অপার প্রকৃতি, প্রসারিত পাহাড়, মনোরম শোভা, মহনীয় সৌন্দর্য নিয়ে আজও বিরাজমান রূপসী দার্জিলিং। তার পাহাড়ি পথে, গহীন বনে প্রতি মুহূর্তে মেঘের আনাগোনা। শোনা যায় তাদের কানে কানে ফিসফিসিয়ে কথা বলা। পাহাড় রানীর অঙ্গে বহুদিন অলংকৃত ‘টাইগার হিল’। সূর্যোদয় উপভোগের সেরা স্থান। হলুদ টুপির ‘ঘুম মনাট্রি’। অভিনব চলার পথ ‘বাতাসিয়া লুপ’। বিস্তর কাঞ্চনজঙ্ঘা, বেঞ্চ সাজানো বসবার বন্দবস্ত-ম্যাল। অঙ্গ-অলংকারে রয়েছে পদ্মজা নাইডু হিমালয়ান জুলজিক্যাল জু, তেনজিং নোরগে মউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট, ন্যাচারাল হিষ্ট্রি মিউজিয়াম ভুটিয়া মনাস্ট্রি, রোপওয়ে আর চারদিকের সবুজ সুন্দর চা বাগান।
মানেভঞ্জন থেকে আমাদের গাড়ি কুয়াশার চাদর ভেদ করে ছুটে চলেছে দার্জিলিং এর পথে।
দার্জিলিং এর পথে।
ঘড়িতে সময় প্রায় ৪ টা। কিছুক্ষণ চলার পর গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। এক দিকে কুয়াশা, এক দিকে বৃষ্টি আর এক দিকে ঠাণ্ডা। একেবারে যা তা অবস্থা। আমি গাড়িতে বসে ভাবছি এই আবহাওয়াতে আমরা দার্জিলিংয়ে ২ দিন কি করবো। আমরা যখন জাপানিজ মনাস্টারী এসে পৌঁছলাম তখন আকাশ বেশ গম্ভীর। চারদিকে অন্ধকার হয়ে এসেছে। বুঝলাম দার্জিলিংয়ে আমরা স্বাগত নই। গাড়ি থেকে নেমেই বুঝলাম এখন মনাস্টারী ঢোকার কোন মানেই হয় না।
জাপানিস মনাস্ট্রির সামনে আমরা
মেঘ আর কুয়াশায় ১০ হাত দূরেরও কিছু দেখা যাচ্ছে না। তাই দেরি না করে আমরা রওনা দিলাম হোটেলের দিকে। হোটেলে উঠে সবাইকে ফ্রেশ হতে বলে আমি আর রওশান আপা বেড়িয়ে পড়লাম খাবারের হোটেল ও মেন্যু ঠিক করতে। দার্জিলিং এ রাতের খাবারটা একটু সকাল সকালই সারতে হয়। বেশিরভাগ খাবার হোটেল ৭-৭.৩০ এর মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়। খাবারের মেন্যু ঠিক করে আমরা চলে এলাম হোটেলে। ৭.৩০ নাগাদ সবাই মিলে চললাম খেতে। প্ল্যান হল খাবার শেষ করে রাতের দার্জিলিং ঘুরে দেখব। তবে দল ছাড়া হওয়া যাবে না কিছুতেই। হারিয়ে যাওয়ার ভয় আছে। দিন আর রাতের দার্জিলিং সম্পূর্ণ আলাদা। দিনের ১১-১২ টার দিকে যেখানে রাস্তায় হাঁটাই মুশকিল হয়ে যায়, সেখানে রাত ১০ টায় দার্জিলিং যেন এক মৃত নগরী। রাস্তায় কোন গাড়ি ঘোড়া নেই, লোকজনের কোলাহল নেই। পুরো শহর ঘুমিয়ে পরে কোন এক জাদুকরের জাদুর ছোঁয়ায়। রাস্তার নিয়ন আলো কেমন যেন ভূতুড়ে মনে হয়। আমরা বেশী দেরি না করে হোটেলে ফিরে এলাম। বেশ রাত পর্যন্ত চলল আড্ডাবাজী।
পরদিনের প্লানে ঘোরাঘুরিটা শহরের আশেপাশেই। তাই খুব সকালে ঘুম থেকে উঠার তাড়া নেই আজ। পরদিন সকাল ৮ টার মধ্যে নাস্তা সেরে আমরা হেঁটে হেঁটেই চললাম চিড়িয়াখানার দিকে। আমাদের হোটেল থেকে ২ কিমি হবে। সকালের মিষ্টি রোদে হাঁটতে খারাপ লাগছে না।
আসলে চিড়িয়াখানা ৯ টার আগে খুলে না। তাই আগে আগে গিয়ে বসে থাকার কোন মানে হয় না। ঠিক ৯ টায় আমরা টিকেট কেটে লাইন ধরে ঢুকে পড়লাম চিড়িয়াখানায়। বিভিন্ন রকম প্রাণী রয়েছে এখানে। প্রায় সবগুলোই এই অঞ্চলের মানে হিমালয় রেঞ্জের। খারাপ লাগলো না। চিড়িয়াখানা দেখে আমরা চলে এলাম HMI (Himalayan Mountaineering Institute ) এ। দেশী বিদেশী অনেক ছাত্র রয়েছে এখানে।
বাংলাদেশের প্রায় সব শিক্ষিত মাউন্টেনিয়ার এখানকার ছাত্র। HMI এর সাথেই রয়েছে HMI যাদুঘর। যাদুঘর চত্বরে রয়েছে শেরপা তেঞ্জিং নরগে এর মূর্তি।
শেরপা তেঞ্জিং নরগে এর মূর্তির সামনে ামরা
সেখানে গিয়ে খুঁজে বের করলাম ডঃ চন্দ্রনাথ দাস স্যারকে। HMI যাদুঘরের কিউরেটর তিনি। তাঁর অফিসে গিয়ে নিজের পরিচয় দিতে হল না। ঠিক চিনলেন আমাকে। চায়ের অফার করলেন। সাথে বন্ধুরা আছে জেনে নিজেই অফিস থেকে বের হয়ে এলেন সবার সাথে দেখা করতে। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন HMI যাদুঘরের সবকিছু। যাদুঘর দেখে আমরা চলে এলাম দার্জিলিং এর বিখ্যাত ‘রোপ-ওয়ে’ তে। ক্যাবল কারে চড়ে চা-বাগান দেখার এর চেয়ে ভালো জায়গা আর হয় না।
‘রোপ-ওয়ে’
এখানে সবসময় ভিড় লেগেই থাকে। আমরা লাইনে দাঁড়িয়ে ৪ জন করে ক্যাবল কারে করে ঘুরে এলাম। এরই মধ্যে ক্ষুধাও লেগে গিয়েছে। কয়েকজন ভাত খেতে চায় আর কয়েকজন স্ট্রিট ফুড।
রাস্তার খাবারের চেয়ে মজার খাবার দুনিয়াতে আর কোথাও নেই!!
যে যার পছন্দ মতো খেয়ে চলে এলাম রুমে। ফ্রেশ হয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার বের হলাম। উদ্দেশ্য বাতাশিয়া লুপ। একটা গাড়ি রিজার্ভ করে চললাম বাতাশিয়া লুপ দেখতে। পড়ন্ত বিকেলে কুয়াশার মাখামাখিতে মায়াবী রূপ ধারন করেছে এই লুপ।
বাতাশিয়া লুপ
মেঘ মেশানো শীতল বাতাস যেমন কাঁপুনি ধরায়, তেমনি অদ্ভুত এক অনুভূতি ছড়িয়ে দেয় সারা শরীরে। ভেঁপু বাজাতে বাজাতে ট্রয় ট্রেন এসে কিছুক্ষণ থেমে আবার চলেও গেল। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে অনন্য তার পথ চলা। সন্ধ্যা পর্যন্ত কাটিয়ে আমরা চলে এলাম হোটেলে।
গত রাতের মত আজও আমরা খাওয়া শেষ করে কিছুক্ষণ রাতের দার্জিলিং উপভোগ করে ফিরে এলাম রুমে। আজ জলদী ঘুমোতে যেতে হবে কারন ভোর ঠিক সাড়ে তিনটায় আমাদের রওনা হতে হবে টাইগার হিলে। বলা হয়ে থাকে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে ঘিরে পৃথিবীর সেরা সূর্যোদয় দেখা যায় এই টাইগার হিল থেকে। ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে আমরা চললাম সেই সেরা সূর্যোদয় দেখতে। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা ঘুরে আমাদের গাড়ি ছুটে চলেছে। সামনে দুইএক জন সুন্দরী আমাদের কাছে লিফট চাইল। দুই গাড়ি মিলে আমরা যাচ্ছি মাত্র ১০ জন। তাই গাড়িতে প্রচুর জায়গা থাকায় আমরা দুজনকে গাড়িতে তুলে নিলাম। এরা মুলত ভোরবেলায় এক ফ্লাক্স কফি নিয়ে বের হয়। টাইগার হিলের যাত্রীদের কাছে কফি বিক্রি করে আবার ভোর থাকতে থাকতেই ফিরে আসে। এটাকে বাড়তি ইনকাম ও বলা যেতে পারে। যাই হোক টাইগার হিলে টপ ক্লাসের টিকেট আমরা আসার আগেই শেষ। সেকেন্ড ক্লাসে আমাদের টিকেট করে আমরা ঢুকে পড়লাম। এখানে প্রচুর ভিড়। সামনের দিকে তো দূরের কথা, সামান্য বসার জায়গাটুকুও নেই। অবশ্য আমরা এখানে বসতে আসিনি। এসেছি সূর্যোদয় দেখতে। বাইরে চারদিক কুয়াশায় ভরে গেছে। এই রকম কুয়াশা থাকলে সূর্য তো দূরের কথা সূর্যের রশ্মিও আমাদের কপালে জুটবে না। ঘড়ির কাটা যতই আগায় আমাদের হতাশা ততই বাড়তে থাকে। এক সময় আমাদের হতাশা দূর হয়। কারন সূর্য উঠার টাইম অনেক আগেই পেরিয়ে গেছে। এখন আর এখানে বসে থাকার কোন মানে হয় না। আমরা কিছুক্ষণ গল্প গুজব করে টাইগার হিল থেকে বেড়িয়ে এলাম। বাইরে এসে কনকনে ঠাণ্ডায় সবাই হাত-মুখ-পা ঢেকে ছবি তুললাম।
আমাদের পরবর্তী গন্তব্য রক গার্ডেন।
মেঘের চাদর জড়িয়ে রখেছে পুরো দার্জিলিং শহর। মেঘের ফাঁক ফোঁকর গলে আমাদের জীপ চলছে রক গার্ডেনের পথে। চারদিকে বিস্তীর্ণ চা বাগান, মাঝে মাঝে পাইনের সারি, কিছু উৎসুক মুখ। সব মিলিয়ে অসাধারণ এক জার্নি। সাড়ে সাতটা নাগাদ আমরা পৌঁছে গেলাম রক গার্ডেনে। গেট এখনো খুলেনি। নয়টায় খুলবে। আমরা পাশের এক ছোট্ট দোকান থেকে গরম গরম আলু-পরটা আর কফি খেয়ে নিলাম। এরই মধ্যে গেট খুলে দিয়েছে আমাদের জন্য। ১০ রুপির টিকেট কেটে আমরা ঢুকে পড়লাম। খুব সুন্দর করে গোছানো এই রক গার্ডেন। প্রকৃতির হাতের ছোঁয়ার সাথে মানুষের যত্নের ছাপ বোঝা যায়। একটি বিশাল ঝর্ণা কয়েকটি ধাপে ধাপে নেমে এসেছে।
মাঝে মাঝে রয়েছে বেশ কিছু ব্রিজ। রয়েছে বাহারি ফুলের সমাহার। চাইলে ট্রেডিশনাল ড্রেস পরে ছবিও তুলে ফেলতে পারেন। এর জন্য অবশ্য অল্প কিছু রুপী দিতে হয়। এই রক গার্ডেন ছিল আমাদের এবারের দার্জিলিং ভ্রমণের শেষ স্পট। তাই এটি দেখা শেষ করে আমরা ফিরে এলাম শহরে। হোটেলে গিয়ে সবাইকে ব্যাগ গুছিয়ে ফ্রেশ হয়ে রেডি হতে বলে আমি আর ইয়াসমিন আপা গেলাম কালিম্পঙের গাড়ি ঠিক করতে।
কবুতরের এপার্টমেন্ট