আজ আমাদের মন খুব খারাপ। আজ ইফতারির আয়োজন নেই। কাল ঈদ হতে পারে এটা জেনেই এই ব্যাবস্থা । আব্বা শুধু চিড়া,কলা ও খেজুর খাবেন।বিকালে ছাদে উঠলাম চাঁদ দেখতে । নাহ, চাঁদ দেখা গেল না । দেখা গেলে দু তিনটি বাজি ফোটে । ১৯৬৯ সাল ,খুলনা শহর । আব্বা মেঝভাইকে রেডিওতে খবর শুনতে বললেন । রাত ৮ টার খবরে বলা হল করাচীতে ঈদের চাঁদ দেখা গেছে । তবুও চারিদিকে চাপা উত্তেজনা।
একদল কাল ঈদ করবে আরেকদল করবেনা ।
আব্বা চিন্তিত ।
আমরা নতুন শার্ট বানিয়েছি দরজির দোকানে গিয়ে। নতুন লুঙ্গি , বাটার স্পঞ্জ । পুরাতন পাঞ্জাবী আর পাজামা ভালো করে সোডা দিয়ে ধুয়ে ভাজ করে বালিশের নিচে চাপা দিয়ে রেখেছি । আব্বা ইস্তিরি করার বাহুল্যতা পছন্দ করেন না । মাঝে মধ্যেই বালিশ উলটে দেখছি কোঁচকানো ভাবটা গেছে কিনা।
খুব ভোরে আব্বা গরম পানি দিয়ে গোসল সেরেছেন । আমরাও একে একে গরম হয়ে যাওয়া বাথরুমে আরামের সাথে গরম পানি দিয়ে গোসল সারলাম ।মা খুব ব্যাস্ত হাড়িতে করে গরম পানি বালতিতে ঢেলে দেওয়ায় । সর সর বলে আমাদের সতর্ক করছিলেন । রাস্তা সংলগ্ন বারান্দায় আব্বা আগে রেলিঙে হাত রেখে আর আমরা পিছনে দাড়িয়ে। এরি মধ্যে দুজন বলে গেল হাজী সাহেব আসেন, চলে আসেন জামাত হবে।একটা হুজুর মার্কা লোক হটাত বাসার নিচে রাস্তায় দাড়িয়ে মুখ উচু করে বলল ঈদ তো কাল হচ্ছে। আব্বা চুপ । এবার গায়ে পড়ে লোকটি জিজ্ঞাসা করল মাওলানা সাহেবের ইরাদা কি? আব্বার সংক্ষিপ্ত উত্তর আজ পড়বো । লোকটি এবার নড়েচড়ে ঝগড়া শুরু করল, একতরফা । আমার বোনও মাথায় লম্বা ঘোমটা দিয়ে আমাদের পিছনে হাজির । লোকটি পাচ মিনিট তার জ্বালাময়ী ভাষণে হাদিস , কোরান বয়ান করে আব্বাকে বলল আসেন তরবারি নিয়ে জ্বিহাদ করি । এবার আব্বা তার হাতের লাঠি রেলিঙ এর উপর উঠিয়ে তাকে বললেন এটা দিয়ে পিটিয়ে তোর জ্বিহাদ বের করে দেবো ।
লোকটি লাফাতে লাফাতে বলতে লাগল আসেন আসেন।
আব্বা বিড়বিড় করে বললেন এতো সহজে যাবেনা ।এবার আব্বা বললেন আমি নামছি । পেছনেই খাড়া উন্মুক্ত সিঁড়ি ।
লোকটি উদ্বিগ্ন হয়ে আমাদের জিজ্ঞাসা করল উনি কি সত্যিই নামছেন?
আমরা পিছনে ঘুরে দেখে তাকে বললাম হ্যা,নামছেন।আব্বা মাঝ সিঁড়ি বরাবর দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে মুচকি হাসছেন।
লোকটির টেনশন চূড়ান্তে । সে গেটের মধ্যের ছোট গেট দিয়ে তাকিয়ে দেখছে বারবার।
একমাত্র বোন চুপচাপ দাড়িয়ে ছিল এবার তার ধৈর্যচ্যুতি ঘটলো । “এই হারামখোর, তুই কার সাথে জ্বিহাদ করতে চাস?চিনিস তুই ইনি কে? দাড়া , আব্বার লাঠি আর আমার বটি দিয়ে তোকে টুকরা করে ফেলব”।বোন দৌড়ালেন বারান্দা দিয়ে ধুপ ধাপ করে রান্নাঘরের দিকে।
এবার লোকটি একবার ডানে ও একবার বামে তাকিয়ে তার স্যান্ডেল খুলে একহাতে নিল আর আরেক হাতে লুঙ্গি তুলে দৌড় দিল । পাশের গলিতে দাড়িয়ে ছিল ছেলেপিলেরা। তারা ধর ধর করে চিৎকার করতেই লোকটির গতি দ্বিগুণ হয়ে গেল।
জন্মের পর আমরা একটি অস্বাভাবিক ঘটনার সাক্ষী হলাম।
আব্বা ও দুই ভাই মিলে একটা রিকশা নিয়ে আমাদের রাস্তার শেষ প্রান্তে সার্কিট হাউস ময়দানে গেলাম ।
মেঝ ভাইকে পাওয়া গেলনা । মনে হয় তিনি আগামিকাল ঈদ করবেন। ম্যাট্রিক পাশ করে কলেজে পড়লে বেশ স্বাধীনতা পাওয়া যায়।
মাত্র তিনটি কাতারে লোক বসেছে বাকিটা খালি।বেশ হতাশা নিয়ে আমরা বসলাম। তিনজন পাগড়ি পড়া আলেম এসে লম্বা ছালাম দিয়ে আব্বাকে বললেন আজ আপনি ইমামতি করবেন।আব্বার অসম্মতি । কে শোনে কার কথা । তারা আব্বার হাত ধরে কায়দা করে দাড় করিয়ে দিলেন । লাইন ভেঙ্গে তারা সাজগোজ করা মসজিদ আকৃতির ঘরের বাইরে ইমামের জায়গায় আব্বাকে দাড় করিয়ে দিলেন। লোকেরা আমাদের জায়নামাজ তুলে নিয়ে আমাদের হাত ধরে সামনের কাতারে জায়গা ফাকা করে বসিয়ে দিলেন। আব্বাকে একটা পাগড়ি পরানো হল।
হটাৎ সামনের স্টেডিয়ামের দেওয়ালে পরপর কটা বোমা ফুটল । সবাই ভয়ে দাড়িয়ে পড়ল । সামনের সীমানা ঘেরা ছিল রঙ্গিন কাগজের পতাকার রশি দিয়ে । ওখানে অনেক লোক দাড়িয়ে ছিল কোন কারন ছাড়াই । বোমা ফুটতেই এই লোকগুলো পকেট থেকে টুপি বের করে পরতে পরতে সাজানো রশি উঠিয়ে দ্রুত মাঠে ঢুকতে লাগল । দক্ষিন দিকের সদর রাস্তায় অনেক দাড়িয়ে থাকা লোকেরা দ্রুত মাঠে ঢুকতে লাগল । একটা বিহারি লোক বাইরে দাড়িয়ে তার সেভেন গিয়ার চাকু ক্যাট ক্যাট করে খুলে শুন্যে ঘুরিয়ে নাচতে নাচতে চিল্লানো শুরু করল আজ নামাজ হোগা , জরুর হোগা । মাঠে কয়েকটি কাতার বেড়ে গেল ।বাইরে দাড়িয়ে থাকা হাজার লোক সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলনা বোধহয় যে নামাজ কি আদৌ হবে।
একজন আলেম মাইকে শেষ ঘোষণা দেওয়ার পর আব্বা নামাজ শুরু করলেন, খুতবা পাঠ করলেন এবং সংক্ষিপ্ত মোনাজাত করলেন । সাধারনত ইমাম সাহেবরা লম্বা সময় নিয়ে কাঁদা কাটি করে মুনাজাত করেন তাতে আমার দুটো হাত উচিয়ে রাখতে ব্যথা করে। আব্বা কাঁদাকাটি করেননি ।
এরপরে যা ঘটলো তার জন্য আমরা একদম প্রস্তুত ছিলাম না।
দলে দলে লোক আব্বার সাথে কোলাকুলি করতে লাগল , সেকি ভিড়, এমনতো কখনো দেখিনি।আচানক এক তরুন মাওলানা এসে আমাদের গলায় পেচানো আরবিয় রুমাল বা টারবেন খুলে দুমাথায় গেরো দিয়ে গলায় ঝুলিয়ে দুহাত ধরিয়ে দিল সামনের দ্মাথায় তারপর একগাদা নোট সব এক রুপির ভিতরে রেখে বলল আসো । এতো দ্রুত ঘটলো যে বুঝতেই পারছিনা এসব কি হচ্ছে । ভিড় ঠেলে বেশ কসরত করে ওরা আমাদের দুভাইকে আব্বার পাশে দাড় করিয়ে বলল সবাই টাকা এখানে দেবে, খেয়াল রাখবে। হ্যাঁ সবাই কাগজের একটাকার রুপি , আধুলি ও সিকি ফেলছে। আব্বাকে কেন ওরা টাকা দিচ্ছে? এভাবে কাটল কিছু সময়।
একসময় আব্বা গেটের দিকে রওনা হলেন। হাটতে হাটতে এবার আব্বা শুধু হাত মেলাচ্ছেন তারপরও কিছু লোক মোলাকাত করবেই । আমাদের একটি পূর্ণ হয়ে যাওয়া রুমাল বড়রা বেধে দিল। খেয়াল করলাম এই বড়রা আব্বাকে ঘিরে সামনে এগুচ্ছে। রিকশায় উঠলাম টাকার ঝুলি সহ ।আব্বা সবার দিকে হাত নাড়িয়ে বিদায় নিলেন।
এবার বাসায় পৌঁছেই সদ্য রান্না করা সেমাই । আমার বোন টাকা গুনে ফেললেন । আজ ঠিক মনে নেই ক’শ রুপি হয়েছিল । আমাদের দুভাইকে অ্যাসাইনমেনট দেওয়া হল রাস্তায় ঘুরে কানা খোঁড়াকে ১ রুপি, সাধারন ভিক্ষুককে আট আনা ও শিশুদের চার আনা বা সিকি বিলাতে হবে।ভিক্ষুক মানুষ খোজে এবার আমরা ভিক্ষুক খুজে নির্দেশ পালন করছি । একবার মনে হল এখান থেকে দু তিন রুপি আলাদা রাখবো কিনা? দোজখের ভয়াবহ আগুনের শাস্তির কথা মনে হতেই ওই চিন্তা উবে গেল। আব্বাতো আমাদের এবার দুই রুপি করে দিয়েছেন এক রুপির বদলে। স্কুলে লাল মশলাদার আলুর কথা মনে পড়ল । বেশ কদিন খাওয়া যাবে ।
দুপুরের খাবার খুবই সাধারন ,যেহেতু প্রস্তুতি নেই।মা আব্বাকে বললেন পোলাওর চাল আনান ,বাসায় ঘি আছে, সবার জন্য জর্দা করব । আব্বা বেশ খুশি আজ, হাসতে হাসতে বললেন তাহলে রাতে সবার জন্য পোলাও আর কোরমা কর । কাজের ছেলেটা বাজারে দৌড়াল । কাপড় ইস্তিরিতে কার্পণ্য করলে কি হবে আব্বার মত খানেদার কমই ছিল।
যাক বিকেল থেকে রাতাবধি আমাদের ঈদ বেশ বাসমতী , ঘি আর গরম মশল্লার গন্ধে মো মো করল ।।