আহমদ ছফার সাক্ষাৎকার
আহমদ ছফা
প্রশ্ন: ১৯৪৭-এর পর পূর্ব পাকিস্তান এবং ১৯৭১-এর বাংলাদেশ এই পর্ব দুটি আপনার চিন্তার জগতকে কিভাবে প্রভাবিত করেছে?
আহমদ ছফা: পাকিস্তান যখন হয় তখন আমি শিশু। পরবর্তী সময়েও পাকিস্তান আমার মনের ওপর কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি। বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে আমি ক্লাস থ্রি বা ফোরের ছাত্র ছিলাম। সে সময় বাংলা ভাষার দাবিতে আমিও মিছিলে গেছি এবং আমার এক ভাই একুশে ফেব্রুয়ারির আন্দোলনে মুসলিম লিগারদের হাতে মার খায়। তার থেকেই পাকিস্তানের কোনও প্রভাব আমার মনে কখনো কাজ করে নি। বরং আমার আকর্ষণ ছিল কোলকাতার প্রতি। ওখানকার পত্রপত্রিকা ও সাহিত্যের প্রতি আমার ছিল প্রবল টান। ‘নবজাতক’ নামে মৈত্রেয়ী দেবী কোলকাতা থেকে একটা পত্রিকা বের করতেন। ১৯৬৫ সালে সেই পত্রিকা তিনি আমার কাছে পাঠাতেন, আমি পত্রিকা বিক্রি করে তাকে টাকাটা পাঠিয়ে দিতাম। পূর্ব বাংলায় আমাদের বাঙালি অবস্থানটা শক্ত করার প্রয়োজনেই সেই সময় আমরা কোলকাতার দিকে অণুপ্রেরণার জন্য তাকাতাম। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম এবং স্বাধীনতার পর, অন্য আর একটা অনুভব আমার মধ্যে এল, তা হচ্ছে-ভবিষ্যতে হয়তো কোলকাতার দিকে আর আমরা তাকাতে পারবো না। কিংবা কোলকাতার প্রতি আমাদের আকর্ষণের প্রেরণাটাও আর হয়তো থাকবে না। কারণ কোলকাতা আমাদের অতীতের প্রেরণা এবং অতীত ঐতিহ্যের উৎস হতে পারে, কিন্তু একাত্তরে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিশেবে কোলকাতা আর আমাদের কিছু দিতে পারবে না এবং আমাদের কক্ষপথ আমাদেরই আবিষ্কার করে নিতে হবে। সেই কক্ষপথ অনুসন্ধানের জন্যে, আমাদের সমস্ত কাজকর্ম ও চিন্তা নিয়োগ করেছি। শুধু আমরা নয়, বাংলাদেশের একটা অংশের মানুষের মধ্যে এ চিন্তাটা এসেছে যে, বাংলাদেশকে তার নিজের মেরুদণ্ডের ওপর দাঁড়াতে হবে, নিজেকে আবিষ্কার করতে হবে।
প্রশ্ন: বাঙালি মুসলমান মানসে পাকিস্তান আন্দোলন কোন প্রক্রিয়া সে সময় সৃষ্টি করেছিল, যার জন্য তারা পাকিস্তান চেয়েছিল?
আহমদ ছফা: এটা খুব জটিল বিষয়। আমার খুব আশঙ্কা হয় সে কারণটা এখনো যায় নি। মুসলিম লীগ এখানেই হয়েছিল। মুসলীম লীগের ভিত্তি এবং শক্তি ছিল বাংলাতেই। ইতিহাসের পাতা উল্টালে আপনি লক্ষ্য করবেন যে, বাংলার অ্যাসেমব্লির মুসলমান সদস্যরা বাংলা ভাগ চান নি এবং তারা স্বাধীন বাংলার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। বাংলার অ্যাসেমব্লির যে সব সদস্য বাংলা ভাগের পক্ষে মত দিয়েছিলেন, তাদের চার ভাগের তিন ভাগ ছিলেন হিন্দু এবং শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি ক্রমাগত এটাই বলেলেন যে ভারতকে এক রাখ কিন্তু বাংলাকে ভাগ করে দাও। হ্যা, বাংলার মুসলমান জনগণ পাকিস্তান চেয়েছিল। কিন্তু সুক্ষ্মভাবে দেখলে বাংলা ভাগ জিন্নাহও চাননি। অনেক সময় বাংলা ভাগের জন্যে বাংলার মুসলমানদের দায়ী করা হয়, এটা সঠিক নয়।
প্রশ্ন: এই পরিপ্রেক্ষিতে আপনি কি বাংলার হিন্দুদেরই বাংলা ভাগের জন্য দায়ী করবেন?
আহমদ ছফা: অচিন্ত বিশ্বস, ‘তপসীলি রাজনীতি’ শীর্ষক একটি লেখায় বলেছেন, তিন থেকে ছ’ভাগ লোকের (বর্ণহিন্দু) স্বার্থে বাংলা ভাগ করা হয়েছে। বক্তব্যটা অমূলক নয়। জয়া চ্যাটার্জ ‘Bengal divided Hindu Communalism and partition’ বইতে এসব তুলে ধরেছে।
প্রশ্ন: ’৪৭-এ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলা গঠনে আবুল হাশিম এবং শরৎ বসুদের প্রচেষ্টা সফল না হবার কারণও কিওই তিন থেকে ছ’ভাগ বর্ণহিন্দুর স্বার্থ?
আহমদ ছফা: না, না, ওটাই একমাত্র কারণ নয়। ওই একটি কারণেই ওই রকম একটা বিরাট ঘটনা ঘটে নি। প্রথমত প্রভাব প্রতিপত্তির দিক দিয়ে ১৯৩০-এর পর বাংলা ভাষা চতুর্থ ভাষা হয়ে গেল কোলকাতায়। প্রথম ভাষা ইংরেজী, দ্বিতীয় ভাষা হিন্দি, তৃতীয় ভাষা উর্দু। তারপর মহাযুদ্ধ, ওই যুদ্ধ বাঙালির অর্থনীতিকে সম্পূর্ণ ভেঙ্গে দিল এবং বাঙালির রাজনীতি সম্পূর্ণভাবে নির্ভর হয়ে গেল পশ্চিমী অবাঙালিদের ওপর। বাংলা ভাগের জন্যে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিদের অর্থটা দিয়েছিল টাটা। যে কারণে সুভাষ বোসকে কংগ্রেস ছাড়তে হল, এমনকি শেষ পর্যন্ত দেশও ছাড়তে হল। গান্ধী এবং নেহেরুকে টাকা দিত মাড়ওয়ারি এবং গুজরাটিরা। একজন বাঙালি সভাপতিকে তারা টাকা দিতে রাজি ছিল না এবং গান্ধী নেহেরু কখনই চান নি সুভাষ বসুর মত একজন বাঙালি কংগ্রেস দলের সভাপতি হোন বা থাকুন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ না হলে এবং বাঙালির অর্থনীতিটা ভেঙ্গে না গেলে হয়তো বাঙালির এই পরিণামটা হত না।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের কিছু মানুষ মনে করেন যে পাকিস্তান হয়েছিল বলেই, পর্ব বাংলার মানুষ বাংলাদেশে পেয়েছে। আপনিও কি এই মতের অনুসারী?
আহমদ ছফা: এর মধ্যে সত্যতা আছে, কিন্তু সম্পূর্ণ সত্য নয়। ইতিহাসের আরও পেছনে যাওয়া দরকার। যেমন পশ্চিম বাংলার অর্থনীতিবিদ ও চিন্তাশীল লেখক ড. অশোক মিত্র বলেছেন, ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ রদ না হলে, অর্থাৎ তখন যদি বঙ্গ বিভাগ হত তবে বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্তের বিকাশ ঘটতো এবং বিকশিত বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত হিন্দুদের সাথে একটা সমঝোতা করে নিত। ফলে ১৯৪৭ দেশ ভাগের কোন প্রয়োজন ঘটতো না। বাংলা ভাগ না হলে ভারতও ভাগ হতো না। কারণ বাংলার বাইরে পাকিস্তানের অস্তিত্ত্ব কোথাও ছিল না। মুসলিম লীগ এখানেই হয়েছে এবং এখানেই ছিল পাকিস্তানের পক্ষে মুসলিম লীগের জনভিত্তি। এছাড়া চিত্তরঞ্জন দাসের ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ যদি কার্যকার হত, তাহলেও বাংলা ভাগ হতো না। তারপর ধরুন ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান, যাতে বাংলা আসামকে একটা জোন করা হবে বলা হয়েছিল। এটা মেনে নেয়া হলেও বাংলা ভাগ হত না। অর্থাৎ কিছু ঐতিহাসিক অনিবার্যতা দীর্ঘকাল ধরে যা হয়ে আসছিল তার চূড়ান্ত অভিঘাতে বাংলা ভাগ হয়েছে।
প্রশ্ন: পাকিস্তান ভাঙ্গার পেছনে কোন ঐতিহাসিক অনিবার্যতা কাজ করেছিল?
আহমদ ছফা: বাঙালি মুসলমানের জাতীয়তাবোধ। কিন্তু শূন্য থেকে তো জাতীয়তাবোধ জন্মায় না। এখানে (পূর্ব বাংলা) যে মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে উঠল তারাই প্রথম অনুভব করলো রাজনীতি, অর্থনীতি, ভাষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানি আধিপত্য প্রতিরোধ করতে না পারলে, বাঙালি হিশাবে তাদের বিকাশ সম্ভব নয়। মওলানা ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিব এরা ছিলেন পাকিস্তান আন্দোলনের নেতা। পরে পাকিস্তানকেও ভাঙ্গতে হল, কারণ ভাগে মিলছিল না। এটা একটা হিশাব, আর একটা হিশাব আছে। অর্থাৎ একটা জাতি কোন উপলক্ষে জেগে ওঠে, কত গভীরে তার প্রভাব পড়ে, অতি তুচ্ছ কারণেও কোনও ঘটনা ঘটতে পারে- কিন্তু তার প্রভাব অনেক সময় দীর্ঘস্থায়ী হয়। সেই দিক থেকে বাঙালি জাতির ইতিহাসে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেয়ে প্রভাব সঞ্চারী বড় কোন ঘটনা নেই।
প্রশ্ন: পূর্ব বাংলার বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয়ের শিকড় অনুসন্ধানে এবং জাতি পরিচয় জেগে ওঠার পেছনে বাংলা ভাষার প্রশ্ন বা প্রভাব কতটা ছিল?
আহমদ ছফা: ভাষা ভিত্তিক জাতি পরিচয়ে ভাষাই প্রধান। ভাষা হল অধিকার উচ্চারণের প্রধান মাধ্যম। এই ভাষার সাথে অর্থনৈতিক বিষয়টাও যুক্ত ছিল যে নিউ মিডল ক্লাস তৈরি হচ্ছিল, তারা চাকরি-বাকরি পেত না যদি বাংলা রাষ্ট্রভাষা না হতো। পূর্ব বাংলার মানুষ তখন তাদের অধিকার এবং অংশ চাইছিল। পূর্ব বাংলাকে তখন একটা স্বাধীন রাষ্ট্র হিশেবে চাওয়া হয় নি। বাংলা রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করা হয়েছি। বাংলা রাষ্ট্রভাষা হবার পর অন্য ইস্যুগুলো এলো, বৈষম্যগুলো পূর্ব বাংলার মানুষের কাছে স্পষ্ট হতে থাকলো। ওই বৈষম্যের বিরুদ্ধে ক্ষোভ দানা বাধতে থাকলো চাকরিতে বৈষম্য, সামরিক বাহিনীতে বৈষম্য, অর্থনৈতিক উন্নয়নে বৈষম্য ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে পূর্ব বাংলার বৈষম্য ছিল। এই বৈষম্যগুলোকে রাজনৈতিক বিষয় হিশেবে পূর্ব বাংলার মানুষের কাছে তুলে ধরা হলো এবং তাতে মানুষ ব্যাপকভাবে সাড়া দিলেন এবং শেষ পর্যন্ত অস্ত্র তুলে ধরলেন পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করার জন্যে। তবে পূর্ব বাংলার প্রতি নানা বৈষম্যের প্রতিবাদে যারা পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংগ্রাম আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন এক সময় এরা ছিলেন পাকিস্তান আন্দোলনের নেতা।
প্রশ্ন: এখানে কি আপনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে উল্লেখ করছেন?
আহমদ ছফা: তা বলতে পারেন। মুসলিম লীগের রাজনীতিতে শেখ মুজিব ছিলেন সোহরাওয়ার্দীর শিষ্য এবং গুরু শিষ্য দু’জনেই ছিলেন পাকিস্তান আন্দোলনের নেতা। বাংলাদেশ যারা স্বাধীন করেছেন এক সময় তাদের বেশির ভাগই ছিলেন মুসলিম লীগে। মুসলিম লীগের Extension or junior partner।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে এবং মুক্তিযুদ্ধে এখানকার বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বামপন্থী, বুর্জোয়া এবং চরম দক্ষিণপন্থী জামাত শিবিরের দৃষ্টিভঙ্গি এবং রাজনৈতিক অবস্থান?
আহমদ ছফা: শেখ মুজিবের প্রতি প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী এবং রাজনীতিকদের একটা সন্দেহ ছিল। শেখ মুজিব গোড়া থেকে ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঘেষা এবং আমি আগেই বলছি, তার রাজনৈতিক গুরু ছিলেন সোহরাওয়ার্দী। তিনি ছিলেন পশ্চিমা ব্লকের লোক। এই পরিস্থিতিতে পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে এখনকার বামপন্থী দলগুলো যে বিরাট ভুল করেছে তা প্রায় আত্মহননের শামিল। একটা সময় বামপন্থীরাই ছিলেন পূর্ব বাংলার প্রধান রাজ্যনৈতিক শক্তি। ১৯৬৫ সালের পূর্বে অবিভক্ত ন্যাপ বা ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিই ছিল পূর্ব বাংলা প্রধান রাজনৈতিক শক্তি। ন্যাপের সাথে ছিল কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়ন সাংস্কৃতিক সংঘ, মহিলা পরিষদ শ্রমিক সংগঠন, কৃষক সমিতি। সব মিলিয়ে একটা বিরটা শক্তি। সে সময়টা ছিল বামপন্থী রাজনীতির স্বর্ণযুগ। বাংলাদেশের বামপন্থী রাজনীতির বর্তমান দৈন্যদশা দেখে পূর্বের অবস্থা কল্পনা করতে পারবেন না। চীন না সোভিয়েত কে সাচ্চা, এই প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায় আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলন। যার আঘাত নেমে আসে পূর্ব বাংলার বাম রাজনীতিতে। দু’টুকরা হয়ে যায় ন্যাপ। ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিব যখন বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রশ্নটি সামনে এনে ছ’দফা ঘোষণা করেন তখন পূর্ব বাংলার বামপন্থী মস্কো এবং পিকিং শিবিরে ভাগ হয়ে পারস্পরিক বাদ-বিসংবাদে মত্ত। এবং দুই শিবির থেকেই ছ’দফার নিন্দা এবং বিরোধিতা করা হয়। অথচ ১৯৫৪ সালে ন্যাপ নেতা অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ‘হোয়াট ইজ অটোনমি’ পুস্তকটি লিখে পূর্ব বাংলার জাতিসত্তার বিষয়টি তুলে ধরেছিলেন। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট আন্দোলন বিভক্ত হবার পর পূর্ব বাংলার বামপন্থীদের কাছে আন্তর্জাতিক ভাবনাই একমাত্র গুরুত্ব পেল।
View this link
১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে রাশিয়ার মধ্যস্থতার পর মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি বলল, আমরা অখণ্ড পাকিস্তানে বিপ্লব করবো। অন্যদিকে পাক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান পিকিং-এর সাথে ভাল সম্পর্ক তৈরি করেছে। সেই সম্পর্কের ভিত্তিতে মাও সেতুং ভাসানীকে বললেন, ডোন্ট ডিস্টার্ব আইয়ুব, সে (আইয়ুব) সমাজতন্ত্রেকে সমর্থন করবে। ফলে সে সময় চীন পন্থীদের মধ্যে পাক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব বিরোধীতা না করার মানসিকতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং মুজিবের ছয়দফার মধ্যে তারা (চীনপন্থী কমিউনিস্ট) সিআইএ-এর গন্ধ আবিষ্কার করলেন। অন্যদিকে ছ’দফার সমর্থনে শহর, বন্দর, গ্রাম, গঞ্জ সর্বত্র প্রবল গণজোয়ার সৃষ্টি হল। সে সময় পূর্ব বাংলার যে একটা মধ্যবিত্ত শ্রেণী তৈরি হয়েছে, বাঙালির একটা জাতীয়তাবাদী আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি হয়েছে, সংগ্রামের একটা স্তরে সে উন্নীত হয়েছে- মস্কো বা পিকিং দুই পন্থীরাই তা শনাক্ত করতে পারে নি। বাঙালির জাতিগত আকাঙ্ক্ষার রাজনৈতিক উন্মেষকালে এরা সঠিক কোন অবস্থান নিতে পারে নি। ছয় দফার প্রতি মানুষের সমর্থন এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের অপ্রতিহত জয়যাত্রা দেখে মস্কোপন্থীরা ছ’দফার প্রতি সমর্থন জানাতে গেলে, শেখ মুজিব এক বাক্যে তাদের জানিয়ে দেন –দলের সাইনবোর্ড পাল্টে আওয়ামী লীগে যোগ দিন।
এছাড়া চারু মজুমদারের শ্রেণীশত্রু খতমের রাজনীতি চীনপন্থী কমিউনিস্টদের প্রবলভাবে প্রভাবিত করে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার পর আমি পশ্চিম বাংলায় ছিলাম। সে সময় পশ্চিম বাংলার বিভিন্ন জায়গায় দেওয়ালে দেখেছি সিপিআই(এম-এল)-এর পক্ষে শেখ মুজিব এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে নানা রাজনৈতিক শ্লোগান লেখা রয়েছে। এক সময় আব্দুল হক এবং মোহাম্মদ তোয়াহা ভাসানীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সারা দেশে হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুট, ধর্ষণ ইত্যাদী নির্বচারে চালাচ্ছে, আবদুল হক সাহেব তখন অখণ্ড পাকিস্তানের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। মোহাম্মদ তোয়াহা এবং সুখেন্দু দস্তিদার আবদুল হকের বিরোধীতা করে দেশের অভ্যন্তরে প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেন। ভাষা আন্দোলনের নেতা আব্দুল মতিন, আলাউদ্দিন, অধ্যাপক অহিদুর রহমান-রা উত্তরবঙ্গের আত্রাই অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র নেতৃত্ব দেন। চিনপন্থী সিরাজ শিকদার স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা কায়েম করার লক্ষ্যে একাধিক সশস্ত্র সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন। তিনি(সিরাজ শিকাদর) পাকিস্তান এবং ভারত-এই দুই থাবা থেকেই পূর্ব বাংলাকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন।
বামপন্থীদের সংগ্রাম থেকেই বাঙালি জাতীয়তার বোধটি এখানেই অঙ্কুরিত হয়েছিল এবং তাদের নেতা ও কর্মীদের পরিচর্যায় তার বিকাশ। সেই কারণেই নানা অত্যাচার ও নির্যাতন তাদের এক সময় ভোগ করতে হয়েছে। শুনতে হয়েছে পাকিস্তান সংহতির শত্রু, বিদেশী গুপ্তচর, ইসলামের দুশমন ইত্যাদি অভিযোগ। কিন্তু সঠিক সময়ে সঠিক অবস্থান না নিতে পারার কারণে সে সবই ব্যর্থ হয়, সৃষ্টি হয় এক ব্যাপক গণবিচ্ছিন্নতা। আজ সেই গণবিচ্ছিন্নতারই ভিতরে রয়েছে এখনকার বামপন্থীরা। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর সমস্ত অপকর্মের দোসর জামায়তের ঘৃণ্য ভূমিকা তো জানেন।
প্রশ্ন: যে লক্ষ্য এবং স্বপ্নকে সামনে রেখে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা প্রাপ্তির ২৬ বছর পর সেই স্বপ্ন কতটা সফল। কিংবা স্বাধীনতা প্রাপ্তির ছাব্বিশ বছরের এই পর্বটিকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
আহমদ ছফা: প্রথম স্বপ্নটা তো বাস্তবায়িত হয়েছে। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিশেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত বাংলার রাজনীতিকে যারা পরিচালনা করতেন তারা ছিলেন উচ্চ বর্গীয় অভিজাত। এখন সন অফ দি সয়েলরা রাজনীতিতে আসছেন। অন্যদিকে আশংকার দিকটি হল এখানে রাতারাতি একটি ইকোনমিক ক্লাস গ্রো করেছে। এই ইকোনমিক ক্লাসটি গড়ে উঠেছে ইকোনমিক প্লানডার(plunder) এবং লুণ্ঠন থেকে। লুণ্ঠনটা হয়েছে ব্যাপকহারে। এমন কয়েকজনকে আমি জানি, মুক্তিযুদ্ধের সময় যাদের ২৫শ’ টাকা ছিল না, এখন তাদের ক্যাপিটাল ২৫শ’ কোটি টাকা। রাজনৈতিক ক্ষমতাকে প্রয়োগ করে তারা এই টাকা আয় করেছে। এর ফলে যে সমস্যার মধ্যে আমরা পড়েছি- যদি পশ্চিম বাংলার সাথে বিষয়টি তুলনা করি বুঝতে সুবিধা হবে। পশ্চিম বাংলার মত (১৯৯৬) বিধানসভা নির্বাচনের আগে (১৯৯১) বর্ধমানে কালু ডোম বলে এক ব্যক্তি কংগ্রেসের এক সর্বভারতীয় ব্যক্তিকে পরাজিত করেছিলেন। এ চিত্র আপনি এখানে পাবেন না। কারণ আওয়ামী লীগ বলুন, বিএনপি বলুন, জাতীয় পার্টি বলুন, জামায়াতের কথা একটু স্বতন্ত্র, সব দল চলছে বাংলাদেশের নব্য ধনীদের অবৈধ উপায়ে আয় করা টাকার ওপর। কাজেই পশ্চিম বাংলার কালু ডোমদের মতো কোন প্রতিনিধি বাংলাদেশের সংসদে যেতে পারবেন না। এখানকার পত্রপত্রিকায় ঋণখেলাপী বলে একটা ব্যাপার দেখে থাকবেন। ব্যাংকগুলো থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে, ঋণ শোধ করা হচ্ছে না। ব্যাংকগুলো এর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে পারছে না, কারণ এদের পক্ষে আছে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। বাংলাদেশের সব বুর্জোয়া দল চলে এদের চাদায়। এর ফলে বাংলাদেশে যে সংসদীয় ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে সেই সংসদে জনগণের সত্যিকার চিন্তা-ভাবনা, আশা-আকাঙ্খার কোন প্রতিফলন ঘটছে না। আপনি ঢাকায় এসে দেখলেন বিএনপির দু’জন এমপি আওয়ামী লীগের মন্ত্রী হলেন। ক্ষমতায় থাকার সময় বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি এইভাবে অন্য দলের এমপি ভাগিয়ে এনে মন্ত্রী বানিয়েছেন। এইভাবে বাংলাদেশের ক্ষমতার রাজনীতিটা একটা দুষ্ট চক্রের মিউজিক্যাল চেয়ারে পরিণত হয়েছে।
আরো পড়ুন.............
View this link
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুলাই, ২০১০ রাত ১:০৮