চেতনার স্বীকৃতি না পাওয়া ৭১এর সেই সব সন্তানহারা মায়েদের জন্য উৎসর্গীকৃত
সত্তরোর্ধ দৌলতউন নিসা আজ ভোর থেকেই
অনাহারে , বিছানায় উচু হয়ে পিঠ ঠেকিয়ে
জানালার বাইরে ঝকঝকে আকাশ আর
নতুন পাতা ছড়ানো আম গাছটির দিকে
তাকিয়েছিলেন ছলছল চোখে ।
দৌলতের দৃষ্টিশক্তি বয়েসের তুলনায় অনেক তীক্ষ্ণ
ভোরের অশ্রুর ফোটাগুলি শুকিয়ে গেছে বোঝা যায় ।
বুকের উপর ছোট এক খানি ছবির ফ্রেম উপুড়
করে রাখা । তাতে ৭০ সালে তোলা একমাত্র পুত্র
রাহুলের ছবি । সময়ের বিবর্তনে মলিন
আর লালচে হয়েছে ছবিখানি । দেওয়ালে লাগানো
বড় একটি ছবিতে রাহুলের মুখখানি হালকা
দাড়ি-গোঁফে ভরা , লম্বা চুল । ছবিখানি
টাইমস পত্রিকা থেকে সংগ্রহ করে বড়
করিয়েছিলেন রাহুলের বাবা । রাহুলের বাবাও
এখন রাহুলের কাছে , বড় একা করে দিয়ে গেছেন
দৌলতকে । তারপর থেকে ভাইয়ের বাড়িতে ওর
ছেলে মেয়ে , নাতি পুতির সমাহারে দৌলত অসম্ভব
আদরে থাকেন সবার । দৌলতও সবার ভিতরে
রাহুলকে খুজে বেড়ান , কিন্তু রাহুল নেই ! রাহুল
কখনো আর ফিরবে জেনেও অপেক্ষায় থাকেন ‘মা’ ।
দৌলত আনমনা হয়ে হাতের তর্জনী দিয়ে
নাভিমূলে কিযেন খুঁচিয়ে দেখছিলেন
তার কোঁচকানো চামড়ার ভাজে নাভিমূল খুজে
পেতে ঝামেলাই হচ্ছিল , তবুও খুজছিলেন এবং
একসময় পেয়েও গেলেন । এই নাভির
ভিতরের অংশে জরায়ুতে রাহুল বাঁধা ছিল
দশটি মাস! তখন বেদনানাশক ছিলোনা
ছিল না নার্সিং হোম । দাই এসে
ধারালো বাঁশের ফালি দিয়ে কেটেছিলেন নাড়ি
আর বিচ্ছিন্ন করেছিলেন দৌলত আর রাহুলের
দশ মাসের বাধন । টুকটুকে ফর্সা আর কোঁকড়ানো
চুলের রাহুল সবার আদর সবার ভালবাসা কেড়েছিল ।
ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক বাবার একমাত্র পুত্র
বি এ সম্পন্ন করেছিল বাংলায় , এম এ তে ভর্তি
হয়েছিল ঢাকা গিয়ে । একাত্তর সালের প্রথম দিকে
ঐ যে ঢাকা গেল সেই থেকে রাহুল গত ৩৩ টি
বছর হয় ঘরে ফেরেনি । একাত্তর সালের মে মাসে
হাতবদল হয়ে আসা চিঠিতে তারা জেনেছিলেন
রাহুল মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবার ট্রেনিং নিচ্ছে ভারতে
সেই থেকে আর কোন সাড়া শব্দ পাওয়া যায়নি।
দেশ স্বাধীন হয়েছে , সবাই ফিরেছে , শুধু – রাহুল
রাহুল ফেরেনি । কেউ বলতেও পারেনি তার কি হয়েছে ।
পাগলের মতো ঢাকা গেছেন খুজে ফিরেছেন রাহুলের
ডিপার্টমেন্টে , সম্ভাব্য সবখানে । বড়ভাই আমেরিকা থেকে
টাইমস এর কপিখানি পাঠিয়েছিলেন তাতে রাহুলের ছবি
ছাপা হয়েছিল অচেনা আরও অনেকের সাথে রাইফেল কাঁধে।
কোন সেক্টর , কোন ক্যাম্পে ট্রেনিং কিছুই জানতেন না ।
অনেক পরে জেনেছিলেন তার প্রিয় সন্তানের সম্ভাব্য কাহিনী
যুদ্ধ করতে করতে পাকিস্তানী সেনাদের হাতে বন্দী
তারপর আর কোন হদিস পাওয়া যায়নি রাহুলের
দৌলত আর করেন নি খোজ প্রিয় সন্তানের কখনো !
একরকম পাথর হয়ে কাটিয়েছিলেন দুই যুগ
রাহুলের বাবাও আগেভাগে চাকরি ছেড়েছিলেন
সন্তানের শোঁকে । অর্থ কষ্ঠ ছিলোনা ধনাঢ্য
পূর্বপুরুষদের কারনে । রাহুলের বাবা আগেই
চলে গেলেন দৌলত কে সম্পূর্ণ একা করে দিয়ে ।
বিশাল বাগান, গাছপালা আর পুকুর ওয়ালা বাড়ীটি
ভাড়া দিয়ে ভাই দৌলতকে নিয়ে এলেন ঢাকায় নিজের
বাড়িতে । প্রায় তিন যুগের কাছাকাছি এসে অনেকে
হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল শহীদ মাতা , বীর খেতাব
দেয়া হবে , আসুন জলদি চলুন বলে । মাসিক
ভাতাগুলোও পাওয়া যাবে আর মিডিয়াতে যা দারুন
কাভারেজ হবেনা , একেবারে ফাটাফাটি । দৌলত
স্তম্ভিত , মৃত ছেলের চামড়া বিক্রির টাকা দিয়ে
আহারাদি হবে? এতদিন বাদে হটাত রাহুলকে
বাদ দিয়ে তার খোজ পড়ল কেন ?
স্বামীর বিশাল সম্পত্তি রাহুলের নামে ট্রাস্ট
করেছেন । দৌলতের ভাই ই যথেষ্ট দৌলতকে
দেখাশুনা করার । পুত্র হত্যাকারীদের দোসরদের
কাছ থেকে অনুকম্পা , সাহায্য ?
কক্ষনোই নয় !!
বছরের দুটি দিন এলে দৌলত ভেঙ্গে পড়েন
অনাহারে থাকেন , সবাই তাকে এ দুটি দিন
সকালে একা কাটাতে দেন , তিনিও তাই ভালবাসেন
বিকালে নাতি পোতারা প্রায় চ্যাং দোলা করে
দৌলতকে নিয়ে বেরুলেন মেঘনা নৌ ভ্রমনে ।
ঈষৎ তাপ মেশানো চৈত্রের হাওয়া মেঘনা
নদীতে ভালোই লাগছিল । হটাত ছোট্ট একটি
জায়গায় দেখলেন খুব উচু উচু বাঁশে
চল্লিশ পঞ্চাশটি পতাকা পতপত করে উড়ছে
এই গ্রামাঞ্চলে , বোধকরি হাটবাজার হবে ।
ওদের স্বাধীনতার প্রতি ভালবাসার প্রকাশ
পতাকা উর্দ্ধে তুলে ধরার প্রতিযোগিতায় মুগ্ধ দৌলত,
তিনি ছোট্ট নাতিটিকে কোলে টেনে নিলেন
অন্য সবাইকে বললেন তাকে ঠাণ্ডা ডাবের পানি দিতে
নাস্তা দিতে , তার খুব খাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছে -----
সারাদিনে এই প্রথম তার খেতে ইচ্ছে করছে ।
প্রিয় পতাকা ধন্য তুমি রাহুলের মায়ের আঁচলেতে !!