বাংলাদেশের মেগা প্রজেক্ট পদ্মা সেতুর ১০ নম্বর পিলারে আবারও ধাক্কা দিয়েছে কাকলি নামের ছোট্ট একটি ফেরি। এর আগে গত ৯ আগস্ট একই পিলারে অন্য একটি ফেরি রো রো বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর সজোর ধাক্কা দিয়েছিল। ধাক্কা লাগার ঘটনা এই প্রথম নয়। প্রথমবার পদ্মা সেতুর ১৬ নম্বর পিলারের সঙ্গে ধাক্কা খায় রো রো ফেরি শাহ মখদুম। রো রো ফেরি শাহজালাল ১৭ নম্বর পিলারে ধাক্কা দিয়ে খবরের শিরোনাম হয়। পিলারের সাথে ফেরির ঘন ঘন ধাক্কা- সংঘর্ষ সরকার ও জনগণের মনে নানা প্রশ্নের উদয় হয়েছে। অনেকে এর সাথে বিভিন্ন "ষড়যন্ত্র তত্ত্ব" খুঁজে বেড়াচ্ছেন।
আওয়ামীগের এক নেতা তো বলেই ফেলেছেন এর সাথে কোন ষড়যন্ত্র আছে কিনা খতিয়ে দেখা হবে। আবার কিছু কিছু মানুষ এই ধারণা পোষণ করে যে যেহেতু চায়নারা এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সেহেতু পিলারের সাথে ফেরির সংঘের্ষ ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা 'র' এর হাত থাকতে পারে।
আওয়ামী মাইন্ডের লোকদের ধারণা সংঘর্ষ ঘটনার সাথে জামায়াত-বিএনপি সরাসরি জড়িত । তারেক জিয়া এই ঘটনার মাস্টার মাইন্ড।
বিএনপির লোকজন আশা করে পিলারের সাথে ফেরির ধাক্কা লাগার ঘটনা নিয়ে ওবায়দুল কাদের কিংবা হাসান সাহেব বিএনপিকে সরাসরি দায়ী করে মিডিয়াতে বক্তব্য দিবেন এবং পরবর্তীতে তাদের বক্তব্য নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে ব্যাপক ট্রল হবে। এর লজিক কারণও আছে। রানা প্লাজা ট্রাজেডির সময় ব্রিটিশ সম্প্রচার কেন্দ্র বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীর বলেছিলেন, ‘‘কিছু হরতাল সমর্থক ভবনটির ফাটল ধরা দেয়ালের বিভিন্ন স্তম্ভ এবং গেট ধরে নাড়াচাড়া করেছে বলে তিনি জানতে পেরেছেন৷'' স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যোগ করেন, ‘‘ভবনটি ধসে পড়ার পেছনে সেটাও একটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে৷''। সে সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্যে দেশ বিদেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিলো।
কিন্তু আমি ভাবছি ভিন্ন কথা। আপনারা খেয়াল করলে দেখতে পাবেন যে, ধাক্কা লাগার যত ঘটনা ঘটেছে তা কিন্তু সম্পূর্ণ স্পান বসানের পর। পিলার পাইলিংয়ের সময় কিন্তু ধাক্কার কোন খবর পাওয়া যায়নি। পদ্মা নদী একটি বিশাল উন্মুক্ত জলরাশি দ্বারা বেষ্টিত এলাকা। পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হওয়ার আগে কিন্তু এই উন্মুক্ত জলরাশিতে ফেরির মাস্টার-সুকানিদের ফেরি চালাতে তেমন কোন সমস্যা হয়নি। বিশাল জলরাশিতে আঁকাবাঁকা করে যেভাবে হোক তারা গন্তব্যে গিয়েছেন। কিন্ত যখন পিলারের কাজ আরম্ভ হলো এবং পিলার মাথা গজাইতে শুরু করল তখন পদ্মার জলপথ বিভিন্ন ভাগে ভাগ হলো। তখন ফেরি চালানোর সময় মাস্টার-সুকানিদের মানুষিক ভাবে কিছুটা চাপ অনুভূত হয়েছে। কিন্তু তেমন একটা প্রভাব ফেলতে পারেনি। তারা মনে করত, পদ্মার শাখা নদীতে ফেরি চালাচ্ছি। অর্থাৎ এই চাপ তারা উত্তরে গেছেন। কিন্তু যখন থেকে সেতুর উপর স্পান বসানো হলো তখন থেকে তাদের মানুষিক চাপ আরো বেড়ে গেলে। তাদের চোখের সামনে বিশাল কংক্রিটের স্থানা ভেসে উঠল। তাদের সামনে বিশাল জলরাশির একটি নির্দিষ্ট সীমারেখা বড় করে দেখা দিলো এবং সাথে বর্ষার প্রবল স্রোত তাদেরকে নানাভাবে চ্যালেঞ্জ জানালো। এহেন পরিস্থিতিতে, জলপথের এই সীমাবদ্ধতা এবং প্রবল স্রোত হয়ত মাস্টার সুকানিদের পক্ষে সব সময় জয় করা সম্ভব হয়নি। তাই মাঝে মধ্যে ফেরির সাথে পিলারের ধাক্কার ঘটনা ঘটেছে এবং খবরে হেড লাইন হচ্ছে।
আপ্নারা যারা নব্বই বা তার আগে গ্রামে বড় হয়েছেন তাদের মনে থাকার কথা, আগেরকার দিনে গ্রাম গঞ্জে প্রচুর খাল ছিলো। বর্ষার সময় সেই খাল ভরা যৌবনে টগবগিয়ে উঠত এবং তাতে প্রচুর স্রোত ছিল। সেই খালের মধ্যে আবার বাঁশের সাঁকো এবং কাঠের পুল থাকতো। মাঝিরা যখন খালের মধ্যে দিয়ে নৌকা বা ট্রলার চালাতেন তখন স্বাভাবিক ভাবেই চালাতন, কিন্তু যখন সাঁকো কিংবা পুলের নিচে আসতেন তখন তারা নৌকা বা ট্রলার অধিক সর্তকতার সাথে চালাতেন। অনেক সময় গতি কমিয়ে দিতেন। তারপরও মাঝেমধ্যে সাঁকো কিংবা পুলের খুঁটির সাথে ছোট বড় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। সড়কেও অনেক দুর্ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে। কোন কোন দুর্ঘটনা অদক্ষতা কিংবা যান্ত্রিক কারণে ঘটছে।
উন্নত প্রযুক্তি থাকা সত্ত্বেও আকাশ পথে বিমান দুর্ঘটনা ঠেকানো যাচ্ছেনা।
সুতরাং ষড়যন্ত্র তত্ত্ব খোঁজার আগে দক্ষ মানব সম্পদ, টেকশই এবং নিরাপদ নৌ পথ তৈরি করার কোন বিকল্প নেই। এই লক্ষে ফেরির মাস্টার-সুকানিদের দক্ষ ও মানুষিকভাবে স্বাবলম্বি করতে হবে। তাদেরকে ব্রেন কাউন্সিলিং করা যেতে পারে। তাদের জীবন ধারণের পদ্ধতির উপর ফলোআপ করা যায়। কেউ নেশা জাতীয় কিছু পান করে কিনা খতিয়ে দেখতে হবে। পদ্মা সেতু হলে তাদের পেশাগত জীবন জীবিকার কোন ক্ষতি হবে কিনা তাও নিরুপন করতে হবে। সম্ভাব্য ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ কিংবা কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে হবে। তাছাড়া ফেরি চলাচলের পথ নিদিষ্ট করে তাতে সর্তক মূলক বিভিন্ন সাইন বসানো যেতে পারে। ব্রিজের নিদিষ্ট সীমারেখায় অনুকূল ও প্রতিকূল স্রোতের মধ্যে ফেরি চালানো জন্য অভিজ্ঞ ট্রাইনী দ্বারা মাস্টার সুকানি ও ওয়ার্ড বয়দের ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করতে হবে ।
মনে রাখতে হবে, পদ্মা সেতু জনগণের ঢাকায় গড়ে উঠা একটি মেগা প্রকল্প। এর কৃতিত্ব আওয়ামী সরকারের। নিরাপত্তার দায়িত্বও আপাতত আওয়ামী সরকারের হাতে। পদ্মা সেতু টেকসই ও নিরাপদ হবে এটাই জনগণের প্রত্যাশা।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই আগস্ট, ২০২১ রাত ৯:৪৪