একাদশীর রাত। শ্রাবণের রাত হলেও আকাশটা সাংঘাতিক পরিস্কার, দূরান্তেও কোনও মেঘ দেখা যাচ্ছে না। উদাস বাউল তার প্রয়োজনীয় পানীয়টুকু গলায় ঢেলে কুঁড়েঘরের ওই একচিলতে মাটির বারান্দায় এসে বসল দোতরা হাতে। সবুজও বসেছে তার পাশে, অনিম খানিকটা দূরে।
জল-মেশানো পানীয় সামান্য গিলেও সবুজ এর মাঝে মাতলামি করতে শুরু করল, 'উদাস'দা? সকাল হয়ে গেল নাকি? ওইটা কী, সূর্য না?'
- 'না গো বাবু। এ হল জোছনার রোদ্দুর', উদাসের কথায় ঘোর থাকলেও কন্ঠ পরিস্কার, নেশা টের পাওয়া যায়না তেমন।
- 'জোছনা?' সবুজ চোখ কচলে তাকায়, 'চাঁদের এত্ত আলো? আমাদের শহরে তো এই বেটি আলো-ই দিতে চায় না! সব আলো তো শালী এখানে দিয়ে দিল!'
অনিমও অনেকক্ষণ ধরে সোনাডাঙার বিলের দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে। বিলের পানিতে প্রতিফলিত আরেক চাঁদের উপস্থিতিতে জোছনার মাতম উঠেছে। দূরে বনের উপর চাঁদের হাট বসেছে যেন।
সবুজ অনিমের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলল, 'দেখলি দোস্ত, এইটারে বলে পরিবেশ; প্রাকৃতিক পরিবেশ। টাউনের মানুষগুলা নিজেরাই এর বারোটা বাজাইছি, তারপর এখন হায়-হায় করি - 'পরিবেশ গেলো, পরিবেশ গেলো !' হিপোক্র্যাটের দল', সবুজকে আজ কথায় পেয়েছে, 'আর দোস্ত পাবলিকরে ছাড়, তোর ওই কবি বন্ধুগুলা এই জিনিস দেখে নাই জীবনে? সবকটা কবিতায় পড়ি - বিষাক্ত সময়, দূর্বিষহ জীবন, কাঁটাতার, ছাড়পোকা, আর, আর বল না....কুরে কুরে খাওয়া সমাজ, নিস্পেষিত যৌবন...শালার কবিতা পড়লে ইচ্ছা হয় গলায় দড়ি দিই। একটা কেউ লিখল না বিলের জলে জোছনা দেখার জন্যে বেঁচে থাকা যায়?'
শব্দ করে হেসে উঠল উদাস, 'বাবু কঠিন কথা বলেচে। গুরুতর কথা...'
অনিমও হাসল। সে নেশা করেনি। একটু সময় নিয়ে জবাব দিল, 'লিখবে না কেন বল? হয়তো অনেক কবিই প্রতিদিন এসব কবিতাও লিখে এমন পাড়াগাঁয়ে। তবে বই-পত্রিকায় বেশি ইনভলভ্ড নগরবাসী কবি আর কবিতারা। পাঠকও ওই শ্রেণীরই বেশি। জানি না, ওরা জানে কিনা, পল্লীর এই মায়া। এত স্নিগ্ধতা, ওই সাঁঝের বাতি...'
'ভাই হাত-জোড় করছি, লেকচার শুরু করিস না', সবুজের কন্ঠ নেশায় করুণ, 'উদাসদা, গান ধরো না?'
উদাস তালে তালে দুলছিল, চোখ বন্ধ রেখেই বলল, 'এই দুনিয়ায় আজও অনেক আলো, বাবু। মানুষ নিজেই আঁধার টেনে আনে। আঁধারকে ভালোবেসে। তারপর কাব্য বানায় - এত্ত আঁধার কেনে চারপাশে?'
অনিম বলে উঠল, 'চমৎকার!'
সবুজ কাতরে উঠল, 'দাদা, তুমিও লেকচার...'
উদাস বলেই চলেছে, 'বাবু, একটা সাদা কাগোজের মাঝে কালো একটা ফোঁটা আঁকো? তারপর কাওকে জিজ্ঞাস করো, কী দেখছো? কেউ বলবে না - সাদা কাগোজ দেখছি, সবাই বলবে - দেখছি একটা কালো ফোঁটা!'
অনিম হাত নেড়ে বলল, 'গভীর কথা বললে বাউল... এত্ত দারুণ !'
সবুজ নেশায় কেঁদে দেবে যেন, 'দোহাই লাগে দাদা আমার...গান শোনাও?'
উদাসের গানের গলা প্রচন্ড কর্কশ। তবু যখন গলা চড়িয়ে গায়, অন্য একটা আবেশ তৈরি হয়। বেসুরেই একটা সুর জেগে ওঠে। দুপুরে দীঘির ঘাটে ওরা উদাসের গান শুনেছিল। কিন্তু এখন এই পরিবেশে, তারা আর জোনাকীর মহাসমাবেশে, বাতাস আর বুনোফুলের স্নিগ্ধতার বাড়াবাড়ি উৎপাতে, উদাসের দোতরা আর কন্ঠে অনিমও কেমন বিনা-মদে নেশাগ্রস্থ হয়ে গেল! উদাস দোতরায় খানিক সুর তুলে গলা চড়ালো,
"ও সাঁই, এত্ত আলোয় মানুষকে ঠাঁই দিলেই যদি তুমি
তবে দুই চোখে তার এত্ত আধাঁর কে ছড়ালো বলো?
অমন ব্যস্ত সারা শহর-পাড়া জীবনপথে ঘুরে
আমি জানি আমায় কে বাসে আর কে বাসেনা ভালো"
সবুজ চিৎকার করে উঠল, 'গুরু এই গান তুমি এখন বাঁধলে? এই এখন এখানে বসে বানালে গুরু?'
উদাস হালকা হাসে, 'হ, বাবু।'
তার দোতরায় তখনও মাতাল করা সুর উঠছে। এ সুর যেন এই রাতের প্রকৃতিরই একটা অংশ। আলাদা কিছু নয়।
অনিমকে ওরা খেয়াল করেনি। সবটা মিলে অনিম নিজেও কেমন ভীষণ একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেছে তখন। সে বাউলের সুরে গাইতে পারল না, দূরে থেকে চিৎকার করে আবৃত্তি করে উঠল,
"ও সাঁই, কাব্য যদি আমার হাতেই লিখিয়ে তুমি নিলে
তবে আমায় এমন কষ্ট দিলে, কষ্ট দিলে কেন?
তোমার প্রেমিক-চোখে জল না দেখে ঘুম আসে না রাতের?
তোমার এত্ত খেয়াল - মন বানালে এমন এলোমেলো!"
সবুজ ঘুরে তাকালো, 'এ আবার কোন গুরু... ... ...অনিম? দোস্ত তুই? দোস্ত তুই গাইছিস? আহা, সাঁই গো, তোমার এত্ত খেয়াল - মন বানালে এমন এলোমেলো !' সবুজের চোখ সত্যি পানি এসে গেল, ' বলো বন্ধু, আরও বলো...'
উদাস প্রথমে মুগ্ধতায় স্তব্ধ হয়ে গেলেও সবুজের কথায় সম্বিত ফিরে পেয়ে সে দোতরায় আরও জোরে আঙুল চালালো। জগৎ-সংসার এখন উদাসের বারান্দায় কেন্দ্রীভূত। অনিম যেন অন্য পৃথিবী থেকে গেয়ে চলল,
"অমন বাতাস এসে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল তারা,
অমন মেঘের উপর আকাশ ছুটে, চাঁদ দিলো ইশারা-
দূরে বনের উপর জোছনা ভাঙে, নদী দিশেহারা
ওসব আমার একা আমার শুধুই দেখার'ই দায় ছিলো?"
জলজ বিল পেরিয়ে দক্ষিণে বেড়িবাঁধের ওপার থেকে হু-হু করে প্রচন্ড বাতাস আসতে লাগল, ক্ষেতের আ'লে কচি ঘাসগুলো এতে মাথা নুইয়ে সায় জানাল। পশ্চিমের বন থেকে নাম-না-জানা কত্তরকম ফুলের ঘ্রাণ এসে একটা অস্থির মহাক্ষণ তৈরি'র পাঁয়তারা করতে লাগল যেন। জোছনার তীব্রতাও যেন ক্রমেই বাড়ছে। আর তিনটা পরস্পরবিচ্ছিন্ন মানুষ যেন একাকার হয়ে কোন অসীমের সন্ধানে নেমে খুব কাছে পৌঁছে যাচ্ছিল!
এই পৃথিবীর এত্ত মোহ, এত্ত মায়া! চাঁদের রোদে পুড়ে তিনটা পাগল বুঝতে পারে, আমরা যারা জীবনকে দূর্বিষহ মনে করি, তারা শুধু বোকামি করি না, পাপ-ও করি।
জীবনটা এরপর কোথায় নিয়ে যাবে কাকে, এসব নিয়ে আর দুশ্চিন্তা করতে ইচ্ছা হয় না।
'যেখানে ইচ্ছা নিয়ে যাক, আই ডোন্ট কেয়ার!' মাতালের মত চিৎকার করে অনিম হেসে ওঠে,
"আমায় কই নেবে, কই নেবে গো সাঁই, কোথায় তোমার খুশি?
আমি পথকে আমার ঘর বানাবো, যা ইচ্ছে তাই করো !
তোমার এত্ত খেয়াল-খুশি, তুমি যা ইচ্ছে তাই করো !"
উদাস অপার বিষ্ময়ে এই আধপাগলাটে, শহুরে অথচ ভীষনরকম বাউল ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রইল ! তুমি কে গো কবি? কোন হারাধন?
উদাসের ঘোর কাটে না। যে ছেলে মনে এমন বাউল হয়েছে, আর কারও যে সাধ্যি নেই তাকে বেঁধে রাখে! ফিসফিস করে উদাস শুধু বলল, 'বাবু গো, যাত্রা সবে শুরু হল তোমার। এ পথ বড় জ্বালার। তুমি পথ ছাড়তে চাইলেও পথ যে তোমায় ছাড়বে না...'
পথ ছাড়ার প্রশ্ন অনেক পরে। যাত্রা তো সবে শুরু।
(এই চ্যাপ্টারে ব্যবহৃত সব গীতিকাব্যও এই লেখকের লেখা)