দেশে ধর্ষণের জোয়ার চলছে। পাশাপাশি প্রতিবাদের ঢেউ উঠেছে। এই প্রতিবাদ সাময়িক এবং কিছুদিন পর ম্রিয়মান হয়ে যাবে। প্রতিবাদীদের নির্দিষ্ট কোন লক্ষ্য নেই। অনেকেই অনেকের মত প্রতিবাদ করছেন। ধর্ষণ প্রতিরোধে অনেকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ডের কথা বলেছেন। তবে প্রতিবাদ যতটা না রাজপথে হচ্ছে তারচেয়ে বেশি হচ্ছে ফেসবুকের ওয়ালে। খবরের কাগজে পড়লাম অনেক জায়গায় ধর্ষণের প্রতিবাদ করতে গিয়ে পুলিশ এবং ছাত্রলীগের হামলার শিকার হয়েছেন!।
যেদেশে ক্ষমতাসীন দ্বারা রাষ্ট্র প্রতিনিয়ত ধর্ষণের শিকার হয় সেদেশে শাসক দলের অনুসারী এবং স্থানীয় প্রভাবশালী দ্বারা নারী ধর্ষণ একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। যতদিন পর্যন্ত না ক্ষমতাসীন দ্বারা রাষ্ট্রকে ধর্ষণ করা থামছে ততদিন পর্যন্ত ধর্ষণ একটি পারিপার্শ্বিক চাপানো বিষয় হয়ে থাকবে। আমাদের এক বিশেষ প্লাস অজ্ঞ মন্ত্রী সাহেব বলেছেন, ‘পৃথিবীর সব দেশেই ধর্ষণ হয়’!। বাহ্ কি চমেৎকার কথা। এখন উনার পরিবারের কেউ ধর্ষণের শিকার হলে উনি এই বাণীর মাধ্যমে নিশ্চয়ই শান্তনা খুঁজবেন। ক্ষমতাসীন এবং রাষ্ট্রীয় পদে থেকে এই উক্তির মাধ্যমে উনি তো নিজেই রাষ্ট্রকে একটি বড় ধরণের ধর্ষণ করেছেন।
অনেকে মনে করতে পারেন ধর্ষণ আগের তুলনায় বেড়েছে, আমি বলছি মোটেও না। ধর্ষণের গ্রাফ মোটামুটি আগের মতই আছে। আগে ধর্ষণের শিকার হলে দৈনিক নিউজে খুব কম আসতো। অনেকে আবার লোক লজ্জার ভয়ে বিষয়টি লুকিয়ে রাখত। কিন্তু বর্তমানের কেউ ধর্ষণের শিকার হলে নিউজটি খুব সহজেই সোশ্যাল মিডিয়ায় পাব্লিশ হয়ে যায়। ধর্ষণের কোন মামলা থানায় রেকর্ড হলে জাতীয় পত্রিকায় গুরুত্ব সহকারে কাভার পায়। আর যদি ধর্ষণ সম্পর্কিত কোন ভিডিও ক্লিপ থাকে তাহলে তো কোন কথাই নাই। মুহুর্তের মধ্যে ভাইরাল এবং দ্বিগুণ গতিতে ভাইরাল হয়ে যায়। এই ভাইরালের পিছনেও ধর্ষকদের হাত আছে। অনেকে ভিডিওর ভিতরে ধর্ষকদের রগরগা দৃশ্য এবং নারীর অসহায়ত্ব দেখার জন্য ক্লিক করেন। ধর্ষকদের মর্দানী এবং নারীর আকুতি মিনুতি তাদেরকে বিনোদিত করে। সর্বশেষ সমাজে ভালো মানুষ সাজার জন্য ফেবুতে ধর্ষণ বিরোধী পোস্ট লিখে! এইভাবে পোস্টাতে পোস্টাতে ভিডিওটি ভাইরাল হয়ে যায়। এরাও এক ধরণের ধর্ষক। এদেশের কোন কিছুর তড়িৎ এবং সঠিক বিচার পেতে হলে ভাইরাল হতে হয়। তাই বাংলাদেশের তড়িৎ বিচার ব্যবস্থা ভাইরালের সমানুপাতিক।
আমাদের দেশে প্রতি নিয়ত ধর্ষণ হচ্ছে। কাউকে হয়ত কাজ দেওয়ার কথা বলে, কাউকে ফাঁদে ফেলে, কাউকে জোর করে, শিশুদের চকলেট, বিস্কুট দেয়ার লোভ দেখিয়ে অথবা একা পেয়ে ধর্ষণ করছে। হালে যোগ হয়েছে বিয়ে কিংবা টাকার প্রলোভনে ধর্ষণ!!
এই ধর্ষণের যারা স্বীকার হচ্ছেন তারা হলো নিন্মবিত্ত পরিবারের। এই সোনার বাংলায় কুলাঙ্গার দ্বারা ধর্ষিত হওয়ার পর পুলিশের কাছে আশ্রয় নিতে গেলে পুলিশ দ্বারা পুনরায় ধর্ষণের নজির আছে। বগুড়ায় পুলিশ কর্তৃক ইয়াসমিন ধর্ষণ এক জ্বলন্ত উদাহরণ। ধর্ষকের তালিকায় মসজিদের ইমাম, মন্দিরে পুরাহিত, স্কুল মাদ্রাসা শিক্ষক, বিরোধী দল, ক্ষমতাশীল দলের কুলাঙ্গার সহ কোট-টাই পরিহিত ভদ্রলোকগণ আছে। তাছাড়া কওমী মাদ্রাসায় শিশু বলৎকারের ঘটনা অহরহ ঘটছে।
এই সমস্ত কুলাঙ্গার দ্বারা অসহায় ও নিন্মবিত্ত পরিবারের মেয়েরা ধর্ষিত হলে তা খুব কম সময় মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। উদাহরণ স্বরূপ "আপন জুয়েলার্সের" বেজন্মা সন্তান যখন একজন ঢাকাইয়া লেডিকে প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ করে, ঠিক একই সময়ে গাজীপুরে এক অসহায় পরিবারের ছোট্ট একটি মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়। গাজীপুরের মেয়েটির বেলায় আমরা চুপ থাকলেও বনানীর রেইনট্রি ঘটনা নিয়ে কতই না লাফালাফি করেছি। গরীবের এই লম্ফজম্ফের কারণ হলো- আপন জুয়েলার্সের কুলাঙ্গারদের উপর আমাদের আলাদা ক্ষোভ আছে। কারণ, তারা উপর জাতের জীব। আমাদের লাফানোর কারণে যদি তারা ঘাটের ঘোলা পানি খায় তাহলে কম কিসের? তাছাড়া অনেকে হুজুগে, কেউ আবেগে, কেউ প্রতিবাদী হয়ে এবং কেউ কেউ নারীবাদীর জাত রক্ষা করতে গিয়ে প্রতিবাদের ঝড় তুলেন। অথচ গাজীপুরের ঘটনাটি আমরা অবলীলায় পাশকাটিয়ে গেছি! কারণ সমাজে তাদের জাত বা ক্লাসিফিকেশন নেই বলে। গাজীপুরের মেয়েটির পরিবার ধর্ষণের বিচার পেয়েছিলো ট্রেনের নিচে বাবা-মেয়ে এক সাথে আত্মহুতি দিয়ে।
বর্তমানে ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের যে জোয়ার উঠেছে এর প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে সিলেটের এমসি কলেজে ক্ষমতাসীন ছাত্রলীগের নেতাদের দ্বারা স্বামীকে আটকিয়ে গৃহবধূকে ধর্ষণের মাধ্যমে । কত বড় জাগ্রত জানোয়ার হলে স্বামীর সামনে স্ত্রীকে ধর্ষণ করতে পারে! একটু চিন্তা করুণ। এই সমস্ত জানোয়ারা এবং তাদের মতাদর্শী জাত ভায়েরা দেশকে ধর্ষণের পাশাপাশি সুযোগ পেলেই নারীদের খামছে ধরছে, কামড়ে ক্ষত বিক্ষত করছে জীবন্ত দেহ। এযেন ৭১ একাত্তরের পাক বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোশরদের কর্তৃক দুই লক্ষ মা বোন নির্যাতনের প্রতিছায়া। বাংলাদেশের এই নব্য ধর্ষকদের প্রতি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আলাদা ক্ষোভ আছে। এই ক্ষোভ মিটানোর জন্য অনেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় এবং কেউ কেউ রাজপথে প্রতিবাদ করছেন। এই প্রতিবাদকারী কেউ কেউ আবার বেঙ্গল স্প্রিং এর স্বপ্ন দেখছেন!
এখানে আরেকটি ঘটনা বলব, নুসরাত মেয়েটাকে যখন শ্লীলতাহানি করা হয় তখন এই সমাজ, থানা এবং প্রশাসন তার পাশে দাঁড়ায়নি। এই না দাঁড়ানোর কারণ হলো নুসরাতের পরিবারের ক্ষমতা এবং টাকা কোনটাই ছিলো না। মেয়েটাকে যখন আগুনে জ্বলসানো হলো প্রথম অবস্হায় তখনো কেউ তার পাশে দাঁড়ায়নি। কিন্তু পরর্বতীতে তা সোশ্যাল মিডিয়ায় দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। এখানে একটি সূক্ষ্ম বিষয় লুকিয়ে আছে। কারণ নুসরাতের ঘটনায় যারা দায়ী তারা আগে থেকেই আকাম কু-কাম করে একটি ক্ষমতাশালী বলয় সৃষ্টি করে রেখেছে। পত্রিকায় পড়েছি স্হানীয় আওয়ামী বেজন্মা নেতা, থানার ওসি কুলাঙ্গারদের পক্ষ নিয়ে ধর্ষণ কাজে সহযোগিতা করেছিলো!
বাংলাদেশে ধর্ষণের বিচার পাইতে গেলে হুমকি ধামকি, হয়রানি, এলাকা ছাড়া, থানায় জোতা ক্ষয়, আইন আদালতে তদবির, স্থানীয় নেতা খেতাদের পকেট ভারী, চোখের পানিতে বাঁলিশ ভিজানি ইত্যাদি কমন বিষয়। আর ধর্ষক যদি প্রভাবশালী, ক্ষমতাশালী হয় তাহলে অনেকে ভবিষৎে ঝামেলার কথা চিন্তা করে অসহায় হয়ে চুপ থাকেন। নতুবা স্হানীয় সালিশে কিছু টাকার বিণিময়ে আপোষ মীমাংসা করা হয়! আচ্ছা মন্ত্রী সাহেব, আপনি না বলেছেন, "পৃথিবীর সব রাষ্ট্রে ধর্ষণ হয়।" এখন বলুন তো পৃথিবীর কোন দেশে ধর্ষণের বিচার পেতে হলে এমন হয়রানির শিকার হতে হয়?
জারজ রাজনৈতিক সিস্টেমে চলছে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। আচ্ছা স্বাধীন রাষ্ট্রে ধর্ষণের বিচার পাওয়ার জন্য প্রতিবাদ করতে হবে কেন? যে দেশে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য ছাত্রদের চোখে গুলি খেতে হয় সেদেশ ধর্ষণের শিকার হয়ে স্বাভাবিক বিচার পাওয়াটা বিলাসিতার নামান্তর।
পুরুষ তুমি মানুষ হও।
হউক প্রতিবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই অক্টোবর, ২০২০ রাত ৮:৫১