান্সে প্রতিষ্ঠিত আর্টিস্ট হওয়ার প্রধান ধাপ ছিল একাডেমি আয়োজিত 'স্যালন এক্সিবিশনে' অংশ নেয়া। শত শত নতুন-পুরাতন শিল্পী'র হাজার হাজার পেইন্টিংস প্রদর্শিত হত প্রতিবারের এক্সিবিশনে। তবে, সমস্যা হল - এক্সিবিশনে মনোনীত করার জন্য যে বিচারক বা জুরি'রা, তারা সবাই ছিলেন পুরোপুরি ক্লাসিক্যাল মন-মানসিকতার ! ফলে বছরের পর বছর ধরে ইম্প্রেশনিস্টদের মত 'অবাধ্য' 'অসংস্কৃত' শিল্পীদের পেইন্টিং রিজেক্ট করা হচ্ছিল, আর স্বাভাবিকভাবেই শিল্পীরাও ছিলেন একাডেমি'র উপর মহাক্ষ্যাপা ! এসব প্রত্যাখ্যাত শিল্পী'রা পরে নিজেদের একদম আলাদা একটা এক্সিবিশনের বন্দোবস্থ করে বসলেন, আর এ থেকেই মূলত শুরু হয় 'ইম্প্রেশনিজম' আন্দোলন। কিন্তু এই আন্দোলন শুরু'র আগে অনেক চটকদার ঘটনাপ্রবাহ আছে। ওসব নিয়ে আরেকদিন বিস্তারিত বলব, আজকে সংক্ষেপে বললাম শুধু কাইবট'এর ভূমিকার কথা বলার জন্য।
ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পীরা বেশিরভাগই ছিলেন অর্থনৈতিক টানা-পোড়েনের মধ্যে; ছবি আঁকার সরঞ্জামই সবসময় যোগাড় হয় না - এর মাঝে গ্যালারী ভাড়া নিয়ে এক্সিবিশন আয়োজন করাটা যে কী পরিমাণ ঝামেলা'র ব্যাপার ছিল বোঝাই যাচ্ছে ! এর মধ্যে আর্টের নেশায় পেয়ে বসা কাইবট' হয়ে আসলেন দাতা হাতেম তাই'র অবতার হয়ে ! ১৮৭৬ সালে দ্বিতীয় 'ইম্প্রেশনিস্ট এক্সিবিশন' থেকে তিনি অংশ নেয়া তো শুরু করলেনই, সেই সাথে ওই বছরই তিনি একটা উইল পর্যন্ত করে বসলেন - "তিনি যদি হুট করে মরে-টরে যান, তাহলেও ইম্প্রেশনিস্টদের পরবর্তী এক্সিবিশনের সমস্ত খরচ বহন করা হবে তার সম্পত্তি থেকে" ! তার বয়স তখন সাতাশ কী আটাশ, হুট করে মরে যাওয়ার মত কোনও ঘটনা ঘটেনি, তাই তিনি নিজেই পরবর্তী বছরের আয়োজন, অংশগ্রহন, তদারকী সব করে গেছেন হৃদয় দিয়ে।
এ তো গেল ব্যক্তি কাইবট'এর গল্প, এবার আমরা চলে যাই শিল্পী কাইবট'কে দেখতে। পোস্টের আসল উদ্দেশ্য অবশ্যই সেটাই। ১৮৭৪-এ কাইবট'এর বাবা মারা গেলে তিনি বিশাল সম্পদের উত্তরাধিকার হন। তখনই এক সময় তিনি তার ঘরে নিজস্ব আর্ট স্টুডিও তৈরি'র কাজে হাত দেন, আর ওই কাজ চলাকালীন সময়ে - ওই সংস্কার কাজটাকে বিষয়বস্তু করেই কাইবট' এঁকে ফেললেন তার মাস্টারপিস এই ছবিটা ~
ইম্প্রেশনিস্টদের এক্সিবিশনে কাইবট'এর প্রথম অংশগ্রহনে এই ছবিটা ছিল; আর ছবিটা শুরুতেই এর বিষয়গুণে সবাইকে কেমন থতমত করে দিল ! ইম্প্রেশনিস্ট'রা শুরু থেকেই ক্লাসিক্যাল বিষয় ছেড়ে সরল-সাধারণ মানুষের জীবন আঁকতে শুরু করেছিলেন, মনে'র ছবিতে সাগরসৈকতে'র মানুষ, পিসারো'র তুলিতে গ্রামের পরিশ্রমী কৃষক, রেনোয়া'র ছবিতে উদ্দাম তারুণ্যে ভরা সব লোকজন - কিন্তু কেন যেন এর আগে কেউই শহুরে শ্রমিকদের নিয়ে কিছু আঁকেন নি ! কর্মচঞ্চলতা বোঝাতে সবাই ছুটে গেছেন মাটির কাছে, সাগরে সংগ্রাম করা মাঝিদের কাছে - অথচ চোখের সামনে যারা সংগ্রাম করে শহর গড়ে যাচ্ছে, তাদের দিকে চোখ গেল না কারও?
কাইবট' শুধু যে কর্মীদের আঁকলেন তাই নয়, সেই সময়ে দ্রুত পরিবর্তনশীল প্যারিসের বুর্জোয়া'দের মুড'ও তুলে ধরতে লাগলেন।
এই ব্রিজের নীচে ছিল ট্রেন-লাইন। প্যারিসে ট্রেন তখন সবে নতুন। পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় মহিলাটার দিকে এক বুর্জোয়া'র ছোঁক-ছোঁক করা দৃষ্টি অথবা রেলিং-এ হাত দেয়া উদাস এক শ্রমজীবি মানুষ - নতুন দিনের প্যারিসের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের চরিত্র যেন ধরা পড়ছিল (এই জিনিস অবশ্য রেনোয়া'র ছবিতে আরও অনেক বেশি নিখুঁত এবং বিস্তারিত। রেনোয়া'কে নিয়ে পোস্টে ওসব বলার ইচ্ছা থাকল)। তবে কাইবট'এর ছবিতে যে জিনিস'টা স্পেশালিটি নিয়ে আসলো, তা হল তার দৃশ্য দেখার অ্যাঙ্গেল। নিচের ছবিটা দেখুন~
রাস্তার মোড়ের এই ছবিটা স্বাভাবিক অবস্থায় যেমন দেখা যায়, কাইবট'এর ইচ্ছা হল এর চেয়ে ভিন্নভাবে দেখার। এমন কোনও উপায়ে, যেন মোড়'টার বিশালত্ব ফুটে উঠে স্পষ্টভাবে ! একারণে কাইবট' বসে পড়লেন ! বোঝা গেল না? মোড়ের এককোণে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখলে যেমন দেখায়, ঠিক ওই পজিশনে যদি আপনি দাঁড়িয়ে না থেকে বসে পড়েন, তাহলে দেখবেন অন্য একটা ভিউ, সামনের রাস্তাটা মনে হবে আরেকটু বিস্তৃত, দালানটা মনে হবে আরেকটু বিশালাকার ! এবং কিভাবে বসবেন তার উপর নির্ভর করবে আপনি দৃশ্যটা কেমন দেখবেন ! দৃশ্যে চলে আসলো "কাইবট' ইফেক্ট" !
কাইবট' তার জানালা থেকেও আঁকতে লাগলেন এমন সব ছবি। দাঁড়িয়ে আছেন নাকি বসে, কাছে আছেন নাকি দূরে - শুধুমাত্র এসবের উপর ভিত্তি করেই আপনি একটা দৃশ্যেরই অনেকগুলো ভিউ পেয়ে যাবেন, আর প্রত্যেকটাই ইউনিক, আপনাকে নতুন জিনিস দেখাবে ! এ ছবিগুলো নিয়ে আর্ট-ক্রিটিক Edmond Duranty বলেছিলেন:
“Depending on whether we are close to the window or further away from it, and depending on whether we are sitting or standing, the frame cuts up the scene in the most unexpected, ever-changing way, creating continual diversion as well as something unhoped for – the enourmous charm of reality”
(Impressionist Masterpieces : Edmond Duranty)
আর নিচের ছবি'টা নিয়ে কী বলা যায় বলুন তো?
বারান্দা থেকে তাকিয়ে দেখা নিচের রাস্তার ছবি। কিন্তু এমন অস্বাভাবিক অ্যাঙ্গেল থেকে আঁকার কথা কে ভাবতে যাবে? কাইবট যেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাচ্ছেন, ছবি আঁকার জন্যে কোনও নির্দিষ্ট ফ্রেম বা বিষয়ের দরকার নেই, যতদিকে চোখ তুলে তাকানো যায়, তত দিক নিয়েই ছবি এঁকে ফেলা যায় ! এই সমস্ত পাগলাটে লোককে যে 'একাডেমি অফ ফাইন আর্টস' বুঝতে পারে নি - এতে আর অস্বাভাবিক কী আছে? কোনও সুনির্দিষ্ট থিম ছাড়া, গল্প ছাড়া এমনকী নির্দিষ্ট অ্যাঙ্গেল ছাড়া যেকোনও এক দিক থেকে ছবি এঁকে ফেলা - এসব তো তখনও কেউ ভাবতেও প্রস্তুত ছিল না ! এগুলো যে নতুন সময়ের শিল্প, দেখে মনে হয় নতুন এক পৃথিবী'র শিল্প !
পার্স্পেক্টিভ বা দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এই নিরীক্ষা কাইবট অনেকক্ষেত্রেই করে গেছেন। দুইটা ভিন্ন ভিউ থেকে 'রু হ্যালভি'র ছবিদুটাও দেখতে পারেন~
এসব ছাড়াও পোর্ট্রেট-ল্যান্ডস্কেপেও স্বাভাবিকভাবেই তিনি ছিলেন পারদর্শী আর ভালরকম স্টাইলিশ।
ট্যালেন্ট নিয়ে কখনও সন্দেহ ছিল না, তারপরও ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পীদের মধ্যে কাইবট' কেন জানি মোটেও আলোচিত কেউ না। জনপ্রিয় কেউ না হলেও কাইবট' অবশ্যই এ আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ একজন চরিত্র। কাইবট' হয়তো আমাদের নতুন জিনিস দেখিয়ে যাননি, কিন্তু পুরানো জিনিসই দেখতে শিখিয়ে গেছেন নতুনভাবে ! অন্য দৃষ্টিতে ! তার গ্রুপের অন্যান্য শিল্পীদের মতই, তবে নিজস্ব স্টাইলে। এই গ্রুপের লোকগুলো'র কাজই যেন ছিল এটা। পৌরাণিক পৃথিবীর গল্প বাদ দিয়ে তারা তাদের ঝলমলে বাস্তব পৃথিবীটাকে যেন পুরোপুরি ধরে রাখতে চাইছিলেন ক্যানভাসে। এই সিরিজের সাথে চলতে থাকলে দেখতে থাকবেন - মনে' বিস্ময়কর প্রাকৃতিক ডিটেইলসে, রেনোয়া' মুড আর এক্সপ্রেশনে, পিসারো ল্যান্ডস্কেপে, দেগা ফিগার মুভমেন্টে,, সেজান ঘনত্ব আর গভীরতায়, বাযিল বাস্তব আব-হাওয়া সৃষ্টিতে, স্যুরা রং-বর্ণালী'র জাদুতে, কাইবট' তার দৃষ্টিকোণে - সবটা মিলে যেন তাদের সময়টাকে পুরোপুরি বেঁধে রাখছিলেন ! এমনকী যে জিনিস সাধারণ-স্বাভাবিক চোখ দেখে না, তারা যেন খুঁজে-পেতে ঠিক সেসব জিনিসই দেখানোর পণ করেছিলেন। কারণ তারা ছিলেন অন্য জাতের মানুষজন।
তারা ছিলেন 'ইম্প্রেশনিস্ট' !