প্রথম পর্বের লিংক এখানে
এ পর্যন্ত পড়েই প্রচন্ড অবিশ্বাস নিয়ে তাকালাম আমি সামনে বসে থাকা লোকটার দিকে। ‘এসব কি লিখেছেন? এটা কি সত্যি কোন গল্প নাকি অন্য কিছু? এ তো আমার জীবনের কথা লিখে রেখেছেন আপনি!’
‘পড়া থামাবেন না প্লিজ। চালিয়ে যান।’ আমার উত্তেজনা একটুও স্পর্শ করতে পারেনি লোকটাকে।
নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই আবার হাতে ধরা কাগজগুলোর দিকে তাকালাম আমি। তারপর পড়তে শুরু করলাম। এ কি অদ্ভুত ঘটনা! সবকিছু কাটায় কাটায় মিলে যাচ্ছে কিভাবে? সেই দিনের সেই রাতের পর থেকে যা যা ঘটেছে আমার জীবনে তার হুবুহু বর্ণনা লেখা রয়েছে এখানে। এমনকি যেসব কথা কারও জানার কথা নয় সেগুলোও এমন ভাবে লেখা আছে যেন ঘটনাগুলো ঘটার সময় লোকটা সেখানে উপস্থিত ছিল। কিভাবে সম্ভব? পাতা উল্টাচ্ছি একের পর এক, আর বার বার অবাক হচ্ছি। শেষ পর্যন্ত আর ধৈর্য ধরে রাখতে পারলাম না। ছুঁড়ে দিলাম কাগজের তাড়াটা লোকটার মুখের উপর। ঘরময় ছড়িয়ে পড়ল পুরনো কাগজের বান্ডিল।
‘যথেষ্ট হয়েছে!’ এ পর্যন্ত যা বলেছেন তার সবকিছু মেনে নিয়েছি। আর নয়। আমার প্রশ্নের জবাব না দিলে এই মূহুর্তে আপনাকে ঘর থেকে বের করে দেব আমি।’
‘তা সম্ভব নয় আশরাফ সাহেব। আমি না চাইলে আমাকে বের করে দেওয়া তো দূরে থাক, আপনি নিজেও এই ঘর থেকে বের হতে পারবেন না!’ বলল লোকটা। চোখের দৃষ্টি ঠান্ডা হয়ে এসেছে তার।
‘তবে রে হারামজাদা...’ বলে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে লোকটার টুঁটি টিপে ধরতে চাইলাম আমি। কিন্তু পারলাম না! কেউ যেন আমার হাত পায়ের সাথে দশ মন ওজনের সীসার টুকরো বেঁধে দিয়েছে, এক চুলও নড়তে পারলাম না চেয়ার থেকে।
‘আমার লেখাটা শেষ পর্যন্ত পড়লে ভাল করতেন, বুঝলেন আশরাফ সাহেব? অবশ্য নিজের গল্পের শেষটা জানার মত সাহস যে আপনার মত লোকের হবে না তা আমার বোঝা উচিত ছিল। আপনি একটা কাপুরুষ, আশরাফ মাহমুদ।’ মৃদু গলায়, চিবিয়ে চিবিয়ে প্রত্যেকটা শব্দ উচ্চারণ করল লোকটা।
‘ক-কে আপনি?’ অনেক কষ্টে জিভটা নাড়ানোর শক্তি সঞ্চয় করে বললাম আমি।’
‘হ্যা, এবার বোধহয় আমার পরিচয়টা দেয়া যায়। অনেকক্ষণ ধোঁয়াশার মধ্যে রাখা হয়েছে আপনাকে। আমি হচ্ছি আপনার সকল লেখালেখি, সৃষ্টিশীল কাজকর্মের প্রধান উৎস। আমাকে ছাড়া আপনি একটুও এগোতে পারতেন না, একটা শব্দও বের হত না আপনার আঙুলের ডগা থেকে। যত গল্প কবিতা উপন্যাস আপনি লিখেছেন তার মূলে ছিলাম আমি। আমি আছি, থাকব।’
শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম আমি। একটা শব্দও বোধগম্য হয়নি আমার।
‘বুঝতে পারেন নি বোধহয়। আরেকটু সহজ করে বলি। পৃথিবীর যত লেখক, কবি, সুরকার, চিত্রকর- মোটকথা যাদের কাজ হল সৃষ্টি করা, তাদের সবার পেছনে থাকি আমি। আমিই তাদের অনুপ্রেরণা, মাথার ভেতর টুং করে বেজে ওঠা ছোট্ট একটা আইডিয়া; যেটাকে মেজে ঘষে বিশাল কোন মহাকাব্য বা ছোট্ট কোন চুটকিতে রূপ দেয়া হয় সেটাকে আমিই সৃষ্টি করি সর্বপ্রথম। গ্রিক পুরান পড়েছেন?’
আস্তে করে মাথা দোলালাম আমি। কিছুটা বুঝতে পারছি কি বলতে চাইছে লোকটা।
‘গ্রিক পুরানে নয়জন দেবীর কথা আছে। বলা হয় মানুষকে শিল্প-সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তারা উৎসাহ জোগাতেন, নতুন নতুন নাটক বা গান লিখতে বসে তখন সাহিত্যিকরা সেই দেবীদের কাছে প্রার্থনা করতেন। তাদের বলা হত মিউজ।’
কিছু না বলে চুপ করে তাকিয়ে থাকলাম আমি। বলার মত কিছু খুঁজে পাচ্ছি না আসলে। বলে চলল লোকটা, ‘আমার কাজটা অনেকটা ওই মিউজদের মত। তবে তাদের সাথে আমার তফাত কোথায় জানেন? মিউজরা শুধু আইডিয়ার হালকা একটা ছোঁয়া দিয়েই কাজ শেষ করত। বাকিটা ছেড়ে দিত কবি সাহিত্যিকদের কল্পনার উপর। কিন্তু আমি ওখানেই থেমে যাই না। যত বিখ্যাত লেখকের কথা আপনি পড়েছেন, শুনেছেন, দেখেছেন তাদের সবার পিছনে ছিলাম আমি। আপনার ভাষায় বললে আমরা।’
‘আপনারা মানে?’
‘আমরা মানে এই কাজ যাদের হাতে। মানুষে কল্পনাশক্তি আছে ঠিক, কিন্তু সেটাকে চুড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে বিশাল কোন প্রাসাদ গড়তে প্রথম যে ইটটা গাড়তে হয় সেটা আমাদের কাজ। আমাদের আলাদা কোন অস্তিত্ব নেই। প্রতি একশ বছরে একজন আসে, আগের জনের সব জ্ঞান, চিন্তা ভাবনা আর অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়ে। তার কাজ হয় সেই শতাব্দীতে সম্ভাবনাময় মানুষদের খুঁজে বের করা, যাদের হাত থেকে মানবজাতির মানসিক উৎকর্ষের আরও কিছু চিহ্ন তৈরি করা যায়। কেউ সফল হয়, কেউ ব্যর্থ হয়। কেউ বা আবার সারাজীবনে কাউকে খুঁজে বের করতে পারে না, কেউ কেউ এতটাই সাফল্য দেখায় যে একই সাথে বহু জ্ঞানী গুনীর আবির্ভাব ঘটে। রেনেসাঁ যুগে যেটা হয়েছিল।’
‘তার মানে আমার সাফল্য, ব্যর্থতা সবই আপনার হাতে? লেখালেখি করে আমি যে সুনাম অর্জন করেছি তার কিছুই আমার প্রাপ্য নয়?’ প্রশ্ন করলাম আমি।
‘আপনার এই প্রশ্নটার জবাব দিতেই আজ আমার এখানে আসা। তবে তার আগে যে আমাদের একটু অতীতে ফিরে যেতে হবে? আচ্ছা, যে রাতে আপনার বন্ধু রায়হানকে পঙ্গু করে দেয়া হয়েছিল, যে রাতের কথা একটু আগে পড়ে ক্ষেপে উঠলেন আপনি, সে রাতের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে আপনার?’
মাথা নাড়লাম আমি।
‘ওই বিশেষ রাতের আমার হিসেব নিকেশ একটু ওলট পালট হয়ে গিয়েছিল, বুঝলেন? কিন্তু কিই বা করার আছে! আমি যেমন আপনাদের সবার গল্প লিখি, আমার গল্পটাও নিশ্চয়ই কেউ লিখছে! সেদিন রাতে তার মেজাজ মর্জি আমার পক্ষে ছিল না খুব সম্ভব।’ মাথা নাড়ল লোকটা, যেন আফসোস হচ্ছে।
‘কিসের হিসেব নিকেশ?’ জিজ্ঞেস করলাম।
‘আমার হিসেব মতে ওইদিন রাতে মারা যাওয়ার কথা আপনার। রায়হান তার চোখের সামনে মরতে দেখবে আপনাকে, পরবর্তীতে আপনার রাজনৈতিক জীবন নিয়ে লিখবে উপন্যাস। যেটা রাতারাতি বিখ্যাত করে দেবে তাকে। টাকায় যেমন টাকা আনে, তেমন একটা সাফল্য তৈরি করে আরেকটা সাফল্যের প্রবেশদ্বার। ওর পর পুরোদমে লেখালেখি শুরু করত রায়হান, কয়েক বছরের মধ্যেই আকাশচুম্বী খ্যাতি অর্জন করত। কখনও লেখালেখি না করলেও ওর ভিতর প্রতিভা ছিল, সেই সাথে পেছন থেকে ধাক্কা দেয়ার জন্যে আমি তো আছিই। দুই জন মিলে অচিরেই পৃথিবীর বুকে আরেকজন কালজয়ী কথাসাহিত্যিকের জন্ম দিতে পারতাম। কিন্তু মিলল না হিসেব। পালিয়ে গেলেন আপনি, আর গুন্ডারা ভেঙে দিল রায়হানের হাত পা। লেখালেখির সম্ভাবনা চিরতরে নষ্ট হয়ে গেল ওর জন্য।
‘বাধ্য হয়েই আপনাকে বেছে নিতে হল আমার। কারণ আমার বরাদ্দ সময়টুকু ফুরিয়ে আসছিল, বড় জোর বছর দশেক সময় বাকি ছিল আর। রায়হানের নামে ওর জীবনের গল্পটা লিখে ফেলেছিলাম আমি, বাধ্য হয়েই সেদিন রাতের পর থেকে ঘটনাপ্রবাহ বদলে দিয়ে বসাতে হল আপনার নাম। তাই বাধ্য হয়েই বলতে হচ্ছে, আপনার লেখালেখির পিছনে আপনার অবদান খুবই সামান্য। সেদিন রাতে আমার গল্পের পরবর্তী নায়ক কাকে বানাব ভাবতে গিয়েই আপনার কথা মনে হল। বিশ্বাস করুন, এমনকি ওই গুন্ডাগুলোর কাউকে বেছে নেব কিনা এমন চিন্তায় আমার মাথায় এসেছিল। কিন্তু বাঁকাতেড়া ইট দিয়ে কি আর প্রাসাদ বানানো যায়?
‘তবে বলতেই হচ্ছে, যতটা আশা করেছিলাম তার চাইতে ভাল কাজ দেখিয়েছেন আপনি। তবে রায়হানের চাইতে ভাল তা বলা যাবে না। তবুও হয়তো আপনাকে দিয়েই কাজ চালিয়ে নিতাম, কিন্তু একটা ঘটনা ঘটে গেছে গতকাল, যে কারণে সব নিয়ম কানুন ভেঙে আমাকে আপনার সামনে হাজির হতে হল। এমনিতে আমরা আমাদের সাবজেক্টের সামনে হাজির হই না, নিজেদের অস্তিত্ব বুঝতেও দিই না তাদের। কিন্তু আপনার ভাগ্যটা অন্যরকম।’
‘কি ঘটনা?’
‘সুস্থ হয়ে উঠেছে রায়হান।’
হা করে তাকিয়ে থাকলাম আমি। রায়হান... সুস্থ হয়ে গেছে? ওর সঙ্গে বছর তিনেক আগে আমার শেষ বার দেখা হয়েছিল। জানিয়েছিল, ডাক্তাররা ব্যর্থ হয়েছে ওর হাত পা ঠিক করতে। বলেছিল, এখন শুধু অলৌকিক ঘটনাই পারে ওকে সুস্থ করে তুলতে। তারপর আর ওর সাথে যোগাযোগ রাখা হয়নি। মাঝে মাঝে মনে হয় না ওর কথা এমন নয়, কিন্তু নানারকম ব্যস্ততায় আর খবর রাখা হয়নি।
সেই রায়হান সুস্থ হয়ে গেছে?
হঠাৎ একটা সন্দেহ মাথাচাড়া দিল আমার মনে। আমি নাকি রায়হানের মত ভাল করতে পারিনি। ওদিকে লোকটা বলছে রায়হান সুস্থ হয়ে গেছে। তার মানে? চোখে জিজ্ঞাসা নিয়ে লোকটার দিকে তাকালাম আমি।
আমার চোখের ভাষা পড়তে পেরেই যেন লোকটা হাসল একটু। বিষন্ন হাসি। বলল, ‘ঠিকই ধরেছেন। এখন যেহেতু রায়হান সুস্থ হয়ে উঠেছে, আপনাকে আর কোন প্রয়োজন নেই আমার। রায়হানের হাত থেকে আপনার চাইতে বহু গুনে উন্নত মানের সাহিত্য তৈরি হবে, পরবর্তী হাজার বছর মানুষ তার লেখা পড়বে, তার নাম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে। সে রকম কোন কিছু করার যোগ্যতা নেই আপনার। বাগানে কোন রুগ্ন গাছ থাকলে সেটাকে উপড়ে ফেলাই ভাল নয় কি?’
‘উপড়ে ফেলা মানে?’
‘রায়হানের হাত ভাল হয়ে ওঠার খবর আমি শুনতে পাই সপ্তাহখানেক আগে।’ আমার প্রশ্ন শুনতেই পায়নি এমন একটা ভাব করে বলে চলল লোকটা, ‘আস্তে আস্তে নাকি কার্যকরী হয়ে উঠছে তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, নড়াচড়ার ক্ষমতা ফিরে পাচ্ছে। তখনই সিদ্ধান্ত নেই যে একবার দেখে আসব তাকে। এখন তার কাছ থেকেই আসছি আমি। খুব দ্রুত লেখালেখি শুরু করতে পারবে সে, আর তার হাত থেকে যে লেখাগুলো বের হবে সেগুলো পরিনত হবে বিশ্বসাহিত্যের অমূল্য সম্পদে। রাজনৈতিক ট্রাজেডির শিকার হওয়ায় পাবলিক সিমপ্যাথিও তার পক্ষে থাকবে। সফল হব আমি।’
এদিকে কখন যেন ঠিক বলতে পারব না, লোকটার ব্যাগটা তুলে নিয়েছি আমি পাশ থেকে। এক ফাঁকে কাঁধ থেকে নামিয়ে টেবিলের উপর রেখে দিয়েছিল সে ব্যাগটা। আমার চোখ স্থির হয়ে আছে লোকটার দিকে, কিন্তু দুই হাত দিয়ে খুলে ফেলেছি ব্যাগটা, হাতড়াচ্ছি ভেতরে। কখন করেছি কাজটা মনে করতে পারলাম না, কিন্তু লোকটার দৃষ্টি যখন আমার হাতের দিকে স্থির হল তখন তার চাউনি অনুসরণ করে আমিও তাকালাম। ততক্ষণে ব্যাগের ভেতর শক্ত কিছু একটায় ঠেকেছে আমার হাত। নিজের অজান্তেই জিনিসটা বের করে আনলাম আমি।
একটা ছুরি। আলো লেগে ঝিক করে উঠল ফলাটা। সম্মোহিতের মত সেদিকে তাকিয়ে থাকলাম আমি।
এরপর এক সাথে দুটো ঘটনা ঘটতে শুরু করল। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতে শুরু করল লোকটা, আর আমার ছুরি ধরা হাতটা উঠে আসতে শুরু করল উপর দিকে। বিস্ফারিত চোখে নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে আছি আমি, অবাক হয়ে দেখছি কিভাবে আমার নিজের হাত আমারই সাথে বেঈমানি করে উঠে আসছে আমারই গলার দিকে!
চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে লোকটা, আমার কোলের উপর থেকে ব্যাগটা তুলে নিয়ে কাঁধে ঝুলিয়ে এগোতে শুরু করেছে দরজার দিকে। ওদিকে আমার হাতে ধরা ছুরিটা ধীরে ধীরে চেপে বসছে কন্ঠার চামড়ার উপর, অ্যাডামস অ্যাপলের উপরের গভীর অংশটা থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করল কয়েক ফোঁটা রক্ত। প্রাণপনে চেষ্টা করছি হাতটা সরিয়ে আনার জন্য, কিন্তু পারছি না কিছুতেই!
দরজার কাছে গিয়ে ঘুরে দাঁড়াল লোকটা। আমার দিকে তাকাল, দেখলাম অদ্ভুত একটা হাসি ফুটে উঠেছে তার মুখে।
‘আশরাফ সাহেব, গল্পের শেষটা আপনার পড়া উচিত ছিল!’
(শেষ)