কোনও একটা বদ্ধ ঘর থেকেও শুধু জায়াগামত একটা ছোট জানালা থাকলেই তা দিয়ে দিগন্ত পর্যন্ত আকাশটা দেখে ফেলা যায় ! অতএব, মানুষ কেন নিজের সীমাবদ্ধতা'র মাঝে থেকেও অসীমের সন্ধানে আগ্রহী হবে না??
--- শাহেদ খান
*******************************************************************
শাহেদ এবার ভাবছে সবার সৃষ্টি হবার তত্ত্ব কী?
ধর্মের জালে আটকা সকল মন-ভোলানো নর্তকী।
সমান মানুষ ভিন্ন সেজে, মানছো আপন কোরান-বেদ
সাঁই বা গোসাঁই, যাই ডাকি তা-ই, ফল একটাই - এ কোন ভেদ?
সব ধর্মের সব খোদার'ই বিচারবেলায় পক্ষপাত :
পুড়বে সকল বিধর্মীরা - মন্দ-ভাল'র নাই তফাৎ !
শাহেদ ভাবে, লক্ষ্য যদি হয় শুধু এই শেষ বিচার,
কিসের তরে ঘর-বাঁধা আর ভালবাসা'র এ সংসার?
বিনোদিনী বলে, 'জগৎ প্রেমের তরেই মন্দ কী?
কিসের লোভে রাখছো জীবন রোজ-হাশরের বন্ধকী?'
গুরু খেপেন, 'অবিশ্বাসীর জবানে ঘোর অভিশাপ !
যাহেরী হোক, বাতেনী হোক - সব কথার হবে হিসাব !'
বিনোদিনী হাসে, 'গুরু প্রেমের কথায় খেপছো, না?
নিজে তুমি হুরের প্রেমে হওনি আশেক-দিওয়ানা?'
'কানু বিনে গীত নাই তোর, অলক্ষী হারামজাদী?'
চোখ টিপে কয় বিনোদিনী, 'সাধে কি আর চুল বাঁধি?'
তর্ক দেখে পালায় শাহেদ, অর্ক থাকে সমুজ্জ্বল;
'কার তরে এই আমি' - আমার আটকা পড়া প্রশ্নদল।
মহান সাধক বলেন, 'মনের সলতে জেলে দীপ বানা'
লক্ষ্য কী তা-য়? সাধক সুধায়, 'হাসিল হবে নিব্বানা'
মন বলে, 'এই বেশ তত্ত্ব, সৃষ্টি মাঝেই স্রষ্টা খোঁজ্
নিজের ঘরে না খুঁজে তোর বাইরে কিসের তালাশ রোজ?
'আনাল হক' বা 'নর-নারায়ন' - নিজের মাঝেই সব জানি,
যতই কাঁদিস, 'এলি এলি' বা 'লামা শাবাক্তানি'
সব মানুষেই তাঁর আশ্রয়, সব ক'টা মন সাঁইয়ের ঘর;
মানুষ হয়েই কোন হিসেবে বিভেদ করিস আপন-পর?
পর'কে নিজেই পর করে দিস, ঘর বাঁধা স্রেফ অজুহাত
ঘরের চোরেই লুটবে কবে, টের পাবি না অকস্মাৎ !
চৌদ্দতলার জমিদারী নিজের হাতেই - রুখবে কে?'
'তত্ত্ব সবার জানা উচিৎ' - শাহেদ ভাবে উদ্বেগে।
মন হেসে কয়, 'আস্তে পাগল, সত্য সবার সমান নয়;
আতকা আরোপ করতে গেলে নিজেই করবি সত্যক্ষয় !
বাউল হইতে ব্লগ লাগে না, স্বধর্ম প্রচারবিমুখ;
নিজের ভিতর ডুব মেরে দেখ, বুঝবি পাগল কত্ত সুখ !'
মোক্ষ তবে সুখ নাকি প্রেম? হাশর নাকি নির্বানা?
নাস্তিক ডাকে, 'যুক্তি মানো, অন্ধের দলে ভিড়বা না'
কালের ফেরে স্টেশন আসে, কেউ ওঠে, কেউ নামতে চায়
মহাকালের তত্ত্ববোঝাই মালগাড়িটা ছুটেই যায় !
যেখান থেকে যাত্রা শুরু, শেষেও আমি সেইখানেই
এত্ত সাধের জীবনটা কার? - আদিমতম প্রশ্ন সেই ~
কিসের তরে বাঁধছি এ ঘর? সাধছি আমার মন-দেহ?
কার তরে এই আমি আমার তাতেই বড় সন্দেহ !
কোত্থেকে এক মাতাল ফকির এক চোখ মেলে তত্ত্ব দেয়,
'ভাল-য় যদি না পাস খুঁজে, সন্ধানী তুই মন্দে হ !'
টীকা-টিপ্পনী:
সাঁই বা গোসাঁই - বাংলা'র নিবিড়তম আধ্যাত্মিক লোকসংস্কৃতির বাহক আউল আর বাউলেরা। আউলদের (ইসলামী সুফীবাদ/আউলিয়ানা ঘরাণা'র) মোক্ষ ছিল দয়াল সাঁই-এর তত্ত্ব-তালাশ। অন্যদিকে বাউলদের (সনাতন আধ্যাত্মবাদ/বাউলিয়ানা) ক্ষেত্রে ছিল তা গোসাঁইয়ের অনুসন্ধান। নামে ভিন্ন হলেও থিম যে অভিন্ন ছিল এ বিষয়ে তাঁরাও ছিলেন সচেতন ও একমত। তাই ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার কাছে ছিলেন তাঁরা সমান আপন, সমান শ্রূদ্ধার গুরুজন। তঁদের প্রতি এই কবির শ্রদ্ধাঞ্জলী রইল।
নিব্বানা - পালি ভাষা'র শব্দ। সংস্কৃত বা বাংলা প্রতিশব্দ হল 'নির্বানা'। বোধিসত্ত'র মূল হল, জরা-জীর্ণতা-রোগ-শোক-সন্তাপ'হীন জীবনের সন্ধান মানুষ এই মর্ত্যেই পেতে পারে যদি সে মনের অন্তঃস্থল আলোকিত করতে পারে। সমস্ত জাগতিক মোহ ও স্বার্থের উপর উঠে গিয়ে মানুষ লাভ করতে পারে নির্বানা। Osho-র ভাষায়:
It is a state of non-being, what Buddha called ‘nirvana'.
মানবমুক্তির পথ অনুসন্ধানে রাজকুমার সিদ্ধার্থ তাঁর সর্বস্ব ত্যাগ করে পথে নেমেছিলেন। এ মহান সাধককে শ্রূদ্ধা জানাই।
'আনাল হক' - প্রবাদে পরিণত হওয়া এই উক্তিটি করেছিলেন আব্বাসীয় শাসনামলের (হিজরী ৩য় শতাব্দী) সময়কার পারস্যের সুফী সাধক ও কবি মনসুর (Mansur Al-Hallaj)। তাঁর এই উক্তির অর্থ, "আমিই চিরসত্য", এতে তিনি মানুষের মাঝেই স্বয়ং আল্লাহ বসবাস করেছেন বলে মত দেন। তাঁর সময়ের কেউ তাঁকে বুঝতে না পারলেও, পরবর্তী পারস্যের কালজয়ী কবি হাফিজ, সাধক জালালউদ্দিন রুমী ও আরও অনেকে ছিলেন মনসুরের লেখনীতে অনুপ্রাণিত কবি। (সূত্র: উইকিপিডিয়া)
এই চিরসাধকের তরে কবির সালাম রইল।
নর-নারায়ন - সনাতন (হিন্দু) ধর্মমতে, সৃষ্টিজগতের নিয়ন্ত্রক আছেন ত্রিমূর্তি (The Great Trinity)। সৃষ্টির দেবতা - ব্রহ্মা, প্রতিপালনের দেবতা - বিষ্ণু এবং ধ্বংসের দেবতা - শিব।
মর্ত্যলোকে বিষ্ণু'র মানুষরূপী অবতার হলেন নারায়ন। মানুষের মাঝেই তার প্রতিপালকের রূপধারণ - এ বোধহয় সবধর্মেই কমবেশি আছে।
হিন্দু ধর্মে আমি এ কথা আরও পেয়েছি উপমহাদেশে আধ্যাত্মবাদের বিখ্যাত গবেষক Bhagwan Shree Rajneesh-এর লেখায়:
The Upanishadas are right when the seers declared, “Aham Brahmasmi” – I am the Absolute !
(The Secret Discourses on Sufism: Chapter One)
জগতের সকল ধর্মের প্রতি আন্তরিক সম্মান জানাই।
'এলি এলি, লামা শাবাক্তানি' - ক্রুশবিদ্ধের পর ক্রাইস্টের শেষ সাত'টি উক্তির মধ্যে একটি। এটিই একমাত্র উক্তি যেটি একাধিক Gospel-এ গ্রন্থিত। আরামাইক ভাষায় বলা এ কথা'র ইংরেজী অনুবাদ হয়, "My God, my God, why have you forsaken me?"
বাইবেলে Gospel of Matthew, ২৭ অনুচ্ছেদ ৪৬ নম্বর আয়াতে বর্ণিত,
About the ninth hour, Jesus called out with a loud voice, saying "E’li E’li la’ma sha-bach-tha’ni?" that is, "My God, my God, why have you forsaken me?"
প্রায় একই কথা Gospel of Mark, ১৫ অনুচ্ছেদ, আয়াত ৩৪:
And at the ninth hour, Jesus called out with a loud voice, "E’li E’li la’ma sha-bach-tha’ni?" which means, when translated, "My God, my God, why have you forsaken me?"
অনেকটা অভিন্ন কথা আমি পেয়েছি পবিত্র 'জবুর শরীফ'-এও (১০২ তম আসমানী কিতাব, রাসূল দাঊদ (আ)-এর কাছে প্রেরিত)। জবুর শরীফের বাংলা অনুবাদে (বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটি থেকে প্রকাশিত;
ISBN: 9789841702359) ৩য় খন্ড, ৭৪ রুকু, ১ম আয়াতে, নিরুপায় হয়ে স্রষ্টার প্রতি সকাতর প্রশ্ন:
"হে আল্লাহ, তুমি চিরদিনের জন্য কেন আমাদের পরিত্যাগ করিয়াছ?"
পরবর্তীতে স্রষ্টা তাঁদের চূড়ান্ত বিজয় দিয়েছিলেন। মানুষকে সঠিক পথ দেখাতে এসে এসব মহামানব সারাটা জীবন অকথ্য নির্যাতন সহ্য করেছেন নিঃস্বার্থভাবে। তাঁদের সবার তরে কবির শ্রূদ্ধা নিবেদন।
টীকা এখানেই শেষ।
পথের অনুসন্ধান কি মানবজাতির কখনও শেষ হবে?
পোস্ট শেষ করব কিংবদন্তী আব্দুল আলীমের একটা গানের ক'টা লাইন দিয়ে। আমার ভাল লাগার একটা গান:
"নদীর কূল নাই, কিনার নাই
আমি কোন কূল হতে কোন কূলে যাব - কাহারে সুধাই?
ওপারে মেঘের ঘটা, টনক বিজলী ছটা
মাঝে নদী বহে সাই সাই রে...
আমি এই দেখিলাম সোনার তরী, আবার দেখি নাই রে !"
আমি এই দেখিলাম সোনার তরী, আবার দেখি নাই !!! -- দয়াময় ! তোমার অনুসন্ধানের পথ আরও কত মরীচিকাময় করে রাখতে পারো !
''খেলিছ, এ বিশ্ব লয়ে, বিরাট শিশু আনমনে;
খেলিছ..'' (নজরুল)